ফরজ সালাতের পর সর্বশ্রেষ্ঠ সালাত তাহাজ্জুদ

প্রশ্ন: ফরজ সালাতের পর সর্বশ্রেষ্ঠ সালাত তাহাজ্জুদ। এ কথা কতটুকু সঠিক? এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: ফরজ সালাতের পর সর্বশ্রেষ্ঠ সালাত তাহাজ্জুদ। আজ আমরা তাহাজ্জুদ সালাতের পরিচয়, আদায়ের সঠিক সময়, সঠিক পদ্ধতি ও রাকআত সংখ্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।

ভূমিকা: রাতের নিঃঝুম পরিবেশে যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে, নিদ্রার আবেশে মানুষ যখন মহান সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালকের কথা বিস্মৃত হয়, সেই সময় আল্লাহর কিছু খাস বান্দা নিদ্রা, আরাম-আয়েশ ও স্ত্রীর শয্যা ত্যাগ করে তাহাজ্জুদ সালাতের মাধ্যমে আল্লাহকে বিশেষভাবে স্মরণ করে। তাহাজ্জুদ’ শব্দটি আরবি মূল ধাতু هُجُوْدٌ (হুজূদুন) এর অর্থ হল: রাত্রিজাগরণ, ঘুম থেকে ওঠা, রাত্রিকালীন ইবাদত ইত্যাদি। সেখান থেকে تَهَجُّدٌ (তাহাজ্জুদুন) পারিভাষিক অর্থে রাত্রিতে ঘুম থেকে জেগে ওঠা বা রাত্রি জেগে ছালাত আদায় করা (আল-মুনজিদ)।
.
পরিভাষায়, তাহাজ্জুদ মূলত ওই নামাজকে বলা হয়, যা রাতের বেলায় ঘুম থেকে ওঠে আদায় করা হয়৷ ফায়দ্বুল বারিতে এসেছে, ‘ঘুম থেকে জাগার পর যদি নামাজ পড়ে, তখন তাকে তাহাজ্জুদ নামে নামকরণ করা হয়৷’[কাশমিরি, ফায়দ্বুল বারি: ২/৪০৭]। ইমাম কুরতুবি (রাহ.)-ও একথা বলেছেন। (তাফসীরে কুরতুবী ১০/৩০৮।) অধিকাংশ আলিমের বক্তব্য এটিই। তাছাড়া দলিলের আলোকে এই মতটিই অগ্রগণ্য। এর বাইরে কোনো কোনো আলিম বলেছেন, মধ্য রাতের পর যে নামাজ পড়া হয়, সেটি তাহাজ্জুদ। আবার কারও মতে, ইশার পরই তাহাজ্জুদ আদায় করা যায়। তবে, অধিকতর সঠিক মত সেটিই, যা আমরা প্রথমে উল্লেখ করেছি। তা হলো, রাতের বেলা ঘুম থেকে ওঠে নামাজ পড়া।
.
◾তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব,ফজিলত মর্যাদা:
____________________________________
রাত্রির সালাত বা ‘সালাতুল লায়েল’ নফল হলেও তা খুবই ফযীলতপূর্ণ। এই নামাযের কথা উল্লেখ করত: মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) কে সম্বোধন করে বলেন-রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ নামায পড়; এ তোমার জন্য একটি অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে মাকামে মাহ্‌মূদে (প্রশংসিত স্থানে) প্রতিষ্ঠিত করবেন। (সূরা ইসারা, ১৭/৭৯)। তাহাজ্জুদ আদায়কারীর মর্যাদা তার চেয়ে বেশি, যে তাহাজ্জুদ আদায় করে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি রাতের বেলা সিজদারত থাকে বা (ইবাদতে) দাঁড়ানো থাকে, আখিরাতের ব্যাপারে শঙ্কিত থাকে এবং নিজ রবের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে, সে কি তার সমান, যে এমনটি করে না?’’ [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৯]।

রাত্রি জাগরণ করে ইবাদত করা রহ্‌মানের বান্দাগণের গুণ। মহান আল্লাহ বলেন, রহমানের বান্দা তারা, যারা ভূপৃষ্ঠে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা প্রশান্তভাবে জবাব দেয়। আর তারা তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দন্ডায়মান থেকে রাত্রি অতিবাহিত করে। (কুরআন মাজীদ ২৫/৬৩-৬৪)।
.
❖ তাহাজ্জুদ নামাজ নফসের প্ররোচনায় গুনাহ সংঘটিত হতে বাধা দানকারী: আল্লাহ বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই রাত্রিজাগরণ প্রবৃত্তি দমনে অত্যন্ত কার্যকর।’’ [সূরা মুযযাম্মিল, আয়াত: ৬]
.
❖ তাহাজ্জুদ জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম উপায়: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘হে লোকসকল! তোমরা সালামের প্রচলন করো, খাদ্য খাওয়াও, আত্মীয়তা রক্ষা করো এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন নামাজ আদায় করো। তাহলে তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’ [তিরমিযি, আস-সুনান: ২৪৮৫; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান: ১৩৩৪; হাদিসটি হাসান সহিহ]।
.
❖ আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য লাভের সুযোগ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা রাতের শেষভাগে বান্দার সবচেয়ে কাছে চলে আসেন। কাজেই যদি পারো, তবে তুমি ওই সময়ে আল্লাহর স্মরণকারীদের মধ্যে শামিল হয়ে যেও। কেননা ওই সময়ের নামাজে ফেরেশতাগণ সূর্যোদয় পর্যন্ত উপস্থিত থাকেন।’’ [নাসাঈ, আস-সুনান: ৫৭২; তিরমিযি, আস-সুনান: ৩৫৭৯]।
.
❖ গুনাহের কাফফারা ও শারীরিক রোগমুক্তির উপায় তাহাজ্জুদের নামাজ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘তোমাদের নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া উচিত। এটি তোমাদের পূর্ববর্তী নেককার লোকদের অভ্যাস। এই নামাজ তোমাদেরকে আল্লাহর নিকটে পৌঁছে দেবে, ভুল-ত্রুটিগুলো মিটিয়ে দেবে, গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখবে এবং শরীর থেকে রোগ দূর করবে।’’ [তিরমিযি, আস-সুনান: ৩৫৪৯; হাদিসটি সহিহ]।
.
❖ ফরজ নামাজের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ এটি: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘ফরজ নামাজের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ হলো, রাতের (তাহাজ্জুদের) নামাজ।’’ [মুসলিম, আস-সহিহ: ১১৬৩, তিরমিযি: ৪৩৮]।
.
❖ রাসূলের চিরাচরিত অভ্যাস: আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, ‘‘কিয়ামুল লাইল (রাতের নামাজ) ত্যাগ করবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা (কখনো) ত্যাগ করতেন না। যখন তিনি অসুস্থ থাকতেন বা ক্লান্তি অনুভব করতেন, তখন বসে আদায় করতেন। [আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৩০৯, আহমাদ, আল-মুসনাদ: ২৪৯১৯; হাদিসটি সহিহ]।

◈ দাউদি নামাজ আল্লাহর কাছে প্রিয়: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট প্রিয়তম নামাজ হলো দাউদ (আ.) এর নামাজ। তিনি অর্ধরাত পর্যন্ত ঘুমোতেন। এরপর রাতের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত নামাজে কাটাতেন। অতঃপর, আবার রাতের এক ষষ্ঠাংশ ঘুমোতেন।’’ [বুখারি, আস-সহিহ: ১০৭৯]।

◈রাসূল (ﷺ) কে জিবরীল আঃ এর নসিহা: মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমার কাছে জিবরীল এসে বললেন, হে মুহাম্মাদ! যত ইচ্ছা বেঁচে থাকুন, আপনি মারা যাবেনই। যাকে ইচ্ছা ভালো বাসুন, আপনি তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন। যা ইচ্ছা তাই আমল করুন, আপনি তার বদলা পাবেন। আর জেনে রাখুন, মুমিনের মর্যাদা হলো তাহাজ্জুদের নামাযে এবং তার ইজ্জত হলো লোকেদের অমুখাপেক্ষী থাকায়।” (ত্বাবরানী, হাকেম, মুস্তাদরাক, বায়হাকী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৮৩১ নং)।

◈ স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে জাগিয়ে রাতের বেলায় ইবাদতের বিরাট ফজিলত: রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “আল্লাহ সেই ব্যক্তির প্রতি দয়া করুন, যে রাতে উঠে ইবাদত করে এবং নিজ স্ত্রীকেও জাগায়। অতঃপর যদি সে (জাগতে) অস্বীকার করে, তাহলে তার মুখে পানির ছিটা দেয়। একইভাবে, আল্লাহ সেই নারীর প্রতি দয়া করুন, যে রাতে উঠে ইবাদত করে এবং নিজ স্বামীকেও জাগায়। অতঃপর যদি সে (জাগতে) অস্বীকার করে, তাহলে সে তার মুখে পানির ছিটা দেয়।” [আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৩০৮; নাসায়ি, আস-সুনান: ১৬১০; হাদিসটির সনদ সহিহ] অন্য হাদিসে এসেছে, ‘‘তাদের (নাম) যিকিরকারী ও যিকিরকারিনীর মধ্যে লিপিবদ্ধ করা হয়।” [আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৩০৯, ইবনু মাজাহ, আস-সুনান:১৩৩৫; হাদিসটির সনদ সহিহ]।

◾তাহাজ্জুদের ব্যাপারে পূর্বসূরি নেককার ব্যক্তিদের চমৎকার কিছু অভিজ্ঞতা ও মন্তব্য:
_________________________________
◈ তাহাজ্জুদ নামাজে চেহারা সুন্দর হয়: ইবনুল কায়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন, ‘কিছু সংখ্যক নারী অধিক পরিমাণে রাতের নামাজ আদায় করতো। তাদেরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা বলে, ‘‘রাতের নামাজ চেহারা সৌন্দর্যময় করে; আমি আমার চেহারাকে লাবণ্যময় করতে পছন্দ করি।’’ ’ [ইবনুল কায়্যিম, রাওদ্বতুল মুহিব্বিন: ২২১]। তবে, কেউ যদি কেবল চেহারা সুন্দর হওয়ার জন্য তাহাজ্জুদ আদায় করেন, তার কোনো নেকি তো হবেই না, চেহারা সুন্দর হওয়ারও সম্ভাবনা থাকবে না। উপরে যে নারীদের কথা বলা হয়েছে, তারা মূলত ইবাদতের নিয়তেই তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। চেহারা সুন্দর হওয়ার বিষয়টি ছিলো বোনাস হিসেবে।
.
ইমাম হাসান আল বাসরি (রাহ.) কে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারীরা কেনো জ্যোতির্ময় চেহারার অধিকারী হয়?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘তাঁরা আল্লাহর সাথে নিভৃতে অবস্থান করেন, ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বিশেষ জ্যোতির্ময় পোষাক পরিধান করান।’ [ইবনুল জাওযি, আল-মাওয়া‘ইয: ১২১]।
.
◈ মানুষের ভালোবাসা অর্জিত হয়: তাবিয়ি সায়িদ ইবনুল মুসায়্যিব (রাহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রাতে নামাজ আদায় করে, আল্লাহ্ তার চেহারায় নূর (জ্যোতি) উদ্ভাসিত করে দেন। প্রত্যেক মুসলিম তাকে ভালোবাসে; যদিও পূর্বে কখনও তাকে না দেখে থাকে। তারা বলে, ‘‘এই লোকটিকে আমার ভালো লাগে।’’ [আবদুল হক, কিতাবুত তাহাজ্জুদ]।
.
◈ গুনাহের কারণে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়: ইমাম সুফিয়ান সাওরি (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন, ‘আমি একটি মাত্র গুনাহের কারণে পাঁচ মাস কিয়ামুল লাইল থেকে বঞ্চিত হয়েছি।’ তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘সেটি কী গোনাহ ছিলো?’ তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি কাঁদছিলো, আমি তাকে ‘লোক দেখানো কান্নাকারী’ বলেছিলাম।’ [আবু নু‘আইম, হিলয়াতুল আউলিয়া: ৭/১৮]।
.
◈ বিশেষত হারাম ইনকাম এবং কুদৃষ্টির ফলে তাহাজ্জুদ নসিব হয় না অনেকের: আবু সুলায়মান আদ-দারানি (রাহ.) বলেন, ‘এমন কত (হারাম) লোকমা আছে, যা কিয়ামুল লাইলে বাধা দিয়েছে! এমন কত (হারাম) দৃষ্টি আছে, যা সূরা তিলাওয়াত থেকে বঞ্চিত করেছে।’ [আবু নু‘আইম, হিলয়াতুল আউলিয়া: ২/৩০৭]।
.
❑ তাহাজ্জুদ নামাজের সঠিক সময়:
__________________________________
তাহাজ্জুদ নামাযের সময় শুরু হয় এশার নামাযের পর থেকে এবং শেষ হয় ফজর উদয় হওয়ার সাথে সাথে। রাতের প্রথমাংশে, মধ্য রাতে এবং শেষাংশে যে কোন সময়ে তাহাজ্জুদ পড়া যায়। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমরা রাতের যে কোন অংশে নবী (ﷺ)-কে নামায পড়তে দেখতে চাইতাম, সেই সময়ই দেখতে পেতাম, তিনি নামায পড়ছেন। আবার রাতের যে কোন অংশে আমরা তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে চাইতাম, তখনই আমরা দেখতে পেতাম, তিনি ঘুমিয়ে আছেন।’(সহীহ বুখারী মুসনাদে আহমাদ নাসাঈ, মিশকাত ১২৪১) সুতরাং এ কথা স্পষ্ট যে, এশার পর থেকে নিয়ে ফজর পর্যন্ত সময়ের ভিতরে তাহাজ্জুদের জন্য কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। অবশ্য আফযল বা উত্তম সময় হল, রাতের শেষ তৃতীয়াংশ। বিশেষত রাতের অবশিষ্ট এক তৃতীয়াংশে তাহাজ্জুদ পড়া উত্তম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আমাদের রব দুনিয়ার আসমানে অবতীর্ণ হন এবং বলেন ডাকার জন্য কেউ আছে কি, যার ডাক আমি শুনবো? চাওয়ার জন্য কেউ আছে কি, যাকে আমি দেব? গুনাহ থেকে মাফ চাওয়ার কেউ আছে কি, যার গুনাহ আমি মাফ করব?’’ [বুখারি, আস-সহিহ: ১০৯৪; মুসলিম, আস-সহিহ ১৮০৮]। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকে ফজর উদয় হওয়ার আগের সময়কে তিন ভাগে ভাগ করলে রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশ বুঝা যায়। রাত্রের শেষাংশে মোরগ যখন বাং দেয় তখন উঠলেও তাহাজ্জুদ পড়া যায়। মহানবী (ﷺ) কখনো কখনো এই সময় উঠতেন। (সহীহ বুখারী, মিশকাত ১২০৭)।

❑ তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের পদ্ধতি:
________________________________
তাহাজ্জুদের সালাতের বিশেষ কোনো নিয়ম নেই। সাধারণ সুন্নাত বা নফল নামাজের মতই এই নামাজ পড়তে হয়। তবে, চাইলে এটি যেমন দুই রাকাত করে আদায় করা যায় আবার চার রাকাত করেও আদায় করা যায়। চার রাকাত করে আদায় করলে, যোহরের ফরজের পূর্বের চার রাকাত সুন্নাতের মতো করে পড়তে হয়। বিশেষ কোনো সূরা দিয়ে এই নামাজ পড়তে হয় না। এটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নফল নামাজ।
.
❑ তাহাজ্জুদ নামাজের রাকাতসংখ্যা:
___________________________________
রাতের নামাযের কোন নির্দিষ্ট রাকআত সংখ্যা নেই। তাহাজ্জুদের নামাজ সর্বনিম্ন ২ রাকাত থেকে শুরু করে ৪, ৬, ৮, ১০ রাকাতও পড়া যায়। এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত। [আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৩৫৭ ও ১৩৬২; আহমাদ, আল-মুসনাদ: ২৫১৫৯]। তবে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাধারণ আমল ছিলো, তিনি অধিকাংশ সময় রাতে ৮ রাকাত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন। [বুখারি, আস-সহিহ: ১১৪৭]। জেনে রাখা ভাল যে, রাক‘আত গণনার চেয়ে ছালাতের খুশূ-খুযূ ও দীর্ঘ সময় ক্বিয়াম, কু‘ঊদ, রুকূ, সুজূদ অধিক যরূরী। যা আজকের মুসলিম সমাজে প্রায় লোপ পেতে বসেছে। ফলে রাত্রির নিভৃত সালাতের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
.
◾তাহাজ্জুদ সালাতের কিরাআত:
_________________________________
তাহাজ্জুদ সালাতের ক্বিরাআত লম্বা হওয়া বাঞ্ছনীয়। মহানবী (ﷺ) বলেন, “শ্রেষ্ঠ নামায হল লম্বা কিয়াম।”(সহীহ মুসলিম,মিশকাত ৪৬, ৮০০)। ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, এক রাতে নবী (ﷺ) এর সাথে নামায পড়লাম। তিনি কিয়াম করতেই থাকলেন, পরিশেষে আমি মন্দ ইচ্ছা করে ফেলেছিলাম। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, সে মন্দ ইচ্ছাটি কি? তিনি বললেন, আমি ইচ্ছা করেছিলাম যে, তাঁকে ছেড়ে দিয়ে বসে যাব! (সহীহ বুখারী,১১৩৫ মুসলিম,১৮৫১)। নবী (ﷺ) এই নামাযে এত দীর্ঘ কিয়াম করতেন যে, তার ফলে তাঁর পা ফুলে যেত। তাঁকে বলা হল যে, আপনার তো আগে-পিছের সকল ত্রুটি আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? (তাও আপনি এত কষ্ট করে ইবাদত করেন কেন)? তিনি বললেন, “আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হ্‌ব না?” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১২২০)। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ১০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে উদাসীনদের তালিকাভুক্ত হয় না, যে ১০০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে আবেদদের তালিকাভুক্ত হয়। আর যে ১০০০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে অজস্র সওয়াব অর্জনকারীদের তালিকাভুক্ত হয়।” (আবু দাঊদ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ তারগীব ৬৩৩)। কখনো তিনি তাহাজ্জুদের নামাযে সূরা বানী ইসরাঈল ও যুমার পড়তেন। (আহমাদ, মুসনাদ) কখনো প্রায় ৫০ আয়াতের মত বা তার থেকে বেশী আয়াত তেলাওয়াত করতেন। (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান)। কখনো বা সূরা মুযাম্মিলের মত লম্বা সূরা পাঠ করতেন। (মুসনাদ, আহমেদ তিরমিজি,৩৪০৫)। একদা তিনি সূরা মায়িদার ১১৮নং আয়াত বারবার পাঠ করতে করতে ফজর করে দিয়েছেন। (ইবনে মাজাহ্‌,ইবনে খুযাইমাহ্‌, মিশকাত ১২০৫)।

◾তাহাজ্জুদ সালাতের ক্বাযা:
______________________________
যে তাহাজ্জুদ-গুযার বান্দার কোন কারণবশত রাতের ১১ রাকআত নামায ছুটে যায় সে তা দিনে বিশেষ করে চাশতের সময় ১২ রাকআত কাযা করতে পারে। মহানবী (ﷺ) এর তাহাজ্জুদ ঘুম বা ব্যথা-বেদনার কারণে ছুটে গেলে দিনে ১২ রাকআত কাযা পড়তেন। (মির‘আত ৪/২৬৬; মুসলিম, মিশকাত হা/১২৫৭, ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ-৩৫) উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত, তিনি বলেন- আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার (পূর্ণ) অযীফা (তাহাজ্জুদের নামায, কুরআন ইত্যাদি) অথবা তার কিছু অংশ রেখে ঘুমিয়ে যায়, কিন্তু তা যদি ফজর ও যোহরের নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে আদায় করে নেয় তবে তার জন্য পূর্ণ সওয়াবই লিপিবদ্ধ করা হয়, যেন সে ঐ অযীফা রাত্রেই সম্পন্ন করেছে।”(সহীহ মুসলিম,৭৪৭)। তাহাজ্জুদ বা বিতর ক্বাযা হয়ে গেলে ‘উবাদাহ বিন সামিত, আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস প্রমুখ সাহাবীগণ ফজর সালাতের আগে তা আদায় করে নিতেন। (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৮৩)।

◾তাহাজ্জুদ নামাজকে সুন্দর ও যথার্থ করতে যে বিষয়গুলো জেনে ভাল:
_________________________________
◈(১) ঘুমাবার আগে তাহাজ্জুদের নিয়ত করে ঘুমাতে হবে। এতে সে শেষ রাত্রে ঘুম থেকে জেগে নামায পড়তে সক্ষম না হলেও তার জন্য তাহাজ্জুদের সওয়াব লিখা হবে। (নাসাঈ, ইবনে মাজাহ্‌, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ তারগীব ৫৯৮)।

(২) যদি কেউ আগ রাতে বিতরের পর দু’রাক‘আত নফল সালাত আদায় করে এবং শেষরাতে তাহাজ্জুদের জন্য উঠতে সক্ষম না হয়, তাহ’লে উক্ত দু’রাক‘আত তার জন্য যথেষ্ট হবে’। (দারেমী, মিশকাত হা/১২৮৬; ছহীহাহ হা/১৯৯৩)।

◈(৩)রাতে ঘুম থেকে জাগার পর নির্দিষ্ট দু‘আ পড়া। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি রাতে ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে এই দু‘আ পাঠ করবেবদু’আটি দেখুন [বুখারি, আস-সহিহ: ১১৫৪]।
.
◈(৪) ঘুম থেকে জেগে সূরা আলে ইমরানের শেষ দশ আয়াত পাঠ করা উত্তম। একটি হাদিসে এসেছে, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে ঘুম থেকে জেগে ঘুমের ঘোর কাটানোর পর সূরা আ-লে ইমরানের শেষ দশ আয়াত পাঠ করেন। এরপর অজু করেন এবং নামাজ পড়েন। [বুখারি, আস-সহিহ: ১৮৩; মুসলিম, আস-সহিহ: ৭৮৩]। এই হাদিসের আলোকে ইমাম নববি (রাহ.) বলেন, ঘুম থেকে জেগে সূরা আলে ইমরানের শেষ দশ আয়াত পড়া উত্তম। (বিশেষত কিয়ামুল লাইলের জন্য জাগলে)।
.
◈(৫) তাহাজ্জুদের জন্য উঠে অজুর পূর্বে মিসওয়াক করা মুস্তাহাব। হুযাইফা (রা.) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের বেলা যখন তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য উঠতেন, তখন মিস্ওয়াক দ্বারা তাঁর মুখ পরিষ্কার করে নিতেন।’ [বুখারি, আস-সহিহ: ১০৭০]।
.
◈(৬)তাহাজ্জুদের নামাজ প্রথমে স্বল্প-পরিসরে দুই রাকআত দিয়ে শুরু করা উত্তম; নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যখন তোমাদের কেউ রাতে নামাজ পড়ার জন্য উঠবে, সে যেন হালকাভাবে দুই রাকাত পড়ার মাধ্যমে নামাজ শুরু করে।” [মুসলিম, আস-সহিহ: ৭৬৮, আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৩২৩]।
.
(৭) তাহাজ্জুদের সালাতে রাসূল (ছাঃ) বিভিন্ন ‘ছানা’ পড়েছেন। তন্মধ্য হ’তে যে কোন ‘ছানা’ পড়া চলে। (মুসলিম, আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১২১২, ১৪, ১৭; নাসাঈ হা/১৬১৭ ইত্যাদি)।

◈(৮) তাহাজ্জুদে দীর্ঘ কিয়াম করে অধিক পরিমাণে কুরআন পড়া উত্তম: জাবির (রা.) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘কোন নামাজ সর্বোত্তম?’ তিনি বলেন, ‘‘যে নামাজে দীর্ঘ কিয়াম (দাঁড়িয়ে থাকা) হয়।’’ [মুসলিম, আস-সহিহ: ৭৫৬]। আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) থেকে আরেকটি বর্ননা দেখুন। [বুখারি, আস-সহিহ: ১০৬৯]।
.
◈(৮) তাহাজ্জুদের ক্বিরাআত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনো সশব্দে কখনো নিঃশব্দে পড়েছেন।(আবুদাঊদ হা/২২৬; তিরমিযী হা/৪৪৯; মিশকাত হা/১২০২-০৩)। তিনি বলেন, সরবে ও নীরবে পাঠকারী প্রকাশ্যে ও গোপনে সাদাক্বাকারীর ন্যায়।

◈(৯) যাদের বড় সূরা মুখস্থ নেই, তারা অনেকগুলো ছোট সূরা প্রতি রাকাতে পড়তে পারেন। তাহলে কিয়াম দীর্ঘ হবে।
.
◈(১০) তাহাজ্জুদের নামাজ ২ রাকাত করে আদায় করা উত্তম; তবে, একত্রে চার রাকাত পড়াও বৈধ। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘রাতের নামাজ দুই দুই রাকাত করে।’’ [বুখারি, আস-সহিহ: ৪৭২; মুসলিম, আস-সহিহ: ৭৪৯]।
.
◈(১১) রুকু-সিজদার তাসবিহ ৫/৭ বার অথবা আরও বেশি করে পড়ে রুকু-সিজদাকে দীর্ঘ করুন। সিজদায় তাসবিহ পাঠের পর আল্লাহর কাছে দু‘আও করতে পারেন।
.
◈(১২) নামাজের স্থানটি নিরিবিলি হওয়া উচিত। মনোযোগ ঠিক থাকে। অন্ধকারে তাহাজ্জুদ পড়া জায়েয। তবে, সামান্য আলো থাকলে সেটা উত্তম। বিশেষত সিজদার স্থানটি। তাহলে, কোনো পোকা-মাকড় বা অন্য কিছুর ভয় থাকে না।

পরিশেষ, উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত রাতের সালাত। আর এই তাহাজ্জুদের গুরুত্ব উপলব্ধির জন্য একটি আয়াত ও একটি হাদিস জানা উচিত। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি রাতের বেলা সিজদারত থাকে বা (ইবাদতে) দাঁড়ানো থাকে, আখিরাতের ব্যাপারে শঙ্কিত থাকে এবং নিজ রবের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে, সে কি তার সমান, যে এমনটি করে না?’’ [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৯]। আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, ‘কিয়ামুল লাইল (রাতের নামাজ) ত্যাগ করবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (কখনো) এটি ত্যাগ করতেন না। যখন তিনি অসুস্থ থাকতেন বা ক্লান্তি অনুভব করতেন, তখন বসে আদায় করতেন।’ [আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৩০৯, আহমাদ, আল-মুসনাদ: ২৪৯১৯; হাদিসটি সহিহ]। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।