সালাতে বিশেষ করে রুকু ও সিজদায় আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় দোয়া করা জায়েয আছে কি

প্রশ্ন: সালাতে বিশেষ করে রুকু ও সিজদায় আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় (বাংলায়) দোয়া করা জায়েয আছে কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি। অতঃপর মহান আল্লাহ তা‘আলা মানব এনং জ্বীনজাতিকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং মানুষের কর্তব্য হল ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করা। আর ইসলামি শরীয়তে কালেমা শাহাদাতের পরে দ্বিতীয় স্তম্ভ সালাত আল্লাহর নৈকট্য লাভের সবচেয়ে বড় মাধ্যম এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি এমন এক ইবাদত, যার ওপর অন্যান্য আমলের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে। যদি সালাত সঠিক হয়, তবে অন্য ইবাদতসমূহও সঠিক হওয়ার আশা করা যায়। পক্ষান্তরে সালাত যদি বাতিল বা ত্রুটিপূর্ণ হয়, তবে অন্যান্য ইবাদতও তার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে না। এজন্যই সালাতকে ইসলামী ইবাদতের মানদণ্ড বলা হয়ে থাকে। সালাতকে পরিপূর্ণভাবে আদায় করার জন্য কুরআন ও হাদীসে কিছু শিষ্টাচার ও বিধান বর্ণিত হয়েছে, যেগুলো মেনে চললে সালাত যেমন সহীহ ও পূর্ণাঙ্গ হবে, তেমনি এতে প্রতিফলিত হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরিপূর্ণ সওয়াব। পক্ষান্তরে এসব আদব উপেক্ষা করলে সালাত বাহ্যিকভাবে সম্পন্ন হলেও তা যথাযথ মর্যাদা পাবে না এবং কাঙ্ক্ষিত পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সালাতের সিজদায় অনেকেই কুরআনের দোয়া এবং বাংলায় দোয়া পড়ার ব্যাপারে সম্মতি দেন আবার অনেকে দেন না। কোনটা করা ঠিক হবে? আমরা এই প্রশ্নটির উত্তর কয়েকটি পয়েন্টে দেওয়ার চেষ্টা করব।
.
প্রথমত: রুকু ও সিজদার সময় সাধারণত তিন ধরনের দোয়া পাঠ করা হয়ে থাকে:
(১).পবিত্র কুরআনের আয়াতভিত্তিক দোয়া। যেমন কুরআনে বর্ণিত দোয়ার আয়াতসমূহ। যেমন: সিজদায়
اللَّهُمَّ رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی الدُّنۡیَا حَسَنَۃً وَّ فِی الۡاٰخِرَۃِ حَسَنَۃً وَّ قِنَا عَذَابَ النَّارِ
“হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন এবং আখেরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।(সূরা বাকারাহ: ২০১; মুসনাদে আহমাদ হা/১৩১৬৩)
.
(২). সহীহ হাদীসে প্রমাণিত দোয়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রুকু ও সিজদায় যে দোয়াগুলো পাঠ করতেন। যেমন: রুকুতে গিয়ে ‘সুবহানা রাব্বিআল আযিম’ (পবিত্রতা আমার সুমহান রব্বের জন্য) বলা। সেজদাতে গিয়ে ‘সুবহানা রাব্বিআল আ’লা’ (পবিত্রতা আমার সুউচ্চ রব্বের জন্য) বলা।দুই সেজদার মাঝখানে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই সেজদার মাঝখানে বলতেন: رَبِّ اغْفِرْ لِيْ، رَبِّ اغْفِرْ لِيْ (রাব্বিগফিরলী, রাব্বিগফিরলী দুই বার) অর্থ- হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করে দাও, আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দাও”।(আবু দাউদ হা/৮৫০, ৮৭৪)
.
(৩). মাতৃভাষায় শরয়ী দোয়া যারা আরবি ভাষায় দোয়া পাঠে ঠিকভাবে সক্ষম নন, তারা শরিয়তসম্মত অর্থবোধক দোয়া নিজ নিজ ভাষায় পাঠ করেন।
.
(১) ও (২) নম্বর বিষয়ে অর্থাৎ রুকু ও সিজদার মধ্যে কুরআনের আয়াত ভিত্তিক দোয়া এবং সহীহ হাদীসে বর্ণিত দোয়াসমূহ কুরআন ও হাদীসে যেভাবে এসেছে, ঠিক সেভাবেই আরবি ভাষায় পাঠ করায় কোনো আপত্তি নেই ইনশাআল্লাহ। এ বিষয়ে আমরা পূর্বে একটি বিস্তারিত আর্টিকেল প্রকাশ করেছি, যা আপনি নিম্নোক্ত লিংকে পড়ে নিতে পারেন: https://tawheedmedia.com/?p=11270 আজ ইনশাআল্লাহ আমরা (৩) নম্বর বিষয়ে আলোচনা করবো:অর্থাৎ সালাতের মধ্যে মাতৃভাষায় বৈধ কোন দোয়া পাঠ করা জায়েয কি না?
.
সালাতে আরবি ব্যতীত অন্য ভাষায় দোয়া করা কিংবা না করার বিষয়ে যেহেতু সরাসরি কোন দলিল নেই সেজন্য এই বিষয়ে ইসলামি ফকিহদের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। কেউ একে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ (হারাম) হিসেবে গণ্য করেছেন, কেউ একে অপছন্দনীয় (মাকরূহ) বলে উল্লেখ করেছেন, আবার কেউ কেউ এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে যারা আরবি ভাষায় দোয়া করতে (অপারগ) অক্ষম তাদের জন্য তা বৈধ বলেছেন। এ বিষয়ে ফকিহদের মতামত নিম্নরূপ:
.
আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ, কুয়েতি ফিক্বহ বিশ্বকোষ-এ এসেছে:
الدعاء بغير العربية في الصلاة:
المنقول عن الحنفية في الدعاء بغير العربية : الكراهة؛ لأن عمر رضي الله تعالى عنه نهى عن رطانة الأعاجم، والرطانة كما في القاموس: الكلام بالأعجمية. وظاهر التعليل: أن الدعاء بغير العربية خلاف الأولى، وأن الكراهة فيه تنزيهية .
ولا يبعد أن يكون الدعاء بالعجمية مكروها تحريما في الصلاة، وتنزيها خارجها.
وذهب المالكية إلى أنه يحرم الدعاء بغير العربية – على ما نقل ابن عابدين عن القرافي – معللا باشتماله على ما ينافي التعظيم، وقيد اللقاني كلام القرافي بالأعجمية المجهولة المدلول، أخذا من تعليله، وهو اشتمالها على ما ينافي جلال الربوبية.
وأما إذا علم مدلولها فيجوز استعمالها مطلقا في الصلاة وغيرها؛ لقوله تعالى: وعلم آدم الأسماء كلها ، وقوله تعالى: وما أرسلنا من رسول إلا بلسان قومه ، وهذا ما صرح به الدسوقي أيضا.
وقد فصل الشافعية الكلام فقالوا: الدعاء في الصلاة إما أن يكون مأثورا أو غير مأثور.
أما الدعاء المأثور ففيه ثلاثة أوجه:
أصحها، ويوافقه ما ذهب إليه الحنابلة: أنه يجوز بغير العربية للعاجز عنها، ولا يجوز للقادر، فإن فعل بطلت صلاته.
والثاني: يجوز لمن يحسن العربية وغيره.
والثالث: لا يجوز لواحد منهما ، لعدم الضرورة إليه.
وأما الدعاء غير المأثور في الصلاة، فلا يجوز اختراعه والإتيان به بالعجمية قولا واحدا.
وأما سائر الأذكار كالتشهد الأول والصلاة على النبي صلى الله عليه وسلم فيه، والقنوت، والتسبيح في الركوع والسجود، وتكبيرات الانتقالات، فعلى القول بجواز الدعاء بالأعجمية : تجوز بالأولى .
وإلا ففي جوازها للعاجز أوجه:
أصحها: الجواز. والثاني: لا. والثالث: يجوز فيما يجبر بسجود السهو”
“সলাতে আরবি ছাড়া অন্য ভাষায় দোয়া করা: হানাফি মাযহাব অনুযায়ী, সলাতের মধ্যে আরবি ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় দোয়া করা মাকরূহ (অপছন্দনীয়) হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এর কারণ হল, খলীফা উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) অ-আরবদের ভাষায় কথা বলায় নিষেধ করেছিলেন। رطّانة’ (রাতানাহ) শব্দটি মূলত অ-আরবদের ভাষায় কথা বলা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ব্যাখ্যা থেকে এটি স্পষ্ট যে, সলাতে আরবি ছাড়া অন্য ভাষায় দোআ করা উত্তম নয়, বরং এটি মাকরূহ তানযিহী (হালকা মাত্রার অপছন্দনীয়)। তবে এটি বলা অতিরঞ্জন নয় যে, সালাতে অন্য ভাষায় দোয়া করা তাহরীমান মাকরূহ (হারামের কাছাকাছি মাত্রায় অপছন্দনীয়) বলে গণ্য হতে পারে, যদিও সালাতের বাইরে তা শুধু তানযিহী মাকরূহ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
.
মালিকি মাযহাব মতে, যা ইবনু আবিদীন আল-কারাফি (রাহিমাহুল্লাহ)-র বরাতে উল্লেখ করেছেন, সালাতে আরবি ছাড়া অন্য ভাষায় দোয়া করা হারাম, কারণ এতে এমন কিছু থাকতে পারে যা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমার পরিপন্থী। তবে আল-লাক্কানি কারাফির এই নিষেধাজ্ঞাটি শুধুমাত্র সেই অজানা ও বিদেশি ভাষার জন্য সীমাবদ্ধ রেখেছেন যার অর্থ স্পষ্ট নয়। কারণ অর্থ না বোঝা অবস্থায় দু’আ করলে সেখানে এমন কিছু থাকতে পারে যা প্রভুত্বের মর্যাদার বিরুদ্ধে যায়। তবে যদি কেউ ওই ভাষার অর্থ স্পষ্টভাবে জানে এবং বুঝতে পারে, তাহলে সেটি সালাত সহ অন্যান্য ইবাদতের মধ্যে দোয়া হিসেবে ব্যবহার করা জায়েজ (অনুমোদনযোগ্য)। কারণ আল্লাহ বলেছেন: “আর আল্লাহ আদমকে সমস্ত নাম শিখিয়েছেন” (সূরা বাকারা ২: ৩১) এবং “আমরা প্রত্যেক নবীকেই পাঠিয়েছি তার জাতির ভাষায়”(সূরা ইব্রাহিম ১৪: ৪]। এ কথাটি আল-দুসুকিও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।
.
শাফিয়ি মাযহাবের আলেমগন এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং বলেছেন: সলাতের মধ্যে দুআ দুই ধরনের হয় মাসনূন (সংকলিত) অথবা অমাসনূন (নতুনভাবে বানানো)। মাসনূন দু’আর বিষয়ে তিনটি মতামত রয়েছে: প্রথম মত: সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত এবং এটি হাম্বলি মাযহাবের অভিমতের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ যদি কেউ আরবি ভাষায় দু’আ করতে অক্ষম হয়, তাহলে তার জন্য অন্য ভাষায় দু’আ করা বৈধ। কিন্তু যদি কেউ আরবি ভাষা জানে, তারপরও সে অন্য ভাষায় দু’আ করে, তাহলে তার সালাত বাতিল হয়ে যাবে। দ্বিতীয় মত: আরবি জানুক বা না জানুক উভয় অবস্থাতেই সলাতে অন্য ভাষায় দু’আ করা বৈধ। তৃতীয় মত: সলাতে অন্য ভাষায় দু’আ করা কোনো অবস্থাতেই বৈধ নয়; কেননা এর কোনো প্রকৃত প্রয়োজন নেই।
.
অপরদিকে অমাসনূন দু’আ অর্থাৎ যদি কেউ সালাতে এমন কোন দোয়া পড়ে যা মাসনূন নয় (অর্থাৎ হাদীসে প্রমাণিত নয়) এবং তা নিজের পক্ষ থেকে রচনাকৃত ও অন্য ভাষায় হয় তাহলে ইমামগণের সর্বসম্মত মতে তা নিষিদ্ধ। অন্যান্য যিকির যেমন: প্রথম তাশাহহুদ, তাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর দরুদ, কুনুত, রুকু ও সিজদায় তাসবীহ, অবস্থান্তরের তাকবীরসমূহ ইত্যাদি যারা সলাতে অন্য ভাষায় দু’আ করার অনুমতি দেন, তাদের মতে এগুলো তো আরও সহজে বৈধ। আর যদি তা বৈধ না হয়, তাহলে যারা আরবি জানে না, তাদের জন্য এগুলোর বৈধতা সম্পর্কে তিনটি মতামত: (১).সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত অনুযায়ী এসব যিকির অন্য ভাষায় পড়া বৈধ। (২).দ্বিতীয় অভিমত অনুযায়ী এটি বৈধ নয়। (৩).তৃতীয় মতামতের ভিত্তিতে শুধু সেসব জায়গায় বৈধ, যেখা।নে ভুল হলে ‘সিজদা সহু’ দ্বারা তা সংশোধন করা সম্ভব।”(আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ, খণ্ড:১১; পৃষ্ঠা: ১৭২)
.
দ্বিতীয়ত: সলাতের বাইরে কিংবা সলাতের ভেতরে যদি কেউ আরবি ভাষায় দোয়া করতে অক্ষম (অপারগ) হয় তাহলে সে অমাসনূন (নবগঠিত) দু’আও করতে পারে, এমনকি তা নিজের মাতৃভাষায়ও হতে পারে, যতক্ষণ না সে দু’আয় কোনো হারাম, গুনাহপূর্ণ কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। নিঃসন্দেহে  নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত মাসনূন দোয়াসমূহের মধ্যে অপার ফজিলত, গভীরতা ও বরকত রয়েছে। তবে মানুষ কখনো নিজে কিংবা প্রিয়জনদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ কামনায়, কিংবা কোনো দুঃখ, বিপদ বা কষ্ট থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় নিজ ভাষায় অন্তর থেকে দোয়া করে থাকে। এটি একটি ব্যাপক বিষয়, এবং কেবলমাত্র সংকলিত দোয়া নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকা জরুরি নয়।কেননা দু’আর মূল উদ্দেশ্য হলো হৃদয়ের একান্ত উপস্থিতি, বিনম্রতা এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আন্তরিকতা। এটি যে ভাষায়ই হোক না কেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সব ভাষা বোঝেন, সব আওয়াজ শ্রবণ করেন এবং আসমান-জমিনের ক্ষুদ্রতম কণাও তাঁর অগোচরে (অজানা) নয়।
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:
” وأمَّا مَن دعا الله مخلصاً له الدين بدعاءٍ جائزٍ: سمعه الله وأجاب دعاه ، سواء كان معرباً أو ملحوناً …
بل ينبغي للداعي ، إذا لم يكن عادته الإعراب : ألا يتكلف الإعراب . قال بعض السلف : إذا جاء الإعراب ذهب الخشوع .
وهذا كما يكره تكلف السجع في الدعاء ، فإذا وقع بغير تكلفٍ : فلا بأس به .فإنَّ أصل الدعاء مِن القلب ، واللسان تابعٌ للقلب ، ومَن جعل همَّته في الدعاء تقويم لسانه ، أضعف توجه قلبه .
ولهذا يدعو المضطر بقلبه دعاء يفتح عليه ، لا يحضره قبل ذلك ، وهذا أمرٌ يجده كلُّ مؤمنٍ في قلبه .والدعاء يجوز بالعربيَّة ، وبغير العربيَّة .والله سبحانه يعلم قصد الداعي ومراده ، وإن لم يقوِّم لسانه ؛ فإنه يعلم ضجيج الأصوات ، باختلاف اللغات ، على تنوع الحاجات”
“যে ব্যক্তি আল্লাহকে আন্তরিকভাবে বৈধ দোয়া করে, আল্লাহ তা শুনেন এবং কবুল করেন সেটা সুশ্রুত আরবি হোক বা ভুলভ্রান্ত…বরং যে ব্যক্তি সাহিত্যিক আরবিতে অভ্যস্ত না, তার উচিত নয় জোর করে ভাষার শুদ্ধতা রক্ষা করার চেষ্টা করা। কিছু সালাফ বলেছিলেন: ‘যখন ব্যাকরণ (ই’রাব) আসে, তখন খুশু (ভক্তি) চলে যায়।’ তেমনি জোর করে ছন্দ মিলিয়ে দোয়া করাও অপছন্দনীয় তবে যদি নিজে থেকে হয়, তাহলে দোষ নেই। দোয়া মূলত অন্তর থেকে আসে, আর জিহ্বা তো অন্তরের অনুসরণকারী। যে ব্যক্তি দোয়ার সময় শুধু তার জিহ্বার শুদ্ধতা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সে নিজের হৃদয়ের মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। এ জন্যই যে ব্যক্তি চরম বিপদে পড়ে, সে হৃদয় থেকে এমন দোয়া করে ফেলে যা সে আগে চিন্তাই করেনি এটা প্রত্যেক মুমিন নিজ হৃদয়ে অনুভব করে থাকে। দোয়া আরবিতে হোক বা অন্য ভাষায় বৈধ।আল্লাহ জানেন দোয়াকারীর উদ্দেশ্য ও মনোভাব, এমনকি সে যদি সঠিক উচ্চারণ না-ও করতে পারে।কারণ আল্লাহ সব ভাষার আওয়াজ ও চাহিদা বুঝেন ও শোনেন।(ইবনু তাইমিয়্যাহ ফাতাওয়া আল-কুবরা, খন্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৪২৪)
.
সালাতে অমাসনূন দোয়ার বৈধতার একটি প্রমাণ হচ্ছে ইবনে মাসউদ (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিস: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে তাশাহ্‌হুদ শিক্ষা দিতেন। এরপর তিনি হাদিসের শেষের দিকে বলেন: (ثُمَّ لِيَتَخَيَّرْ مِنَ الدُّعاَءِ أَعْجَبَهُ إِلَيْهِ فَيَدْعُوْا) অত:পর তার কাছে যে দু’আ পছন্দনীয়, তা নির্বাচন করে দু’আ করবে।” অন্য এক বর্ণনায় আছে,( ثُمَّ يَتَخَيَّرْ مِنَ الْمَسْأَلَةِ مَا شَاءَ )”অতঃপর যা ইচ্ছা চেয়ে দোয়া করতে পারে।” (বুখারী হা/৮৩৫ ও মুসলিম হা/৪০২) এই হাদিসগুলো নামাজের শেষাংশে সেজদার পর থেকে সালাম ফিরানোর পূর্ব পর্যন্ত দোয়া করার বিষয়ে নির্দেশ প্রদান করে। কেননা দোয়া করার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দুইটি: সিজদাতে ও শেষ বৈঠকের তাশাহ্‌হুদের পর। হাফেয ইবনে হাজার (রহঃ) বলেন:موطن الدعاء في الصلاة السجود أو التشهد “সলাতে দোয়া করার স্থান হচ্ছে সিজদা কিংবা তাশাহ্‌হুদ।(ফাতহুর বারী;খণ্ড;১১;পৃষ্ঠা;১৮৬ থেকে সমাপ্ত) শাইখ বিন বায (রহঃ) বলেন:محل الدعاء في الصلاة : السجود ، وفي آخر التحيات قبل السلام “সলাতে দোয়া করার স্থান: সিজদা ও আত্তাহিয়্যাতু শেষে সালাম ফেরানোর পূর্বে।(মাজমুউ ফাতাওয়া বিন বায; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩১০)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন; والأحاديث في هذا المعنى كثيرة ، وهي تدل على شرعية الدعاء في هذه المواضع بما أحبه المسلم من الدعاء سواء كان يتعلق بالآخرة أو يتعلق بمصالحه الدنيوية ، بشرط ألا يكون في دعائه إثم ولا قطيعة رحم ، والأفضل أن يكثر من الدعاء المأثور عن النبي صلى الله عليه وسلم ” ا”এই বিষয়ে বহু হাদীস রয়েছে, যা প্রমাণ করে যে উক্ত স্থানগুলোতে মুসলিমদের পছন্দ অনুযায়ী দোয়া করা শারঈ দৃষ্টিতে বৈধ তা আখিরাত সংক্রান্ত হোক কিংবা দুনিয়াবী কল্যাণ সম্পর্কিত। তবে শর্ত হল: দোয়ায় যেন কোনো গুনাহ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার কিছু না থাকে। আর সর্বোত্তম হচ্ছে,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত দোয়াগুলো বেশি বেশি পাঠ করা।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ১৭২)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: আল্লাহ আপনাদের পুরস্কৃত করুন। প্রশ্নকারী জানতে চাচ্ছেন: কেউ যদি আরবি না জানে, তাহলে সে কি সালাতে আরবি ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় দোয়া করতে পারবে? জবাবে শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
الدعاء بغير اللغة العربية من شخص لا يعرف اللغة العربية جائز سواء في الصلاة أو خارج الصلاة لأن هذا الرجل الذي لا يعرف العربية لو كلف أن يدعو بالعربية لكان هذا من تكليف ما ليس في وسعه، وقد قال الله تعالى : (( لا يكلف الله نفسا إلا وسعها )).
فإذا قال قائل : نُعَلِّمه.
قلنا: وإذا علمته الألفاظ وهو لا يعرف المعاني فما الفائدة؟
وعلى كل فالدعاء يجوز للإنسان أن يدعو الله بلسانه أي بلسان الداعي باللغة العربية أو غير العربية.
وأما القرآن فلا يجوز أن ينطق به أحد إلا باللغة العربية على كل حال.
وأما الأذكار الواردة فهذه إن تعذر أن يتعلمها باللغة العربية فلا بأس أن يذكر الله بلسانه، لكن كما تعلمون لفظ الجلالة مثلا لا يمكن أن يحول إلى غير اللغة العربية، وإذا لم يمكن فله أن يدعو بغير العربية.
فصار الأقسام كم ؟ ثلاثة.
الأول : ما لا يجوز إلا بالعربية، وهو القرآن.
الثاني : ما يجوز بالعربية وغيرها ممن لا يحسن العربية، وهو دعاء الله لما ليس واردا.
والثالث : الدعاء بالوارد كالأذكار ونحوها، نقول: إن كان قادرا بالعربية فلتكن بالعربية وإن كان عاجزا فبلغته.
“যে ব্যক্তি আরবি জানে না, তার জন্য আরবি ছাড়া অন্য ভাষায় দোয়া করা বৈধ সেটা সলাতের মধ্যে হোক বা সলাতের বাইরে হোক। কারণ যে ব্যক্তি আরবি জানে না, তাকে যদি আরবিতে দোয়া করার বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়, তবে তা হবে তার সাধ্যের বাইরে একটি দায়িত্ব। অথচ আল্লাহ বলেন :”আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না।”(সূরা বাকারা: ২৮৬) যদি কেউ বলে: আমরা তাকে (আরবি) শিখিয়ে দেব। আমরা বলি: তুমি যদি তাকে শুধু শব্দ শেখাও, কিন্তু সে যদি তার মানে না বোঝে, তবে এতে কী লাভ? সুতরাং একজন ব্যক্তি তার নিজের ভাষায় আল্লাহর কাছে দোয়া করতে পারে সেটা আরবিতে হোক বা অন্য কোনো ভাষায়। কিন্তু কুরআনের বেলায় এটি শুধু আরবিতেই পড়া বৈধ, যেকোনো অবস্থাতেই। আর যেসব যিকির বা দোয়া শরীয়তে নির্ধারিত হয়েছে, সেগুলোর আরবি শেখা যদি কারো জন্য খুব কষ্টসাধ্য হয়, তাহলে সে তার নিজের ভাষায় আল্লাহকে স্মরণ করতে পারে। তবে যেমনটা আপনারা জানেন, উদাহরণস্বরূপ “আল্লাহ” নামটি অন্য কোনো ভাষায় অনুবাদ করা যায় না। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে সে তার নিজের ভাষায় দোয়া করতে পারে।
সারসংক্ষেপে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়:
১. যা শুধু আরবিতেই বৈধ তা হলো কুরআন।
২. যা আরবি ও অন্য ভাষায় বৈধ আরবি না জানা ব্যক্তির জন্য যেমন: নির্ধারিত নয় এমন সাধারণ দোয়া।
৩. শরীয়ত নির্ধারিত দোয়া বা যিকির যদি কেউ আরবিতে বলার সক্ষমতা রাখে, তবে তাকে আরবিতে বলতে হবে। আর যদি অক্ষম হয়, তাহলে নিজের ভাষায় বলতে পারে।”(ইবনু উসামীন লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং-৬১)
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে সালাতের মধ্যে মাতৃভাষায় দোয়া করা বিশেষত সেজদাহ অবস্থায় কিংবা সালাম ফিরানোর পূর্বে একটি মতভেদপূর্ণ বিষয়। তবে সালাফদের বক্তব্য ও শারঈ মূলনীতির আলোকে প্রতীয়মান হয়, যে ব্যক্তি আরবি ভাষা জানেন, তার জন্য আরবিতেই দোয়া করা উচিত। তবে যারা আরবিতে দক্ষ নন বা যাদের জন্য আরবি শেখা কঠিন, তাদের জন্য সালাতের মধ্যে মাতৃভাষায় দোয়া করা বৈধ। বিশেষত সেজদার সময়, তারা প্রথমে সেজদার তাসবীহ (যেমন: সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা) পাঠ করবে, এর পর দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী মাতৃভাষায় দোয়া করতে পারবে। একইভাবে, শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ ও দরূদ পাঠের পর সালাম ফিরানোর পূর্বে মাতৃভাষায় শরিয়তসম্মত যেকোনো কল্যাণকর দোয়া পাঠ করা জায়েয। এই দোয়া হাদীস থেকেই হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা ইসলামে নেই; বরং ব্যক্তি নিজ প্রয়োজনমাফিক বৈধ যে কোনো দোয়া করতে পারে। এই বিধান ফরজ কিংবা নফল সকল সলাতেই প্রযোজ্য। যদি আরবি ভাষায় দোয়া করা আবশ্যক করে তোলা হয়, তবে তা ইসলামের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, দুনিয়ার সকল মানুষের মাতৃভাষা আরবি নয় এবং অনেকের পক্ষেই আরবি শেখা কষ্টসাধ্য। সুতরাং যারা আরবিতে দোয়া করতে অক্ষম তারা যেন আরবি ভাষা শেখার আন্তরিক প্রচেষ্টা করে। আর শিখে নেওয়া পর্যন্ত তারা সেজদার অবস্থায় এবং সালামের আগের মুহূর্তে মাতৃভাষায় আল্লাহর কাছে দোয়া করবে নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, পরিবার-পরিজনের জন্য, সমগ্র উম্মাহর ঈমানদার নারী-পুরুষদের জন্য এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সর্বপ্রকার কল্যাণের জন্য। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফি.।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি সৌদি আরব।
Share: