প্রশ্ন: আর রাসুলুল মুকাদ্দাস বা রাসূলে পাক, এবং আল কুরআনুল মুকাদ্দাস বা কুরআনে পাক। এই শব্দগুচ্ছ ব্যবহারের অনুমতি আছে কি?
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর “রাসূলে পাক” এবং “কুরআনে পাক” বাক্যগুলোতে আরবি ও ফারসির শব্দ মিশ্রিত হয়েছে। “রাসূলে পাক” এবং “কুরআনে পাক” আরবি বাক্যগুলো সঠিকভাবে হবে:الرسول المقدَّس —(আর রসুলুল মুকাদ্দাস) বা “পবিত্র রাসূল”القرآن المقدَّس —(আল কুরআনুল মুকাদ্দাস) বা “পবিত্র কুরআন”।
.
আরবী ‘রাসূল’ (رَسُول) শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রেরিত, প্রেরণকৃত, দূত, প্রতিনিধি, বার্তাবাহক (Messenger, Emissary, Envoy, Delegate, Apostle) ইত্যাদি।আরবী ‘আরসালা’ (أرسل) অর্থ প্রেরণ করা। অন্যের পক্ষ থেকে কোনো সংবাদ, তথ্য বা বাণী নিয়ে যিনি আগমন করেন তাকে রাসূল বলা হয়। শারঈ পরিভাষায় রাসূল অর্থ আল্লাহর মনোনিত ও নির্বাচিত ব্যক্তি যাকে আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে তাঁর বাণী ও নির্দেশনা প্রদান করেছেন এবং তা মানুষের কাছে প্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন।অপরদিকে ফারসি পাক” শব্দের বাংলা অর্থ “পবিত্র” বা “শুদ্ধ” অতএব, “রাসূলে পাক” অর্থ “পবিত্র প্রেরিত রাসূল” বা “শুদ্ধ দূত”। এখন আর রসুলুল মুকাদ্দাস বা রাসূলে পাক এবং আল কুরআনুল মুকাদ্দাস কুরআনে পাক।শব্দগুচ্ছ ব্যবহারের অনুমতি আছে কিনা এটি নিয়ে একটু আলোচনা করার চেষ্টা করব।
.

.
ইবনে মানযুর (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বিখ্যাত গ্রন্থ লিসানুল আরবে বলা হয়েছে :
” و ” المُقَدَّس ” : المُبارَك ، والأَرض المُقَدَّسة : المطهَّرة ، وقال الفرَّاء : الأَرض المقدَّسة : الطاهرة ، وهي دِمَشْق وفِلَسْطين وبعض الأُرْدُنْ ، ويقال : أَرض مقدَّسة أَي : مباركة ، وهو قول قتادة ، وإِليه ذهب ابن الأَعرابي “
“এবং আল মুকাদ্দাস (المقدّس)” অর্থ ‘বরকতময়’ বা ‘পবিত্র’।“আল-আরদ আল-মুকাদ্দাসাহ (الأرض المقدّسة)” অর্থ ‘পবিত্র ভূমি’।ফাররাআ বলেন: পবিত্র ভূমি বলতে বোঝায় দামেশক, ফিলিস্তিন এবং জর্ডানের কিছু অংশ। আবার বলা হয়, পবিত্র ভূমি মানে বরকতময় ভূমি এ কথাই কাতাদাহ বলেছেন, ইবনুল আ’রাবিও এ অভিমতই পোষণ করেছেন।”(লিসানুল আরব; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ১৬৮)
.
শায়খ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন:
والقرآن هو أحق بالطهر والتقديس من كل كلام ؛ فهو مطهر عن كل عيب ونقص ، مقدس عن الخطأ ، أو أن يشتبه بكلام البشر ؛ لكننا مع ذلك نرى أن وصفه ذلك ، لا يعني أن يطلق عليه أنه ( الكتاب المقدس ) على سبيل الاسم ، أو اللقب الملازم له ، كما هو حال النصارى مع كتابهم ؛ لأننا لم نعرف ذلك عن السلف ، ولم يعد عنهم تلك التسمية ، ويخشى أن يكون فيها ـ أيضا ـ نوع تشبه أو محاكاة لأهل الكتاب مع كتابهم
“অতএব, নিঃসন্দেহ কুরআনুল কারিম অন্য সকল বাণীর চেয়ে সর্বোচ্চ পবিত্র এবং সম্মানযোগ্য; এটি ত্রুটিমুক্ত, দোষ, ঘাটতি এবং যাবতীয় অপূর্ণতা থেকে পবিত্র, এবং মানব রচিত বাক্যের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।তবুও, আমরা মনে করি কুরআনের ক্ষেত্রে “المقدَّس” (পবিত্র) শব্দটি ব্যবহার করা মানে এই নয় যে কুরআনুল কারিমকে الكتاب المقدس (পবিত্র গ্রন্থ) এই নামে ডাকা হবে, যেমন খ্রিস্টানরা তাদের বাইবেলকে বলে থাকে। কারণ,এমন নামকরণ আমরা সাহাবা বা সালাফদের থেকে পাইনি, তারা কখনো কুরআনকে এই নামে ডাকেননি।বরং,এ ধরনের নাম ব্যবহার করলে আহলে কিতাবদের (খ্রিস্টানদের) অনুকরণ বা মিল পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে অনুচিত। (এ বিষয়ে বিস্তারিত দেখতে পারে ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৭৬০৪৬)
.

والحاصل : أن التقديس لا يختص به سبحانه بل يستعمل في حق الآدميين ، يقال : فلان رجل مقدَّس : إذا أريد تبعيده عن مسقطات العدالة ووصفه بالخير ، ولا يقال : رجل مسبَّح ، بل ربما يستعمل في غير ذوي العقول أيضاً ، فيقال : قدَّس الله روح فلان ، ولا يقال : سبَّحه .ومن ذلك قوله تعالى ( ادْخُلُوا الأَرضَ المُقَدَّسَةَ ) يعني : أرض المقدسة ، يعني : أرض الشام .
সংক্ষেপে: “তাকদিস (পবিত্রতা) শুধু আল্লাহর জন্য সীমাবদ্ধ নয়। এটা মানবজাতির ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায়, যেমন বলা হয়: “ফুলান ব্যক্তি একজন ‘মুকাদ্দাস’ (পবিত্র ব্যক্তি)”,যদি তার ন্যায়পরায়ণতা ও সদগুণ বোঝাতে হয়। তবে মুসাববাহ (তাসবীহপ্রাপ্ত ব্যক্তি) বলা হয় না। এমনকি অচেতন জিনিস বা সত্তার ক্ষেত্রেও এই শব্দ ব্যবহৃত হয়,যেমন বলা হয়: قدس الله روح فلان (আল্লাহ অমুকের আত্মাকে পবিত্র করুন), কিন্তু “سبحه الله বলা হয় না। এছাড়াও এর উদাহরণ কুরআনের আয়াতেও এসেছে: অর্থ: তোমরা পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করো”(সূরা আল-মায়িদাহ ৫:২১) অর্থাৎ “আল-আরদুল-মুকাদ্দাসাহ”, যা আশ-শামের (বৃহত্তর সিরিয়ার) ভূমিকে নির্দেশ করছে।”(আল-ফুরুক আল-লুগাওয়িয়্যাহ; পৃষ্ঠা: ১২৫)
.
এছাড়াও “তাফসীরে আস-সাদীতে বলা হয়েছে: (قُلْ نَزَّلَهُ رُوحُ الْقُدُسِ) “বলুন,(হে মুহাম্মদ),পবিত্র আত্মা (রূহুল-কুদুস) এটি অবতীর্ণ করেছেন”।(সূরা নাহল: ১০২) এখানে “রূহুল-কুদুস”অর্থ হলো ফেরেশতা জিব্রাঈল,যিনি হলেন ত্রুটিমুক্ত,পবিত্র বার্তাবাহক এবং সকল বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার ঊর্ধ্বে।”(তাফসীরে আস-সাদী,পৃষ্ঠা;৪৪৯) আর সূরা আল-মায়িদাহ/২১-এ আল্লাহ বলেন:(يَا قَوْمِ ادْخُلُوا الْأَرْضَ الْمُقَدَّسَةَ الَّتِي كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ وَلَا تَرْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِكُمْ فَتَنْقَلِبُوا خَاسِرِينَ) হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি লিখে দিয়েছেন তাতে তোমরা প্রবেশ কর,এবং পশ্চাদপসরণ করো না, করলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে প্রত্যাবর্তন করবে।”(সূরা মায়েদাহ;২১) আয়াতের তাফসিরে হাফিয ইবনে কাসির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:”فقال تعالى مخبراً عن موسى أنه قال ( يَا قَوْمِ ادْخُلُوا الأرْضَ الْمُقَدَّسَةَ ) أي : المطهرة“এখানে আল্লাহ বলেন, মূসা (আলাইহিস সালাম) তার জনগণের উদ্দেশে বললেন: ‘হে আমার জনগণ! সেই পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ কর”।এর মানে হলো: পবিত্র (অপরিচ্ছন্নতা মুক্ত) ভূমি।”(তাফসিরে ইবনু কাসীর;খণ্ড;৩;পৃষ্ঠা;৭৫) ইবনে আশুর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:والأرض المقدّسة بمعنى : المطهّرة المباركة ، أي الّتي بارك الله فيها “পবিত্র ভূমি অর্থ হলো পরিশুদ্ধ এবং বরকতময় ভূমি,অর্থাৎ যে ভূমিতে আল্লাহ বরকত দিয়েছেন।”(তাহরীর ওয়াত-তানভীর, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা: ১৬২)
.

(১).মুবারক (বরকতময়) বর্ণনা:
ক.কুরআন মাজিদ সম্পর্কে, এটিকে বরকতময় (মুবারক) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে যেখানে আল্লাহ তাআলা বলেছেন:كِتٰبٌ اَنۡزَلۡنٰهُ اِلَیۡكَ مُبٰرَكٌ “এটা মুবারক কিতাব, এটা আমরা আপনার প্রতি নাযিল করেছি,..।(সূরা সোয়াদ: ২৯)
খ.নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও বরকতময় তাঁর বার্তায়, তাঁর কার্যকলাপে, তাঁর সত্তায় এবং এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর রেখে যাওয়া চিহ্নসমূহে। সাঈদ বিন আলী বিন ওয়াহাফ আল-কাহতানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
والأمور المباركة أنواع منها : 1. القرآن الكريم مبارَك ، أي : كثير البركات والخيرات ؛ لأن فيه خير الدنيا والآخرة ، وطلب البركة من القرآن يكون : بتلاوته حق تلاوته والعمل بما فيه على الوجه الذي يرضي الله عز وجل . 2. الرسول صلّى الله عليه وسلّم مبارك ، جعل الله فيه البركة ، وهذه البركة نوعان : أ. بركة معنوية : وهي ما يحصل من بركات رسالته في الدنيا والآخرة ، لأن الله أرسله رحمة للعالمين وأخرج الناس من الظلمات إلى النور وأحل لهم الطيبات وحرم عليهم الخبائث وختم به الرسل ، ودينه يحمل اليسر والسماحة . ب. بركة حسّيّة ، وهي على نوعين : النوع الأول : بركة في أفعاله صلّى الله عليه وسلّم ، وهي ما أكرمه الله به من المعجزات الباهرة الدالة على صدقه . النوع الثاني : بركة في ذاته وآثاره الحسية ، وهي ما جعل الله له صلّى الله عليه وسلّم من البركة في ذاته ؛ ولهذا تبرك به الصحابة في حياته وبما بقي له من آثار جسده بعد وفاته “
বরকতপূর্ণ জিনিস (মুবারক) বিভিন্ন ধরণের হয়, যার মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি অন্তর্ভুক্ত:
(১).কুরআন মাজিদ বরকতময় অর্থাৎ, এটি বহু কল্যাণ ও ফায়দাসমৃদ্ধ; কারণ এতে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিহিত। কুরআন থেকে বরকত লাভের উপায় হলো যথাযথভাবে এর তিলাওয়াত করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এতে যা বলা হয়েছে তার উপর আমল করা প্রয়োজন।
(২).রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বরকতময় – আল্লাহ তাঁর মাঝে বরকত রেখেছেন। এই বরকত দুই প্রকার:
ক. আধ্যাত্মিক বরকত (معنوية): তাঁর বার্তার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতে যে বরকত এসেছে,তা।কারন আল্লাহ তাঁকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছেন। তিনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে এসেছেন, তাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ হালাল করেছেন, অপবিত্র বস্তুসমূহ হারাম করেছেন, তাঁকে সব নবীর শেষ নবী বানিয়েছেন,এবং তাঁর ধর্ম হল সহজতা এবং সহনশীলতার ধর্ম।
খ. ইন্দ্রিয়গত বরকত (حسّيّة): এটিও দুই প্রকার:
প্রথম প্রকার: তাঁর কর্মে বরকত আল্লাহ তাঁকে যে বিস্ময়কর মুজিজা দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন,সেগুলো তাঁর সত্যতার প্রমাণ বহন করে।
দ্বিতীয় প্রকার: তাঁর সত্তা ও তাঁর দেহগত চিহ্নে বরকত
অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর দেহ ও সত্তায় বরকত দিয়েছেন।
এজন্য সাহাবিগণ তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর সাথে তাবাররুক (বরকত লাভের উদ্দেশ্যে স্পর্শ ইত্যাদি) করতেন এবং মৃত্যুর পরেও তাঁর শরীরের অবশিষ্ট বস্তু দিয়ে তাবাররুক করতেন।”(নূরুসসুন্নাহ ও জুলমাতুল বিদআহ পৃষ্ঠা: ৪৯-৫০)
(২). মুতাহহার (পবিত্র) বর্ণনা:
ক.কুরআন মাজিদকে কুরআনকে (মুতাহহার) পবিত্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:”আল্লাহর কাছ থেকে এক রাসূল, যিনি তেলাওয়াত করেন পবিত্র কিতাবসমূহ”(সূরা বাইয়্যিনাহ: ২) তাফসিরে তাবারীতে এসেছে: يقول : يقرأ صحفاً مطهرة من الباطل ” এখানে বলা হয়েছে,তিনি এমন পবিত্র কিতাব পাঠ করেন, যা মিথ্যা থেকে মুক্ত।”(তাফসিরে তাবারী; খণ্ড: ২৪; পৃষ্ঠা: ৫৪০)
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন: ( مُطَهَّرَة ):منقاة من الشرك ومن رذائل الأخلاق ومن كل ما يسوء ؛ لأنها نزيهة مقدسة.”মুতাহহারা অর্থ:তা শিরক,নিন্দনীয় চরিত্র ও সব অপবিত্রতা থেকে পরিশুদ্ধ। কারণ, এটি সম্মানিত ও পবিত্র।”(তাফসির জুয ‘আম্মা; পৃষ্ঠা: ২৮১)
খ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও মুতাহহার আল্লাহ তাআলা তাঁর অন্তরকে পবিত্র করেছেন।
ইমাম আবুল কাসিম সুহাইলী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: والقول عندي في الرسول عليه السلام : أنه متطهِّر ومُطهَّر ، أما متطهِّر : فلأنه بشرٌ آدميٌّ يغتسل من الجنابة ويتوضأ من الحدث ، وأما مطهَّر : فلأنه قد غُسل باطنُه وشُقَّ عن قلبه ومُلئ حكمة وإيماناً فهو مطهَّر ومتطهِّر”আমার মতে,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হচ্ছেন ‘মুতাত্তাহির’ (যিনি নিজেকে পবিত্র করেন) এবং ‘মুতাহ্হার’ (যাকে আল্লাহ পবিত্র করেছেন)।‘মুতাত্তাহির কারণ,তিনি একজন মানুষ, যিনি জানাবাত অবস্থায় গসল করেন, হাদাস থেকে অজু করেন। ‘মুতাহ্হার’ কারণ, তাঁর অন্তর ধুয়ে ফেলা হয়েছে, চিরে ফেলা হয়েছে এবং তা হিকমাহ ও ঈমানে পূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। অতএব তিনি পবিত্র ও নিজেকে পবিত্রকারী উভয়ই।”(আর রওযুল উনুফ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১১৯)
.
শায়খ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন:
ومع أن رسول الله صلى الله عليه وسلم مطهر مبارك ، منزه عن كل ما يعيبه ويشينه وينقص من قدره وشانه ، حاشاه ، صلى الله عليه وسلم ؛ فإننا لا نرى أن يطلق عليه وصف (المقدس) أو يقرن ذلك باسمه ؛ ولا نعلم أحدا من أهل السلف أو أهل العلم والسنة والاتباع قد فعل ذلك معه صلى الله عليه وسلم ، ولا نعلم أيضا أنه أطلق عليه ذلك في شيء من النصوص الشرعية ، ويخشى أن يفتح ذلك باب الغلو ، والإطراء له بما يخالف هديه ، ويوقع في نهيه صلى الله عليه وسلم في قوله ( لَا تُطْرُونِي كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ ) رواه البخاري ( 3261 ) .
“যদিও আল্লাহর রাসূল ﷺ পূত-পবিত্র, বরকতময়, এবং এমন সব দোষত্রুটি ও নিন্দনীয় বিষয় থেকে মুক্ত, যা তাঁর মর্যাদা ও সন্মান ক্ষুণ্ন করে। মহান আল্লাহ তাঁর মর্যাদাকে সর্বদা পবিত্র রাখুন (ﷺ) তবুও আমরা মনে করি না যে তাঁর জন্য “পবিত্র” (المقدس) উপাধি ব্যবহার করা উচিত বা এ শব্দটি তাঁর নামের সঙ্গে সংযুক্ত করা উচিত।কারন আমরা জানি না যে সালাফ কিংবা আহলে সুন্নাহ ও অনুসরণের পথে চলা কোনো আলেম,কখনো তাঁর জন্য এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন; আবার এটাও জানা নেই যে শরিয়তের কোনো নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে তাঁর জন্য এ উপাধি প্রয়োগ করা হয়েছে। বরং আশঙ্কা করা হয়, এভাবে বললে তাঁর সম্পর্কে বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জনের এমন একটি দরজা খুলে যেতে পারে, যা তাঁর নিজের নির্দেশনা ও আদর্শের পরিপন্থী।যখন তিনি বলেছিলেন: “তোমরা আমার প্রশংসা করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। যেমন খ্রিষ্টানরা ঈসা ইবনে মারইয়াম সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করে থাকে। আমি আল্লাহর বান্দা। তাই আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূলই বলো।”(সহীহ বুখারী, হা/৩৪৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৪; শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৬৮১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হা/৬২৩৯; জামেউস সগীর, হা/১৩৩১৯; মুসনাদে হুমাইদী, হা/৩০; ইসলাম সুওয়াল জাওয়াব, ফাতাওয়া নং-১৭৫৮২৮)
.
বুখারীর হাদিসটির ব্যাখ্যায় শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, আবুল ফাদল আহমাদ বিন আলি ইবনু হাজার আল-আসকালানি, (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম:৭৭৩ হি: মৃত: ৮৫২ হি:] বলেন:وقال ابن التين : معنى قوله ( لاَ تُطْرُونِي ) : لا تمدحوني كمدح النصارى ، حتى غلا بعضهم في عيسى ، فجعله إلهاً مع الله ، وبعضهم ادَّعى أنه هو الله ، وبعضهم ابن الله “ইবনুত তীন বলেন হাদীসে রাসূল (ﷺ)-এর বাণী ‘আমাকে অতিরিক্ত প্রশংসা করো না’ এর অর্থ হলো: তোমরা আমাকে এমনভাবে প্রশংসা করো না যেমন নাসারা (খ্রিস্টানরা) ঈসা (আ.)-এর প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করেছে। তাদের মধ্যে কেউ ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর সাথে শরিক বানিয়েছে, কেউ দাবি করেছে তিনি নিজেই আল্লাহ, আবার কেউ বলেছে তিনি আল্লাহর পুত্র।” (ফাতহুল বারী ফী শারহিল বুখারী,খণ্ড: ১২, পৃষ্ঠা: ১৪৯)
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! উপরের আলোচনার ভিত্তিতে আমাদের বক্তব্য হলো “রাসূলুল মুকাদ্দাস” বা “রাসূলে পাক”, এবং “আল-কুরআনুল মুকাদ্দাস” বা “কুরআনে পাক” এই ধরনের শব্দগুচ্ছ কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ্তে সরাসরি ব্যবহৃত হয়নি। আমাদের পূর্ববর্তী সালাফে সালিহীন অর্থাৎ সাহাবী, তাবেঈ ও তাবেঈ তাবেঈন এমনকি তাদের পরবর্তী বিশিষ্ট আলেমগণও এ ধরনের অভিব্যক্তি ব্যবহার করেননি।অতএব, যেহেতু এ শব্দগুচ্ছ শরীয়তের প্রমাণিত ভাষার অন্তর্ভুক্ত নয়, তাই এগুলো ব্যবহার না করাই উত্তম এবং নিরাপদ। বিশেষত, যখন “রাসূলে পাক” বলা হয়, তখন অনেক সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নাম উল্লেখের পর তার ওপর দুরুদ পাঠ করা থেকে বিরত থাকা হয়। অথচ, উম্মতের ওপর তার একটি হক হলো তার নাম শুনলেই দুরুদ পাঠ করা। এছাড়া বাস্তবে দেখা যায়, “রাসূলে পাক” শব্দগুচ্ছটি আমাদের সমাজে মূলত বিদআতপন্থী বা শিয়া-মুখাপেক্ষী কিছু সুন্নি বক্তাদের মধ্যে বেশি প্রচলিত। সুতরাং এ ধরনের শব্দ পরিহার করে আমরা “রাসূল (ﷺ)” বলব যাতে একদিকে সুন্নাহ অনুসরণ করা হয়, অন্যদিকে দুরুদ পাঠের হকও আদায় হয় এবং আমরা নেকি অর্জন করি। ইনশাআল্লাহ। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।