পবিত্র কাবাঘর সর্বপ্রথম কে নির্মাণ করেন এবং হিন্দুদের টাকায় কাবাঘর নির্মাণ করা হয়েছে উক্ত বক্তব্য কতটুকু সঠিক

মাসজিদুল হারাম অর্থাৎ কা‘বাগৃহ সর্বপ্রথম কে নির্মাণ করেন এই সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও রাসূল ﷺ এর সহীহ হাদীসে সরাসরি কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে পৃথিবীর বুকে নির্মিত প্রথম মসজিদ হ’ল বায়তুল্লাহ অর্থাৎ মসজিদুল হারাম এই মর্মে কুরআনে আয়াত রয়েছে (দেখুন সূরা আলে-ইমরান ৩/৯৬)। যেহেতু কে সর্বপ্রথম কাবা নির্মাণ করেন এই সম্পর্কে সরাসরি দলিল নেই তাই আহালুল আলেমগনের মধ্যে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। ইমাম ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ)বলেন, কা‘বাগৃহ প্রথম কে নির্মাণ করেন, সে বিষয়ে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। যেমন কেউ বলেন, সর্বপ্রথম ফেরেশতাগণ কা‘বাগৃহ নির্মাণ করেন। কেউ বলেন, আদম (আলাইহিস সালাম) সর্বপ্রথম কা‘বাগৃহ নির্মাণ করেন। কেউ বলেন ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) সর্বপ্রথম কা‘বাঘর নির্মাণ করেন। (তাফসীরে ইবনু কাসীর, সূরা বাক্বারাহ ১২৫ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য )
.
হাদীসে এসেছে আবূ যার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করেন, ‘পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মাসজিদ কোনটি? তিনি উত্তরে বলেন, মাসজিদুল হারাম। আবার প্রশ্ন করেন, এরপর কোনটি? তিনি উত্তর দেন, মাসজিদে বায়তুল মুক্বাদ্দাস। আবার জিজ্ঞেস করেন, এই দুটি মাসজিদ নির্মাণের মধ্যে কত দিনের ব্যবধান ছিল? তিনি উত্তর দেন, ৪০ বছর। (সহীহ বুখারী, হা/৩৪২৫; সহীহ মুসলিম, হা/৫২০)
.
পরবর্তীতে নবী ইবরাহীম (আঃ) মাসজিদুল হারাম ও সোলায়মান (আঃ) মাসজিদুল আক্বসা পুনর্নির্মাণ করেন এটি নিয়ে দলিল রয়েছে (দেখুন সুনানে নাসাঈ হা/৬৯৩; বিস্তারিত দ্রঃ ফাৎহুল বারী ৬/৪০৮, মিরকাতুল মাফাতীহ ২/৪৬৮)। যেমন প্রথম রাসূল নূহ (আঃ)-এর সময় প্লাবনে বায়তুল্লাহর প্রাচীর বিনষ্ট হ’লেও ভিত্তি আগের মতই থেকে যায়। পরবর্তীতে আল্লাহর হুকুমে একই ভিত্তি ভূমিতে ইবরাহীম (আঃ) তা পুনঃনির্মাণ করেন। (নবীদের কাহিনী,১ম খন্ড, পৃঃ ১৪৪-৪৫) মহান আল্লাহ বলেন,আর স্মরণ কর) যখন আমরা ইব্রাহীমকে বায়তুল্লাহর স্থান নির্ধারণ করে দিয়ে বলেছিলাম যে, তুমি আমার সাথে কাউকে শরীক করো না এবং আমার এ গৃহকে তাওয়াফকারীদের জন্য, সালাত কায়েমকারীদের জন্য এবং রুকূ-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ’ (সূরা হজ্জ ২২/২৬)। ইবরাহীম (আঃ)-কে কা‘বা ঘর নির্মাণ করতে তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আঃ) সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেন। আল্লাহ বলেন, وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ‘আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল বায়তুল্লাহর ভিত্তি উত্তোলন করেছিল, তখন তারা প্রার্থনা করেছিল, হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি আমাদের পক্ষ হ’তে এটি কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’(সূরা বাক্বারাহ ২/১২৭)।
.
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, পবিত্র নগরী কাবাঘর কোন না কোন নবীর মাধ্যমে সর্বপ্রথম নির্মাণ করা হয়েছে কোন হিন্দুদের মাধ্যমে বা তাদের টাকায় নয়। এখন যে বা যারা বলেছেন কাবাঘর হিন্দুদের টাকায় তৈরি করা হয়েছে এভাবে বলা তাদের উচিত হয়নি কেননা এই বক্তব্য পরিপূর্ণ সঠিক নয়। তবে হা কাবাঘর নির্মাণের পর পরবর্তীতে সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দিলে তখন মক্কার মুশরিকরা সাহায্য করেছেন। তাদের হালাল অর্থ দিয়ে পুনরায় সংস্কার করেছেন। যেমন ইতিহাস থেকে যানা যায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন পঁয়ত্রিশ বছরে পদার্পণ করেন তখন কুরাইশগণ ক্বাবা’হ গৃহের পুনঃনির্মাণ কাজ আরম্ভ করেন। কারণ, ক্বাবা’হ গৃহের স্থানটি চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় ছিল মাত্র। দেয়ালের উপর কোন ছাদ ছিল না। এ অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে কিছু সংখ্যক চোর এর মধ্যে প্রবেশ করে রক্ষিত বহু মূল্যবান সম্পদ এবং অলঙ্কারাদি চুরি করে নিয়ে যায়। ইসমাঈল (আঃ)-এর আমল হতেই এ ঘরের উচ্চতা ছিল ৯ হাত। গৃহটি বহু পূর্বে নির্মিত হওয়ার কারণে দেয়ালগুলোতে ফাটল সৃষ্টি হয়ে যে কোন মুহূর্তে তা ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। তাছাড়া সেই বছরেই মক্কা প্লাবিত হয়ে যাওয়ার কারণে ক্বাবা’হমুখী জলধারা সৃষ্টি হয়েছিল। তাছাড়া প্রবাহিত হওয়ায় ক্বাবা’হগৃহের দেওয়ালের চরম অবনতি ঘটে এবং যে কোন মুহূর্তে তা ধ্বসে পড়ার আশঙ্কা ঘণীভূত হয়ে ওঠে। এমন এক নাজুক অবস্থার প্রেক্ষাপটে কুরাইশগণ সংকল্পবদ্ধ হলেন ক্বাবা’হ গৃহের স্থান ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার উদ্দেশ্যে তা পুনঃনির্মাণের জন্য। ক্বাবা’হ গৃহ নির্মাণের উদ্দেশ্যে সকল গোত্রের কুরাইশগণ একত্রিত হয়ে সম্মিলিতভাবে কতিপয় নীতি নির্ধারণ করে নিলেন। সেগুলো হচ্ছে যথাক্রমেঃ ক্বাবা’হ গৃহ নির্মাণ করতে গিয়ে শুধুমাত্র বৈধ অর্থ-সম্পদ (হালাল) ব্যবহার করা হবে। এতে বেশ্যাবৃত্তির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ, সুদের অর্থ এবং হক নষ্ট করে সংগৃহীত হয়েছে এমন কোন অর্থ নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা চলবে না। এ সকল নীতির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন করে নির্মাণ কাজ আরম্ভ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। (ইবনু হিশাম ১/১৯৪)
.
এখন প্রশ্ন হতে পারে মসজিদ নির্মানে অমুসলিমের অর্থ গ্রহণ করা যাবে কিনা? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো আসমানের নিছে ভূপৃষ্ঠের উপর সর্বাধিক পবিত্র ও নিরাপদ স্থান হল মসজিদ। তাই মুসলিমদের উচিত তাদের ইবাদতের স্থান নিজস্ব পবিত্র ও হালাল অর্থ দিয়ে নির্মাণ করা, এতে যেমন যাকাতের সম্পদ বা টাকা ব্যবহার করা যাবেনা তেমনি মুসলিম মিস্ত্রী-শ্রমিক থাকতে কোন অমুসলিম কাফের মিস্ত্রী-শ্রমিক দ্বারা মসজিদ নির্মাণ বৈধ নয়।(মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ৮/১৫২ ও ২১/২০-৩৮) পাশাপাশি জেনে রাখা ভাল, মুসলিমদের সামাজিক বা রাজনৈতিক কোন ক্ষতির আশঙ্কা না হলে মসজিদ ও মাদ্রাসার জন্য অমুসলিমদের নিকট থেকে হালাল অনুদান তারা যদি খুশী হয়ে স্বেচ্ছায় সাহায্য দিতে চাইলে সে অর্থ মসজিদ নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা জায়েজ। তবে শর্ত হল, দান করার সময় মসজিদের উপর তার (অমুসলিমের) কোন কতৃর্ত্ব বা নিয়ন্ত্রন থাকতে পারবে না। সে যদি এর মাধ্যমে মসজিদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাহলে এ কাজে তার অর্থ/সহযোগিতা গ্রহণ করা বৈধ নয়। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, فيجوز أن يبنيها البر والفاجر والمسلم والكافر ‘সৎ-অসৎ, মুসলিম-অমুসলিম সকলেই মসজিদ নির্মাণ করতে পারে (ইসলাম ওয়েব, ফাতাওয়া নং-২১৪৫৪, ২৬৬১)
.
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, সৌদি ফাতাওয়া বোর্ডের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, إذا كان فيه شرط يخالف الشرع فلا أما التبرع المجرد فإنه ليس فيه شيء والنبي ﷺ قبل كثيْرًا من هدايا المشركيْن ‘অমুসলিমদের অনুদানের সঙ্গে শরী‘আত বিরোধী কোন শর্ত যুক্ত থাকলে তা গ্রহণ করা যাবে না। তবে নিঃশর্ত অনুদান গ্রহণ করাতে কোন সমস্যা নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুশরিকদের দেয়া অসংখ্য উপহার গ্রহণ করেছেন’ (ইবনু বায, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ২৮তম খণ্ড, পৃ. ২৩৭)। এছাড়া ইসলাম অমুসলিমদের উপহার গ্রহণ করা জায়েয করেছে। সেক্ষেত্রে তাদের অনুদান মসজিদ নির্মাণের কাজে ব্যবহার করাও জায়েজ (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৬৪৫৭) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।