ভূমিকা: ৬০ হিজরীতে ইরাকবাসীদের নিকট সংবাদ পৌঁছলো যে, হুসাইন (রাঃ) ইয়াযীদের হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেননি।তারা তাঁর নিকট চিঠি-পত্র পাঠিয়ে জানিয়ে দিল যে ইরাক বাসীরা তাঁর হাতে খেলাফতের বয়াত করতে আগ্রহী। ইয়াজিদকে তারা সমর্থন করেন না বলেও সাফ জানিয়ে দিল। তারা আরও বলল যে, ইরাক বাসীরা ইয়াজিদের পিতা মুয়াবিয়া (রা:) এর প্রতিও মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না কুফার লোকেরা দলে দলে এসে তাকে কুফায় যেতে বলেন। এমনকি কূফার নেতাদের নিকট হ’তে প্রায় ১৫০ টি লিখিত চিঠি অনুরোধ পত্র তাঁর নিকটে পৌঁছে আবার কারো মতে ৫ শতাধিক চিঠি পাঠানো হয় সত্যতা যাচাই করার জন্য তিনি তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকীলকে পাঠান। মুসলিম কূফায় গিয়ে পৌঁছালেন। গিয়ে দেখলেন, আসলেই কূফার লোকেরা হুসাইন (রাঃ)-কেই চাচ্ছে। লোকেরা মুসলিমের হাতেই হুসাইনের পক্ষে বায়‘আত গ্রহণ করেন, হানী বিন উরওয়ার ঘরে’। প্রায় ১২ থেকে ১৮ হাযার মানুষ বায়‘আত গ্রহণ করেন। মুসলিম বিন আকীল তাদের চাতুরতা বুঝতে না পেরে হুসাইনকে কূফার আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে পত্র লিখেন। তিনি আকীলের কথার উপর ভিত্তি করে জিলহজ মাসের ৮ তারিখে কূফার দিকে রওনা হ’লেন। যদিও তাকে কূফার যেতে জালীলুল ক্বদর ছাহাবীরা নিষেধ করেছিলেন যেমন: আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ), আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ), জাবের (রাঃ), যুবায়ের (রাঃ), ইবনে জা‘ফর (রাঃ) প্রমুখ সাহাবীবৃন্দ’। কিন্তু তিনি সবাইকে নিরাশ করে দিয়ে বললেন, ‘আল্লাহ যা ফায়ছালা করবেন তাই হবে। এই জবার শুনে সবাই ‘ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাই-হি রাজিঊন’ বলে উঠলেন’।(আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ -ইসমাঈল ইবনু কাছীর ৮/১৬২-১৬৩; তাহযীবুত তাহযীব-ইবনু হাজার আসক্বালানী ২/৩০৭ পৃঃ)
.
হোসাইন কুফায় যাচ্ছে সিরিয়াতে ইয়াজিদের নিকট এই খবর পৌঁছা মাত্র বসরার গভর্নর উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য পাঠালেন। ইয়াজিদ উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে আদেশ দিলেন যে, তিনি যেন কুফা বাসীকে তার বিরুদ্ধে হুসাইনের সাথে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ করতে নিষেধ করেন। সে হুসাইনকে হত্যা করার আদেশ দেন নি।উবাইদুল্লাহ কুফায় গিয়ে পৌঁছলেন। তিনি বিষয়টি তদন্ত করতে লাগলেন এবং মানুষকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। পরিশেষে তিনি নিশ্চিত হলেন যে, হানী বিন উরওয়ার ঘরে হুসাইনের পক্ষে বয়াত নেওয়া হচ্ছে।অতঃপর মুসলিম বিন আকীল চার হাজার সমর্থক নিয়ে অগ্রসর হয়ে দ্বিপ্রহরের সময় উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের প্রাসাদ ঘেরাও করলেন। এ সময় উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ প্রাসাদের গেট বন্দ করে দাঁড়িয়ে এক ভাষণ দিলেন। তাতে তিনি ইয়াজিদের সেনা বাহিনীর ভয় দেখালেন। তিনি এমন ভীতি প্রদর্শন করলেন যে, লোকেরা ইয়াজিদের ধরপাকড় এবং শাস্তির ভয়ে আস্তে আস্তে পলায়ন করতে শুরু করল। ইয়াজিদের ভয়ে কুফা বাসীদের পলায়ন ও বিশ্বাস ঘাতকতার লোমহর্ষক ঘটনা জানতে চাইলে পাঠকদের প্রতি ইমাম ইবনে তাইমীয়া (র:) কর্তৃক রচিত মিনহাজুস সুন্নাহ বইটি পড়ার অনুরোধ রইল। যাই হোক কুফা বাসীদের চার হাজার লোক পালাতে পালাতে এক পর্যায়ে মুসলিম বিন আকীলের সাথে মাত্র ৩০ জন লোক অবশিষ্ট রইল কোন বর্ননায় তিন জনের কথাও রয়েছে সূর্য অস্ত যাওয়ার পর মুসলিম বিন আকীল তাদের নিয়ে মাগরিবের সালাতে দাড়ালেন সালাত শেষে মুসলিম দেখলেন, হুসাইন প্রেমিক আল্লাহর একজন বান্দাও তার সাথে অবশিষ্ট নেই সবাই ফালিয়ে গেছে। এবার তাকে গ্রেপ্তার করা হল। উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ তাকে হত্যার আদেশ দিলেন। মুসলিম বিন আকীল উবাইদুল্লাহ এর নিকট আবেদন করলেন, তাকে যেন হুসাইনের নিকট একটি চিঠি পাঠানোর অনুমতি দেয়া হয়। এতে উবাইদুল্লাহ রাজী হলেন। চিঠির সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ছিল এ রকম: হুসাইন! পরিবার-পরিজন নিয়ে ফেরত যাও। কুফা বাসীদের ধোঁকায় পড়ো না। কেননা তারা তোমার সাথে মিথ্যা বলেছে। আমার সাথেও তারা সত্য বলেনি। আমার দেয়া এই তথ্য মিথ্যা নয়।” অতঃপর যুল হজ্জ মাসের ৯ তারিখ আরাফা দিবসে উবাইদুল্লাহ মুসলিমকে হত্যার আদেশ প্রদান করেন। এখানে বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, মুসলিম ইতিপূর্বে কুফা বাসীদের ওয়াদার উপর ভিত্তি করে হুসাইনকে আগমনের জন্য চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠির উপর ভিত্তি করে যুলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখে হুসাইন (রা:) মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন। অনেক সাহাবী তাঁকে বের হতে নিষেধ করেছিলেন। তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর, আব্দুল্লাহ বিন আমর এবং তাঁর ভাই মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফীয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইবনে উমর দুই তিন দিনের পথ ঘোড়ায় দৌড়ে এসে কুফায় যেতে নিষেধ করলেন এবং একপর্যায়ে হুসাইনকে লক্ষ্য করে বলেন: হুসাইন! আমি তোমাকে একটি হাদীছ শুনাবো। জিবরীল (আঃ) আগমন করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়া এবং আখিরাত- এ দুটি থেকে যে কোন একটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তিনি দুনিয়া বাদ দিয়ে আখিরাতকে বেছে নিয়েছেন। আর তুমি তাঁর অংশ। আল্লাহর শপথ! তোমাদের কেউ কখনই দুনিয়ার সম্পদ লাভে সক্ষম হবেন না। তোমাদের ভালর জন্যই আল্লাহ তোমাদেরকে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে ফিরিয়ে রেখেছেন। হুসাইন তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং যাত্রা বিরতি করতে অস্বীকার করলেন। অতঃপর ইবনে উমর হুসাইনের সাথে আলিঙ্গন করে বিদায় দিলেন এবং ক্রন্দন করলেন। হুসাইন (রাঃ)-এর আগমনের খবর শুনে কূফার গর্ভনর নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ) জনগনকে ডেকে বিশৃংঙ্খলা না ঘটাতে উপদেশ দেন। ফলে কুচক্রীদের পরামর্শ ক্রমে ইয়াজিদ তাকে গর্ভনর পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। ঐদিকে ওবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে একই সাথে বছরা ও কূফার গর্ভনর পদে নিযুক্ত করেন ও মুসলিম বিন আকীলকে হত্যা করে। অতঃপর পথিমধ্যে হুসাইন (রাঃ) পরিস্থিতি অবগত হয়ে রাস্তা পরিবর্তন করেন এবং পথিমধ্যে ওবাইদুল্লাহর সেনাপতি তাঁর গতিপথ রোধ করে। তিনি ইবনে যিয়াদ এর নিকট ৩টি প্রস্তাব দিয়ে চিঠি লিখেন।
১. আমাকে সীমান্তের কোন এক স্থানে চলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার হোক।
২. মদীনার ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক।
৩. আমাকে ইয়াযীদের হাতে হাত রেখে বায়‘আত গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হোক।
কিন্তু ইয়াযীদের সৈন্যরা কোন প্রস্তাবই মেনে নিল না। যদিও সেনাপতি সা‘দ বিন আবী ওয়াকক্বাছ উক্ত প্রস্তাব মেনে নেন। কিন্তু কুটকৌশলী ওবাইদুল্লাহ মেনে নেননি এমনকি তার হাতে বায়‘আত গ্রহণের নির্দেশ পাঠায়’।সঙ্গত কারণে হুসাইন(রাঃ) তার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন এমননি যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে’। যদিও সেনাপতি হুর বিন ইয়াযীদ তার পক্ষ অবলম্বন করেন ও ইবনে যিয়াদের দু’জন সেন্যকে নিহত করেন। অতঃপর শাহাদাত বরণ করেন’ ত্বাবারনীতে উল্লেখ করা হয়েছে, যখন শত্রুদের নিক্ষিপ্ত তীর এসে হুসাইন (রাঃ)-এর কোলে অশ্রিত শিশু পুত্রের বক্ষ ভেদ করল; তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহ! তুমি ফায়ছালা কর আমাদের এবং ঐ কওমের মধ্যে যারা আমাদের সাহায্যের নাম করে ডেকে এনে হত্যা করছে’।[তাহযীবুত তাহযীব-ইবনু হাজার আসক্বালানী ২/৩০৪ পৃঃ; আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ -ইসমাঈল ইবনু কাছীর ৮/১৯৯ পৃঃ]
.
অতঃপর হুসাইন (রাঃ) স্বল্প সংখ্যক সেন্য নিয়ে বীবদর্পে তাদের সাথে যুদ্ধ করলেন; উক্ত যুদ্ধে হুসাইন রাঃ এর সঙ্গে ছিল মাত্র ৩০ জন অশ্ববাহিনী ৪০ জন পদাতিক বাহিনী এবং আহলে বায়াতের শিশু নারী পুরুষ সহ ১৭ জন অবশেষে নিকৃষ্ট এক ব্যক্তি তার নাম ‘শিমার বিন যিন-যাওশানের নির্দেশে পিচাশ খাওলা আল আসহাবী হুসাইন (রাঃ)-কে বর্শা দিয়ে সিনায় আঘাত করে ধরাশায়ী করে ফেলেন। অতঃপর নরপশু সিনান ইবনে আনাস আন-নাখাঈ হুসাইন রাঃ কে নির্মমভাবে হত্যা করে অবশ্য কেউ কেউ বলেছেন শিমার ইবনে যিল-যাওশান হুসাইন রাঃ কে হত্যা করেন এভাবেই ৩৩ টি বর্ষা ও ৩৪ টি তরবারির নির্মম আঘাতে ৬১হিজরীতে ১০ই মুহাররম শুক্রবার রাসূল (ছাঃ)- এর কনিষ্ঠ নাতি হুসাইন বিন আলী (রাঃ) ৫৮ বছর বয়সে শাহাদতের অমীয় সুধা পান করলেন’ উক্ত যুদ্ধে হুসাইন রাঃ এর পক্ষে মোট ৭২ জন শহীদ হয় এর এভাবেই ইবনে যিয়াদের মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসে এক কালো ইতিহাসের যবানীপাত হলো।[ বিস্তারিত দেখুন আল-মু‘জামুল ওয়াফী’ [আরবী-বাংলা), ড. মুহাম্মাদ ফযলুল রহমান রিয়াদ প্রকাশনী, ৮ম সংস্করণ ৮ পৃঃ ]
কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমানে আমরা দেখেছি প্রায় সর্ব মহল থেকে আশূরার মূল বিষয় বলে কারবালার ঘটনাকেই বুঝানো হচ্ছে। কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিকোণ থেকে এটা সঠিক নয়। ইসলামের আগমনের পূর্বে আশূরা ছিল। যেমন আমরা হাদীছ দ্বারা জানতে পেরেছি। তখন মক্কার মুশরিকরা যেমন আশূরার ছিয়াম পালন করত তেমনি ইহুদীরা মূসা (আঃ)-এর বিজয়ের স্মরণে আশূরার ছিয়াম পালন করত। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আশূরার ছিয়াম পালন করেছেন জীবনের প্রতিটি বছর। তার ইন্তেকালের পর তার ছাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) আশূরা পালন করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ইন্তেকালের প্রায় ৫০ বছর পর হিজরী ৬১ সালে কারবালার ময়দানে জান্নাতী যুবকদের নেতা, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রিয় নাতী সাইয়েদুনা হুসাইন (রাঃ) শাহাদত বরণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে মুসলিম উম্মাহর জন্য এটা একটা হৃদয় বিদারক ঘটনা। ঘটনাক্রমে এ মর্মান্তিক ইতিহাস উক্ত আশূরার দিন সংঘঠিত হয়েছিল।
.
আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও তার সাহাবায়ে কেরাম যে আশূরা পালন করেছেন ও যে আশূরা উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য রেখে গেছেন, তাতে কারবালার ঘটনার কোনই ভূমিকা ছিলনা। থাকার প্রশ্নই আসতে পারেনা। কারবালার এ দুঃখজনক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ), আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ), আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ), আনাস বিন মালেক (রাঃ), আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ), জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ), সাহল বিন সা‘আদ (রাঃ), যায়েদ বিন আরকাম (রাঃ), সালামাতা ইবনুল আওকা (রাঃ) সহ বহু সংখ্যক ছাহাবায়ে কেরাম জীবিত ছিলেন। তারা তাদের পরবর্তী লোকদের চেয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর পরিবারবর্গকে অনেক বেশী ভালবাসতেন। তারা আশূরার দিনে কারবালার ঘটনার স্মরণে কোন কিছুর প্রচলন করেননি। মাতম, তাযিয়া মিছিল, আলোচনা সভা কোন কিছুরই প্রমাণ পাওয়া যায় না। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যেভাবে আশূরা পালন করেছেন তারা সেভাবেই তা অনুসরণ করেছেন। অতএব আমরা কারবালা কেন্দ্রীক যে আশূরা পালন করে থাকি, এ ধরণের আশূরা না রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পালন করেছেন, না তার ছাহাবায়ে কেরাম। যদি এ পদ্ধতিতে আশূরা পালন আল্লাহর রাসূলের মুহাববতের পরিচয় হয়ে থাকত, তাহ’লে এ সকল বিজ্ঞ ছাহাবাগণ তা পালন থেকে বিরত থাকতেন না, তারা সাহসী ছিলেন। তারা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করতেন না। কিন্তু তারা তা করেননি। তাই যে সত্য কথাটি আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি তা হ’ল, আশূরার দিনে কারবালার ঘটনা স্মরণে যা কিছু করা হয় তাতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবাদের রেখে যাওয়া আশূরাকে ভুলিয়ে দিয়ে বিকৃত এক নতুন আশূরা প্রচলনের প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারবালার যুদ্ধ হয়েছিল ৬১ হিজরীতে। আর আশূরার ছিয়াম ইসলামে প্রবর্তন হয় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করার পর ২য় হিজরীতে। প্রাক ইসলামী যুগেও মুশরিকরা তা পালন করত যা ইতিপূর্বে ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে বর্ণনা করা হয়েছে। আর তার কারণ ছিল, মূসা (আঃ) ফেরাউনের অত্যাচার হ’তে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আল্লাহর রহমতে বেঁচে ছিলেন তাই শুকরিয়া আদায় হেতু তিনি ছিয়াম রেখেছিলেন। কিন্তু শরুর সেই মহাসত্য ইতিহাসকে বর্জন করে পরবর্তীতে ৫৮ বছর পর ঘটনাচক্রে একই তারিখে কারবালার যুদ্ধে ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর মৃত্যুকে আশূরার ইতিহাস বলা হচ্ছে।
আশূরায়ে মুহাররমকে কেন্দ্র করে আমাদের নামধারী মুসলিম সমাজে বিশেষ করে শী‘আদের মধ্যে অংসখ্য ভ্রান্ত আক্বীদা ও আমল প্রচলিত আছে। বিশেষ করে আমরা যারা বাঙালী বাংলা সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন রচিত ‘বিষাদ সিন্ধু’ পড়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। অথচ এটি কোন নির্ভরযোগ্য ইসলামিক কোন গ্রন্থ নয় বরং একটি উপন্যাস মাত্র’।[সোনামণি প্রতিভা’ নভে-ডিসে -২০১৪, ১৪ পৃঃ, ]
৩৫২ হিজরীতে শী‘আ আমীর আহমাদ বিন বুইয়া দায়লামী ওরফে ‘মুইযযুদ্দৌলা’ ১০ই মুহাররমকে শোক দিবস ঘোষণা করেন। এই দিনে অফিস, আদালত বন্ধ রাখতে আদেশ প্রদান করেন, এমনকি মহিলাদের চুল ছিঁড়তে, চেহারা কালো করতে, রাস্তায় নেমে শোক গাঁথা গেয়ে চলতে বাধ্য করে। শহরে-গ্রামে সর্বত্র সকলকে শোক মিছিলে যোগদান করতে আদেশ দেন। শী‘আরা খুশী হয়ে এই আদেশ মেনে নেয়। কিন্তু ৩৫৩ হিজরীতে সুন্নীদের উপর দিবস পালনের আদেশ জারী করলে শী‘আ-সুন্নীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ বেধে যায়। যারই ফলশ্রূতিতে আজ পর্যন্ত এই সংঘাত চলছে। কিছু বিষয় পরিস্কার করা দরকার যেমনঃ
◾হুসাইনের বের হওয়া ন্যায় সংগত ছিল কি?
বিজ্ঞ সাহাবীদের মতে কুফার উদ্দেশ্যে হুসাইনের বের হওয়াতে কল্যাণের কোন লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় নি। এ জন্যই অনেক সাহাবী তাঁকে বের হতে নিষেধ করেছেন এবং তাঁকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি বিরত হন নি। কুফায় যাওয়ার কারণেই ঐ সমস্ত জালেম ও স্বৈরাচারেরা রাসূলের দৌহিত্রকে শহীদ করতে সক্ষম হয়েছিল। তার বের হওয়া এবং নিহত হওয়াতে যে পরিমাণ ফিতনা ও ফসাদ সৃষ্টি হয়েছিল, মদিনায় অবস্থান করলে তা হওয়ার ছিল না। কিন্তু মানুষের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আল্লাহর নির্ধারিত ফয়সালা ও তকদীরের লিখন বাস্তবে পরিণত হওয়া ছাড়া ভিন্ন কোন উপায় ছিল না। হুসাইনের হত্যায় বিরাট বড় অন্যায় সংঘটিত হয়েছে, কিন্তু তা নবীদের হত্যার চেয়ে অধিক ভয়াবহ ছিল না। আল্লাহর নবী ইয়াহ-ইয়া (আঃ)কে পাপিষ্ঠরা হত্যা করেছে। জাকারিয়া (আঃ)কেও তাঁর জাতির লোকেরা নির্মমভাবে শহীদ করেছে। এমনি আরও অনেক নবীকে বনী ইসরাইলরা কতল করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
قل قد جاءكم رسل من قبلي بالبينات وبالذي قلتم فلم قتلتموهم إن كنتم صادقين
“তুমি তাদের বলে দাও, তোমাদের মাঝে আমার পূর্বে বহু রসূল নিদর্শনসমূহ এবং তোমরা যা আবদার করেছ তা নিয়ে এসেছিলেন, তখন তোমরা কেন তাদেরকে হত্যা করলে যদি তোমরা সত্য হয়ে থাক।[সূরা আল-ইমরান: ১৮৩]
وَ مَا تَدۡرِیۡ نَفۡسٌۢ بِاَیِّ اَرۡضٍ تَمُوۡتُ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلِیۡمٌ خَبِیۡرٌ ﴿٪۳۴﴾
এবং কেউ জানে না কোন্ স্থানে তার মৃত্যু ঘটবে। নিশ্চয় আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।[সূরা লোকমানঃ৩৪]
◾হুসাইনের হত্যাকারী নির্ধারণে ইবনে উমর (রা:)এর অভিমত:
ইবনে আবী নু’ম হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ আমি একদা আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন একজন লোক তাঁকে মশা হত্যা করার হুকুম জানতে চাইল। তিনি তখন লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি কোন দেশের লোক? সে বলল: ইরাকের। ইবনে উমর (রা:) তখন উপস্থিত লোকদেরকে লক্ষ্য করে বললেন: তোমরা এই লোকটির প্রতি লক্ষ্য কর। সে আমাকে মশা হত্যা করার হুকুম জিজ্ঞেস করছে। অথচ তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাতিকে হত্যা করেছে। আর আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, এরা দুজন (হাসান ও হুসাইন) আমার দুনিয়ার দুটি ফুল। (বুখারী, হাদীছ নং- ৫৯৯৪) অন্য বর্ণনায় মশার স্থলে মাছির কথা এসেছে।
◾হুসাইন (রাঃ)-কে হত্যার জন্য কে দায়ী?
হুসাইন (রাঃ)-কে হত্যার জন্য অবশ্যই সরাসরি ইয়াযীদ দায়ী নয় বরং ওবাদুল্লাহ বিন যিয়াদই ও কুফাবাসী দায়ী। (আল্লাহই ভালো জানেন) হুসাইনের ভাষণই প্রমান বহন করে এর জন্য ইয়াযীদ নয় বরং ইরাকবাসীরাই দায়ী। তিনি বলেন, ‘তোমরা কি পত্রের মাধ্যমে আমাকে এখানে আসতে আহবান করোনি? আমাকে সাহায্য করার ওয়াদা করোনি? অকল্যাণ হোক তোমাদের! যেই অস্ত্র দিয়ে আমরা ও তোমরা মিলে ইসলামের শক্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। এখন সেই অস্ত্র তোমরা আমার বিরুদ্ধে চালাতে যাচ্ছ! মাছি যেমন উড়ে যায় তেমনি তোমরা আমার পক্ষের কৃত বায়‘আত থেকে সরে যাচ্ছ! পোঁকা-মাকড়ের ন্যায় তোমরা উঠে যাচ্ছ এবং সকল ওয়াদা-অঙ্গীকার ভঙ্গ করছ। ধ্বংস হোক এই উম্মতের তাগুতের দলেরা’।[আল-ইরশাদ নিলমুদীদ: ২৪১ পৃঃ।]
হুসাইনের এই ভাষণ কোন ভাবেই ইয়াযীদকে দায়ী করেননি। বরং ঘুরেফিরে ইরাকবাসীকেই দায়ী করা হয়েছে। অতঃপর হুসাইন (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করেন; ‘হে আল্লাহ! আপনি যদি তাদের হায়াত র্দীঘ করেন, তাহ’লে তাদের দলেন মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে দিন। তাদের দলে দলে বিচ্ছিন্ন করে দিন। তাদের শাসকদের উপর কখনোই সন্তুষ্ট করবেন না। তারা আমাদের সাহায্য করবে বলে ডেকে এনেছে। অতঃপর আমাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা বশত হত্যার জন্য উদ্যত হয়েছে’।[আল-ইরশাদ নিলমুদীদ: ২৪১ পৃঃ।]
পরবর্তীতে তাদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছিলো এমনকি ওবাইদুল্লাহকে নিকৃষ্টভাবে হত্যা করা হয়েছিল’।[কারবালার প্রকৃত ঘটনা ২৬ পৃঃ]
আর হুসাইন (রাঃ)-এর ছিন্ন মাথা যখন ইয়াযীদের সম্মুখে আনা হয়। তখন তিনি ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাহি রাজিউন পড়ে
কেঁদে উঠে বলেছিলেন, ‘ওবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ উপরে আল্লাহ পাক লা‘নত করুন। আল্লাহর কসম যদি হুসাইনরে সাথে ওর রক্তের সম্পর্ক থাকত, তাহ’লে সে কিছুতেই হুসাইনকে হত্যা করত না। তিনি আরও বলেন, হুসাইনের খুন ছাড়াও আমি ইরাকবাসীকে আমার অনুগত্যে রাযী করাতে পারতাম’।[ইবনু তাইমিয়াহ, মুখতাছার মিনহাজুস সুন্নাহ ৩৫০ পৃঃ ]
এমনকি হুসাইনকে পরিবারের স্ত্রী কন্যা ও শিশুগণ ইয়াযীদের প্রসাদে প্রবেশ করলে প্রাসাদে কান্নার রোল পড়ে যায়। ইয়াযীদ তাঁদেরকে বিপুলভাবে সম্মানিত ও মূল্যবান হাদিয়া দিয়ে সম্মানে মদীনায় প্রেরণ করেন’।[ইবনু তাইমিয়াহ, মুখতাছার মিনহাজুস সুন্নাহ ৩৫০ পৃঃ ।]
অনেকেই বলে থাকে যে, ইয়াযীদ লম্পট, নারীভোগী ও হুসাইনের পরিবারের সাথে খারাপ আচরণ করেছে এগুলো ভিত্তিহীন কথা।
ইয়াযীদের চরিত্র সম্পর্কে হুসাইন (রাঃ)-এর অন্যতম বৈমাত্রেয় ছোট ভাই শী‘আদের খ্যাতনামা ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়্যাহ (রাঃ) বলেন, ‘আমি তার ইয়াযীদ এর মধ্যে ঐ সব বিষয় দেখিনি, যেসবের কথা তোমরা বলছো। অথচ আমি তাঁর নিকটে হাযির থেকেছি ও অবস্থান করেছি এবং তাকে নিয়মিত ভাবে ছালাতে অভ্যস্ত ও কল্যানের আকাংখা দেখেছি। তিনি ফিহক্ব বিষয়ে আলোচনা করতেন আর সুন্নাতের পাবন্দ’।[আল-বিদায়াহ: ৮/২৩৬ পৃঃ]
এমনকি তার পিতা মু‘আবিয়া (রাঃ) হুসাইনের (রাঃ) সম্পর্কে অসিয়ত করে বলেছিলেন; ‘যদি তিনি (হুসাইন) তোমার বিরুদ্ধে উত্থান করেন ও তুমি তার উপরে বিজয়ী হও, তাহ’লে তাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। কারণ তার রয়েছে রক্তের সম্পর্ক, যা অতুলনীয় এবং রয়েছে মহান অধিকার’।[তারীখে ইবনে খালদূন ৩/১৮ পৃঃ।] মূলকথা মু‘আবিয়া (রাঃ) ইয়াযীদ ও বিভিন্ন ঐতিহাসিকের কথা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হুসাইনের হত্যার জন্য প্রত্যক্ষভাবে ইয়াযীদ দায়ী ছিলেন না। আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী। (সংকলিত)
________________________
জুয়েল মাহমুদ সালাফি