প্রশ্ন: মসজিদের নাম আল ফুরকান সালাফিয়্যাহ অথবা সালাফী হলে কোন সমস্যা আছে কি?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: প্রথমেই আমাদের জানা উচিত সালাফি বলতে কি বা কাদেরকে বুঝানো হয়। সালাফী’ শব্দটি এসেছে সালাফ (سَلَفَ) থেকে। সালাফ শব্দটির শেষে সম্বন্ধসূচক ‘ইয়া’ (ي) যোগ করে সালাফী (سَلَفِيٌّ) বলা হয়। যেমন: বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশী। অগ্রবর্তী বা পূর্ববর্তী প্রত্যেকের ক্ষেত্রে ‘সালাফ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন, َفَجَعَلْنَاهُمْ سَلَفًا وَمَثَلًا لِلْآخِرِيْن “এভাবে আমি তাদেরকে করলাম সালাফ (অতীতের মানুষ), আর পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত।” [সূরাহ যুখরুফ: ৫৬] ইমাম বাগাউয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) এই আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে বলেছেন, “পূর্বসূরিদের মধ্যে যাঁরা আমাদের অগ্রবর্তী হয়েছেন, তাঁরাই ‘সালাফ’। আমরা তাঁদেরকে আগের মানুষ বানালাম বা অগ্রবর্তী করলাম, যাতে করে তাঁদের দেখে পরবর্তীরা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।” [তাফসীরে বাগাউয়ী, খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ১২৮; গৃহীত: ‘আল্লামাহ ‘আব্দুল্লাহ বুখারী (হাফিযাহুল্লাহ), মা হিয়াস সালাফিয়্যাহ; পৃষ্ঠা: ১১; দারুল ইস্তিক্বামাহ, কায়রো কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪৩৩ হি./২০১২ খ্রি. (১ম প্রকাশ)] রাসূল (ﷺ) মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় তার মেয়ে ফাতিমা (রাঃ) কে বলেন, ‘তুমি মহান আল্লাহকে ভয় করো এবং ধৈর্য্য ধরো। কেননা আমি তোমার উত্তম সালাফ’ (বুখারী, হা/৬২৮৫)। রাসূল (ﷺ) ফাতিমা (রাঃ) এর আগে মারা যাচ্ছেন বলে তিনি নিজেকে ফাতিমা (রাঃ) এর জন্য ‘সালাফ’ বলেছেন। সুতরাং সালাফ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, যারা অতীতে চলে গেছেন। এ তো হলো ‘সালাফ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ। কিন্তু ‘সালাফ’ কারা? সালাফদের পরিচয় দিতে গিয়ে,এ ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব একটি সুপরিচিত প্রাচীন মাযহাব (আদর্শ)। আল্লাহ তা‘আলা আবূ হানীফাহ, মালিক, শাফি‘ঈ ও আহমাদকে সৃষ্টি করার পূর্ব থেকেই এই মাযহাবের অস্তিত্ব ছিল। নিশ্চয় এটি সাহাবীদের মাযহাব, যাঁরা এই মাযহাব স্বয়ং তাঁদের নাবী’র কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন। যে ব্যক্তি এই মাযহাবের বিরোধিতা করবে, সে আহলুস সুন্নাহ’র নিকট বিদ‘আতী হিসেবে পরিগণিত হবে।” [ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ), মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাউয়িয়্যাহ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৬০১; প্রকাশনার নামবিহীন; প্রকাশকাল: ১৪০৬ হি./১৯৮৬ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]।
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি সালাফদের মাযহাব প্রকাশ করে, তার দিকে নিজেকে সম্পৃক্ত করে (অর্থাৎ, নিজেকে ‘সালাফী’ বলে) এবং ওই মাযহাবের সাথে নিজেকে যুক্ত করে, তার কোনো দোষ নেই। বরং সর্বসম্মতিক্রমে এই মাযহাব গ্রহণ করা ওয়াজিব। কেননা সালাফদের মাযহাব হক ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।” [ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১৪৯; বাদশাহ ফাহাদ প্রিন্টিং প্রেস; বাদশাহ ফাহাদ (রাহিমাহুল্লাহ)’র রাজকীয় ফরমানে মুদ্রিত; সন: ১৪২৫ হি./২০০৪ খ্রি.]।
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দা’ইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন, সালাফদের দিকে নিসবত করে ‘সালাফিয়্যাহ’ বলা হয়। আর সালাফগণ হলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাহাবীগণ এবং প্রথম তিন যুগের সুপথপ্রাপ্ত ইমামগণ। যাঁদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ﷺ কল্যাণের সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, “আমার যুগের লোকেরাই সর্বোত্তম ব্যক্তি, তারপর যারা তাদের নিকটবর্তী, তারপর যারা তাদের নিকটবর্তী।” (সাহীহ বুখারী, হা/২৬৫২)”(ফাতাওয়া লাজনাহ দাইমাহ, ফাতওয়া নং: ১৩৬১ ফাতওয়া অনুবাদক আব্দুল্লাহ মৃধা ভাই)।
.
এবার আসি মূল কথায়, মসজিদের নামের সাথে বিশেষ কোন ব্যক্তি, গোত্র, স্থান বা বৈশিষ্ট্যগত নামে নামকরণ করতে শরীয়তী দৃষ্টিতে কোন আপত্তি নেই ইনশাআল্লাহ। কেননা রাসূল (ﷺ) এর যুগে মসজিদে ক্বোবা’,‘মসজিদে বনী যুরায়েক্ব’ নামে মসজিদ সমূহের নামকরণ করা হয়েছিল (বুখারী হা/৪২০; মুসলিম হা/১৮৭০; মিশকাত হা/৩৮৭০)। ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, এ হাদীস দ্বারা মসজিদকে এর নির্মাতা বা এতে সালাত আদায় কারীদের সাথে সম্পর্কিত করা জায়েয হওয়ার ফায়দা পাওয়া যায় (ফাৎহুল বারী হা/৪২০-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ)। ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, পরিচিতির স্বার্থে এরূপ নামকরণে কোন বাধা নেই (আল-মাজমূ‘২/২০৮)।
এছাড়া মসজিদুল হারাম মসজিদুল আক্বছা, নামদ্বয় পবিত্র কুরআনে এসেছে (ইসরা ১৭/১)। আর মসজিদ আবাদকারীদের গুণাবলি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, পরকালকে বিশ্বাস করে,সালাত আদায় করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না- তারাই আল্লাহর মসজিদসমূহ আবাদ করবে’ (আত-তওবা, ৯/১৮)।
.
সুতরাং পরিচিতির জন্য ফিতনার আশঙ্কা না থাকলে মসজিদের নাম আল ফুরকান সালাফিয়্যাহ না দিয়ে আল ফুরকান সালাফি অথবা শুধু সালাফি নামে নামকরণ করা যায়। যেহেতু বাংলাদেশে আহালুল হাদীস বা সালাফিদের মত বিশুদ্ধ আক্বীদা মানহাজের চেয়ে বিদ‘আতী আক্বীদার অনুসারী বেশী, তাই এর বৈশিষ্ট্যগত পরিচয় প্রকাশ এবং নিরাপত্তা ও স্বকীয়তা রক্ষার সৎ উদ্দেশ্যেই সালাফি নামে মসজিদ রেজিস্ট্রি করা যেতে পারে। এর সবচেয়ে বড় উপকারিতা এই যে, এর ফলে এর পরিচালনা কমিটিতে কোন বিদ‘আতী ঢুকতে সাহস পায় না। এমনকি বিদ‘আতী দলগুলিও এখানে প্রবেশ করে না। কারন সালাফী বা আহলে হাদীস’এটি কোন দলের নাম নয় বরং এটি হ’ল পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের অনুসারীদের নাম। এক্ষণে যে মসজিদের ব্যবস্থাপনা সালাফি আলেমগণের হাতে থাকে এবং যে মসজিদ পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় এবং যাবতীয় শিরক ও বিদ‘আতী আচার-অনুষ্ঠান হ’তে মুক্ত থাকে, তাকেই সালাফী বা আহলেহাদীস মসজিদ’ বলা হয়। তবে সেখানে যেকোন মুসলমানের সালাত আদায়ের পূর্ণ অধিকার থাকবে। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়:
রফিকুল ইসলাম বিন সাঈদ।