প্রশ্ন: “আস স্বলাতু খইরুম মিনান নাউম” এই বাক্যটি কখন বলতে হবে। প্রথম আযানে নাকি দ্বিতীয় আযানে? একটি দলিল ভিত্তিক পর্যালোচনা।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: একাধিক সহীহ হাদীসে ফজরের আজানে “তাসবীব” আস স্বলাতু খইরুম মিনান নাউম বলার কথা বর্ণিত হয়েছে। আবার কিছু কিছু হাদিসে সাধারণভাবে “তাসবীব” আস স্বলাতু খইরুম মিনান নাউম প্রথম আযানে বলার বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে
প্রথম আযান দ্বারা কি উদ্দেশ্য এটা কি ফজরের পূর্বের আজান অর্থাৎ সেহরির আযান নাকি ফজরের আযান সেটা ঐ হাদীসগুলোতে স্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়নি। আর সেজন্যই দু-একজন আলেম বিষয়টি নিয়ে মতানৈক্য করেছেন। আমরা পুরো বিষয়টি পরিস্কার করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। যে হাদীসগুলোর আলোকে ইমাম আলবানী এবং তার কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী “আস স্বলাতু খইরুম মিনান নাউম” বাক্যটি শেষ রাতের তাহাজ্জুদের সাথে খাস করেছেন সে সমস্ত হাদীসের অন্তর্ভুক্ত হলো:
.
(১). সাহাবী আবু মাহযুরাহ্ রাসূল (ﷺ)-কে বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে আযানের নিয়ম শিখিয়ে দিন। তিনি তাকে আযানের শব্দগুলো শিখিয়ে দেন এবং বলেন, যদি সকালের সালাত হয় তাহলে তুমি বলবে, ‘আস-সালাতু খায়রুম মিনান্ নাঊম, আস-সালাতু খাইরুম মিনান্ নাঊম’…(আবু দাউদ হা/৫০০; সুনানে নাসাঈ হা/৬৪৭; মিশকাত হা/৬৪৫; সহীহ আবু দাঊদ হা/৫০০; হাদিসটিকে আল্লামা নাসির উদ্দিন আলবানী সহীহ বলেছেন।)
.
(২). প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) [মৃত: ৭৩ হি.] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন; তাসবীব (“আস স্বলাতু খইরুম মিনান নাউম”) প্রথম আযানে হাইয়া আলাল ফালাহ এই বাক্যটির পরে ছিল। অর্থাৎ প্রথম আযানে “হাইয়া আলাল ফালাহ” এর পরে তাসবীব “আস স্বলাতু খইরুম মিনান নাউম” বলতে হবে। (ইমাম তাহাবী শারহুল মায়ানী; খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৮২ ইমাম ইবনে হাজার তালখীসুল হাবীর; খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ১৬৯ ইমাম বাইহাকী: খন্ড:১ পৃষ্ঠা: ৪২৩; এ বর্ননা করেছেন ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীসটি হাসান বলেছেন, দেখুন আলবানী তামামুল মিন্নাত পৃষ্ঠা: ১৪৬; আস সামারুল মুসতাতাব: পৃষ্ঠা:১৩১)
.
এই হাদিসগুলো তাদের স্বপক্ষে দলিল যারা বলে যে, ফজরের আযানের “তাসবীব” হলো নামাযের প্রথম আযানে যেটি রাতের শেষভাগে তাহাজ্জুদের জন্য দেওয়া হয়। শাইখ আলবানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, তাসবীব হবে ফজরের প্রথম আযানে, যা ফজরের সময় হওয়ার প্রায় পনেরো মিনিট পূর্বে দেয়া হয়। কেননা আবু মাহযুরা (রাদিআল্লাহু আনহু) হতে হাদীসটি এসেছে। আর তা ইবনু উমার রাদিআল্লাহু আনহুর হাদীছের সাথে মিলে গেছে। (আলবানী তামামুল মিন্নাতে পৃষ্ঠা: ১৪৬)। কিন্তু জমহুর ওলামাদের বিশুদ্ধ মতে আলবানী (রহিমাহুল্লাহ) এর এই ইজতিহাদ বিশুদ্ধ হয়নি। কারণ আলোচ্য হাদীসে সকালের সালাত (صلاة الصبح) দ্বারা কখনোই তাহাজ্জুদের আযান প্রমাণিত হয় না, বরং এটি যে ফজরের ফরয সালাতের আযানই হবে,সেটা খুব সহজেই বুঝা যায়।এর কারণ হচ্ছে, তাহাজ্জুদের সালাতকে কোন হাদীসেই ফজরের সালাত বলা হয়নি। সে কারণে আবু মাহযূরাহ্ হতে বর্ণিত যে হাদীসে বলা হয়েছে প্রথম আযানের কথা সে আযান দ্বারা ফজরের সালাতের আযানকেই বুঝতে হবে।কেননা অন্য হাদীসে ইক্বামতকে দ্বিতীয় আযান হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও ‘প্রথম আযান’ দ্বারা যে ফজরের সালাতের আযানকে বুঝানো হয়েছে তা স্পষ্ট হয়েছে আবু মাহ্যূরাহ হতে বর্ণিত আরেকটি হাদীস দ্বারা, যাতে বলা হয়েছে, আবু মাহযুরাহ ফজরের আযানে ‘আস-সালাতু খায়রুম মিন… বলেছেন। সুতরাং সঠিক মত হলো, “আস স্বলাতু খইরুম মিনান নাউম” শুধুমাত্র তখনই বলতে হবে যখন নামাজের সময় হবে অর্থাৎ ফজরের নামাজের সময় হবে। এটাই একাধিক হাদীস এবং জমহুর সালাফদের মত। আর এটি বেশ কয়েকটি কারণে হতে পারে। যথা:
.
(ক). الأول (আওয়াল) “প্রথম” এই শব্দটি ইকামাতের সাথে সম্পর্কিত। আর ইকামত হলো দ্বিতীয় আজান। কারণ একাধিক সহীহ হাদীসে রয়েছে যেখানে ইকামতকে আজান নামে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন- রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “بَيْنَ كُلِّ أَذَانَيْنِ صَلاَةٌ” অর্থ: প্রত্যেক দুই আযানের মাঝখানে নামায রয়েছে। (সহীহ বুখারী হা/৬২৪, সহীহ মসলিম হা/৮৩৮, তিরমিযী হা/১৮৫, নাসায়ী হা/৬৮১, আবু দাঊদ হা/১২৮৩, ইবনু মাজাহ হা/১১৬২)
.
সহীহ মুসলিমে অপর একটি হাদীসে বলা হয়েছে যে, সময় শুরু হওয়ার পরে যে নামাযের আযান আসে তাকে বলা হয় নামাযের প্রথম আযান। এটি আম্মাজান আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে তিনি রাসূল (ﷺ)-এর সালাত সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন; রাসূল (ﷺ) রাতের প্রথম ভাগে ঘুমাতেন এবং শেষ ভাগে জেগে উঠতেন, অতঃপর স্ত্রীর সাথে ঘনিষ্ঠতার কোনো প্রয়োজন হলে তিনি সেই চাহিদা পূরণ করতেন, তারপর তিনি আবার ঘুমাতেন। অতঃপর প্রথম আযানের সময় হলে ঘুম থেকে উঠতেন, তিনি নাপাক না হয়ে থাকলে একজন মানুষ নামাজের জন্য যেভাবে ওযু করে থাকে সেভাবে ওযু করতেন এবং তারপর ফজরের দুই রাকাআত (সুন্নত) সালাত আদায় করতেন। (সহীহ মুসলিম হা/১৬১৩; ই.ফা. ১৫৯৮, ই.সে. ১৬০৫)
.
উক্ত হাদীসের ব্যাখায় শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, والمقصود بالركعتين : سنة الفجر الراتبة এই হাদিসের মধ্যে দুই রাকাআত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ফজরের ফরজ নামাজের পূর্বের নিয়মিত সুন্নাত নামাজ (সুন্নতের রাতেবা)। নববী শরহে মুসলিম হা/৭৩৭ ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
.
(খ). কিছু সহীহ হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যে আযানে এই তাসবীব অর্থাৎ “আস স্বলাতু খইরুম মিনান নাউম” বাক্যাংশটি বলা হয় তাকে আযান আল সুবহে বা ফজরের নামাযের আযান। সুতরাং “ফজরের নামায”-এ বলা (বর্ণিত) এগুলো এমন শব্দ যেটা প্রমাণ করছে যে তাসবিবটা হবে সালাতের সময় (ফজর) প্রবেশ করার পরে এবং এটি ঐ আজানের পরে হবে যে আজানটা শেষ রাত্রে সালাতের সময় শুরু হওয়ার পূর্বে অর্থাৎ তাহাজ্জুদে দেওয়া হয়। নিচের হাদিসগুলো এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন:
.
(১). আবু মাহযূরাহ (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে আযানের নিয়ম শিখিয়ে দিন। তিনি আমার মাথার সম্মুখ ভাগে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি বলবে; আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার-উচ্চস্বরে। এরপর কিছুটা নীচু স্বরে বলবে; আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ। হাইয়্যা আলাস সলাহ, হাইয়্যা আলাস সলাহ। হাইয়্যা আলাল ফালাহ, হাইয়্যা আলাল ফালাহ। ফজরের সালাত হলে বলবে; আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম, আসালাতু খাইরুম মিনান নাউম (ঘুমের চেয়ে সালাত উত্তম-দু’বার)। আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। (আবু দাউদ হা/৫০০; নাসায়ী হা/৬৩৩; শাইখ আলবানী হাদিসটিকে সহিহ আবু দাউদে বর্ণনা করেছেন)
.
(২). আবু মাহজুরা হতে আবু দাউদের অন্য বর্ণনায় রয়েছে- وكان يقول في الفجر الصلاة خير من النوم ফজরের আজানে তিনি “আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম” বলতেন। (আবু দাউদ হা/৫০৪)। সহীহ আবু দাউদে শায়েখ আলবানী রহ. হাদিসটিকে সহিহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
.
(৩). বিলাল (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, একদা তিনি ফজরের আযান দেওয়ার জন্য রাসূল (ﷺ)-এর নিকটে আসলেন। তাকে বলা হলো যে, তিনি ঘুমিয়ে আছেন। তখন বেলাল (রাঃ) বললেন, الصَّلاَةُ خَيْرٌ مِنَ النَّوْمِ (ঘুম থেকে সালাত উত্তম)। অতঃপর এই শব্দাবলী ফজরের আযানের সাথে যুক্ত করে দেওয়া হলো এবং বিষয়টি এভাবেই সাব্যস্ত হয়ে গেল। (ইবনু মাজাহ হা/৭১৬, হাদীসটি বিশুদ্ধ)।
.
(৪). প্রখ্যাত সাহাবী আনাস ইবনু মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) [মৃত: ৯৩ হি.] বলেন; من السنۃ إذا قال المؤذن في أذان الفجر حي علی الفلاح قال: الصلوٰۃ خیر من النوم، الصلوٰۃ خیر من النوم সুন্নাতের মধ্যে এটি একটি যে, যখন মুয়াজ্জিন ফজরের আযানে “হাইয়্যা আলাল ফালাহ” বলবে তখন সে (মুয়াজ্জিন) “আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাউম” দুই বার বলবে। (সুনানুল কুবরা লিল বাইহাকি; খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৪২৩ সহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/৩৮৬; আল-আসারুস সহীহাহ হা/৪৭১; হাদীসটি সহীহ)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী আদ-দিমাশক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি.] উপরোক্ত হাদীসটি সহীহ বলেছেন। অতঃপর এই হাদীসটি ইমাম দারাকুতনী এবং ইমাম ত্বহাবীও ১/৮২ ইবনে আউন থেকে হুশাইমের সানাদে বর্ণনা করেছেন যে- كان التثويب في صلاة الغداة) إذا قال المؤذن : حي على الفلاح قال : الصلاة خير من النوم )( مرتين ) তাসবীবটা ফজরের সলাতে বলতে হয়। অর্থাৎ যখন মুয়াজ্জিন ফজরের আযানে “হাইয়া আলাল ফালাহ” বলবে তখন সে (মুয়াজ্জিন) যেন বলে “আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম” (দুইবার)। এই শব্দে ইবনে সাকানও বর্ণনা করেছেন এবং সহিহ বলেছেন যেমনটি ইবনে হাজার তার তালখীসে কাবীরে (৩/১৪৮ ) বলেছেন।(দেখুন আলবানী আস সামারুল মুসতাতাব পৃষ্ঠা: ১৩২)
.
সুতরাং এ সমস্ত হাদিসগুলোর মাধ্যমে এটাই প্রমাণ হলো যে, তাসবীব “আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাউম” বাক্যটি ফজরের সালাতের আযানে বলতে হয়। আর এই আজান হলো যখন ফজরের সালাতের সময় হয়ে যায়। যেমন- নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, فَإِذَا حَضَرَتْ الصَّلاَةُ فَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ أَحَدُكُمْ وَلْيَؤُمَّكُمْ أَكْبَرُكُمْ যখন নামাযের সময় হয়, তখন তোমাদের মধ্যে কেউ যেন নামাযের আযান দেয়, এবং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বয়সে বড় সে যেন ইমামতি করে। (সহীহ বুখারী হা/৬৩১ আ.প্র. ৫৯৫, ই.ফা. ৬০৩)
.
অপরদিকে রাত্রের শেষে যে আযানটা দেওয়া হয় সেটা কিন্তু নামাজের আজান নয়। অর্থাৎ ফজরের আজান নয়, বরং এটা হলো যেন তোমাদের মধ্যে যারা তাহাজ্জুদের সালাতে রত তারা যেন ফিরে যেতে পারে আর যারা ঘুমন্ত তাদেরকে জাগিয়ে দিতে পারে। যেমনটি সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন। আবদুল্লাহ্ ইবনু মাস‘ঊদ (রাযি.) হতে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন; বিলালের আযান যেন তোমাদের কাউকে সাহরী খাওয়া হতে বিরত না রাখে। কেননা, সে রাত থাকতে আযান দেয়- যেন তোমাদের মধ্যে যারা তাহাজ্জুদের সালাতে রত তারা ফিরে যায় আর যারা ঘুমন্ত তাদেরকে জাগিয়ে দেয়। অতঃপর তিনি বললেন; ফজর বা সুবহে সদিক বলা যায় না- তিনি একবার আঙ্গুল উপরের দিকে উঠিয়ে নীচের দিকে নামিয়ে ইঙ্গিত করে বললেন, যতক্ষণ না এরূপ হয়ে যায়। (সহীহ বুখারী হা/৬২১; আধুনিক প্রকাশনী ৫৮৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫৯৪)। এটা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে সালাতের সময় প্রবেশ করার পর যে আজানে “তাসবীব” দেওয়া হয় সেটা বিদআত নয় বরং সুন্নাহ। যারা বিদআত বলে এটি তাদের অজ্ঞতা।
.
▪️এবার বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আলেমদের কয়েকটি ফাতওয়া দেখুন:
.
সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণকে জিজ্ঞেসা করা হয়েছিলো; ফজরের প্রথম আযানে তাসবীব বলার ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ করা কি আমাদের উচিত নয় যেমনভাবে নাসাঈ, ইবনে খুযাইমা এবং বায়হাকিতে বর্ণিত হয়েছে? জবাবে স্থায়ী কমিটির আলেমগন বলেন; نعم ، ينبغي الإتيان بالتثويب في الأذان الأول للفجر امتثالا لأمر النبي صلى الله عليه وسلم ، وواضح من الحديث أنه الأذان الذي يكون عند طلوع الفجر الصادق ، وسمي أولاً بالنسبة للإقامة ، فإنها أذان شرعاً ، كما في حديث : ( بين كل أذانين صلاة ) ، وليس المراد بالأذان الأول ما ينادى به قبل ظهور الفجر الصادق ؛ فإنه شرع ليلاً ليستيقظ النائم ، وليرجع القائم ، وليس أذاناً للإعلام بالفجر ، ومن تدبر أحاديث التثويب لم يفهم منها إلا أن التثويب في أذان الإعلام بوقت الفجر لا الأذان الذي يكون ليلا قبيل الفجر জি হ্যাঁ! রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশ মেনে ফজরের নামাজের প্রথম আযানে তাসবীব পাঠ করা উচিত। হাদিস থেকে এটা স্পষ্ট যে, এটি হলো সেই আযান যেটার স্পষ্ট ফজর উদিত হলেই হয় অর্থাৎ ফজরের আজান। আর এটিকে প্রথম একামতের সাথে সম্পর্ক করা হয়েছে কেননা এটা শরয়ী আযান। যেমনটি হাদীসে রয়েছে- بين كل أذانين صلاة “দুই আযানের মাঝে সালাত রয়েছে।” (সহীহ বুখারী হা/৫৯৮, মসলিম হা/ ৮৩৮)। প্রথম আযান দ্বারা ফজর উদিত হওয়ার পূর্বের আযানকে বলা হয়নি কেননা সেটা ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগ্রত করার জন্য দেওয়া হয়। সেটা মূলত ফজরের আযান নয়। যে ব্যক্তি তাসবীবের হাদিসগুলো নিয়ে গবেষণা করবে সে অবশ্যই বুঝতে পারবে যে এটা হলো ফজরের সময়ের আযানের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে , ফজরের পূর্বক্ষণে রাতে যে আযানটা দেওয়া হয় সেটার ক্ষেত্রে বলা হয়নি। (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; গ্রুপ: ২; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৬৩)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]- কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন: আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম বাক্যটি কি ফজরের পূর্বে প্রথম আযানে বলা হয়? নাকি দ্বিতীয় আজানে? এর সঠিক দলিল কোনটি? মুয়াজ্জিনের বলার পরে যে ব্যক্তি শুনবে (আযানের উত্তরদাতা ) সে কি বলবে? (পোস্ট বড় হয়ে যাবে তাই আরবি উল্লেখ করিনি শুধু অনুবাদ উপস্থাপন করছি)
.
উত্তরে শাইখ বলেন; সুন্নাত হলো ফজরের পরে শেষের আজানে এটা বলতে হয়। আর এমনটি আবু মাহজুরা এবং আয়েশা রা. এর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। ফজরের পরে শেষের আযানে মুয়াজ্জিন এটা (আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম) বলবে। আয়েশা (রা.) বলেন; নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘুম থেকে উঠে দুই রাকাআত সালাত আদায় করেন, তারপর ওই আযানের পর নামাযের জন্য বের হন, যেটা নামাযের শেষ আযান ছিল প্রথম আযান নামকরণ করার দিক থেকে। আবার সেটাকে নামাযের প্রথম আযান বলা হয়, একামতের দিকে লক্ষ্য করে। কেননা একামতকে দ্বিতীয় আজান বলা হয়। হাদিসের মধ্যে এই শব্দটি ওই আজানের ক্ষেত্রে এসেছে যে আযানটা ফজর উদিত হওয়ার পরে দেওয়া হয় অর্থাৎ ফজরের আজান। আর ফজরের আযানকে দ্বিতীয় আযান বলা হয় শেষ রাত্রির দিকে আজান দেওয়ার বিবেচনায়। (অর্থাৎ প্রথম আজান তাহাজ্জুদের আর দ্বিতীয় আযান ফজরের, সেই দিকে লক্ষ্য করে ফজরের আজানটা হবে দ্বিতীয় আজান।) আবার ফজরের আযানটাই একামতের দিকে লক্ষ্য করে প্রথম আজান হবে; কেননা একামত হলো দ্বিতীয় আজান। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; প্রত্যেক দুই আযানের মাঝে নামায রয়েছে । এখানে দুই আযান দ্বারা উদ্দেশ্য হল আযান এবং ইকামত। মোয়াজ্জিন যখন আস স্বলাতু খইরুম মিনান নাউম বলবে, উত্তর দাতাও মুয়াজ্জিনের মতোই আস স্বলাতু খইরুম মিনান নাউম বলবে। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; মুয়াজ্জিন যা বলবে তোমরা তাই বলো। তবে যখন মোয়াজ্জিন হাইয়া আলাস সালাহ , হাইয়া আলাল ফালাহ বলবে তখন উত্তরদাতা লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ বলবে। উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুসলিম রহ. সেটি সহিহ সানাদে বর্ণনা করেছেন। (বিন বায মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খন্ড: ১০ পৃষ্ঠা: ৩৪০)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] কে প্রশ্ন করা হয়েছিল
“আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম” কথাটি কি ফজরের প্রথম আযানে বলতে হবে না দ্বিতীয় আযানে?
.
জবাবে শাইখ বলেন : (الصلاة خير من النوم) “আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম” কথাটি ফজরের প্রথম আযানে বলতে হবে। যেমনটি হাদীসে এসেছে- “সকালের প্রথম আযান প্রদান করলে বলবে, (الصلاة خير من النوم) “আসসালাতু খাইরুম্ মিনান্ নাওম” ঘুম থেকে নামায উত্তম। এটা প্রথম আযানে, দ্বিতীয় আযানে নয়। কিন্তু জানা দরকার এ হাদীসে প্রথম আযান বলতে কি বুঝানো হয়েছে? এটা হচ্ছে সেই আযান যা নামাযের সময় হওয়ার পর প্রদান করা হয়। আর দ্বিতীয় আযান হচ্ছে- ইক্বামত। কেননা ইক্বামতকেও ‘আযান’ বলা হয়েছে। যেমন: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, (بَيْنَ كُلِّ أَذَانَيْنِ صَلَاةٌ) “প্রত্যেক দু’আযানের মধ্যবর্তী সময়ে সালাত রয়েছে।” (সহীহ বুখারী হা/৬২৪)। উক্ত হাদীসে দু’আযান বলতে ‘আযান ও ইক্বামত’ উদ্দেশ্য।
অপরদিকে সহীহ বুখারীতে বলা হয়েছে- আমীরুল মু’মেনীন ঊসমান বিন আফ্ফান (রাঃ) জুমআর জন্য তৃতীয় আযান বৃদ্ধি করেন। অতএব, বেলালকে প্রথম আযানে যে “আসসালাতু খাইরুম মিনান্ নাওম” বলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ফজর নামাযের আযান। ফজর উদিত হওয়ার আগে যে আযানের কথা পাওয়া যায় তা ফজরের আযান নয়। লোকেরা শেষ রাতের ঐ আযানকে ফজর সালাতের প্রথম আযানরূপে আখ্যা দিয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ফজর সালাতের জন্য নয়। কেননা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, إِنَّ بِلاَلاً يُؤَذِّنُ بِلَيْلٍ لِيُوقِظَ نَائِمَكُمْ وَلِيَرْجِعَ قَائِمَكُمْ “বেলাল রাতে আযান দিয়ে থাকে। যাতে করে ঘুমন্ত ব্যক্তি জাগ্রত হয় এবং নফল সালাত আদায়কারী ফিরে যায়।” অর্থাৎ- ঘুমন্ত ব্যক্তি জাগ্রত হয়ে সাহূর খাবে আর ক্বিয়ামুল লায়ল বা তাহাজ্জুদ সালাত আদায়কারী নামায শেষ করে সাহূর খাবে।(সহীহ বুখারী হা/৬২১; সহীহ মুসলিম হা/১০৩৯)। তাছাড়া নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মালেক বিন হুওয়াইরিসকে বলেছিলেন; فَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلَاةُ فَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ أَحَدُكُمْ “নামাযের সময় উপস্থিত হলে তোমাদের মধ্যে একজন যেন আযান দেয়।” আর আমরা জানি যে, ফজর উদিত না হলে সালাতের সময় উপস্থিত হবে না। (সহীহ বুখারী হা/৬৩১; আ.প্র. ৫৯৫, ই.ফা. ৬০৩) অতএব ফজর হওয়ার আগের আযান ফজর সালাতের জন্য নয়। অতএব সাধারণভাবে মানুষ ফজরের আযানে যে “আছ্ছালাতু খাইরুম মিনান নাওম” বলে থাকে সেটাই সঠিক ও বিশুদ্ধ।
.
কিন্তু যারা ধারণা করে থাকে যে, প্রথম আযান বলতে ফজরের পূর্বের আযান উদ্দেশ্য তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক নয়। তারা দলীল পেশ করে থাকে যে, প্রথম আযান বলতে সেই আযানই উদ্দেশ্য যা শেষ রাতে নফল বা তাহাজ্জুদ নামাযের জন্য দেয়া হয় এবং সেজন্য বলা হয়; “আছ্ছালাতু খাইরুম্ মিনান্ নাওম” অর্থাৎ- ঘুম থেকে নামায উত্তম। এখানে ‘উত্তম’ শব্দটি দ্বারা বুঝা যায় এ আহ্বানটি নফল নামাযের জন্যই। আমরা জবাবে বলব; ‘উত্তম’ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব কাজের জন্যও ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ্ বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنجِيكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ، تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنتُمْ تَعْلَمُونَ “হে ঈমানদারগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক বাণিজ্যের সন্ধান দিব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি থেকে মুক্তি দিবে? তা এই যে, তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহ্র পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ও জীবন পন করে জিহা|দ করবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম; যদি তোমাদের জ্ঞান থাকে।” (সূরা সফফ; ১০, ১১)। আল্লাহ্ জুমআর সালাত সম্পর্কে বলেন; يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِي لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنتُمْ تَعْلَمُونَ “হে ঈমানদারগণ! যখন জুমআর দিনে সালাতের জন্য আহবান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহ্র যিকিরের প্রতি দ্রুত অগ্রসর হও, বেচা-কেনা ছেড়ে দাও। এটা তোমাদের জন্য উত্তম।” (সূরা জুমআ; ৬৬/৯)। অতএব ‘উত্তম’ শব্দটি যেমন ফরয বিষয়ে ব্যবহার হয় তেমনি মুস্তাহাব ও নফলের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়। (দেখুন, উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘ খন্ড:২ পৃষ্ঠা:৬১-৬৪ এবং ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম প্রশ্ন নং-১৯৮)
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে,”আসসালাতু খাইরুম মিনান্ নাওম” এই বাক্যটি ফজরের মূল আযানের সাথে দিতে হবে; সেহরি কিংবা তাহাজ্জুতের সালাতের সাথে নয়। এটাই বিশুদ্ধ হাদীস এবং আহালুল ইমামগণ এর মাজহাব। সুতরাং যারা ভিন্ন মত দিয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে আমরা বললো এটি তাদের ইজতিহাদ আর এ কথা সবারই জানা যে ইজতিহাদ ভুল বা সঠিক উভয় হতে পারে;ঔ যেমনটি এই মাসয়ালায় হয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে সুন্নাতের উপর আমল এবং বিদআত বর্জন করার তৌফিক দান করুক। পাশাপাশি যাবতীয় ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টিকারী ব্যক্তিবর্গ থেকে হেফাজত করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_______________________
উপস্থাপনায়:
আপনাদের দ্বীনি ভাই
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।