বিদ’আত সম্পর্কে বিস্তারিত

বিদআতের সংজ্ঞাঃ যে সব ধরনের কাজ বা অনুষ্ঠান ইবাদত বা সওয়াবের কাজ বলে কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা স্বীকৃত নয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে যা কখনো করেননি বা কাউকে কখনো করতে বলেননি, তাঁর সাহাবাদের সময়ও তা ইবাদত হিসেবে প্রচলিত ছিলনা এমন সব কাজ বা অনুষ্ঠানাদি সওয়াবের উদ্দ্যেশে পালন করার নামই বিদ’আত। বিদ’আত বলতে বুঝায় দ্বীন পরিপূর্ণ হওয়া সত্বেও দ্বীনের মধ্যে পরিবর্তন আনা।

যেমন উদাহরণস্বরূপঃ খাওয়ার সময় বলতে হয় “বিসমিল্লাহ’ কিন্তু আমরা যদি ভাল মনে করে আর একটু বাড়িয়ে বলি ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ তাহলেই সেটা হবে বিদআত। আবার যেমন, প্রত্যেক ফরয সলাতের পর ৩৩বার করে ‘সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবর’ পড়তে হয় কিন্তু আমি ভাল মনে করে ৩৩বারের জায়গায় যদি ৪০বার করে নিয়মিত পড়ার প্রচলন করি তাহলেই সেটা হবে বিদ’আত। অনেকেই বলেন কাজটা তো ভাল, করলে ক্ষতি কী? আমরা জানি মাগরিবের ফরয সালাত তিন রাক’আত, আমি যদি ভাল মনে কৱে তিন রাক’আতের জায়গায় ছয় রাকআত পরি তাহলেই সেটা কী হবে? কাজটা তো ভাল! আর এভাবে যদি ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে ভাল মনে করে যে যার মত পরিবর্তন আনতে থাকে তাহলে আল্লাহ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর মাধ্যমে আমাদের জন্য যে ইসলাম পাঠিয়েছেন একসময় এর অরিজিনাল অস্তিত্ব আর থাকবে না। যেভাবে খৃষ্টান ধর্ম পরিবর্তন হয়ে গেছে। ইসা (আ.)-এর মৃত্যুর পর অতি উৎসাহিরা তাদের ধর্মে ভাল মনে করে এটাসেটা ঢুকাতে ঢুকাতে প্রকৃত ধর্মই পরিবর্তন করে ফেলেছে। তাই ইসলামের ক্ষেত্রে আল্লাহ নিজে সূরা মায়িদার ৩ নং আয়াতের মাধ্যমে দ্বীন ইসলামে যে কোন ধরনের পরিবর্তনকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। অর্থাৎ দ্বীন ইসলামে কোন প্রকার পরিবর্তন চলবে না, দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণ, কিয়ামত পর্যন্ত আর কিছু নতুন করে সংযোজন করতে হবে না।

বিদআতের ব্যাপারে কুরআনের দলিলঃ
لاتخشوهم واخشون اليوم أملك اليوم يس البنين فروا من رینگ
الگ پینگم وأتممت علیکم نعمتي ورضيت لكم الإسلام بيئا
“আজ তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে আমি সম্পূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতকে সম্যকভাবে সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্যে ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম (মনোনীত করলাম)।” (সূরা মায়িদাঃ ৩)
এ আয়াত থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, দ্বীন-ইসলাম পরিপূর্ণ। তাতে নেই কোন কিছুর অভাব । অতএব তা মানুষের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত সকল দ্বীনি প্রয়োজন পূরণে পূর্ণমাত্রায় সক্ষম। এই দ্বীনে বিশ্বাসীদের দিক নির্দেশনা বা গাইডেন্সের জন্য এই দ্বীন ছাড়া অন্য কোন দিকে তাকাবার প্রয়োজন অতীতেও হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। এতে মানুষের সব মৌলিক প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা যেমন রয়েছে তেমনি এতে নেই কোন অপ্রয়োজনীয় বা বাহুল্য জিনিস। ফলে দ্বীন থেকে যেমন কোন কিছু বাদ দেয়া যাবেনা, তেমনি এর সাথে কোন কিছু যোগ করাও যাবে না। এ দুটোই দ্বীনের পরিপূর্ণতার বিপরীত এবং সূরা মায়িদার ৩ নম্বর আয়াতে দেয়া আল্লাহর ঘোষণার পরিপন্থী। ইসলামী ইবাদতের ক্ষেত্রে সওয়াবের কাজ বলে এমন সব অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করা যা নৰী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামের যামানায় চালু হয়নি, তা যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন তা হবে স্পষ্ট বিদআত ।
দ্বীন তো আল্লাহর দেয়া এবং রাসূলের উপস্থাপিত জিনিস। তাতে যখন কেউ নতুন কিছু যুক্ত করে, তখন তার অর্থ এই হয় যে, আল্লাহ বা রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেন বুঝতেই পারেননি যে দ্বীনে অসংগতি, অস্পষ্টতা, ত্রুটি বা অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে (নাউজুবিল্লাহ)। তাই তথাকথিত নব্য জ্ঞানীরা নিজেদের ইচ্ছামত সব নতুন জিনিসপ্রথা এর মাঝে যুক্ত করে দ্বীনের ত্রুটি দূর করছেন বা এর অসম্পূর্ণতাকে সম্পূর্ণ করছেন। ভেবে দেখি, এটা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি কতবড় যুলম অথচ দয়াময় আল্লাহ আমাদেরকে একটি সম্পূর্ণ জীবনবিধান (complete code of conduct for life) উপহার দিয়েছেন এবং রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের কাছে তা পূর্ণভাবে উপস্থাপন করেছেন।

বিদ’আত কিভাবে চালু হয়ঃ
মুসলিম সমাজে বিদ’আত উদ্ভুত ও চালু হওয়ার মুলে চারটি কারণ লক্ষ্য করা যায়।

প্রথমটি হলঃ কোন ব্যক্তি নিজের থেকে বিদ’আত উদ্ভাবন করে সমাজে তা চালু করে দেয়। পরে এটা সাধারণভাবে সমাজে প্রচলিত হয়ে পড়ে।

দ্বিতীয়টি হলঃ কোন আলেম ব্যক্তি হয়ত শরীয়তের বিরোধী একটা কাজ করেছেন, করেছেন তা শরীয়তের বিরোধী জানা সত্ত্বেও, কিন্তু তা দেখে অস্ত্রঃ লোকেরা মনে করতে শুরু করে যে, হুজুর যেহেতু করেছেন, সেহেতু এ কাজ শরীয়তসম্মত না হয়ে পারে না। এভাবে এক ব্যক্তির কারণে গোটা সমাজেই বিদ’আতের প্রচলন হয়ে পড়ে।

তৃতীয়টি হলঃ সাধারণ মুসলিম অজ্ঞ লোকেরা যখন শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ করতে শুরু করে। তখন সমাজের আলেমগণ সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব হয়ে থাকেন, তার প্রতিবাদ করেন না, সে কাজ করতে নিষেধও করেন না– বলেন না যে, এ কাজ শরীয়তের বিরোধী, তোমরা এ কাজ কিছুতেই করতে পারবে না। ফলে সাধারণ লোকদের মনে ধারণা জন্মে যে, এ কাজ নিশ্চিয়ই নাজায়িয হবে না, বিদ’আত হবে না। হলে কি আর আলেম সাহেবরা তার প্রতিবাদ করতেন না? এভাবে সমাজে সম্পূর্ণ বিদ’আত বা নাজায়িয কাজ শরীয়তসম্মত’ কাজরূপে পরিচিত ও প্রচলিত হয়ে পড়ে ।

চতুর্থটি হলঃ কোন কাজ হয়ত মূলতঃই ভাল, শরীয়তসম্মত কিংবা সুন্নাত অনুরূপ । কিন্তু বহুকাল পর্যন্ত তা সমাজের লোকদের সামনে বলা হয়নি, প্রচার করা হয়নি। তখন সে সম্পর্কে সাধারণের ধারণা হয় যে, এ কাজ নিশ্চয়ই ভালো নয়, ভাল হলে আলেম সাহেবরা কি এতদিন তা বলতেন না! এভাবে একটি শরীয়তসম্মত কাজকে শেষ পর্যন্ত শরীয়ত বিরোধী বলে লোকেরা মনে করতে থাকে আর এ-ও একটি বড় বিদআত।

বিদ’আত প্রচলিত হওয়ার মনস্তাত্ত্বিক কারণঃ
বিদ’আত প্রচলিত হওয়ার মনস্তাত্ত্বিক কারণও রয়েছে। আর তা হল এই যে, মানুষ স্বভাবতই চিরন্তন শান্তি ও সুখ (জান্নাত) লাভ করার আকাংখী । আর এ কারণে সে বেশী বেশী নেক কাজ করতে সচেষ্ট হয়ে থাকে। দ্বীনের হুকুম আহকাম যথাযথ পালন করা আপাতদৃষ্টিতে কারো কাছে কঠিন বোধ হলেও সহজসাধ্য সওয়াবের কাজ করার জন্য লালায়িত হয় খুব বেশী । আর তখনই সে শয়তানের ষড়যন্ত্রে পড়ে যায় । এই লোভ ও শয়তানী ষড়যন্ত্রের কারণে খুব তাড়াহুড়া করে কিছু সহজ সওয়াবের কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয় । নিজ থেকেই ধরে নেয় যে, এগুলো সব নেক কাজ, সওয়াবের কাজ। তা করলে এত বেশী সওয়াব পাওয়া যাবে যে, জান্নাতের চিরস্থায়ী সুখ-শান্তি লাভ করা কিছুমাত্র কঠিন হবে না । কিন্তু এ সময়ে যে কাজগুলোকে সওয়াবের কাজ বলে মনে করে নেয়া হয়, সেগুলো শরীয়ত অনুযায়ী কি না ও বাস্তবিকই সওয়াবের কাজ কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবার মত ইসলামী জ্ঞান বা যোগ্যতাও যেমন থাকে না, তেমনি সে দিকে বিশেষ উৎসাহও দেখানো হয় না। কেননা তাতে করে চিরন্তন সুখ লাভের সুখ-স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। আর তাতেই তাদের ভয় । আর এভাবেই সমাজে বিদ’আত প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিদ’আত সমর্থনে পীর-ওলীর দোহাইঃ
বিদআতপন্থীরা সাধারণত নিজেদের উদ্ভাবিত বিদআতের সমর্থনে সূফীয়ে। কিরাম ও মাশায়েখে তরীকতের দোহাই দিয়ে থাকে। তারা বড় বড় ও সুস্পষ্ট বিদআতী কাজকেও বিদ’আত নয় — বড় সওয়াবের কাজ বলে চালিয়ে দেয়। আর বলে । অমুক ওলী-আল্লাহ, অমুক পীর কিবলা নিজে এ কাজ করেছেন এবং করতে বলেছেন। আর তার মত ওলী আল্লাহই যখন এ কাজ করেছেন, করতে বলে গেছেন, তখন তা বিদ’আত হতে পারে না, তা অবশ্যই বড় সওয়াবের কাজ হবে। তা না হলে কি আর তিনি তা করতেন? বিদ’আতের সমর্থনে এরূপ পীরের দোহাই দেয়ার ফলে সমাজে দু’ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। একটি প্রতিক্রিয়া এই যে, কোনটি সুন্নাত আর কোনটি বিদ’আত, কোনটি জায়িয আর কোনটি নাজায়িয তা নির্দিষ্টভাবে ও নিঃসন্দেহে জানবার জন্যে কুরআন, হাদীস, সাহাবাদের আমল ও জীবন-চরিত ইত্যাদি কিছুই খুঁজে দেখা হয় না। কেবল দেখা হয় অমুক হুযুর কিবলা এ কাজ করেছেন কিনা, তিনিই যদি করে থাকেন তাহলে তা করতে আর কোন দ্বিধাবোধ করা হয় না। সেক্ষেত্রে এতটুকুও চিন্তা করা হয় না যে, যার বা যাদের দোহাই দেয়া হচ্ছে সে বা তারা কুরআন-হাদীস অনুযায়ী কাজ করেছে কিনা তারা শরীয়তের ভিত্তিতে এ কাজ করেছে না নিজেদের ইচ্ছামত করেছে। এর দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া এই দেখা দিয়েছে যে, জনসাধারণ মনে করতে শুরু করেছে, শরীয়ত ও মারেফাত (বা তরীকত) দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। শরীয়তে যা নাজায়িয, মারিফাতের দৃষ্টিতে তাই জায়িয । কেননা একদিকে শরীয়তের দলিল দিয়ে বলা হচ্ছে ? এটা বিদ’আত কিন্তু পীরের দোহাই দিয়ে সেটিকেই জায়িয করে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে শরীয়ত আর মারিফাতের দুই পরস্পর বিরোধী হওয়ার ধারণা প্রকট হয়ে উঠে । এরূপ ধারণা দ্বীন-ইসলামের। পক্ষে যে কতখানি মারাত্মক, তা বলে শেষ করা কঠিন। শরীয়তের বিপরীত কোন কিছু কোন অবস্থাতেই বা কোন অজুহাতেই গ্রহণযোগ্য নয়।

বিদআতের তিনটি মৌলিক নীতিমালা রয়েছেঃ

১. এমন আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সওয়াবের আশা করা যা শরীয়ত সিদ্ধ নয়। কেননা শরীয়তের স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হল- এমন আমল দ্বারা আল্লাহর নিকট সওয়াবের আশা করতে হবে যা কুরআনে আল্লাহ নিজে কিংবা সহীহ হাদীসে তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুমোদন করেছেন। তাহলেই কাজটি ইবাদত বলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে আমল অনুমোদন করেননি সে আমলের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা হবে বিদ’আত।

২. দ্বীনের অনুমোদিত ব্যবস্থা ও পদ্ধতির বাইরে অন্য ব্যবস্থার অনুসরণ ও স্বীকৃতি প্রদান। ইসলামে একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, শরীয়তের বেঁধে দেয়া পদ্ধতি ও বিধানের মধ্যে থাকা ওয়াজিব। যে ব্যক্তি ইসলামী শরীয়ত ব্যতীত অন্য বিধান ও পদ্ধতি অনুসরণ করল ও তার প্রতি আনুগত্যের স্বীকৃতি প্রদান করল সে বিদআতে লিপ্ত হল।

৩. যে সকল কর্মকান্ড সরাসরি বিদ’আত না হলেও বিদ’আতের দিকে পরিচালিত করে এবং পরিশেষে মানুষকে বিদ’আতে লিপ্ত করে, সেগুলোর হুকুম বিদ’আতেরই অনুরূপ ।
জেনে রাখা ভাল যে, সুন্নাত’-এর অর্থ বুঝতে ভুল হলে বিদআত চিহ্নিত করতেও ভুল হবে। এদিকে ইঙ্গিত করে ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সুন্নাতকে বিদ’আত থেকে পৃথক করা; কেননা সুন্নাত হচ্ছে ঐ বিষয় যা শরীয়ত প্রণেতা যার নির্দেশ প্রদান করেছেন। আর বিদআত হচ্ছে ঐ বিষয় যা শরীয়ত প্রণেতা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত বলে অনুমোদন করেননি। এ বিষয়ে মানুষ মৌলিক ও অমৌলিক অনেক ক্ষেত্রে প্রচুর বিভ্রান্তির বেড়াজালে নিমজ্জিত হয়েছে। কেননা, প্রত্যেক দলই ধারণা করে যে, তাদের অনুসৃত পন্থাই হল সুন্নাত এবং তাদের বিরোধীদের পথ হল বিদ’আত।” বিদ’আতের উপরোল্লিখিত তিনটি প্রধান মৌলিক নীতিমালার আলোকে বিদ’আতকে চিহ্নিত করার জন্য আরো বেশ কিছু সাধারণ নীতিমালা শরীয়ত বিশেষজ্ঞ আলেমগণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা দ্বারা একজন সাধারণ মানুষ সহজেই কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসের ভিত্তিতে বিদ’আতের পরিচয় লাভ করতে পারে ও সমাজে প্রচলিত বিদ’আতসমূহকে চিহ্নিত করতে পারে। কেননা প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব হল শরীয়তের দৃষ্টিতে যা বিদ’আত তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জেনে নেয়া ও তা থেকে পুরোপুরি বেঁচে থাকা। নীচে উদাহরণ স্বরূপ কিছু দৃষ্টান্তসহ অতীব গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় নীতিমালা উল্লেখ করা হল।

প্রথম নীতিঃ অত্যধিক দুর্বল, মিথ্যা ও জাল হাদীসের ভিত্তিতে যে সকল ইবাদত করা হয়, তা শরীয়তে বিদ’আত বলে বিবেচিত। এটি বিদ’আত চিহ্নিত করার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নীতি। কেননা ইবাদত হচ্ছে পুরোপুরি অহী নির্ভর । শরীয়তের কোন বিধান কিংবা কোন ইবাদত শরীয়তের গ্রহণযোগ্য সহীহ দলিল ছাড়া সাব্যস্ত হয় না। জাল বা মিথ্যা হাদীস মূলতঃ হাদীস নয় । অতএব এ ধরনের হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত হওয়া কোন বিধান বা ইবাদত শরীয়তের অংশ হওয়া সম্ভব নয় বিধায় সে অনুযায়ী আমল বিদ’আত হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে থাকে। অত্যধিক দুর্বল হাদীসের ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের মত হল এর দ্বারাও শরীয়তের কোন বিধান সাব্যস্ত হবে না।

উদাহরণঃ রজব মাসের প্রথম জুমুআর রাতে অথবা ২৭শে রজব যে বিশেষ শবে মি’রাজের সলাত আদায় করা হয় তা বিদ’আত হিসেবে গণ্য। অনুরূপভাবে শবেবরাতের রাতে যে ১০০ রাকাত সালাত বিশেষ পদ্ধতিতে আদায় করা হয় যাকে সালাতুর রাগায়েব বলেও অভিহিত করা হয়, তাও বিদ’আত হিসেবে গণ্য। কেননা এর ফযীলত সম্পর্কিত হাদীসটি জাল ।

দ্বিতীয় নীতিঃ যে সকল ইবাদত শুধুমাত্র মনগড়া মতামত ও খেয়াল-খুশীর উপর ভিত্তি করে প্রণীত হয় সে সকল ইবাদত বিদ’আত হিসেবে গণ্য । যেমন কোন এক আলেম বা আবেদ ব্যক্তির কথা কিংবা কোন দেশের প্রথা অথবা স্বপ্ন কিংবা কাহিনী যদি হয় কোন আমল বা ইবাদতের দলিল তাহলে তা হবে বিদ’আত। দ্বীনের প্রকৃত নীতি হল- আল কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমেই শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের কাছে সুজান আসে। সুতরাং শরীয়তের হালাল-হারাম এবং ইবাদত ও আমল নির্ধারিত হবে এ দু’টি দলিলের ভিত্তিতে। এ দু’টি দলিল ছাড়া অন্য পন্থায় স্থিরীকৃত ‘আমল ও ইবাদত তাই বিদআত বলে গণ্য হবে। এ জন্যই বিদ’আতপন্থীগণ তাদের বিদ’আতগুলোর ক্ষেত্রে শরয়ী দলীলের অপব্যাখ্যা করে সংশয় সৃষ্টি করে। এ প্রসঙ্গে ইমাম শাতেবী রহ. বলেন “সুন্নাতী তরীকার মধ্যে আছে এবং সুন্নাতের অনুসারী বলে দাবীদার যে সকল ব্যক্তি সুন্নাতের বাইরে অবস্থান করছে, তারা নিজ নিজ মাসআলাগুলোতে সুন্নাহ দ্বারা দলিল পেশের ভান করেন।”

উদাহরণঃ কাশফ, অন্তর্দৃষ্টি তথা মুরাকাবা-মুশাহাবা, স্বপ্ন ও কারামতের উপর ভিত্তি করে শরীয়াতের হালাল-হারাম নির্ধারণ করা কিংবা কোন বিশেষ আমল বা ইবাদতের প্রচলন করা । শুধুমাত্র আল্লাহ কিংবা হু-হু অথবা ইল্লাল্লাহ” এর যিকর উপরোক্ত নীতির আলোকে ইবাদত বলে গণ্য হবে না।

তৃতীয় নীতিঃ কোন বাধা-বিপত্তির কারণে নয় বরং এমনিতেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সকল আমল ও ইবাদত থেকে বিরত থেকেছিলেন, পরবর্তীতে তার উম্মতের কেউ যদি সে আমল করে, তবে তা শরীয়তে বিদ’আত হিসেবে গণ্য হবে। কেননা তা যদি শরীয়তসম্মত হত তাহলে তা করার প্রয়োজন বিদ্যমান ছিল। অথচ কোন বাধাবিপত্তি ছাড়াই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে আমল বা ইবাদত ত্যাগ করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আমলটি শরীয়তসম্মত নয় । অতএব সে “আমল করা যেহেতু আর কারো জন্য জায়িয নেই, তাই তা করা হবে বিদ’আত।

উদাহরণঃ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ও জুমা ছাড়া অন্যান্য সালাতের জন্য অথবা অন্য কোন বিষয়ে ‘আযান দেয়া উপরোক্ত নীতির আলোকে বিদ’আত বলে গণ্য হবে। যেমন, বিপদ-আপদ ও ঝড়-তুফান আসলে ঘরে আযান দেয়াও উপরোক্ত নীতির আলোকে বিদ’আত বলে গণ্য হবে। কেননা বিপদ-আপদে কী পাঠ করা উচিত বা কী আমল করা উচিত তা হাদীসে সুন্দরভাবে বর্ণিত আছে।

চতুর্থ নীতিঃ সালাফে সালেহীন তথা সাহাবায়ে কেরাম, ও তাবেয়ীন যদি কোন বাধা না থাকা সত্ত্বেও কোন ইবাদতের কাজ করা কিংবা বর্ণনা করা অথবা লিপিবদ্ধ করা থেকে বিরত থেকে থাকেন, তাহলে এমন পরিস্থিতিতে তাদের বিরত থাকার কারণে প্রমাণিত হয় যে, কাজটি তাদের দৃষ্টিতে শরীয়তসিদ্ধ নয় । কারণ তা যদি শরীয়তসিদ্ধ হত তাহলে তাদের জন্য তা করার প্রয়োজন বিদ্যমান ছিল। তা সত্ত্বেও যেহেতু তারা কোন বাঁধাবিপত্তি ছাড়াই উক্ত ‘আমল ত্যাগ করেছেন, তাই পরবর্তী যুগে কেউ এসে সে আমল বা ইবাদত প্রচলিত করলে তা হবে বিদ’আত । হুযাইফা (রা.)বলেন, “যে সকল ইবাদত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবাগণ করেননি তোমরা সে সকল ইবাদত কর না। (সহীহ বুখারী) ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, “আর যে ধরনের ইবাদত পালন থেকে নৰী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরত থেকেছেন অথচ তা যদি শরীয়তসম্মত হত তাহলে তিনি নিজে তা অবশ্যই পালন করতেন, অথবা অনুমতি প্রদান করতেন এবং তাঁর পরে খলিফাগণ ও সাহাবীগণ তা পালন করতেন । অতএব এ কথা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করা ওয়াজিব যে এ কাজটি বিদ’আত ও ভ্রষ্টতা।”

উদাহরণঃ ইসলামের বিশেষ বিশেষ দিবসসমূহ ও ঐতিহাসিক উপলক্ষগুলোকে ঈদ উৎসবের মত উদযাপন করা। কেননা ইসলামী শরীয়াতই ঈদ উৎসব নির্ধারণ ও অনুমোদন করে। শরীয়াতের বাইরে অন্য কোন উপলক্ষকে ঈদ উৎসবে পরিণত করার ইখতিয়ার কোন ব্যক্তি বা দলের নেই। এ ধরনের উপলক্ষের মধ্যে একটি রয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম দিবস (মিলাদুন্নবী) উদযাপন।

পঞ্চম নীতিঃ যে সকল ইবাদত শরীয়াতের মূলনীতিসমূহ এবং মাকাসিদ তথা উদ্দেশ্য ও লক্ষের বিপরীত সে সবই হবে বিদআত ।

উদাহরণঃ ফরয সালাতের আযানের আগে মাইকে দুরূদ পাঠ । কেননা আযানের উদ্দেশ্য লোকদেরকে জামাআতে সালাত আদায়ের প্রতি আহবান করা, মাইকে দুরূদ পাঠের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।

ষষ্ঠ নীতিঃ প্রথা ও মু’আমালাত বিষয়ক কোন কাজের মাধ্যমে যদি শরীয়তের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছাড়াই আল্লাহর কাছে সওয়াব লাভের আশা করা হয় তাহলে তা হবে বিদ’আত।

উদাহরণঃ পশমী কাপড়, চট, ছেড়া ও তালি এবং ময়লাযুক্ত কাপড় কিংবা নির্দিষ্ট রঙের পোষাক পরিধান করাকে ইবাদত ও আল্লাহর প্রিয় পাত্র হওয়ার পন্থা মনে করা। একই ভাবে সার্বক্ষণিক চুপ থাকাকে কিংবা রুটি ও গোশত ভক্ষণ ও পানি পান থেকে বিরত থাকাকে অথবা ছায়াযুক্ত স্থান ত্যাগ করে সূর্যের আলোয় দাঁড়িয়ে কাজ করাকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পন্থা হিসেবে নির্ধারণ করা । উল্লেখিত কাজসমূহ কেউ যদি এমনিতেই করে তবে তা নাজায়িয নয়, কিন্তু এ সকল ‘আদাত কিংবা মোয়ামালাতের কাজগুলোকে যদি কেউ ইবাদতের রূপ প্রদান করে কিংবা সওয়াব লাভের উপায় মনে করে তবে তখনই তা হবে বিদ’আত। কেননা এগুলো ইবাদত ও সওয়াব লাভের পন্থা হওয়ার কোন দলিল শরীয়তে নেই।

সপ্তম নীতিঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সকল কাজ নিষেধ করে দিয়েছেন সেগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সওয়াব লাভের আশা করা হলে সেগুলো হবে বিদ’আত।

উদাহরণঃ গান-বাদ্য ও কাওয়ালী বলা ও শোনা অথবা নাচের মাধ্যমে যিকর করে আল্লাহর কাছে সওয়াবের আশা করা। এবং কাফির, মুশরিক ও বিজাতীয়দের অনুকরণের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সওয়াব লাভের আশা ।

অষ্টম নীতিঃ যে সকল ইবাদত শরীয়তে নির্ধারিত সময়, স্থান ও পদ্ধতির সাথে প্রণয়ন করা হয়েছে সেগুলোকে সে নির্ধারিত সময়, স্থান ও পদ্ধতি থেকে পরিবর্তন করা বিদ’আত বলে গণ্য হবে।

উদাহরণঃ নির্ধারিত সময় পরিবর্তনের উদাহরণ- যেমন যিলহাজ্জ মাসের এক তারিখে কুরবানী করা। কেননা, কুরবানীর শরয়ী সময় হল ১০ যিলহাজ্জ ও তৎপরবর্তী আইয়ামে তাশরীকের দিনগুলো। নির্ধারিত স্থান পরিবর্তনের উদাহরণ- যেমন মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও ইতিকাফ করা । কেননা, শরীয়ত কর্তৃক ই’তিকাফের নির্ধারিত স্থান হচ্ছে মসজিদ।

নবম নীতিঃ আম তথা ব্যাপক অর্থবোধক দলিল দ্বারা শরীয়তে যে সকল ইবাদতকে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে সেগুলোকে কোন নির্দিষ্ট সময় কিংবা নির্দিষ্ট স্থান অথবা অন্য কিছুর সাথে এমনভাবে সীমাবদ্ধ করা বিদআত বলে গণ্য হবে যা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত ইবাদতের এ সীমাবদ্ধ করণ প্রক্রিয়া শরীয়তসম্মত, অথচ পূর্বোক্ত আম দলীলের মধ্যে এ সীমাবদ্ধ করণের উপর কোন প্রমাণ ও দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় না।

উদাহরণঃ যে দিনগুলোতে শরীয়াত রোযা বা সিয়াম রাখার বিষয়টি সাধারণভাবে উন্মুক্ত রেখেছে যেমন মঙ্গল বার, বুধবার কিংবা মাসের ৭, ৮ ও ৯ ইত্যাদি তারিখসমূহ, সে দিনগুলোর কোন এক বা একাধিক দিন বা বারকে বিশেষ ফযীলাত আছে বলে সিয়াম পালনের জন্য যদি কেউ খাস ও সীমাবদ্ধ করে অথচ বাস করার কোন দলিল শরীয়তে নেই, যেমন ফাতিহা-ইইয়াযদাহমের দিন সিয়াম পালন করা, তাহলে শরীয়তের দৃষ্টিতে তা হবে বিদ’আত, কেননা দলিল ছাড়া শরীয়াতের কোন হুকুমকে খাস ও সীমাবদ্ধ করা জায়িয নেই।

দশম নীতিঃ শরীয়াতে যে পরিমাণ অনুমোদন দেয়া হয়েছে ইবাদত করতে গিয়ে সে ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশী আমল করার মাধ্যমে বাড়াবাড়ি করা এবং কঠোরতা আরোপ করা বিদ’আত বলে বিবেচিত।

উদাহরণঃ সারা রাত জেগে নিদ্রা পরিহার করে কিয়ামুল লাইল এর মাধ্যমে এবং ভঙ্গ না করে সারা বছর সিয়াম রাখার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা এবং অনুরূপভাবে স্ত্রী, পরিবার ও সংসার ত্যাগ করে বৈরাগ্যবাদ গ্রহণ করা বা চিল্লায় যাওয়া।

একাদশ নীতিঃ যে সকল আকীদাহ, মতামত ও বক্তব্য আল-কুরআন ও সুন্নাতের বিপরীত কিংবা এ উম্মাতের সালাফে সালেহীনের ইজমা’ বিরোধী সেগুলো শরীয়তের দৃষ্টিতে বিদ’আত। এই নীতির আলোকে নিমোক্ত দু’টি বিষয় শরীয়তের দৃষ্টিতে বিদ’আত ও প্রত্যাখ্যাত বলে গণ্য হবে।

১ম বিষয়ঃ নিজস্ব আকল ও বিবেকপ্রসূত মতামতকে অমোঘ ও নিশ্চিত নীতিরূপে নির্ধারণ করা এবং কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্যকে এ নীতির সাথে মিলিয়ে যদি দেখা যায় যে, সে বক্তব্য উক্ত মতামতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তাহলে তা গ্রহণ করা এবং যদি দেখা যায় যে, কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্য উক্ত মতামত বিরোধী তাহলে সে বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা। অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর উপরে নিজের আকল ও বিবেককে অগ্রাধিকার দেয়া। শরীয়াতের দৃষ্টিতে এ বিষয়টি অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এ ব্যাপারে ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন : “বিবেকের মতামত অথবা কিয়াস দ্বারা আল কুরআনের বিরোধিতা করাকে সালাফে সালেহীনের কেউই বৈধ মনে করতেন না। এ বিদ’আতটি তথনই প্রচলিত হয় যখন জাহমিয়া, মু’তাযিলা ও তাদের অনুরূপ কতিপয় এমন ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে যারা বিবেকপ্রসূত রায়ের উপর ধর্মীয় মূলনীতি নির্ধারণ করেছিলেন এবং সেই রায়ের দিকে কুরআনের বক্তব্যকে পরিচালিত করেছিলেন এবং বলেছিলেন, যখন বিবেক ও শরীয়ার মধ্যে বিরোধিতা দেখা দিবে তখন হয় শরীয়াতের সঠিক মর্ম বোধগম্য নয় বলে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা হবে অথবা বিবেকের রায় অনুযায়ী তা’বীল ও ব্যাখ্যা করা হবে। এরা হল সে সব লোক যারা কোন দলিল ছাড়াই আল্লাহর আয়াতের ব্যাপারে তর্ক করে থাকে।”

২য় বিষয়ঃ কোন জ্ঞান ও ইলম ছাড়াই দ্বীনী বিষয়ে ফাতওয়া দেয়া । ইমাম শাতিৰী রহ. বলেন, “যারা অনিশ্চিত কোন বক্তব্যকে অন্ধভাবে মেনে নেয়ার উপর নির্ভর করে অথবা গ্রহণযোগ্য কোন কারণ ছাড়াই কোন বিষয়কে প্রাধান্য দেয়, তারা প্রকৃত পক্ষে দ্বীনের রজ্জু ছিন্ন করে শরীয়াত বহির্ভূত কাজের সাথে জড়িত থাকে। আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহে এ থেকে আমাদেরকে নিরাপদ রাখুন । ফাতওয়ার এ পদ্ধতি আল্লাহ তা’আলার দ্বীনের মধ্যে নতুন উদ্ভাবিত বিদ’আতেরই অন্তর্ভুক্ত, তেমনিভাবে আকল বা বিবেককে দ্বীনের সর্বক্ষেত্রে Dominator হিসেবে স্থির করা নব উদ্ভাবিত বিদআত ।”

দ্বাদশ নীতিঃ যে সকল আকীদা কুরআন ও সুন্নাহয় আসেনি এবং সাহাবা ও তাবেয়ীনের কাছ থেকেও বর্ণিত হয়নি, সেগুলো বিদআতী আকীদা হিসেবে শরীয়তে গণ্য।

উদাহরণঃ সূফী তরীকাসমূহের সে সব আকীদা ও বিষয়সমূহ যা কুরআন ও সুন্নায় আসেনি এবং সাহাবা ও তাবেয়ীনের কাছ থেকেও বর্ণিত হয়নি। ইমাম শাতিবী রহ. বলেন, “তারমধ্যে রয়েছে এমন সব অলৌকিক বিষয় যা শ্রবণকালে মুরিদদের উপর শিরধার্য্য করে দেয়া হয়। আর মুরিদদের কর্তব্য হল যা থেকে সে বিমুক্ত হয়েছে পুনরায় পীরের পক্ষ থেকে তা করার অনুমতি ও ইঙ্গিত না পেলে তা না করা…..এভাবে আরো অনেক বিষয় যা তারা আবিষ্কার করেছে, সালাফদের প্রথম যুগে যার কোন উদাহরণ খোঁজে পাওয়া যায় না ।

ত্রয়োদশ নীতিঃ দ্বীনি ব্যাপারে অহেতুক তর্ক, ঝগড়া-বিবাদ ও বাড়াবাড়িপূর্ণ প্রশ্ন বিদ’আত হিসেবে গণ্য। এ নীতির মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো শামিলঃ

উদাহরণঃ মুতাশাবিহাত বা মানুষের বোধগম্য নয় এমন বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করা । ইমাম মালেক রহ.-কে এক ব্যক্তি আরশের উপর আল্লাহর উঠার প্রকৃতি-ধরন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন “কিরূপ উঠা তা বোধগম্য নয়, তবে উঠা একটি জানা ও জ্ঞাত বিষয়, এর প্রতি ঈমান রাখা ওয়াজিব এবং প্রশ্ন করা বিদ’আত” । ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ রহ. বলেন, “কেননা এ প্রশ্নটি ছিল এমন বিষয় সম্পর্কে যা মানুষের জ্ঞাত নয় এবং এর জবাব দেয়াও সম্ভব নয়” দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন কিছু নিয়ে গোঁড়ামি করা এবং গোঁড়ামির কারণে মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা বিদ’আত বলে গণ্য। এছাড়া মুসলিমদের কাউকে উপযুক্ত দলিল ছাড়া কাফির ও বিদ’আতী বলে অপবাদ দেয়াও বিদ’আত বলে গণ্য।

চতুর্দশ নীতিঃ দ্বীনের স্থায়ী ও প্রমাণিত অবস্থান ও শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখাকে পরিবর্তন করা বিদআত । উদাহরণঃ চুরি ও ব্যভিচারের শাস্তি পরিবর্তন করে আর্থিক জরিমানা দন্ড প্রদান করা বিদআত।

পঞ্চদশ নীতিঃ অমুসলিমদের সাথে তাদের নিজস্ব যে সকল প্রথা ও ইবাদত রয়েছে মুসলিমদের মধ্যে সেগুলোর অনুসরণ বিদ’আত বলে গণ্য।

উদাহরণঃ কাফিরদের উৎসব ও পর্ব অনুষ্ঠানের অনুকরণে উৎসব ও পর্ব পালন করা । ইমাম যাহাবী রহ. বলেন, “জন্ম উৎসব, নববর্ষ উৎসব পালনের মাধ্যমে অমুসলিমদের অনুকরণ নিকৃষ্ট বিদ’আত”।

বিদ’আতীর পরিণামঃ
মহান আল্লাহ বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে নিষেধ করেন তা। বর্জন কর। (সূরা হাশরঃ ৭)।

বিদ’আত কবীরা গুনাহর চেয়েও মারাত্মকঃ
কারণ যে কবীরা গুনাহ করে সে জানে এটা জঘন্য অপরাধ এবং কোন একদিন সে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে পারে বা তওবা করতে পারে এবং আল্লাহ চাইলে তাকে মাফ করেও দিতে পারেন । কিন্তু বিদ’আতকারী খুব পুণ্যের কাজ মনে করে বেশী বেশী বিদ’আতী কাজ করতে থাকে তাই তার আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া বা তওবা করার কোন সম্ভাবনা থাকে না।

বিদআতে হাসানা এবং বিদআতে “সাইয়ে”বলতে ইসলামে কিছু নেইঃ
হাসানা’ মানে ভাল আর ‘সাইয়ো ‘ মানে মন্দ । বিদ’আত তো বিদ’আতই এর আর ভাল কি আর মন্দ কি? যা কুরআন-সুন্নাহতে নেই তা যতোই ভাল মনে হোক না কেন তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় সোজা কথা। কেউ কেউ বলে থাকেন শবেবরাত, মিলাদ, মিলাদুন্নবী ইত্যাদি বিদআতে হাসানা, অর্থাৎ এই কাজগুলো বিদআত কিন্তু ভাল বিদআত। ইবাদতের ক্ষেত্রে আমাদেরকে সবসময় মূল ফর্মুলার দিকে ফিরে যেতে হবে। কোন কাজ যতই ভাল বা পূণ্যের কাজ বলে মনে হোক না কেন তা যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করে না থাকেন তা সওয়াবের আশায় কোনভাবেই করা যাবে না।
যেমন একজন লোক চোর, এখন যদি বলা হয় সে ভাল চোর! চোর তো চোরই তার আবার ভাল কি আর মন্দ কি? সে খারাপ লোক এটাই তার মূল পরিচয় । তাই বিদআতে হাসানা এবং বিদআতে সাইয়েআ সুস্পষ্ট গুনাহর কাজ এবং ভাল বিদ’আত এই ধরনের মনে করাও আরেকটি বিদ’আত ।
ইমাম মালিক (রহ.) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ইসলামের মাঝে কোন বিদআতের প্রচলন করে, আর তাকে হাসানাহ বা ভাল বলে মনে করে, সে যেন প্রকারান্তরে এ বিশ্বাস পোষণ করে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পয়গাম পৌছাতে খিয়ানত করেছেন। কারণ, আল্লাহ তা’আলা নিজেই বলেনঃ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করে দিলাম। সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর যুগে যা ধর্মরূপে গণ্য ছিল না, আজও তা ধর্ম বলে গণ্য হতে পারে না। (আল-ইতেসামঃ ইমাম শাতেবী)
যে সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে ইসলামে কোন ভাল পদ্ধতি প্রচলন করল, সে তার সওয়াব পাবে এবং সেই পদ্ধতি অনুযায়ী যারা কাজ করবে তাদের সওয়াবও সে পাবে, তাতে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন খারাপ পদ্ধতি প্রবর্তন করবে সে তার পাপ বহন করবে, এবং যারা সেই পদ্ধতি অনুসরণ করবে, তাদের পাপও সে বহন করবে, তাতে তাদের পাপের কোন কমতি হবে না (সহীহ মুসলিম)।

বিদ’আত সম্পর্কে ভুল ধারণার অবসানঃ

প্রথম কথাঃ বিদ’আত বা নব আবিষ্কার সকল ক্ষেত্রে নিন্দিত নয় । শুধু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, ইবাদত-বন্দেগীর মধ্যে যা কিছু নব-আবিষ্কার সেটা হল নিন্দিত ও পরিত্যাজ্য। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই বিদ’আতকে নিষিদ্ধ করেছেন। আর শরীয়তের পরিভাষায় এটাকেই বিদ’আত বলা হয়।

দ্বিতীয় কথাঃ ধর্মীয় ক্ষেত্র ছাড়া মানব কল্যাণের অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নব আবিস্কার গ্রহণযোগ্য। এই নব-আবিষ্কারকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেনি, বরং উৎসাহিত করেছে। যেমনঃ মাইক, টিভি, ফোন, কম্পিউটার, প্লেন ইত্যাদি।

তৃতীয় কথাঃ ধর্মীয় কোন বিধি-বিধান বা আচার-অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে কোন কিছুকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা বা কোন পদ্ধতি অবলম্বন করা বিদআতের মধ্যে গণ্য হবে না। যেমন আযান দেয়ার জন্য মাইকের ব্যবহার, সালাত ও সিয়ামের সময় জানতে ঘড়ি, কম্পাস ও ক্যালেন্ডারের ব্যবহার — ইত্যাদি বিদআতের মধ্যে গণ্য হবে না। কারণ, কেউ এগুলোকে ধর্মের অংশ মনে করে না বা এগুলোর মাধ্যমে ধর্মে কোন নতুন আচার চালু হয়নি। বরং, যা হয়েছে তাহল প্রাচীন আচারের অবকাঠামো ঠিক রেখে তা বাস্তবায়নে আধুনিক পদ্ধতির অবলম্বন যা শরীয়তের পরিভাষায় ভাল ও উপকারী পদ্ধতি বলা যায়। বিদ’আত নয় ।

আধুনিক প্রযুক্তি (টেকনলজী) ব্যবহার বিদ’আত নয়ঃ
কেউ কেউ আমরা মনে করতে পারি যে, টিভি, কম্পিউটার, প্রজেক্টর, ফেইসবুক, স্মার্ট ফোন ইত্যাদিও তো নতুন আবিষ্কার । তাহলেতো এগুলোও বিদ’আত। না, এই ধারণা মোটেও ঠিক নয়। বিদআতের সাথে শুধুমাত্র ইবাদতের সম্পর্ক। বরং মানব কল্যাণে সকল আবিষ্কার ইসলাম স্বাদরে গ্রহণ কার। এই সকল আবিষ্কারের কারণে ইসলামের আরো প্রসার ঘটছে। আজকাল মানুষ টেকনলজি ব্যবহার করে দ্বীনের কাজ করছে, সামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে, অর্থনীতির উন্নয়ন হচ্ছে, মানুষের দুর্ভোগ কমে যাচ্ছে, জীবনযাপন আরো সহজ হয়ে উঠছে । যেমন আগে হাজ্জ করতে যেতে হতো ঘোড়া, উট বা পায়ে হেটে, কিন্তু এখন ব্যবহার হচ্ছে প্লেন । আজকাল ইসলামিক প্রোগ্রামে বা মসজিদে এতো লোক হয় যে সাউন্ড সিস্টেম ছাড়া তো কল্পনাই করা যায় না। তাই এই ধরনের নতুন আবিষ্কার বিদ’আত নয় ।

 

লেখকঃ আসাদ রনি {মোঃ আসাদুজ্জামান}
বইঃ মুসলিমদের একটাই পথ।।