সালাত আদায়ের সময় ভুলক্রমে কোনো রাকআতে একটি রুকু একটি সিজদা একটি দাঁড়ানো বা একটি বসা বৃদ্ধি করলে তা শুদ্ধ করার নিয়ম

প্রশ্ন: কোন ব্যক্তি যদি সালাত আদায়ের সময় ভুলক্রমে কোনো রাকআতে একটি রুকু, একটি সিজদা, একটি দাঁড়ানো বা একটি বসা বৃদ্ধি করে, তাহলে সেই ভুল কীভাবে শুদ্ধ করতে হবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে সালাতের যেমন: একটি রুকু, একটি সিজদা, একটি দাঁড়ানো বা একটি বসা বৃদ্ধি করে, তাহলে তার সালাত বাতিল হয়ে যাবে। কারণ এভাবে সালাতে কিছু যোগ করা মানে হচ্ছে আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্ধারিত বিধান অমান্য করে ভিন্ন পদ্ধতিতে সালাত পড়া বা নিজের পক্ষ থেকে এক নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করা। আর ইবাদাতে নতুন কিছু সংযোজন করা শারঈ দৃষ্টিতে বিদআত, যা প্রত্যাখ্যাত।” কারন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: (من عمل عملاً ليس عليه أمرنا فهو رد) “যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যা আমাদের নির্দেশনার ভিত্তিতে নয় তা প্রত্যাখ্যাত।”(সহীহ মুসলিম হা/১৭১৮)
.
পক্ষান্তরে কেউ যদি ভুলবশত একটি রুকু, একটি সিজদা, একটি দাঁড়ানো বা একটি বসা বৃদ্ধি করে তাহলে সালাত বাতিল হবে না। কিন্তু সালাত শেষ করে সালাম ফিরানোর পর সাহু সিজদা দিতে হবে। এর পক্ষে দলীল হলো আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহুর) হাদীস; যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিকেলের দুই সালাতের কোনো এক সালাতে, সেটা যোহর কিংবা আসর, দুই রাকাত পড়ে সালাম ফিরিয়ে ফেলেন। তারা (সাহাবীরা) যখন বিষয়টি তাঁকে জানাল তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাকি সালাত পড়ে সালাম ফেরালেন। সালামের পর তিনি দুটি সিজদাহ দিলেন।”(সহীহ বুখারী হা/৪৮২;ও মুসলিম হা/৫৭৩) আরো একটি দলীল হল ইবনে মাসউদ (রাদিয়াল্লাহু আনহুর) হাদীস, তিনি বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে যোহরের সালাত পাঁচ রাকাত পড়ালেন। সালাত শেষে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল: ‘সালাত কি বৃদ্ধি করা হয়েছে?’ তিনি বললেন: “এ প্রশ্ন কেন?” তারা বলল: আপনি পাঁচ রাকাত সালাত পড়েছেন। তিনি তখন তার দুই পা ঘুরিয়ে কিবলামুখী হলেন এবং দুটি সিজদাহ দিলেন।”(সহীহ বুখারী হা/৪০৪) ও মুসলিম হা/৫৭২)
.
কোনও ইমাম যদি সালাতে অতিরিক্ত রাকআত আদায়ের জন্য দাড়িয়ে যান এমন অবস্থায় করনীয় সম্পর্কে শারহ মুনতাহাল ইরাদাত গ্রন্থে বলা হয়েছে:
إن قام إلى خامسة لم يجز للمأموم متابعته لأنه ” يعتقد خطأه , وأن ما قام إليه ليس من صلاته . فإن تبعه جاهلا , أو ناسيا , أو فارقه : صحت له (أي الصلاة) , ويلزم من علم الحال مفارقته ، ويسلم المفارق لإمامه بعد قيامه إلى الزائدة , وتنبيهه وإبائه الرجوع , إذا أتم التشهد الأخير
যদি (ইমাম) ভুলবশত পঞ্চম রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে যান, তাহলে মুক্তাদির জন্য তাঁর অনুসরণ করা জায়েয নয়। কারণ মুক্তাদি সুনিশ্চিতভাবে জানেন যে, ইমাম ভুল করেছেন এবং যে রাকাআতে তিনি দাঁড়িয়েছেন তা সালাতের অংশ নয়। তবে যদি মুক্তাদি অজ্ঞতাবশত বা ভুলবশত ইমামের অনুসরণ করে ফেলেন, কিংবা ইমামের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তাহলেও তাঁর সালাত শুদ্ধ হবে। যে ব্যক্তি প্রকৃত অবস্থা নিশ্চিতভাবে জানে, ইমামের অনুসরণ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া তার জন্য আবশ্যক। যে ব্যক্তি ইমাম থেকে আলাদা হয়ে গেছেন ইমাম অতিরিক্ত রাকাআতের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর তিনি আলাদাভাবে সালাম ফিরিয়ে নিবেন এবং শেষ তাশাহ্‌হুদ সম্পন্ন করার পর ভুল থেকে ফিরে আসার জন্য ইমামকে সতর্ক করবেন।”(শারহ মুনতাহাল ইরাদাত; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২২৩)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন: যুলফি শহরের একজন বোন জানতে চেয়েছেন আমি যোহরের সালাত আদায় করছিলাম। চতুর্থ রাকাতে রুকু করার পর যখন সিজদায় যেতে যাচ্ছিলাম, তখন ভুলবশত আবার রুকু করে ফেলি। এরপর বিষয়টি মনে পড়ে গেলে আমি সিজদায় চলে যাই। এখন কি আমার সালাত পুনরায় পড়তে হবে?
উত্তরে শাইখ বলেন:
ليس عليك إعادة، عليك سجود السهو؛ لأنك زدت ركوعاً سهواً فعليك بعد الفراغ من التحيات والدعاء سجدتان للسهو تسجدين سجدتين مثل سجود الصلاة تقولين فيهما: سبحان ربي الأعلى، سبحان ربي الأعلى، وتجلسين بينهما مثلما تجلسين بين السجدتين تقولي: رب اغفر لي، رب اغفر لي بين السجدتين ثم تسلمين، هذا الذي عليك، وهكذا لو زدت سجوداً أو زدت ركعة خامسة في الظهر أو العشاء أو العصر أو رابعة في المغرب أو ثالثة في الفجر سهواً ثم تذكرت تسجدي للسهو. نعم.
المقدم: جزاكم الله خيراً
“না, আপনার সালাত পুনরায় পড়ার প্রয়োজন নেই; বরং আপনাকে সাহু (ভুল সংশোধনের সিজদা) সেজদা করতে হবে। কারণ আপনি ভুলবশত একটি অতিরিক্ত রুকু করেছেন। এজন্য তাশাহহুদ ও দোয়ার পর সাহু সেজদার নিয়তে দুইটি সেজদা করতে হবে। এই সেজদাগুলো সালাতের স্বাভাবিক সেজদার মতো হবে, এবং এতে আপনি বলবেন: “سُبْحَانَ رَبِّيَ الأَعْلَى” (সুবহান রব্বিয়াল আ‘লা)। দুই সেজদার মাঝখানে সাধারণ নিয়মে বসে বলবেন: “رَبِّ اغْفِرْ لِي، رَبِّ اغْفِرْ لِي” (রব্বিগফিরলী, রব্বিগফিরলী)। এরপর সালাম ফিরিয়ে সালাত শেষ করবেন। এটাই আপনার জন্য করণীয়। এমনকি কেউ যদি ভুল করে একটি সেজদা বেশি করে ফেলে, কিংবা যোহর, আসর বা এশার নামাজে পাঁচ রাকাআত, মাগরিবে চার রাকাআত, অথবা ফজরে তিন রাকাআত পড়ে ফেলে এবং পরে তা স্মরণ হয় তবুও তার সালাত বাতিল হবে না। বরং তাকে সাহু সেজদা করতে হবে। উপস্থাপক: আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।”(বিন বায অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-৮৩২৪)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: যদি ইমাম ভুল করে পাঁচ রাকাত সালাত আদায় করে ফেলে, তবে তাঁর সালাতের হুকুম কী এবং তাঁর পেছনে যারা সালাত আদায় করেছে তাদের সালাতের হুকুম কী? এবং যে ব্যক্তি দেরীতে এসে ইমামের সাথে যোগ দিয়েছে সে কি এই অতিরিক্ত রাকাত গণনা করবে?”
তিনি উত্তরে বলেন :
إذا صلى الإمام خمسا سهوا فإن صلاته صحيحة ، وصلاة من اتبعه في ذلك ساهيا أو جاهلا صحيحة أيضا .وأما من علم بالزيادة فإنه إذا قام الإمام إلى الزائدة وجب عليه أن يجلس ويسلم ، لأنه في هذه الحالة يعتقد أن صلاة إمامه باطلة إلا إذا كان يخشى أن إمامه قام إلى الزائدة ، لأنه أخل بقراءة الفاتحة ( مثلا ) في إحدى الركعات فحينئذ ينتظر ولا يسلم ( أي ينتظر حتى يسلم مع الإمام ) .وأما بالنسبة للمسبوق الذي دخل مع الإمام في الثانية فما بعدها فإن هذه الركعة الزائدة تحسب له ، فإذا دخل مع الإمام في الثانية مثلا سلم مع الإمام الذي زاد ركعة ، وإن دخل في الثالثة أتى بركعة بعد سلام الإمام من الزائدة ، وذلك لأننا لو قلنا بأن المسبوق لا يعتد بالزائدة للزم من ذلك أن يزيد ركعة عمدا ، وهذا موجب لبطلان الصلاة ، أما الإمام فهو معذور بالزيادة ، لأنه كان ناسيا فلا تبطل صلاته
“যদি ইমাম ভুল করে পাঁচ রাকাআত সালাত আদায় করে তবে তাঁর সালাত শুদ্ধ এবং যে মুক্তাদিরা ভুলবশত অথবা অজ্ঞতাবশত তাঁকে অনুসরণ করেছে তাদের সালাতও শুদ্ধ। কিন্তু যে মুক্তাদি নিশ্চিত থাকেন যে, এটি অতিরিক্ত রাকাআত, তার জন্য ইমাম পঞ্চম রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে গেলে বসে পড়া ও সালাম ফিরিয়ে ফেলা ওয়াজিব। কারণ এক্ষেত্রে তিনি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেন যে, ইমামের সালাত সঠিক নয়। যদি তিনি এ আশংকা করেন যে, ইমাম কোন এক রাকাআতে সূরা ফাতিহা পড়ায় গরমিল করেছেন বিধায় অতিরিক্ত পঞ্চম রাকাত পড়ছেন সেক্ষেত্রে তিনি সালাম না ফিরিয়ে ইমামের জন্য অপেক্ষা করবেন। অর্থাৎ ইমামের সাথে সালাম ফিরানোর জন্য অপেক্ষা করবেন। আর যে ব্যক্তি দেরিতে এসে ইমামের সাথে দ্বিতীয় রাকাতে বা পরবর্তী কোন রাকাআতে যোগ দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত সালাত আদায় করেছে, এ অতিরিক্ত রাকাতটি তার ক্ষেত্রে গণনা করা হবে।যদি সে ইমামের সাথে দ্বিতীয় রাকাতে যোগ দেয়, তবে সে ইমামের সাথে অতিরিক্ত রাকাআতসহ সালাম ফিরাবে। আর যদি সে তৃতীয় রাকাতে এসে যোগ দেয়, তবে ইমামের অতিরিক্ত রাকাতের সালাম ফিরানো শেষে আরেক রাকাত যোগ করবে। কারণ আমরা যদি বলি, যে মুক্তাদি দেরিতে যোগ দিয়েছে তাঁর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত রাকাআতটি গণ্য হবে না, তবে তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে অতিরিক্ত এক রাকাত যোগ করতে হবে যা সালাত বাতিল হওয়ার কারণ। পক্ষান্তরে এই ইমাম অতিরিক্ত রাকাআত আদায় করার ক্ষেত্রে ওজরগ্রস্ত। কারণ তিনি ভুল করেছেন। তাই তাঁর সালাত বাতিল হবে না।”(ইবনু উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খণ্ড: ১৪; পৃষ্ঠা: ১৯)।
▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
Share: