একজন মুসলিম নারী-পুরুষ কি বর্তমান যুগের ইহুদী ও খ্রিষ্টান নারী পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে

নারী-পুরুষের মাঝে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিবাহ হচ্ছে একমাত্র বৈধ, বিধিবদ্ধ, সর্বজনীন এবং পবিত্র ব্যবস্থা। ঈমানদার নারী-পুরুষের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক হয় স্থায়ী এবং দাম্পত্য জীবন হয় সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের। তবে ইসলামী শরী‘আতে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যার কারণে মুসলিম নারী-পুরুষের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয়ে যায় কিংবা মুসলিম বংশ, পরিবার অথবা নামে মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েজ নয় যেমন, অমুসলিম কাফের,মুশরিক,রাফিদ্বী শিয়া,আক্বীদাগত বিদআতী মুনাফিক ইত্যাদি। তবে পবিত্র কুরআনের সূরা আল মায়েদার ৫নং আয়াতের হুকুম অনুসারে ইসলামি শরী‘আতে একজন মুসলিম পুরুষের জন্য আহলে কিতাব তথা ইহুদী ও খ্রিষ্টান নারীকে বিবাহ করার ব্যাপারে জমহূর আলেমগন কিছু শর্ত সাপেক্ষে জায়েয বলেছেন। (আল-মুগনী, ৭/৯৯ পৃ.)। বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, ‘আহলে কিতাবের এমন নারী যে অন্যায়-অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকে তার সাথে বিবাহ বৈধ। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাদের স্ত্রী ও খাবার আমাদের জন্য হালাল করেছেন। কিন্তু যদি বর্তমান যুগে তার সাথে বিয়ের কারণে দ্বীনের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে যেমন; সন্তানাদি তার মতই থেকে যাবে, মুসলিম হবে না বা সে নিজেও তার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, সে ক্ষেত্রে বিবাহ করা যাবে না। (ফাতাওয়া ইসলামিয়া, ৩/১৭২ পৃ.)।
.
কিন্তু আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সর্বসম্মতিক্রমে কোন অবস্থাতেই অমুসলিম ইহুদি খ্রিস্টান পুরুষের সাথে একজন মুসলিম নারীর বিবাহ জায়েজ নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মুশরিকরা বিশ্বাস স্থাপন না করা পর্যন্ত তোমরা তাদেরকে বিবাহ করো না এবং নিশ্চয় মুমিনা দাসী মুশরিক (স্বাধীনা) মহিলা অপেক্ষা উত্তম। যদিও সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে ফেলে এবং মুশরিকরা বিশ্বাস স্থাপন না করা পর্যন্ত তাদের সাথে (মুসলমান নারীদের) বিবাহ প্রদান করো না এবং নিশ্চয় মুশরিকরা তোমাদের মনঃপুত হলেও বিশ্বাসী দাস তদপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর; এরাই জাহান্নামের দিকে আহ্বান করে এবং আল্লাহ স্বীয় ইচ্ছায় জান্নাত ও ক্ষমার দিকে আহ্বান করেন ও মানবম-লীর জন্যে স্বীয় নিদর্শনাবলী বিবৃত করেন, যেন তারা শিক্ষা গ্রহণ করে।’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২২১)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) (৭০১-৭৭৪ হি.) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ‘মুমিন নারীরা কাফিরদের জন্য হালাল নয়। আর কাফিররাও তাদের জন্য হালাল নয়। এই আয়াতের দ্বারা মুসলিম নারীদেরকে মুশরিকদের জন্য হারাম করা হয়েছে।’ (তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৯৩)।
.
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সম্মানিত শিক্ষক ইমাম আব্দুর রাযযাক ছান‘আনী (রাহিমাহুল্লাহ) উল্লেখ করেছেন, আবু যুবাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি জাবির (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বলতে শুনেছি, কিতাবী নারীগণ আমাদের জন্য হালাল। (অর্থাৎ তাদেরকে বিবাহ করা যাবে) কিন্তু আমাদের নারীগণ তাদের জন্য হারাম।’ (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৭৪, হা/১২৬৫৬)। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন: আহালুল আলেমগন একমত যে, কোন কাফের মুসলমান থেকে মিরাছ (পরিত্যক্ত সম্পত্তি) পাবে না। কোন কাফের মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে না।(আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা (৩/১৩০)। এ ছাড়াও আরো উল্লেখ হয়েছে যে, জাবির (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, আমরা কিতাবী নারীদেরকে বিবাহ করতে পারি। কিন্তু তারা আমাদের নারীদেরকে বিবাহ করতে পারবে না।’ (তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৮৩; ‘আওনুল মা‘বূদ শারহু সুনানি আবী দাঊদ, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৯)।
.
এব্যাপারে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু এর মতামত হলো-যায়েদ বিন ওয়াহাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এই মর্মে পত্র লিখে পাঠান যে, মুসলিম পুরুষ খ্রিষ্টান নারীকে বিবাহ করতে পারবে। কিন্তু কোন খ্রিষ্টান পুরুষ কোন মুসলিম নারীকে বিবাহ করতে পারবে না।’ (আস-সুনানুল কুবরা, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৭২, হা/১৪৩৬২; তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৫৮১)। এমনকি ইমামদের এ ব্যাপারে ইজমাও রয়েছে। যেমন, ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হি.) বলেন, فالقول به لإجماع الجميع من الأمة عليه ‘এটা মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মত অভিমত।’ (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৭৮, হা/১০০৫৮)। সুতরাং উপরিউক্ত আলোচনায় প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী শরী‘আতে কোন মুসলিম নারীকে কোন অমুসলিম কাফের মুশরিক পুরুষের কাছে বিবাহ দেয়া বৈধ নয়।
.
▪️যে সকল শর্তসাপেক্ষে একজন মুসলিম পুরুষ আহলে কিতাব তথা ইহুদি কিংবা খ্রিস্টান নারীকে বিবাহ করতে পারে সে শর্তগুলো হল। যেমন:

▪️ক). প্রকৃতপক্ষেই আহলে কিতাব হতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হল, পাশ্চাত্যে অনেক নারী বংশগতভাবে ইহুদী বা খ্রিষ্টান হলেও তারা বিশ্বাসের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ নাস্তিক। তাই এধরনের নারীদেরকে বিবাহ করার বৈধতা নেই। কেননা তারা প্রকৃত পক্ষে আহলে কিতাব নয়। খোদ ইসরাইলে ৫২% জনগণ নাস্তিক। অথচ এটা একমাত্র কট্টর ইহুদী রাষ্ট্র। তাহলে অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর অবস্থা কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। (ছহীহফাতুর রায় আস-সাদেরাহ, ২৪/৯/১৯৯৫ ইং, পৃ. ৫৩)।

▪️খ). নেক্কার হতে হবে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, এবং তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের সতী-সাধ্বী নারীরাও, যখন তোমরা তাদেরকে তাদের বিনিময় (মোহর) দিবে তাদেরকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করার জন্য, কাম বাসনা চরিতার্থ করা কিংবা গোপন প্রেমে লিপ্ত হওয়ার জন্য নয়।’ (সূরা আল-মায়িদাহ: ৫)। অথচ বর্তমান যুগের আহলে কিতাব নারীদের চরিত্র সর্বজনবিদিত। সুতরাং, এমন আহলে কিতাব নারীকে বিবাহ করা জায়েয নেই। আহমদ ইবনু ইয়াহইয়া বলেন,‘আহলে কিতাব নারীদের সাথে বিবাহের বিষয়টি সীমাবদ্ধ সেসব নারীর ক্ষেত্রে, যারা মুসলিম শাসকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মুসলিম রাষ্ট্রে অবস্থান করে। একথা সর্বজনবিদিত যে, বর্তমান মুসলিম শাসকদের সাথে তাদের কোন চুক্তি ও অঙ্গিকার নেই। না তারা জিযয়া প্রদান করে, আর না শারঈ এমন কোন বিধান নিজেদের উপর আবশ্যক করে, যা চুক্তির কারণে তাদের উপর আবশ্যক এবং তা করলে তারা মুসলিমদের ন্যায় সুযোগ-সুবিধা পেত বা দায়-দায়িত্ব বহনে তাদের অনুগামী হত।’ (আল-মিইয়ারুল মাগরিবি ওয়াল জামেঊল মাগরিব আন ফাতাওয়া আহলি ইফরীক্বিয়্যাহ ওয়াল আন্দালুসি ওয়াল মাগরিব, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪৯-২৫০)।

▪️গ). আহলে কিতাব নারীকে বিবাহ করার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে, সে মুসলিম রাষ্ট্রের অনুগত নাগরিক (ذمي) হতে হবে। তাই অমুসলিম বা সেক্যুলার দেশের কোন আহলে কিতাব নারীকে বিবাহ করা মাকরূহে তাহরীমী তথা নাজায়েয। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যদি আহলে কিতাব নারীগণ অমুসলিম রাষ্ট্রে অবস্থান করে তবে তাদের বিবাহ করা হালাল নয়।’ (মুসান্নাফ ইবন আবী শায়বা, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৫৯, হা/১৬৪৩১)। অন্যত্র ক্বাতাদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত যে, তিনি আহলে কিতাব নারীদের বিবাহ করাকে অপছন্দ করতেন। তবে (যদি মুসলিম শাসকের সাথে) চুক্তিবদ্ধ হয়ে (মুসলিম রাষ্ট্রে অবস্থান করে), তাহলে ভিন্ন কথা।’ (মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২৯৪, হাদীছ নং- ৯৬৫৮)। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! কিছু বিষয় সংকলিত।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
___________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: