মানুষ যদি ভালো-মন্দ কাজ আল্লাহর ইচ্ছায় ও তাকদীরের লিপিবদ্ধ থাকার কারণে করে তাহলে কেন আল্লাহ মন্দ কাজের জন্য শাস্তি দেবেন

প্রশ্ন: দুনিয়ায় মানুষ ভালো-মন্দ যত কাজ করে তা আল্লাহর ইচ্ছায় ও তাকদীরের লিপিবদ্ধ থাকার কারণে করে। তাই মানুষের কি দোষ? কেন আল্লাহ তাকে মন্দ কাজের জন্য শাস্তি দেবেন?
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: তাক্বদীর সম্পর্কে সঠিক বুঝ ও ধারণা না থাকার কারণে অনেক মুসলিম নামধারী মানুষও পথভ্রষ্ট হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে ইসলামে বিভিন্ন দল ও উপদলের। অনেক লোক তাক্বদীর অস্বীকার কারীদের ভ্রান্ত কথায় প্রতারিত হয়েছেন। তাক্বদীর নামক পথটি খুবই সংকীর্ণ, পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত। অনেকেই এ পথে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছে। হ্যাঁ, তাক্বদীর খুবই পিচ্ছিল একটি পথ একথা ঠিক কিন্তু পিচ্ছিল বলে হাঁটা যাবে না বিষয়টা এমন নয়; বরং খুব সতর্কতার সাথে হাঁটতে হবে। তাক্বদীর সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিশুদ্ধ আক্বীদা হলো, মহান আল্লাহ স্বীয় জ্ঞানে স্বাধীনভাবে তাকদ্বীর নির্ধারণ করেছেন, তাক্বদীরের প্রতি বিশ্বাস’ মুমিনের মৌলিক ও অপরিহার্য ছয়টি আক্বীদার অন্তর্ভুক্ত। তাক্বদীর একটি গায়েবী বিষয়, যার রহস্য মহান আল্লাহ ব্যতীত কেউ অবগত নন। তাকদ্বীর তাওহীদে রুবুবিয়্যার অন্তর্ভুক্ত। মহান রব কোন কিছু কাউকে জিজ্ঞেস করে করেন না। যেমন;তিনি আপনার অনুমতি নিয়ে আপনাকে সৃষ্টি করেননি,আবার মৃত্যু দানের সময় আপনাকে জিজ্ঞেস করে দিবেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,‘কোন সম্প্রদায়ের সম্পর্কে যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছা করেন তবে তা রদ করার কেউ নেই এবং তিনি ছাড়া তাদের কোন অভিভাবক নেই।’ (সূরা রা’দ,১৩/১১)
.
তাকদ্বীর সম্পর্কে আলেমগনকে যেসকল প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তা হল:

(১).অনেকে প্রশ্ন করেন, মানুষ ভালো-মন্দ যত কাজ করে তা আল্লাহর ইচ্ছায় ও তাকদীরের লিপিবদ্ধ থাকার কারণে করে। তাই মানুষের কি দোষ? কেন আল্লাহ তাকে মন্দ কাজের জন্য শাস্তি দেবেন?

(২).আবার অনেকের প্রশ্নের ভাষা এ রকম যে; আমি জান্নাতে যাবো, না জাহান্নামে যাবো তাতো অনেক আগেই লেখা হয়েছে। তাই কষ্ট করে নেক আমল করে লাভ কী? তাকদীরে জান্নাত লেখা থাকলে কোনো আমল না করেও জান্নাতে যাওয়া যাবে। আর কপালে জাহান্নাম লেখা থাকলে হাজার ভালো কাজ করেও জান্নাতে যাওয়া যাবে না।

(৩).আবার অনেকে বলেন, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া যখন কিছুই হয় না, তাই আমি যদি কোনো খারাপ কাজ করে থাকি তবে তা আল্লাহর ইচ্ছায় করেছি। আল্লাহ ইচ্ছে করলে আমাকে ফিরিয়ে রাখতে পারতেন। মোটকথা প্রশ্নের ভাষার ধরন যাই হোকনা কেন,সারকথা কথা হলো সব কিছু যখন আল্লাহর ইচ্ছায় হয় তখন মানুষের কী দোষ? এ সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অনেক বিজ্ঞজন হিমশিম খেয়েছেন। এক পর্যায়ে কখনো বা বলতে বাধ্য হয়েছেন, তাকদীর সম্পর্কে বেশি আলোচনা বা প্রশ্ন করা ঠিক নয়। এ ব্যাপারে যুক্তি-তর্ক করতে গিয়ে অনেকে গোমরাহ হয়েছে এবং তৈরি হয়েছে জাবরিয়া, কাদারিয়া, মুতাজিলা, ইত্যাদি বাতিল ফিরকার। তাই পাঠকদের জন্য আমি এ বিষয়টি সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো। যাদের বিবেক বুদ্ধি রয়েছে আশা করি তারা অবশ্যই বুঝতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।
.
প্রথম কথা হল, মানুষ ভালো-মন্দ যত কাজ করে তা আল্লাহর ইচ্ছায় ও তাকদীরে লিপিবদ্ধ থাকার কারণে করে। তাই মানুষের কি দোষ? এ ধরনের প্রশ্ন কোনো মুসলিম করতে পারে কিনা? প্রিয় পাঠক, আল্লাহর কালাম পবিত্র কুরআনুল কারীমের প্রতি দৃষ্টি দিলে যা দেখা যায় তাতে প্রমাণিত হয় যে, এ ধরনের প্রশ্ন কোন মুসলিম নয় বরং কাফির-মুশরিকরা করত। যেমন; মহান আল্লাহ বলেন, “অচিরেই মুশরিকরা বলবে, আল্লাহ যদি চাইতেন, আমরা শির্ক করতাম না এবং আমাদের পিতৃপুরুষরাও না এবং আমরা কোনো কিছু হারাম করতাম না। এভাবেই তাদের পূর্ববর্তীরা মিথ্যারোপ করেছে, যে পর্যন্ত না তারা আমার আযাব আস্বাদন করেছে। বল, তোমাদের কাছে কি কোনো জ্ঞান আছে, যা তোমরা আমাদের জন্য প্রকাশ করবে? তোমরা তো শুধু ধারণার অনুসরণ করছ এবং তোমরা তো কেবল অনুমান করছ।”(সূরা আনআম; ৮/১৪৮)। প্রিয় পাঠক দেখুন! মুশরিকরা তাদের শির্কের ব্যাপারে আল্লাহর ইচ্ছার কথা বলে রেহাই পাবার প্রয়াস পেয়েছে এবং তাদের এ কথা দ্বারা তারা ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করেছে। অতএব, যারা আল্লাহর ইচ্ছার দোহাই দিয়ে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে ও সৎকর্ম থেকে দূরে থাকতে চায় তারা মূলতঃ মুশরিকদের মতোই কাজ করল ও তাদেরকে অনুসরণ করল। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো বলেন,“আর যারা শির্ক করেছে, তারা বলল, যদি আল্লাহ চাইতেন তবে আমরা তাকে ছাড়া কোনো কিছুর ইবাদত করতাম না এবং আমাদের পিতৃপুরুষরাও না। আর তার বিপরীতে আমরা কোনো কিছু হারাম করতাম না। এমনিই করেছে, যারা তাদের পূর্বে ছিল। সুতরাং স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেওয়া ছাড়া রাসূলদের কি কোনো কর্তব্য আছে?”(সূরা আন নাহল,১৬;৩৫)। তিনি অপর আয়াতে আরো বলেন, “আর তারা (মুশরিকরা) বলে,পরম করুণাময় আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমরা এদের ইবাদত করতাম না, এ বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। তারা শুধু মনগড়া কথা বলছে”(সূরা আয-যুখরুফ; ৪৩/২০)
.
উপরে উল্লি­খিত তিনটি আয়াতে কারীমা পাঠ করে কয়েকটি বিষয় স্পষ্টভাবে জানা গেল। যেমন:

(১).মুশরিকরা আল্লাহর ইচ্ছার দোহাই দিয়ে শির্ক করত। তাদের শির্কের প্রমাণ হিসাবে তারা আল্লাহর ইচ্ছাকে পেশ করত।

(২).তারা বিশ্বাস করত সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছায় হয়। এ বিশ্বাস পোষণ করার পরও তারা কাফির ও মুশরিক রয়ে গেছে।

(৩).তারা আল্লাহর গুণাবলীতে বিশ্বাস করত (যেমন, সূরা যুখরুফের আলোচ্য আয়াতে রহমান গুণ) তারপরেও তারা মুশরিক থেকেছে। (৪).তারা তাদের শির্কের সমর্থনে আল্লাহর ইচ্ছাকে প্রমাণ হিসাবে পেশ করে বলেছে যে, তারা এসব আল্লাহর ইচ্ছায়ই করছে। আল্লাহ তাদের মিথ্যাবাদী বলেছেন। কারণ, তারা বলেছে তাদের শির্কি কাজগুলো আল্লাহর ইচ্ছায় করা হচ্ছে।

(৫).তাদের এ সকল বক্তব্য নতুন কিছু নয়। তাদের পূর্বপুরুষরাও এ রকম বক্তব্য দিয়েছে। এরপরও যদি কোনো মুসলিম ব্যক্তি কাফির-মুশরিকদের মত অনুরূপ প্রশ্ন করে তাকে আমরা কয়েকটি উত্তর দিতে পারি। যেমন:
🔹(১). যে ব্যক্তি এ ধরনের প্রশ্ন করবে তাকে বলা হবে, আপনি জান্নাতে যেতে চান না জাহান্নামে? উত্তরে সে হয়তো বলবে, আমি জান্নাতে যেতে চাই। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করুন, আচ্ছা আপনার তাকদীরে কী লেখা আছে জান্নাত না জাহান্নাম, আপনি কি তা জানেন? সে বলবে, না আমি জানি না। আচ্ছা, তাহলে বিষয়টি আপনার কাছে অজ্ঞাত। আর অজ্ঞাত বিষয়ের উপর নির্ভর করে কোনো ভালো কাজ ছেড়ে দেওয়া কি কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে? দুনিয়ার স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় পাশ করবে না ফেল করবে, এটা অজানা থাকার পরও মানুষ দিনরাত অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করে, পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে পাশ করার আশায়। পিপাসা লাগলে পানি না খেয়ে ভরসা করে বসে থাকেনা। অপারেশন সাকসেস হবে কি হবে না, তা অজ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও মানুষ তাদের প্রিয়জনদের অপারেশন করায় রোগমুক্তির আশায়। ফলাফল অজ্ঞাত থাকার অজুহাতে কোনো কাজ ছেড়ে দিয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা সুস্থ মস্তিস্কের কাজ হতে পারে না। অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী জীবনের জন্য তারা ভাগ্যের উপর ভরসা না করে চেষ্টা করে। কিন্তু যত ভরসা কেবল চিরস্থায়ী জীবনের ক্ষেত্রেই করে!আপনার তাকদীরে জান্নাত লেখা আছে না জাহান্নাম তা আপনার জানা নেই। কিন্তু আপনার লক্ষ্য যখন জান্নাত তখন লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য অবশ্যই কাজ করতে হবে। যেমন: দুনিয়াবি-পার্থিব সকল কাজ-কর্ম ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জন করার বেলায় আমরা করে থাকি। আর জান্নাত ও জাহান্নামের স্রষ্টা যখন বলে দিয়েছেন এটা জান্নাতের পথ আর ওটা জাহান্নামের পথ তখন তা বিশ্বাস করে আমল করতে আপনার-আমার অসুবিধা কোথায়?
.
🔹(২). যার তাকদীরে জান্নাত লেখা আছে সাথে সাথে এটাও লেখা আছে যে, সে জান্নাত লাভের জন্য নেক আমল করবে তাই জান্নাতে যাবে। আর যার তাকদীরে জাহান্নাম লেখা আছে সাথে সাথে এটাও লেখা আছে যে, সে জাহান্নামের কাজ করবে ফলে সে জাহান্নামে যাবে। রাসূল (ﷺ) একটি হাদীসের শেষে বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ জান্নাতবাসীদের আমাল করতে থাকে, এমনকি তার ও জান্নাতের মধ্যে মাত্র এক হাত দূরত্ব থাকে, এমন সময় তার প্রতি তাক্বদীরের লিখা তার সামনে আসে। আর তখন সে জাহান্নামীদের কাজ করতে থাকে এবং জাহান্নামে প্রবেশ করে। তোমাদের কোন ব্যক্তি জাহান্নামীদের মত আমাল করতে শুরু করে, এমনকি তার ও জাহান্নামের মধ্যে এক হাত দূরত্ব অবশিষ্ট থাকে। এমন সময় তার প্রতি সে লেখা (তাক্বদীর) সামনে আসে, তখন সে জান্নাতীদের কাজ করতে শুরু করে, ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করে। (সহীহ বুখারী হা/৩২০৮, সহীহ মুসলিম হা/২৬৪৩, মিশকাত হা/৮২)। রাসূল (ﷺ) আরো বলেন, তোমাদের প্রত্যেকের ঠিকানা লেখা হয়ে গিয়েছে, হয় তা জাহান্নামে অথবা জান্নাতে। (একথা শুনে) এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! তবে কি আমরা তাক্বদীরের উপর ভরসা করব না? রাসূল বললেন, না, আমল করতে থাক। প্রত্যেককে তা-ই সহজ করে দেয়া হবে, যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (সূরা লাইল,৯২/৫-৬; সহীহ বুখারী হা/৪৯৪৭)
.
🔹(৩). সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছায় এবং তার জানা অনুসারে হয়। মানুষ সকল কাজই আল্লাহর ইচ্ছায় করে ঠিকই কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক করে না। আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক কাজ করার জন্য সে জান্নাতে যাবে আর আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক কাজ না করার জন্য সে জাহান্নামে যাবে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, ইচ্ছা (ইরাদা বা মাশিয়্যত) ও সন্তুষ্টি (রেযা) এ দুয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি? জবাব; হ্যাঁ অবশ্যই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। অর্থাৎ, আল্লাহর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা সহজে বুঝানো যেতে পারে। যেমন; এক ব্যক্তির ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ল। চিকিৎসক বললেন তার পেটে অপারেশন করতে হবে। অপারেশন ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। এখন বেচারা অপারেশন করাতে রাজী নয়। কারন এ কাজে সে সন্তুষ্ট নয়, কিন্তু রোগ মুক্তির আশায় তবুও সে অপারেশন করিয়ে থাকে। এমন কি এ কাজের জন্য ডাক্তারকে টাকা পয়সা দেয়। অতএব, দেখা গেল এ অপারেশনে তার ইচ্ছা পাওয়া গেল, কিন্তু তার সন্তুষ্টি পাওয়া যায় নি। অপারেশন করাতে সে ইচ্ছুক কিন্তু রাজী নয়। আবার ধরুন,আপনার ইনকাম সীমিত বর্তমানের জিনিসপত্রের যে দাম সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন কিন্তু আপনার ইচ্ছে স্ত্রী সন্তানকে স্বর্ণের গহনা কিনে দিবেন কিন্তু স্বর্ণের ভরি, ৯২ হাজার টাকা শুনে আপনি অসন্তুষ্ট। ডিম কিনার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ডিমের দোকানে গিয়ে ডিমের হালি ৬০ টাকা শুনে আপনি অসন্তুষ্ট। তাহলে প্রমান হলো ইচ্ছা ও সন্তুষ্টি দুটো আলাদা বিষয়। অনেক সময় ইচ্ছা পাওয়া যায়, কিন্তু সেখানে সন্তুষ্টি পাওয়া যায় না। কিন্তু যেখানে সন্তুষ্টি পাওয়া যায় সেখানে ইচ্ছা অবশ্যই থাকে। তাই সকল কাজ মানুষ আল্লাহর ইচ্ছায় করে ঠিকই কিন্তু তার সন্তুষ্টি ও রেজামন্দি বা খুশি অনুযায়ী করে না। বিভ্রান্তি তখনই দেখা দেয় যখন ইচ্ছা দ্বারা সন্তুষ্টি বুঝানো হয়। তাই জান্নাতে যেতে হলে আল্লাহর ইচ্ছায় কাজ করলে হবে না।বরং তাঁর সন্তুষ্টি অনুযায়ী কাজ করতে হবে। যে কাজে তিনি সন্তুষ্ট হন বলে শরীয়তে দলিল প্রমাণ আছে, সে সকল কাজ করতে হবে। প্রশ্ন হতে পারে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি বুঝার উপায় কি? জবাব কোন কোন কাজে মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হন, আর কোন‌ কোন কাজে তিনি অসন্তুষ্ট হন তা বুঝা যাবে একমাত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা। যে কোনো কাজ সংঘটিত হয়ে গেলেই সাধারণ ভাবে বুঝে নেয়া হবে যে, এটা আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় হয়েছে। কিন্তু তা আল্লাহর সন্তুষ্টিতে হয়েছে কিনা তা বুঝা যাবে না কুরআন বা হাদীসের মাধ্যম ব্যতীত। কুরআন বা হাদীসে উক্ত বিষয়টির সমর্থন থাকলে বুঝা যাবে সেটা আল্লাহর সন্তুষ্টিতে সম্পন্ন হয়েছে যেমন,সালাত আদায়,সিয়াম পালন,সুদ বর্জন ইত্যাদি। আর যদি কাজটি কুরআন বা হাদীসের পরিপন্থী যেমন শিরক,বিদআত,কুফুর ও যাবতীয় নিষিদ্ধ কর্ম হয় তাহলে ধরে নেয়া হবে কাজটি আল্লাহর সন্তুষ্টির খেলাফ বা বিরুদ্ধে হয়েছে। তাই আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী কাজ করলে জান্নাতের অধিকারী হওয়া যাবে। আর তার সন্তুষ্টি অনুযায়ী কাজ না করলে জাহান্নামে যেতে হবে। ভালো করে মনে রাখতে হবে সব কাজ আল্লাহর ইচ্ছায় হয় ঠিকই কিন্তু সব কাজ তার সন্তুষ্টি মোতাবেক হয় না। আরো মনে রাখতে হবে, ইচ্ছা ও সন্তুষ্টি এক বিষয় নয়। দুটো আলাদা বিষয়। যা আমি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছি।মহান আল্লাহ বলেন,“তাদের প্রতি আল্লাহ তা’আলা সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এ সন্তুষ্টি তার জন্যই যে ব্যক্তি স্বীয় রবকে ভয় করে।”(সূরা বাইয়িনাহ,৯৮/৮) তিনি অপর আয়াতে বলেন,যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং ঈমান আন তাহলে তোমাদেরকে আযাব দিয়ে আল্লাহ কী করবেন? আর আল্লাহ পুরস্কার দানকারী,মহাজ্ঞানী (সূরা নিসা,৪/১৪৭)
.
🔹(৪). আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর ইচ্ছায় সবকিছু হয়। তাই তিনি ইচ্ছা করেই মানুষকে ইচ্ছা শক্তি দিয়েছেন। যাতে মানুষ নিজ ইচ্ছায় ও স্বাধীনতায় ভালো ও মন্দ পথ অবলম্বন ও বর্জন করতে পারে।যেমন; আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,“বল, সত্য তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে; সুতরাং যার ইচ্ছা বিশ্বাস করুক ও যার ইচ্ছা সত্য প্রত্যাখ্যান করুক।”(সূরা আল কাহাফ; ১৮/২৯)। তাই বলা যায়, আল্লাহর দেওয়া ইচ্ছাশক্তিতেই মানুষ ভালো-মন্দ কাজ করে। তবে আল্লাহ ইচ্ছা করলে মানুষের ইচ্ছাশক্তি রহিত করে ভালো বা মন্দ কাজ করতে বাধ্য করতে পারেন। মানুষ কোনো খারাপ কাজ করলে এ কথা বলা যাবে না যে, এ ক্ষেত্রে মানুষের কোনো ইচ্ছা ছিল না। এ কথাও বলা যাবে না যে, আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজটি হয়েছে। কাজটা আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে এটা যেমন সত্য, তেমনি মানুষের ইচ্ছাও কাজটা করার ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছে, এটাও সত্য। আপনাদের প্রশ্ন হতে পারে এটা কীভাবে এটা সম্ভব? বিষয়টি পরিস্কার ভাবে বুঝার জন্য একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আশা করি বিষয়টা পরিষ্কার হবে ইনশাআল্লাহ। উদাহরণটা হল, আমরা সবাই বাসা বাড়িতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি, বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ ও বিদ্যুৎ গ্রাহকের ভূমিকা। বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে, তেমনি বিদ্যুৎ গ্রাহকও ইচ্ছে করলে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু মাস শেষে দায় বহন করতে হবে বিদ্যুৎ গ্রাহকের। মাস শেষে যখন হাজার টাকার বিদ্যুৎ বিল আসল, তখন বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে এ কথা বলে দোষ দেওয়া চরম বোকামি হবে যে, তারা কেন বিদ্যুৎ সরবরাহ করল, তারা ইচ্ছা করলে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে আমার বিদ্যুৎ খরচ কমাতে পারত। তারা ইচ্ছা করলে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে আপনার খরচ কমাতে পারত এটা যেমন ঠিক, তেমনি আপনিও সাশ্রয়ী হয়ে বিদ্যুৎ খরচ কমাতে পারতেন, এটাও ঠিক। আর খরচের এ দায়ভার বহন করবে গ্রাহক, সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষ নয়। কেননা এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের ইচ্ছা ও কর্ম দুটোই দায়ী। তাই মানুষের ভালো-মন্দ আমলের ব্যাপারেও এটা বলা যায় যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে মানুষ মন্দকাজ করত না। আবার মন্দ কাজ করার জন্য মানুষই দায়ী- তার ইচ্ছা শক্তি প্রয়োগের জন্য।
.
🔹(৫). আল্লাহ নিজের ইচ্ছায় মানুষকে ভালো ও মন্দ কাজ করার ইচ্ছাশক্তি দান করে থাকেন। তিনি তাঁর ইচ্ছায় কাউকে ভালো বা মন্দ কাজ করার জন্য বাধ্য করেন না। যদি তিনি এরূপ করতেন তাহলে দুনিয়ার সকল মানুষ ঈমানদার হয়ে যেতো। যেমন: তিনি বলেন, “আর যদি তোমার রব চাইতেন, তবে যমীনের সকলেই ঈমান আনত। তবে কি তুমি মানুষকে বাধ্য করবে, যাতে তারা মুমিন হয়?”(সূরা ইউনুস; ১০/৯৯)। অপর আয়াতে বলেন,আমি যদি চাইতাম তাহলে পূর্বাহ্নেই প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার হেদায়াত দিয়ে দিতাম। কিন্তু আমার সে কথা পূর্ণ হয়ে গেছে, যা আমি বলেছি যে, আমি জাহান্নাম জিন ও মানুষ দিয়ে ভরে দেবো’’।(সূরা সাজদা,৩২/১৩)সারকথা, নিজেদের খারাপ কাজগুলো আল্লাহর ইচ্ছায় ও তাকদীরের লেখার কারণে হয়েছে এ ধরনের কথা বলে খারাপ কর্মের শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। তাকদীরের দোহাই দিয়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তি বা জান্নাত লাভ কোনটাই করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে ছোট একটা ঘটনা উল্লে­খ না করে পারছি না। আর তা হল; উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহ আনহুর খেলাফত কালে এক লোক চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত হলো ও আদালতে তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত হলো। শাস্তি হিসেবে তার হাত কাটার নির্দেশ দেওয়া হল। লোকটি উমর রা. এর কাছে গিয়ে বলল, মুসলিম জাহানের হে মহান খলীফা! আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছু হয় না। আমিও তো আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে নই। আমি তো তার ইচ্ছায়ই চুরি করেছি। আমার হাত কাটা যাবে কেন? উমার রাদিয়াল্লাহ আনহু বললেন, সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছায় বা তাকদীরের কারণে হয়। তুমি যেমন আল্লাহর ইচ্ছায় চুরি করেছ, তেমনি তোমার হাত আল্লাহর ইচ্ছায়ই কাটা হবে। উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কথা ও কাজের মধ্যে সাহাবীদের গভীর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। সূরা আনআমে আল্লাহ তা‘আলা এ কথাই ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন,‘‘এ ধরনের উদ্ভট কথা তৈরী করে এদের পূর্ববর্তী লোকেরাও সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।’’ এতে জানা গেল তাদের উদ্দেশ্য ছিল সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা। এমনটি নয় যে, তারা তাকদীরের প্রতি ঈমান রাখতো। তাদের এ কথা ও কাজ পূর্বযুগের কাফেরদের কথা ও কাজের মতই। (সূরা আনআম; ৮/১৪৮)। সুতরাং, চোরের হাত কাটাও তাকদীরে নির্ধারিত রয়েছে। চোর যদি বলে চুরি করা নির্ধারিত রয়েছে। হাত কাটার কথা তাকদীরে নেই, তাহলে তাকে বলা হবে, তুমি কিভাবে জানলে উহা তাকদীরে নেই? তুমি কি গায়েব সম্পর্কে অবগত আছো? সুতরাং চুরি করার কারণে যেহেতু চোরের হাত কাটা হয়, তাই বুঝা গেলো ইহাও তাকদীরে নির্ধারিত। কেননা আল্লাহর রাজত্বে আল্লাহর তাকদীর ও ইচ্ছা ব্যতীত কোনো কিছুই সংঘটিত হয় না। আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কোনো কিছু হয় বলে বিশ্বাস করা কুফুরী। (বেশ কিছু নোট ইসলাম হাউজ.কম থেকে সংকলিত)।
.
পরিশেষে উপরোক্ত চুরির ঘটনার আলোকে, বিচার দিবসে জাহান্নামী ফয়সালা হওয়ার পর যদি কোনো মানুষ মহান আল্লাহ তা’আলাকে বলে যে, ‘হে আল্লাহ! আমি বিশ্বাস করতাম আপনার ইচ্ছা ছাড়া কিছু হয় না, আপনিও তাই বলেছেন। আমি যে অন্যায় করেছি, জুলুম করেছি তা তো আপনার ইচ্ছায়ই করেছি। কাজেই আজ আপনি এ কাজের অপরাধে আমাকে জাহান্নামে পাঠাবেন কেন?’ তখন মহান আল্লাহ আহকামুল হাকেমীন যদি বলেন, ঠিক আছে। তোমার কথাই ঠিক। আমার ইচ্ছায় যখন পাপাচারে লিপ্ত হয়েছো, আমার নাফরমানী করেছ, এখন আমার ইচ্ছায়ই তোমাকে জাহান্নামে যেতে হবে। তুমি তো জানো আমার ইচ্ছার সামনে তোমার কিছুই করার নেই। আমার ইচ্ছায় যখন পাপাচার করতে তোমার আপত্তি ছিল না তাহলে এখন জাহান্নামে যেতে আপত্তি কেন? তখন সে মানুষটির কিছু বলার থাকবে কি? প্রশ্ন রইলো প্রত্যেক বিবেকবান পাঠকের কাছে! হে পাঠক, বিচারের দিন মানুষ আল্লাহর দুটি অবস্থা দেখবে হয় আল্লাহর দয়া দেখবে অথবা আল্লাহর ন্যায়বিচার দেখবে। কিন্তু কখনোই আল্লাহর জুলুম দেখবে না। কারন তিনি নিজের এবং বান্দার উপর জুলুম হারাম ঘোষণা করেছেন (সহীহ মুসলিম হা/২৫২৭ মিশকাত হা/২৩২৬) আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক অর্থে তাকদির বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।