শিয়ারা কেন শুধুমাত্র হুসাইনকে সম্মানিত ও মহিমান্বিত করে

প্রশ্ন: আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর একাধিক সন্তান থাকা সত্ত্বেও শিয়ারা কেন শুধুমাত্র হুসাইনকে সম্মানিত ও মহিমান্বিত করে?
▬▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি। অতঃপর আমার ইতি পূর্বেই শিয়াদের উৎপত্তি সংক্রান্ত একটি পোস্টে উল্লেখ করেছিলাম যে, প্রখ্যাত সাহাবী উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) এর মৃত্যুর পর ইহু-দীদের ষড়যন্ত্রের ফসল হিসাবে আলী এবং মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) এর মাঝে সংঘটিত যুদ্ধকে কেন্দ্র করে শী‘আ সম্প্রদায়ের জন্ম হয়। সুতরাং ইসলামের চতুর্থ খলিফা প্রখ্যাত সাহাবী আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ৪০ হি.] এর একাধিক সন্তান থাকা সত্ত্বেও শিয়ারা কেন শুধুমাত্র হুসাইনকে সম্মানিত ও মহিমান্বিত করে? এই বিষয়টি আমরা শিয়াদের দৃষ্টিকোণ এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের কতিপয় আলেমদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
.
▪️প্রথমেই শিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইমামতের (নেতৃত্ব) বিষয়ে:
.
শিয়া মতবাদ অনুসারে, ইমামত (নেতৃত্ব) একমাত্র হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর বংশধরদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর মাধ্যমে নয়। তারা বলে যে, এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ নির্বাচন এবং আল্লাহ যা চান তাই করেন। কিছু শিয়া বলেন, এটি ছিল হুসাইনের ওপর হওয়া কষ্ট ও শহীদের জন্য এক ধরনের প্রতিদান। অন্যরা বলেন এটি ছিল হাসানের বিরুদ্ধে একটি শাস্তি, কারণ তিনি মু‘আবিয়ার সাথে সন্ধি করেছিলেন। তারা এর পক্ষে কিছু রেওয়ায়েত (বর্ণনা) উল্লেখ করেন। যেমন:
.
হিশাম ইবনু সালিম বলেন: আমি ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম: হাসান উত্তম, না হুসাইন?
জবাবে তিনি বললেন:
الحسن أفضل من الحسين.قلت: فكيف صارت الإمامة من بعد الحسين في عقبه، دون ولد الحسن؟ فقال: إن الله تبارك وتعالى أحب أن يجعل سُنَّة موسى وهارون، جارية في الحسن والحسين، ألا ترى أنهما كانا شريكين في النبوة، كما كان الحسن والحسين شريكين في الإمامة؟ وإن الله عز وجل جعل النبوة في ولد هارون، ولم يجعلها في ولد موسى؛ وإن كان موسى أفضل من هارون.
“হাসান, হুসাইনের চেয়ে উত্তম। আমি বললাম: তাহলে ইমামত কেন হুসাইনের বংশে গেল, হাসানের সন্তানদের মধ্যে নয়? তিনি বললেন: আল্লাহ তা‘আলা চেয়েছিলেন যে মূসা ও হারূনের উদাহরণটি হাসান ও হুসাইনের মধ্যে বাস্তবায়িত হোক। আপনি কি দেখেন না যে, মূসা ও হারূন উভয়েই নবুয়তের অংশীদার ছিলেন, তেমনি হাসান ও হুসাইন ছিলেন ইমামতের অংশীদার? আর আল্লাহ নবুয়ত দিয়েছেন হারূনের সন্তানদের, মূসার নয়, যদিও মূসা হারূনের চেয়ে উত্তম ছিলেন।”(বিহারুল আনওয়ার; খণ্ড: ২৫; পৃষ্ঠা: ২৪৯)
.
শিয়া সূত্র থেকে বর্ণিত বানোয়াট হাদীসসমূহ:
.
মুহাম্মদ ইবনে আবি ইয়াকুব -বালখি বলেন: আমি আবুল হাসান রেযা (আলাইহিস সালাম)-কে জিজ্ঞেস করলাম:”কী কারণে ইমামত (ধর্মীয় নেতৃত্ব) হুসাইনের বংশধরদের মধ্যে নির্ধারিত হলো, হাসানের বংশধরদের মধ্যে নয়?”
তিনি বললেন: لأن الله عزوجل جعلها في ولد الحسين، ولم يجعلها في ولد الحسن، والله لا يُسأل عما يفعل. “কারণ আল্লাহ তাআলা ইমামত হুসাইনের বংশধরদের মধ্যে স্থাপন করেছেন, হাসানের বংশধরদের মধ্যে তা স্থাপন করেননি। আর আল্লাহ যা করেন, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করতে পারে না। (বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড: ২৫; পৃষ্ঠা: ২৬০)
.
ইমাম সাদিক (আলাইহিস সালাম) বলেন: “আল্লাহ তাআলা হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর শাহাদাতের প্রতিদানে তাঁর বংশধরদের মধ্যে ইমামত স্থাপন করেছেন। (তা’য়ীলুল আয়াত, পৃষ্ঠা: ৫৯৮)
.
আলী ইবনুল হুসাইন তাঁর চাচা মুহাম্মদ ইবনুল হানাফিয়্যাহ-কে বলেছিলেন: হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) যখন মু‘আবিয়ার সঙ্গে আপস করলেন, তখন আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলেন না যে ইমামত ও ওসিয়্যত (ধারাবাহিক নেতৃত্ব) হাসানের বংশধরদের মধ্যে থাকুক। বরং তিনি তা হুসাইনের বংশধরদের মধ্যেই নির্ধারণ করলেন।”(বিহারুল আনওয়ার,৪২/৭৭) কুম্মী তাঁর গ্রন্থ “আল-ইমামাহ ওয়াত-তাবসিরাহ মিনাল হাইরাহ”-তে উল্লেখ করেন: হাসান মু‘আবিয়ার সঙ্গে যা করলেন, তা দেখে আল্লাহর ইচ্ছা বদলে গেল (বাদা’ ঘটল); এখন থেকে তিনি কেবল হুসাইনের বংশধরদের মধ্যেই ওসিয়্যত ও ইমামত নির্ধারণ করবেন।(আল-ইমামাহ ওয়াত-তাবসিরাহ মিনাল হাইরাহ” পৃষ্ঠা: ১৯৪)
.
তাদের ভ্রান্ত কথাবার্তা সমালোচনা ও বিশ্লেষণ: এই সব বক্তব্য মিথ্যা, মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত। কারন কোনো ইমামই নিষ্পাপ (মাসূম) নন, না হাসানের বংশধরদের মধ্য থেকে, না হুসাইনের বংশধরদের মধ্য থেকে আল্লাহ তাঁদের উভয়কেই সন্তুষ্ট করুন। “বাদা’” (যার অর্থ, আল্লাহর সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা বদলে যাওয়া) এই বিশ্বাস আল্লাহর প্রতি কুফর; কারণ এটি আল্লাহর জ্ঞানহীনতা নির্দেশ করে, যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।(দেখুন, ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৫৩৫৪৩২)
.
▪️দ্বিতীয়ত: আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের কতিপয় আলেমদের দৃষ্টিভঙ্গি:
.
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মানহাজ হচ্ছে: সাইয়্যিদুনা হাসান ও সাইয়্যিদুনা হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) দু-জনই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নাজাতপ্রাপ্ত নাতি, জান্নাতী যুবকদের নেতা এবং আহলুল বায়তের অমূল্য রত্ন। তা সত্ত্বেও ইতিহাসে এমন কয়েকটি দল ও মতবাদ দেখা যায়, যারা ইমামত-সংক্রান্ত ধারা শুধু হুসাইন (রাঃ)-এর বংশে সীমাবদ্ধ রেখেছেন,অথচ হাসান (রাঃ)-এর বংশকে সে মর্যাদায় অংশীদার মনে করে না। এর পেছনে সু-পরিকল্পিত বাস্তবধর্মী সামাজিক-রাজনৈতিক কিছু আছে আর তা হচ্ছে; হুসাইন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) ও তাঁর বংশধরদের মধ্যে ইমামত নির্ধারিত হওয়ার পেছনে একটি কারণ হতে পারে পারস্যের বাদশাহ ইয়াজদার্দের কন্যা শাহরবানু (বা শাহ জানান)-এর সঙ্গে হুসাইনের বিবাহ। হুসাইন বিয়ে করেছিলেন একজন ইরানি (ফারসি) নারীকে, যিনি ছিলেন কিসরা (পারস্য সম্রাট) ইয়াজদগার্দের কন্যা, নাম ছিল শাহরবানু (বা শাহজানাহ)।মুসলিমরা যখন কিসরার কন্যাদের বন্দী করে, তখন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) [মৃত: ২৩ হি.] হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে তাঁদের একজন, শাহজানাহকে উপহার দেন। বিবাহের পর এই রাজকন্যার গর্ভ থেকেই জন্ম নেন আলী ইবনুল হুসাইন যিনি ইতিহাসে ‘যাইনুল আবিদীন’ নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে শিয়া মতবাদে তাঁকে হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর একমাত্র বৈধ উত্তরসূরি এবং ‘মাসূম ইমাম’ অর্থাৎ নিষ্পাপ, ত্রুটিমুক্ত নেতা হিসেবে গণ্য করা হয়। এই ব্যাখ্যা অযৌক্তিক নয়। তবে ইতিহাস ও বাস্তবতার নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করলে একথা স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় যে, শিয়া সম্প্রদায়ের চিন্তাধারা একদিকে প্রবল আবেগনির্ভর, অন্যদিকে অন্তঃবিরোধী ও দৃষ্টিকটুভাবে বৈপরীত্যপূর্ণ। কেননা তাদের এই ভ্রান্ত দাবির বাস্তবতা-বিচ্যুতি সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এর সহোদর ভাই হাসান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এর আচরণে। ইসলামের বৃহত্তর কল্যাণের কথা ভেবে তিনি স্বেচ্ছায় খিলাফতের দায়িত্ব আমির মুʿআবিয়া (রাযি.) এর হাতে অর্পণ করেন। যদি সত্যিই কেউ মাসূম অর্থাৎ ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে হতেন, তবে এমন সিদ্ধান্ত তাঁর পক্ষে গ্রহণীয় হতো না। সুতরাং শিয়াদের ‘মাসূমিয়াত’ এর দাবিটি বাস্তবভিত্তিক নয়, এটিই ইতিহাসের নির্মোহ সাক্ষ্য। (বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৫৩৫৪৩২)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফি.।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি সৌদি আরব।
Share: