সাহু সিজদা কাকে বলে এবং সাহু সিজদা কোন কোন কারনে দিতে হয়

সাহু সিজদা হল ভুল সংশোধনী। ফরজ অথবা নফল যেকোন সালাতে ভুল করে কোন ওয়াজিব অংশ ত্যাগ করলে ঐ ভুলের খেসারত স্বরুপ এবং ভুল আনয়নকারী শয়তানের প্রতি চাবুক স্বরুপ দুটি সিজদাহ করতে হয়। অর্থাৎ সালাতে ভুলক্রমে কোন ‘ওয়াজিব’ তরক হলে শেষ বৈঠকের তাশাহহুদ শেষে সালাম ফিরানোর পূর্বে অথবা পরে সিজদায়ে সাহু দিতে হয়। ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন, সালাতের ওয়াজিব তরক হলে ‘সিজদায়ে সাহু’ ওয়াজিব হবে এবং সুন্নাত তরক হলে ‘সিজদায়ে সাহু’ সুন্নাত হবে। (শাওকানী, আ-সায়লুল জাররার, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা; ২৭৪) রাসূল ﷺ বলেছেন, তোমাদের যে কোন ব্যক্তি সালাত আদায় করতে দাঁড়ালে তার নিকটে শায়ত্বন আসে। সে তাকে সন্দেহ-সংশয়ে ফেলে দেয়, এতে সে স্মরণ রাখতে পারে না কত রাক‘আত সালাত সে আদায় করছে। তাই তোমাদের কোন ব্যক্তি এ অবস্থাপ্রাপ্ত হলে সে যেন (শেষ বৈঠকে) বসা অবস্থায় দু’টি সিজদা করে। (সহীহ বুখারী হা/ ১২৩২ সহীহ মুসলিম হা/ ৩৮৯)

◾সালাতে সাধারণত সাহু সিজদা চারটি কারণে দেয়া হয়। যেমন:
▪️(১) সালাত পূর্ণ হওয়ার পূর্বে সালাম ফিরালে।
▪️(২) সালাত কম-বেশি হলে।
▪️(৩) তাশাহ্হুদ ছুটে গেলে ও
▪️(৪) সালাতে সন্দেহ হলে। (বিস্তারিত দেখুন যাদুল মা‘আদ, ১/১৬৯ পৃ.সহীহ মুসলিম, মিশকাত হা/১০১৫; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১০১৮ ‘সহো’ অনুচ্ছেদ-২০। মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১০১৬ সালাত’ অধ্যায়-৪, ‘সাহু অনুচ্ছেদ-২০ মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১০১৭ ; মুসলিম, মিশকাত হা/১০২১)।

▪️সাহু সিজদা দেওয়ার নিয়ম হল:
_________________________________
(১) যদি ইমাম সালাতরত অবস্থায় নিজের ভুল সম্পর্কে নিশ্চিত হন কিংবা সরবে ‘সুবহানাল্লাহ’ বলার মাধ্যমে লোকমা দিয়ে মুক্তাদীগণ ভুল ধরিয়ে দেন, তবে তিনি শেষ বৈঠকের তাশাহ্হুদ দুরুদ অন্যান্য দোয়া শেষে তাকবীর দিয়ে পরপর দু’টি সিজদা দিবেন। অতঃপর সালাম ফিরাবেন। যেমন: রাসূল ﷺ বলেছেন, তোমাদের কোন ব্যক্তি যখন সালাতের মধ্যে সন্দেহ করে যে, সে কতটুকু সালাত আদায় করছে? তিন রাক‘আত না চার রাক‘আত, তাহলে সে যেন সন্দেহ দূর করে। যে সংখ্যার উপর তার দৃঢ়তা সৃষ্টি হয় তার ওপর নির্ভর করবে। তারপর সালাতের সালাম ফিরানোর পূর্বে দু’টো সিজদা করবে। (সহীহ মুসলিম হা/ ৫৭১ মিশকাত হা/১০১৫; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১০১৮ ‘সহো’ অনুচ্ছেদ-২০)।

(২) যদি ভুল করে রাক‘আত বেশী পড়ে সালাম ফিরিয়ে দেন, অতঃপর ভুল ধরা পড়ে, তখন (পূর্বের ন্যায় বসে) তাকবীর দিয়ে ‘সিজদায়ে সহো’ করে সালাম ফিরাবেন। যেমন: রাসূল ﷺ একবার চার রাকআতের জায়গায় পাঁচ রাক‘আত সালাত আদায় করেন। সাহাবীগন মনে করিয়ে দিলে তিনি দুটি সাহু সিজদা করেছেন। (সহীহ বুখারী হা/ ৪০১ সহীহ মুসলিম হা/ ৫৭২ মিশকাত হা/১০১৬)।

(৩) যদি রাক‘আত কম করে সালাম ফিরিয়ে দেন। তখন তাকবীর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাকী সালাত আদায় করবেন ও উপরোক্তভাবে ‘সিজদায়ে সাহু’ দিয়ে পুনরায় সালাম ফিরাবেন। যেমন একবার রাসূল ﷺ চার রাকআত সালাতের জায়গায় দুই রাকাআত পড়ে সালাম ফিরিয়েছেন পরে সাহাবীরা বললে তিনি পূনরায় বাকি দুই রাকাআত সালাত আদায় করে দুটি সাহু সিজদা আদায় করেছেন। (সহীহ বুখারী হা/৪৮২, সহীহ মুসলিম হা/ ৫৭৩ মিশকাত হা/১০১৭)।
.
(৪). চার রাকআত বিশিষ্ট সালাতে দুই রাকাআত পড়ে তাশাহুদে না বসে ভুলে দাঁড়িয়ে গেলে শেষ বৈঠকে সালাম ফিরানোর পূর্বে বা পরে দুটি সাহু সিজদা আদায় করবে। যেমন: আব্দুল্লাহ বিন বুহায়না (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন রাসূল ﷺ যোহরের সালাতে দ্বিতীয় রাক‘আতে না বসেই দাঁড়িয়ে গেলেন। অতঃপর সালামের পূর্বে দু’টি সহো সিজদা দিলেন (সহীহ বুখারী হা/৮২৯; মিশকাত হা/১০১৮) অপর বর্ননায় রাসূল ﷺ বলেছেন,ইমাম দু’ রাক‘আত সালাত আদায় করার পর (প্রথম বৈঠকে না বসে তৃতীয় রাক‘আতের জন্যে) উঠে গেলে যদি সোজা দাঁড়িয়ে যাবার পূর্বে মনে হয় তাহলে সে যেন বসে যায়। আর যদি সোজা দাঁড়িয়ে যায় তবে সে বসবে না (এবং শেষ বৈঠকে) দু’টি সাহু সিজদা করবে। (আবূ দাঊদ হা/ ১০৩৬, ইবনু মাজাহ হা/১২০৮ মিশকাত হা/১০২০)
.
সুতরাং ভুলবশত সালাতের কম অথবা বেশী যাই-ই হৌক শেষ বৈঠকে সালাম ফিরানোর আগে বা পরে দু’টি ‘সিজদায়ে সাহু’ দিবেন (সহীহ মুসলিম হা/৫৭২ সালাতু রাসূল (ﷺ) ১৫৩-৫৪ পৃ.)। মোটকথা ‘সিজদায়ে সহো’ সালামের পূর্বে ও পরে দু’ভাবেই জায়েয আছে।ইবনু আব্দিল বার্র, আত-তাহমীদ ১০/২০১-২০৪; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ৭/১৪৮)
.
জেনে রাখা ভাল যে, প্রচলিত মাজহাবের অনুসরণ অনুকরণ গিয়ে সালাতে ভুল করলে অধিকাংশ মুছল্লী তাশাহহুদ পড়ে ডান দিকে একবার সালাম ফিরায় অতঃপর ‘সিজদায়ে সাহু’ দিয়ে আবার তাশাহ্হুদ পড়ে।অথচ এই আমলটি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। বিশেষ করে একদিকে সালাম ফিরানোর বিশুদ্ধ কোন দলীলই নেই। এটি একেবারেই ভিত্তিহীন। আর ‘সিজদায়ে সাহু’র পর তাশাহহুদ পড়া সম্পর্কে মাত্র একটি বর্ণনা এসেছে। কিন্তু সেটাও যঈফ (যঈফ আবূ দাঊদ, হা/১০৩৯, পৃষ্ঠা: ৮৩; বিস্তারিত দ্র. তানক্বীহ, পৃষ্ঠা: ৩৩২-৩৫)। উক্ত হাদীস সহীহ হাদীসেরও বিরোধী। কারণ একই রাবী থেকে সহীহ বুখারীতে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সেখানে তাশাহ্হুদ পড়ার কথা নেই (সহীহ বুখারী, হা/৪৮২ (ইফাবা হা/৪৬৬); মিশকাত হা/১০১৭)।মির‘আতুল মাফাতীহ ২/৩২-৩৩ পৃ.; ঐ, ৩/৪০৭, হা/১০২৪)
.
পাশাপাশি যদি কেউ সাহু সিজদা দিতে ভুলে যায় তবে পরে স্মরণ হলেই সাহু সিজদা দিবেন।কারন আলেমগণ উল্লেখ করেছেন, ভুলক্রমে যে ব্যক্তির সহু সিজদা ছুটে গেছে যদি খুব বেশি বিলম্ব না হয় তাহলে সে তখনি সেটা কাযা করে নিবে। আর যদি দীর্ঘ সময় বিলম্ব হয় তাহলে মুসল্লির উপর থেকে সহু সিজদা আদায় করার দায়িত্ব বাদ যাবে এবং তার সালাত সহিহ হবে।(ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ১/৩৮৫; উসাইমীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ৩/৫৩৭)
.
ইমাম আল-বুহুতি (রহঃ) বলেন: কেউ যদি সালামের আগে আদায় করা মুস্তাহাব এমন কোন সাহু সিজদা দিতে ভুলে যায়; সে সাহু সিজদাটি যদি ওয়াজিব হয় তাহলে সে ব্যক্তি ওয়াজিব হিসেবে এটাকে কাযা করে নিবে। আর যদি অন্য কোন নামায শুরু করে দেয় তাহলে ঐ নামাযের সালাম ফিরানোর পর সহু সিজদা কাযা করবে; যদি এর মধ্যে বেশি বিলম্ব না হয়; ওজু না ভাঙ্গে এবং মসজিদ থেকে বের না হয়। যেহেতু সিজদাটি আদায় করার সময় এখনো আছে। আর যদি প্রথা অনুযায়ী খুব দেরী হয়ে যায়, কিংবা ওজু ছুটে যায় কিংবা মসজিদ থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে সহু সিজদা আর কাযা করা যাবে না। যেহেতু এটি আদায় করার সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। তবে তার সালাত শুদ্ধ হবে। যেমন অন্য যে কোন ওয়াজিব ভুলক্রমে পরিত্যাগ করলেও সালাত শুদ্ধ হয়।(মুনতাহাল ইরাদাত,১/২৩৫) যে ব্যক্তি এ মাসয়ালার বিধান জানে না এমন ব্যক্তি ও জেনে ভুলকারী উভয়ের জন্য হুকুম অভিন্ন।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন, যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে সহু সিজদা ছেড়ে দেয় তাহলে তার সালাত বাতিল হয়ে যাবে এবং তাকে পুনরায় নামায পড়তে হবে। আর যদি ভুলক্রমে কিংবা অজ্ঞতাবশত ছেড়ে দেয় তাহলে তাকে পুনরায় নামায পড়তে হবে না। তার সালাত সহিহ।(ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়া সমগ্র খণ্ড-২ (৬/১০)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] কে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে,যদি কেউ নামাযের রাকাতে বেশি করে কিংবা কম করে এবং সহু সিজদা না দেয় তাহলে তার সালাত কি বাতিল হয়ে যাবে?

তিনি জবাবে বলেন: এক্ষেত্রে বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রয়োজন। যদি সে ব্যক্তি সহু সিজদা দেয়ার হুকুম জানার পরও সালাতের মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে সহু সিজদা না দেয় তাহলে তার সালাত বাতিল হয়ে যাবে। আর যদি অজ্ঞতাবশত কিংবা ভুলক্রমে সাহু সিজদা না দেয় তাহলে তার সালাত শুদ্ধ হবে। [নুরুন আলাদ-দারব ফতোয়াসমগ্র থেকে সংক্ষেপিত ও সমাপ্ত]
.
▪️সাহু সিজদার আনুষঙ্গিক কয়েকটি মাসায়েল:
_____________________________________
(১). ভুলবশত: যে কোনও ওয়াজিব (যেমন রুকূ বা সিজদার তাসবীহ ইত্যাদি মূলেই) ত্যাগ করলে ঐ একই নিয়মে সিজদাহ করতে হবে।
.
(২). ইমাম সাহু সিজদাহ করলে মুক্তাদী ভুল না করলেও তাঁর অনুসরণে তাঁর সাথে সিজদাহ করতে বাধ্য। ইমামের পশ্চাতে মুক্তাদী ভুল করলে যদি সে প্রথম রাকআত থেকেই ইমামের সাথে থাকে, তাহলে তাকে পৃথকভাবে সিজদাহ করতে হবে না। কারণ, তার এ ভুল ইমাম বহন করে নেবে। অবশ্য মসবূক (জামাআতে পিছিয়ে পড়া মুক্তাদী) হলে, ইমামের সালাম ফিরার পর তার বাকী সালাত আদায় করতে উঠলে শেষে ভুল অনুসারে যথানিয়মে সিজদাহ করবে। কিন্তু যদি ইমাম সালাম ফিরার পর সিজদাহ করেন, তাহলে তাঁর সাথে মসবূকের সহু সিজদাহ করা সম্ভব নয়। কারণ সে সালাম ফিরতে পাবে না। তাই সে উঠে বাকী সালাত আদায় করে শেষে যথানিয়মে একাকী সিজদাহ করে নেবে। অবশ্য সে যদি ইমামের ভুলের পর জামাআতে শামিল হয়ে থাকে, তাহলে সে ক্ষেত্রে তাকে সিজদাহ করতে হবে না।
.
(৩). ইমাম ভুল করে এক রাকআত সালাত বেশী পড়লে এক রাকআত ছুটে গেছে এমন মসবূক (পিছে পড়ে যাওয়া) সালাত আদায়কারীকে সেই রাকআত গণ্য করতে পারে না। সে রাকআত যেহেতু ইমামের বাতিল, সেহেতু তারও বাতিল। তাকে নিয়ম মত উঠে বাকী এক রাকআত কাযা পড়তে হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌ সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩০৯)
.
(৪). সতর্কতার বিষয় যে, ভুল করে সালাতের কোন রুকন ছুটে গেলে সালাতই হয় না। কোন ওয়াজেব ছুটে গেলে সিজদা-এ সাহও দ্বারা পূরণ হয়ে যায় এবং কোন সুন্নত ছুটে গেলে সালাতের কোন ক্ষতি হয় না তথা সহু সিজদারও প্রয়োজন হয় না।
.
(৫). ক্বিরাআত করতে করতে ভুলে গেলে অথবা কাশিতে ধরলে যদি পরিমাণ মত পড়া হয়ে থাকে, তাহলে ইমাম তখনই রুকূতে চলে যাবেন। অবশ্য ক্বিরাআত ছোট মনে হলে অন্য সূরাও পড়তে পারেন। আটকে যাওয়ার পর সূরা ইখলাস পড়েও রুকূ যেতে পারেন। অবশ্য ক্বিরাআত ভুল পড়লে শেষে ঐ সূরা পড়তে হয় -এ কথা মনে করা ঠিক নয়। (আরো বিস্তারিত জানতে সালাতে মুবাশ্বির বইটি পড়তে পারেন ইনশাআল্লাহ। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।