পৃথিবীতে ব্যক্তি এবং সমাজের উপর পাপের প্রতিক্রিয়া

পৃথিবীতে ব্যক্তি এবং সমাজের উপর পাপের প্রতিক্রিয়া

লেখক: আবদুল্লাহিল হাদী মু.ইউসুফ

সম্পাদনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী আব্দুল জলীল

ভূমিকাঃ শাব্দিকভাবে কোন অন্যায় বা অপরাধকে আমরা পাপ বলে বুঝি। আর ইসলামের দৃষ্টিতে পাপ হল আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের কোন বিধি-বিধানকে অমান্য করা।
মানুষ মাত্রই কোন না কোন পাপ করছে। তবে কেউ কম কেউ বেশি, কিন্তু কোন সময় হয়ত কোন মানুষ এই পাপ নিয়ে চিন্তা করে এবং সতর্ক হয় আবার কেউ কেউ হয়ত কখনো তার পাপের ব্যাপারে কোন ভ্রুক্ষেপেই করে না। তবে কেউ তার পাপ নিয়ে চিন্তা করুক আর নাই করুক ব্যক্তি এবং সমাজের উপর পৃথিবীতেই পাপের একটি প্রতিক্রিয়া রয়েছে আবার অন্য দিকে রয়েছে পরকালে তার কঠিন পরিণতি।

আসুন, দেখা যাক পৃথিবীতে ব্যক্তি এবং সমাজের উপর পাপ কী ধরণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেঃ

ক) ব্যক্তির উপর পাপের প্রতিক্রিয়া সমূহঃ
১. ইসলামী জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হওয়া: ইসলামী জ্ঞান হল মানুষের জন্য আল্লাহ্ প্রদত্ব এমন একটি জ্যোতি যা মানুষকে আলোর পথ প্রদর্শন করে। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

وعن معاوية – رضي الله عنه – قَالَ : قَالَ رسول الله – صلى الله عليه وسلم – : (( مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْراً يُفَقِّهْهُ في الدِّينِ )) متفقٌ عَلَيْهِ

“মোয়াবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “আল্লাহ্ যার ভাল চান তিনি তাকে দ্বীনের (ইসলামের) জ্ঞান দান করেন”। ( বোখারী ও মুসলিম)
ইমাম শাফিয়ী (রাহিমাহুল্লাহ্) তাঁর উস্তাদ ওকীর নিকট স্বীয় স্মরণ শক্তি কম বলে অভিযোগ করলে উত্তরে উস্তাদ বললেনঃ “পাপ কাজ পরিহার কর।”
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেনঃ

والله سبحانه جعل مما يعاقب به الناس على الذنوب: سلب الهدى والعلم النافع

“আল্লাহ্ মানুষের পাপের শাস্তি হিসেবে মানুষকে পৃথিবীতে হেদায়েত এবং কল্যাণকর জ্ঞান থেকে বঞ্চিত করেন”। (মাজমুউল ফাতাওয়া খঃ১৪পৃঃ১৫২)

২.হালাল রিযিক থেকে মাহরুম হওয়াঃ
আল্লাহ্ ভীরুতা যেমন মানুষের রিযিক বৃদ্ধির করাণ এমনিভাবে পাপ মানুষকে রিযিক থেকে বঞ্চিত করে। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

عُقْبَةَ بن عَامِرٍ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : (إِذَا رَأَيْتَ اللَّهَ يُعْطِي الْعَبْدَ مَا يُحِبُّ وَهُوَ مُقِيمٌ عَلَى مَعَاصِيهِ فَإِنَّمَا ذَلِكَ لَهُ مِنْهُ اسْتِدْرَاجٌ ، ثُمَّ نَزَعَ هَذِهِ الآيَةَ : ( فَلَمَّا نَسُوا مَا ذُكِّرُوا بِهِ فَتَحْنَا عَلَيْهِمْ أَبْوَابَ كُلِّ شَيْءٍ حَتَّى إِذَا فَرِحُوا بِمَا أُوتُوا أَخَذْنَاهُمْ بَغْتَةً فَإِذَا هُمْ مُبْلِسُونَ فَقُطِعَ دَابِرُ الْقَوْمِ الَّذِينَ ظَلَمُوا وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ) الأنعام/৪৫

. رواه الطبراني في “الكبير” (১৭/৩৩০) ، وصححه الألباني في “السلسلة الصحيحة” (৪১৩)

“উকবা বিন আমের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেছেন,তিনি বলেছেনঃবান্দা পাপে লিপ্ত থাকা সত্বেও যদি দেখ যে আল্লাহ্ তার চাহিদা পুরণ করছেন তাহলে মনে করবে যে এটা হলতাকে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ঢিল দেয়া। এরপর তিনি এই আয়াত তেলওয়াত করলেনঃ অতঃপর তাদেরকে যা উপদেশ ও নসিহত করা হয়েছিল তা যখন তারা ভুলে গেল তখন আমি তাদের জন্য প্রতিটি বস্তুর দরজা উন্মুক্ত করে দিলাম, শেষ পর্যন্ত যখন তারা তাদেরকে দেয়া বস্তু লাভ করে খুব আনন্দিত এবং উল্লাসিত হল তখন হঠাৎ একদিন আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম,আর তারা সেই অবস্থায় নিরাশ হয়ে পড়ল”। (সূরা আনআম-৪৪), (ত্বাবারানী, আলবানী রাহিমাহুল্লাহ হাদীস সহীহ বলেছেন।)

৩.পাপীর নিকট পৃথিবীর সমস্ত কাজ জটিল বলে মনে হয়ঃ
পাপী যা কিছু করতে চায় তাই যেন তার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। পদে পদে নানাভাবে বাধা গ্রস্থ হয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ্ভীরুদের জন্য তাদের জীবন যাপনকে আল্লাহ্ সহজ করে দেন।
আল্লাহর বাণীঃ

وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَّهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ

“যে কেউ আল্লাহ্ কে ভয় করে আল্লাহ্ তার জন্য পথ করেদেন আর তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে দান করবেন রিযিক”। (সূরা তালাক ২-৩)

ইমাম ত্বহাবী বলেন: “আল্লাহ্ দায়িত্ব নিয়েছেন মুমিনকে প্রত্যেক সংকীর্ণতা থেকে পথ দেখানোর এবং তার কল্পনাতীতভাবে তাকে রিযিক দেয়ার, আর কারো ক্ষেত্রে যদি অনুরূপ নাহয় তাহলে বুঝতে হবে তার আল্লাহ্ভীরুতায় ক্রুটি রয়েছে। অতএব সেযেন তাওবা করে”। (আক্বীদা তাহাভীয়া পৃষ্ঠা নং ২৬৯)
এক আরবী কবির ভাষায়ঃ

بتقوى الاله نجا من نجا وفاز وصار الى ما رجا

“আল্লাহ ভীরুতার মাধ্যমেই যে মুক্তি পাওয়ার সে মুক্তি পেয়েছে এবং সফলতা লাভ করে কাঙ্খিত স্থানে পৌঁছেছে।”
৪. আল্লাহর আনুগত্যতা থেকে বঞ্চিত হওয়াঃ
পাপ মানুষকে আল্লাহর আনুগত্য থেকে বঞ্চিত করে। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

وجُعِلَ الذُّلُّة والصَّغَار على مَنْ خالَف أمري

“ যে ব্যক্তি আমার নির্দেশ অমান্য করবে তার জন্য লাঞ্ছনা এবং অবমাননা অবধারিত”। (আহমদ)

ওমার বিন খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আবু উবাইদা বিন জাররাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কে লক্ষ্য করে বলেনঃ

انا كنا اذل قوم فاعزنا الله بالاسلام فمهما نطلب العز بغير ما اعزنا الله به، اذلنا الله.

“আমরা ছিলাম লাঞ্ছিত এবং অপমানিত একটি জাতি। আল্লাহ্ আমাদেরকে ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। অতএব আল্লাহ্ আমাদেরকে যা দিয়ে সম্মানিত করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছুর দ্বারা সম্মানিত হতে চাইলে আল্লাহ্ আমাদেরকে লাঞ্ছিত অপমানিত করবেন”। (হাকেম খঃ১পৃ:৬১-৬২)
আরবী কবি বলেনঃ

رايت الذنوب تميت القلوب وقد تورث الذل ادمانها
وترك الذنوب حياة القلوب وخير لنفسك عصيانها

অর্থঃ “আমি দেখেছি যে, পাপসমূহ অন্তর সমূহকে নির্জিব করে ফেলে আর ধারাবাহিকভাবে পাপ করতে থাকলে তা মানুষকে লাঞ্ছিত এবং অপমানিত করে।
পাপ পরিহার করলে অন্তরসমূহ সঞ্জিবিত হয় আর তোমার জন্য পাপ পরিহার করাই উত্তম।”

৫. পাপ যখন বৃদ্ধিপায় তখন তা পাপীর অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয় ফলে সে গাফিল বা অবহেলাকারী হিসেবে আল্লাহর নিকট চিহ্নত হয়ে যায়: হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ (صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) قَالَ : إِنَّ العَبْدَ إِذَا أَخْطَأَ خَطِيئَةً نُكِتَتْ فِي قَلْبِهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ ، فَإِذَا هُوَ نَزَعَ وَاسْتَغْفَرَ وَتَابَ سُقِلَ قَلْبُهُ ، وَإِنْ عَادَ زِيدَ فِيهَا حَتَّى تَعْلُوَ قَلْبَهُ ، وَهُوَ الرَّانُ الَّذِي ذَكَرَ اللَّهُ كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ

“আবু হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “বান্দা যখন কোন পাপ করে তখন তার অন্তরে একটি কাল দাগ পড়ে যায়। আর যখন সে তা থেকে বিরত হয়, ক্ষমা চায় ও ফিরে আসে তখন তার অন্তর পরিচ্ছন্ন হয়।পুনরায় যদি পাপে লিপ্ত হয় তাহলে তার অন্তুরে মরিচা পড়ে তা কুলষিত হয়ে যায়। যার কথা আল্লাহ বলেছেনঃ “বরং তাদের কৃতকর্মের ফলে তাদের অন্তরে মরিচা পড়ে গেছে”। (সূরা মোতাফফিফীন: ১৪, তিরমিযী, আলবানী রাহিমাহুল্লাহ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)

৬. পাপের কারণে বান্দা আল্লাহর নিকট হেয় প্রতিপন্ন হয়ঃ আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَمَنْ يُهِنِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُكْرِمٍ إِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يَشَاءُ

“আল্লাহ যাকে হেয় করেন তাকে সম্মানদাতা কেউ নেই, আল্লাহ্ যা খুশি তা করেন”। (সূরা হাজ্ব: ১৮)

৭.পাপ জীবনকে বরকতহীন করে তোলেঃ

ইমাম ইবনুল কায়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:

وَإِنَّمَا كَانَتْ مَعْصِيَةُ اللَّهِ سَبَبًا لِمَحْقِ بَرَكَةِ الرِّزْقِ وَالْأَجَلِ، لِأَنَّ الشَّيْطَانَ مُوَكَّلٌ بِهَا وَبِأَصْحَابِهَا، فَسُلْطَانُهُ عَلَيْهِمْ، وَكُلُّ شَيْءٍ يَتَّصِلُ بِهِ الشَّيْطَانُ وَيُقَارِنُهُ، فَبَرَكَتُهُ مَمْحُوقَةٌ

“আল্লাহর অবাধ্যতা রিযিক এবং জীবন বরকতহীন হওয়ার কারণ। কেননা শয়তান পাপের বা পাপীদের দায়িত্বশীল। তাদের ওপর তার কর্তৃত্ব চলে। আর যে জিনিসের সাথে শয়তান থাকে বা শয়তানের সম্পর্ক থাকে তা বরকত শূণ্য হয়।” (আদ্দা ওয়াদ্দাওয়া, পৃঃ ১৩১-১৩২)

ইবনে রজব হাম্বলী রহ. বলেন:

وإنَّ كلَّ زمانٍ شغَلَه المؤمنُ بطاعة الله – تعالى – فهو زمانٌ مُبَارك عليْه، وكلَّ زمان شغَلَه العبدُ بمعصية الله – تعالى – فهو مشؤومٌ عليه، فالشؤم في الحقيقة هو في معصية الله – تعالى.

“ মুমেন ব্যক্তি যতটুকু সময় আল্লাহর ইবাদতে ব্যয় করে ততটুকু সময় তার জন্য বরকতময় হয়। আর যতটুকু সময় বান্দা পাপের কাজে ব্যয় করে সেটা তার জন্য ক্ষতিকর। আর প্রকৃত ক্ষতি হল আল্লাহর অবাধ্য হওয়া”। (লাতায়েফুল মায়ারেফ, পৃষ্ঠা নং ১৫১)

৮. পাপ লাঞ্ছনাকে অবধারিত করেঃ আল্লাহর বাণীঃ

مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعِزَّةَ فَلِلَّهِ الْعِزَّةُ جَمِيعًا

“কেউ ইজ্জত সম্মান চাইলে সে জেনে রাখুক যে, সমস্ত ইজ্জত আল্লাহরই”। (সূরা ফাতের-১০) অতএব আল্লাহর আনুগত্যের মাঝেই রয়েছে মানুষের সম্মান আর তাঁর অবাধ্যতার মাঝে রয়েছে লাঞ্ছনা এবং অবমাননা।
৯. পাপ মানুষকে লজ্জাহীন করে দেয়ঃ রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

عَنْ أَنَسٍ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ (صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ ): إِنَّلِكُلِّ دِينٍ خُلُقًا ، وَخُلُقُ الإِسْلاَمِ الْحَيَاءُ.

“ প্রত্যেক ধর্মেরই চরিত্র আছে আর ইসলামের চরিত্র হল লজ্জাবোধ”। (ইবনু মাজাহ, আনাস রা. হতে বর্ণিত, আলবানী রাহিমাহুল্লাহ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)
অপর একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

((إِنَّ مِمَّا أَدْرَكَ النَّاسُ مِنْ كَلاَمِ النُّبُوَّةِ الأُولَى: إِذَا لَمْ تَسْتَحِ فَاصْنَعْ مَاشِئْتَ)). رواه البخاريُّ

“নিশ্চয় নবুয়তের প্রথম পর্যায়ের যে কথাটি মানুষ লাভ করেছে তা হল, যদি তোমার লজ্জাবোধ না থাকে তাহলে তুমি যা খুশি তা কর”। (বোখারী, হাদীস নং-৬১২০)
১০. পাপ আল্লাহর দেয়া নে’মতকে বিলুপ্ত করে দেয়: ইবনুল কাইয়েম রহ. বলেন: “যখনই বন্দার অনাকাঙ্খিত কিছু হয়ে তা তার পাপের কারণেই হয়”। (মাদারেজুস সালেকীন, ১ম খণ্ড, ৩২১ পৃষ্ঠা)

ذَٰلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَىٰ قَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ ۙ وَأَنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

“এই শাস্তির কারণ এই যে, আল্লাহ্ কোন জাতির উপর নিয়ামত দান করে সেই নিয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই জাতি নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন না করে নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ মহাশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী”। (সূরা আনফাল-৫৩)

ইমাম ইবনুল কাইয়েম রাহ. আরও বলেন: “আল্লাহর আনুগত্যের ন্যায় অন্য কোন কিছু তাঁর নে’মতকে সংরক্ষণ করতে পারে না। আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ন্যায় অন্য কোন কিছু দ্বারা নে’মত বৃদ্ধি পায় না। আর বান্দার কাছ থেকে পাপের ন্যায় অন্য কোন কিছু তা বিলুপ্ত করে না। পাপ নে’মতের জন্য আগুন স্বরূপ যা নে’মতকে জ্বালিয়ে দেয়, যেমন আগুন শুকনা কাঠকে জ্বালিয়ে দেয়”। (বাদায়েয় আল ফাওয়ায়েদ খণ্ড ২, পৃষ্ঠা নং ৭১২)

১১. নিরাপত্বা এবং শান্তি বিদূরিত করেঃ আল্লাহর বাণীঃ

وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا قَرْيَةً كَانَتْ آمِنَةً مُطْمَئِنَّةً يَأْتِيهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَكَفَرَتْ بِأَنْعُمِ اللَّهِ فَأَذَاقَهَا اللَّهُ لِبَاسَ الْجُوعِ وَالْخَوْفِ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ

“আল্লাহ্ দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন এক জনপদের যা ছিল নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত। যেথায় আসত সর্বদিক থেকে প্রচুর জীবনোপকরণ। অতঃপর তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করলো, ফলে তারা যা করত তার জন্য আল্লাহ্ তাদেরকে আস্বাদ গ্রহণ করালেন ক্ষুধা ও ভীতির আচ্ছাদন”। (সূরা নাহাল-১১২)

পাপের সামাজিক প্রতিক্রিয়াঃ

১) পৃথিবীতে ভূমিকম্প ও ভূমি ধ্বস হওয়াঃ

আমরা বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জ্বলচ্ছাস, সুনামী আরো নানান রকম দুর্ঘটনার কথা শুনে থাকি, আর তখন হয়ত এ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞগণ বিভিন্নভাবে তার ব্যাখ্যা করে থাকে, কিন্তু তার মূল কারণ হল মানুষের কৃতকর্মের আংশিক প্রতিফল। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

فَكُلًّا أَخَذْنَا بِذَنْبِهِ ۖ فَمِنْهُمْ مَنْ أَرْسَلْنَا عَلَيْهِ حَاصِبًا وَمِنْهُمْ مَنْ أَخَذَتْهُ الصَّيْحَةُ وَمِنْهُمْ مَنْ خَسَفْنَا بِهِ الْأَرْضَ وَمِنْهُمْ مَنْ أَغْرَقْنَا ۚ وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيَظْلِمَهُمْ وَلَٰكِنْ كَانُوا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ

“তাদের প্রত্যেককেই তার অপরাধের জন্য শাস্তি দিয়েছিলাম, তাদের কারো প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচণ্ড ঝটিকা, তাদের কাউকে আঘাত করেছিল বিকট শব্দ, কাউকেও আমি প্রথিত করেছিলাম ভূ-গর্ভে এবং কাউকেও করেছিলাম নিমজ্জিত। আল্লাহ্ তাদের প্রতি কোন যুলুম করেন নি তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি যুলুম করেছিল”।(সূরা আনকাবুত-৪০)

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে

عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : فِي هَذِهِ الْأُمَّةِ خَسْفٌ وَمَسْخٌ وَقَذْفٌ . فَقَالَ رَجُلٌ مِنْ الْمُسْلِمِينَ : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، وَمَتَى ذَاكَ ؟ قَالَ إِذَا ظَهَرَتْ الْقَيْنَاتُ وَالْمَعَازِفُ وَشُرِبَتْ الْخُمُورُ

“ ইমরান বিন হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃরাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ এই উম্মতের মাঝে ভূমিধ্বস, আকৃতি পরিবর্তন,সলিল সমাধি হবে। কোন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল ইয়া রাসূলাল্লাহ্ তা কখন হবে? তিনি বললেনঃ যখন এই উম্মতের মাঝে গায়িকা, বাদ্যযন্ত্র এবং মদপান দেখা দিবে। (তিরমিযী) আলবানী রাহিমাহুল্লাহ হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।

২.সমুদ্রে ও স্থলে বিভিন্নরকমের বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়াঃ আল্লাহ তায়ালা বলেন:

ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ

“ মানুষের কৃতকর্মের কারণে সমুদ্রে এবং স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে,যার ফলে তাদেরকে কোন কোন কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান যাতে তারা ফিরে আসে”। (সূরা রূম-৪১)

উপসংহারঃ
প্রিয় পাঠক, এই হল পাপের পার্থিব প্রতিক্রিয়া। এর পর রয়েছে তার পরকালীন শাস্তি যা আরো ভয়াবহ ও বেদনাদায়ক। তাই আমাদের উচিত সর্বপ্রকার পাপ পরিহার করা এবং অতীত পাপের জন্য আল্লাহর নিকট তাওবা করা।