যুহুদ বা দুনিয়া-বিমুখতা বলতে কী বুঝায়? তালি-দেয়া কাপড় পরা, প্রতিদিন রোজা রাখা, সমাজ থেকে দূরে থাকা ইত্যাদি কী যুহুদ?

প্রশ্নঃ যুহুদ বা দুনিয়া-বিমুখতা বলতে কী বুঝায়? তালি-দেয়া কাপড় পরা, প্রতিদিন রোজা রাখা, সমাজ থেকে দূরে থাকা ইত্যাদি কী যুহুদ?
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
উত্তরঃ ‘যুহুদ’ মানে এই নয় যে- তালি দেয়া কাপড় পরা, মানুষকে এড়িয়ে চলা, সমাজ থেকে দূরে থাকা, প্রতিদিন রোজা রাখা। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হচ্ছেন- যুহুদ অবলম্বনকারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। কিন্তু তিনি নতুন কাপড় পরতেন। কোন প্রতিনিধি দল আসলে সেজন্য পরিপাটি হতেন। জুমার দিন ও ঈদের দিনে নিজেকে পরিপাটি করতেন। মানুষের সাথে মিশতেন। মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করতেন, দ্বীনি বিষয়াদি শিক্ষা দিতেন। তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে প্রতিদিন রোজা রাখা থেকে বারণ করতেন। বরঞ্চ ‘যুহুদ’ মানে হচ্ছে- হারাম থেকে বেঁচে থাকা এবং আল্লাহ যা অপছন্দ করেন সেটা থেকেও বেঁচে থাকা। বিলাসিতা প্রকাশ ও অতিমাত্রায় দুনিয়া উপভোগ থেকে দূরে থাকা। পরকালের জন্য উত্তম সম্বল গ্রহণ করা। যুহুদের সবচেয়ে উত্তম ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনীতে।
আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দিন। আমাদের নবী মুহাম্মদ ও তাঁর পরিবার-পরিজন এবং সাহাবীদের উপর আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক।
ফতোয়া ও গবেষণা বিষয়ক স্থায়ী কমিটি
সদস্য- শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায
সদস্য- শাইখ আব্দুর রাজ্জাক আফিফি
সদস্য- আব্দুল্লাহ গাদয়ান
সদস্য- শাইখ আব্দুল্লাহ বিন কুয়ুদ
ফাতাওয়াল লাজনাদ দায়িমা লিল বুহুছ ওয়াল ইফতা (ফতোয়া ও গবেষণা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়া সমগ্র) ২৪/৩৬৯।
প্রশ্নঃ এক নারী আমাকে চুম্বন করেছে। তাতে সাড়া দিয়ে আমিও তাকে চুম্বন করেছি এবং আমরা একে অপরকে স্পর্শ ও চুম্বন করতে থাকলাম। অনতিবিলম্বে সে আমাকে চূড়ান্ত যৌন কর্মের আবেদন জানাল। কিন্তু আমি আল্লাহর কাছে ব্যভিচারের শাস্তির ভয়ে তা হতে বিরত থেকেছি। আমি যা করেছি সে কর্মের কারণে আমি কি যিনাকারী (ব্যভিচারী) গণ্য হব?
উত্তরঃ
এক:
এই নারীকে চুম্বন ও স্পর্শ করার মাধ্যমে আপনি নিকৃষ্টতম গুনাহর কাজে লিপ্ত হয়েছেন। আপনার অনুতপ্ত হয়ে এ গুনাহ থেকে তওবা করা এবং এর থেকে ফিরে আসার অটল সিদ্ধান্ত নেয়া অনিবার্য। এছাড়া এই ধরনের ফিতনাতে লিপ্ত হওয়ার যাবতীয় উপায় উপকরণ হতে দূরে থাকাও আপনার কর্তব্য। যেমন, বেগানা নারীর সাথে মেলামেশা, নির্জনবাস, হারাম দৃষ্টি ইত্যাদি। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ আপনাকে ব্যভিচারের কবিরা গুনাহ হতে বাঁচিয়েছেন; যে গুনাহকারীর জন্য আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে কঠিন শাস্তি ঘোষণা করেছেন। যদি এই গুনাহকারী বিবাহিত হয় তাহলে তাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা হবে। আর যদি অবিবাহিত হয় তাহলে তাকে ১০০ বেত্রাঘাত করা হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে জানিয়েছেন, যিনাকারীদেরকে কবরে শাস্তি দেয়া হয় এবং তিনি আমাদেরকে আরো জানিয়েছেন সে শাস্তি কতই না মর্মন্তুদ। দেখুন প্রশ্নোত্তর নং (8829)।
আল্লাহর সীমারেখাগুলো লঙ্ঘনে এ মহিলার কত বড় স্পর্ধা!! নিজেই হারামের প্রতি আহ্বান জানায়, অশ্লীলতায় লিপ্ত হয় এবং কোন ভয়ভীতি ছাড়া পাপকাজে মেতে উঠে। অপরদিকে আপনার উপর আল্লাহ তাআলার কত বড় অনুগ্রহ এই চরম মুহূর্তে এসে আপনি নিজেকে সংবরণ করতে পেরেছেন এবং ঈমানের শেষ জ্যোতিটুকু আপনার অন্তরে জ্বলে উঠেছে এবং আপনি এই মহা অন্যায় থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পেরেছেন।
দুই:
যে ব্যভিচারের শাস্তির কথা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি সে ব্যভিচার হচ্ছে একটি যৌনাঙ্গ অপর একটি যৌনাঙ্গের ভিতরে প্রবেশ করানোর মাধ্যমে সংঘটিত ব্যভিচার। এই কর্মের পূর্বে যা কিছু ঘটে থাকে যেমন, স্পর্শকরণ, চুম্বনকরণ, যৌনাঙ্গে অঙ্গুলি প্রবেশ করানো ইত্যাদি অতি গর্হিত ও মারাত্মক গুনাহ। কিন্তু এগুলোর জন্য ব্যভিচারের শাস্তি দেয়া হবে না; বরং শিক্ষামূলক শাস্তি দেয়া হবে। তবে ইসলামি শরিয়তে এ ধরনের গুনাহগুলোকে ব্যভিচার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
যেমনটি এসেছে সহিহ বুখারি (৬২৪৩) ও সহিহ মুসলিম (২৬৫৭) এর হাদিসে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“নিশ্চয় আল্লাহ বনি আদমের উপর যতটুকু যিনা লিখে রেখেছেন সে তা করবেই; এর থেকে কোন নিস্তার নেই। চোখের যিনা হচ্ছে- দেখা; জিহ্বার যিনা হচ্ছে- কথা, অন্তর কামনা করে ও উত্তেজিত হয় এবং যৌনাঙ্গ সেটাকে বাস্তবায়ন করে অথবা বাস্তবায়ন করে না।” সহিহ মুসলিমে আরো এসেছে- “দুই চক্ষুর যিনা হচ্ছে- দেখা, দুই কানের যিনা হচ্ছে- শুনা, জিহ্বার যিনা হচ্ছে- কথা, হাতের যিনা হচ্ছে- ধরা, পায়ের যিনা হচ্ছে- হাঁটা, অন্তর কামনা-বাসনা করে; আর যৌনাঙ্গ সেটাকে বাস্তবায়ন করে অথবা করে না।”
ইবনে বাত্তাল (রহঃ) বলেন:
“দৃষ্টি ও কথাকে যিনা বলা হয়েছে যেহেতু এগুলো প্রকৃত যিনার আহ্বায়ক। এজন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যৌনাঙ্গ সেটাকে বাস্তবায়ন করে অথবা করে না।” ফাতহুল বারি হতে সংকলিত।
সুতরাং আপনি অনতিবিলম্বে তওবা করুন। এই মহিলার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করুন। এই মহিলা আপনাকে ঈমান হারা করতে পারে, আপনার পুতঃপবিত্র চরিত্রে কালিমা লেপন করতে পারে এবং আপনাকে ফাসেক ও পাপাচারীদের কাতারে নিয়ে শামিল করতে পারে। আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। শয়তানের সকল ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে আপনি সাবধান হোন। বেগানা নারীর দিকে চোখ তুলে তাকানোর মাধ্যমে গুনাহর সূচনা হয় এবং ব্যভিচারের মাধ্যমে শেষ হয়।
আল্লাহ আমাদেরকে ও আপনাকে পবিত্র রাখুন।
আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
প্রশ্নঃ যে ব্যক্তি কোন মুসলিমকে “কুত্তা” বলে অথবা “শুয়োর” বলে অথবা এ ধরনের অন্য কোন অশ্লীল শব্দ বলে গালি দিয়েছে তার উপর কী অনিবার্য হবে? সে কি গুনাহগার হবে?
উত্তরঃ
সে ব্যক্তি গুনাহগার হবে। তার উপর শিক্ষামূলক শাস্তি কার্যকর করা হবে এবং তাকে তওবা করতে হবে।
আল্লাহই ভাল জানেন।
ইমাম নববীর ফতোয়া সংকলন, পৃষ্ঠা- ২২৪
প্রশ্নঃ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তরে আমাদের মুসলমান ভাইয়েরা যে নির্যাতন নিষ্পেষণের শিকার হচ্ছে তাদের প্রতি আমাদের কর্তব্য কী?
উত্তরঃ
আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
“মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই”।
আল্লাহ তাদের ব্যাপারে আরো বলেছেন:
“তারা কাফেরদের ব্যাপারে বজ্রকঠোর, পরস্পরের মাঝে অতিশয় দয়ালু”।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“এক মুমিন আরেক মুমিনের নিকট মাথা যেমন দেহের নিকট। ঈমানদারের দুঃখ-কষ্টে মুমিন দুঃখ-কষ্ট অনুভব করে যেভাবে মাথায় ব্যথার কারণে গোটা দেহ ব্যথাতুর হয়ে পড়ে।” [মুসনাদে আহমাদ]
এক মুমিনের প্রতি অপর মুমিনের সমবেদনার প্রকারগুলো ইবনুল কাইয়্যেম খুব সুন্দরভাবে সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন, তিনি বলেন: মুমিনের প্রতি সমবেদনা জানানো কয়েকভাবে হতে পারে। সম্পদ দিয়ে সমবেদনা। প্রভাব প্রতিপত্তির মাধ্যমে সমবেদনা। শারীরিক ও কায়িক শ্রম দিয়ে সমবেদনা। উপদেশ ও সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে সমবেদনা। তাদের জন্য দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করার মাধ্যমে সমবেদনা। তাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করার মাধ্যমে সমবেদনা। ব্যক্তির ঈমানের সবলতা ও দুর্বলতার ভিত্তিতে এ সমবেদনার তারতম্য ঘটে। ব্যক্তির ঈমান সবল হলে সমবেদনা তীব্র হয়। ঈমান দুর্বল হলে সমবেদনাও দুর্বল হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদের প্রতি উল্লেখিত সকল প্রকার সমবেদনার মাধ্যমে সবচেয়ে উত্তম সমব্যথী ছিলেন।[আল-ফাওয়ায়েদ, ১/১৭১]
খলিল ইবনে আহমাদ একবার তাঁর এক বন্ধুর সাথে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ করে তার বন্ধুর জুতাটি ছিড়ে গেল। তখন তাঁর বন্ধু ছেঁড়া জুতাটি হাতে নিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে লাগলেন। তা দেখে খলিলও তাঁর জুতাজোড়া খুলে হাতে নিলেন এবং খালি পায়ে হেঁটে চললেন। তখন তাঁর বন্ধু তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি জুতা খুললে কেন? খলিল বললেন: তুমি খালি পায়ে হাঁটছ তাই তোমার প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।
শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
ইসলামিক প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ।।