পবিত্রতা, ওযু, গোসল এবং তায়াম্মুম

অধ্যায়ঃ পবিত্রতা, ওযু, গোসল এবং তায়াম্মুম
____________________________________
(১) ইস্তিঞ্জা ও ঢিলা কুলুখের সুন্নতী তরীকা।
(২) ইসলাম আমাদেরকে নির্লজ্জ, বেহায়া হতে শিক্ষা দেয়না।
(৩) লজ্জাস্থান ধরে রাস্তায় হাটাহাটি করা বেদাত।
(৪) পেশাব করার পর মনে হয় কয়েক ফোঁটা বের হয়েছে।
(৫) পেশাব করার পরে যার সত্যি সত্যিই পেশাব বের হয় সে কি করবে?                                                                                         (৬) গোসল ফরয হওয়ার কারণ সমূহ।
(৭) সুন্নাহ অনুযায়ী ফরয গোসল করার পদ্ধতি।                                                                                                                               (৮) ওযু করার সুন্নতী পদ্ধতি।
(৯) ওযু সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়।
____________________________________
ইস্তিঞ্জা ও ঢিলা কুলুখের সুন্নতী তরীকা
আমার এই লেখাতে নারী ও পুরুষের সবার জন্যেই পেশাব ও পায়খানার পরে পবিত্রতা অর্জনের পদ্ধতি কি, সেটা বর্ণনা করা হয়েছে। অনেকে মনে করেন, নারী ও পুরুষের পবিত্রতা অর্জনের পদ্ধতি আলাদা। তাই অনেকে প্রশ্ন করেন, নারীদের পবিত্রতার পদ্ধতি কি? আসলে নারী ও পুরুষের, উভয়ের পবিত্রতা অর্জনের পদ্ধতি একই। সুতরাং, নিচে বর্ণিত এই নিয়ম অনুযায়ী নারী ও পুরুষ, সবাই পবিত্রতা অর্জন করতে পারবেন।
পেশাব-পায়খানার পরে নাপাকী দুইভাবে দূর করা যেতে পারেঃ
(১) পানি দ্বারা এবং (২) ঢিলা-কুলুখ অথবা টিস্যু দ্বারা।
পানি দ্বারা নাপাকী দূর করলে তার পূর্বে ঢিলা বা কুলুখ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। এটা নারী ও পুরষ, উভয়ের জন্য। আমাদের দেশের অনেকে মনে করেন, পুরুষের পবিত্রতা অর্জনের জন্যে শুধুমাত্র পানি যথেষ্ঠ না, প্রথমে ঢিলা কুলুখ নিয়ে এরপরে পানি দিয়ে ধুইতে হবে। আসলে এটা একটা ভুল ধারণা। ঢিলা-কুলুখের নিয়ম নারী-পুরুষ সবার জন্যই এক। বরং, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়ে ‘কুবা’ মসজিদের কিছু মুসল্লী ঢিলা-কুলুখ না নিয়ে সরাসরি পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করতো। আর আল্লাহ তাআ’লা এই কাজটিকে পছন্দ করেছিলেন, এজন্য তাদের প্রশংসা করে কুরআনে আয়াতও নাযিল করা হয়েছিলো। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “সেখানে এমন কিছু লোক আছে যারা নিজেদেরকে পূত-পবিত্র রাখতে পছন্দ করে।” সুরা তাওবাঃ ১০৮। এই আয়াতটি কুবাবাসী লোকদের উদ্দেশ্যে নাযিল করা হয়েছে। কারণ, তারা শুধুমাত্র পানি দ্বারা ইসতেঞ্জা করতো।” তিরমিযী, আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ, হাদীস সহীহ।
পবিত্রতা অর্জনের জন্য পেশাব করার পরে তাড়াহুড়া করে উঠে না পড়ে, একটু সময় অপেক্ষা করতে হবে, যাতে করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, পেশাব আর বের হবেনা। তারপর পানি অথবা ঢিলা-কুলুখ, অথবা টিস্যু দিয়ে নাপাকী পরিষ্কার করতে হবে। শুধু পানি দিয়ে নাপাকী দূর করা উত্তম, সেইক্ষেত্রে আর ঢিলা-কুলুখ বা টিস্যু ব্যবহার করতে হবেনা। তবে নাপাকী দূর হয়েছে, এটা নিশ্চিত হলে পানি ব্যবহার না করে শুধু টিস্যু বা ঢিলা কুলুখ ব্যবহার করলেও পবিত্রতা অর্জন হবে। কিন্তু, এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যাবেনা বা শয়তানের ওসওয়াসাকে অন্তরে স্থান দেওয়া যাবেনা। আপনি এটা নিয়ে দুঃশিচন্তা করে আপনার জীবন অতিষ্ট করে তুলবেন না আবার পেশাব থেকে বেঁচে থাকতে অসতর্কও হবেন না। আপনার যতটুকু সাধ্য আছে সে অনুযায়ী চেষ্টা করবেন নাপাকী থেকে মুক্ত থাকার জন্য। কিন্তু রোগের কারণে সেটা সম্ভব না হলে, আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কোনো বোঝা চাপিয়ে দেন না।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুলুখ ও পানি একত্রে ব্যবহার করেছেন, এ মর্মে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। তিনি কখনো কেবল পানি ব্যবহার করেছেন। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ, মিশকাতঃ ৩৪২, ৩৬০ ‘টয়লেটের শিষ্টাচার’ অনুচ্ছেদ। কখনো তিনি বেজোড় সংখ্যক কুলুখ ব্যবহার করেছেন। সহীহ বুখারীঃ ১৫৫, ‘ওযু’ অধ্যায় ‘কুলুখ’ ব্যবহার অনুচ্ছেদ ২০। ওযু শেষে তিনি হালকা পানির ছিটা লজ্জাস্থান বরাবর ছিটিয়ে দিতেন। আহমাদ, আবু দাঊদ, মিশকাতঃ ৩৬১। এটি ছিল সন্দেহ দূর করার জন্য। এর চেয়ে বেশী কিছু করা বাড়াবাড়ি মাত্র। উল্লেখ্য, ঢিলা ব্যবহার করার পর পানি নেওয়ার যে বর্ণনা প্রচলিত আছে, তা একেবারেই ভিত্তিহীন কথা। ইরওয়াউল গালীলঃ ৪২; সিলসিলা যঈফাহঃ ১০৩১।
____________________________________
ইসলাম আমাদেরকে নির্লজ্জ, বেহায়া হতে শিক্ষা দেয়না
আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন নামায পড়া আমার কাছে খুব কঠিন একটা কাজ মনে হতো। কারণ আমার উস্তাদেরা শিক্ষা দিতো, ছেলেদের পেশাব করার পরে লজ্জাস্থানে ঢিলা-কুলুখ ধরে ৪০ কদম হাটতে হবে (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক)! বিষয়টা শুনে ঘৃণায় আমার গা কেমন জানি রি রি করে উঠতো। আবার তারা বলতো এটা করা ওয়াজিব, না করলে পবিত্রতা অর্জন হবেনা, আর পবিত্রতা ছাড়া নামাযও হবেনা। তাই ১০ বছর বয়সে আমার উপরে নামায ফরয হওয়ার আগে থেকেই আমার দুঃশ্চিন্তা হতো, কিভাবে আমি এই (জঘন্য) অভ্যাসটা গড়ে তুলবো।
আমাদের দেশের প্রচলিত মসজিদগুলোর বাথরুমের পাশ দিয়ে গেলে ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়, না জানি কখন আপনি সভ্যতা বিরোধী এই নির্লজ্জ কাজের সম্মুখে পড়ে যান। অথচ, যে করছে সে দিব্যি এগুলো নেকীর কাজ মনে করে করে যাচ্ছে, কোনো বিকার নেই (লা হা’উলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ)! যাই হোক, আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ আমাকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ জানার সুযোগ করে দিয়েছেন। এই জঘন্য কাজ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনে একবারও করেন নি, এমনকি কোনো সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীদের কেউই করেন নি। এটা স্রেফ জাহেল (মূর্খ) মুসলমানের ফতোয়া।
আমাদের দেশের বিশাল একটা জনগোষ্ঠী দ্বীনের নামে এই নিকৃষ্ট বেদাতের সাথে জড়িত। আপনারা নিজে জানুন, শেয়ার করে অন্যদেরকে এই নোংরা বিদাতী স্বভাব থেকে সতর্ক করুন। এইরকম যত্ত নিকৃষ্ট শিরক ও বেদাত আমাদের দেশে প্রচলিত আছে, সেইগুলোর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করুন। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর প্রিয় বন্ধু, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাতের প্রচার প্রসারের জন্য কাজ করার তোওফিক দান করুন, আমিন।
____________________________________
লজ্জাস্থান ধরে রাস্তায় হাটাহাটি করা বেদাত
আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্যে, ইবাদতের নামে যেই কাজ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে করেন নি, তাঁর সাহাবীদেরকে করতে বলেননি অথবা, কোনো সাহাবী, তাবেয়ী বা তাবে তাবেয়ী করেননি, সেই কাজটা হলো বেদাত (দ্বীনের মাঝে নতুন আবিষ্কার)। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইস্তিঞ্জার পরে ৪০ কদম হাটেন নি, তাঁর সাহাবীদের এমনটা করতে বলেন নি, কোনো একজন সাহাবী এমনটা করেননি। এমনকি যেসমস্ত সাহাবীদের অসুস্থতার কারণে পেশাব ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তো, তারাও এইরকম বেহায়াপনা কাজ করেন নি।
সুতরাং, কেউ যদি বলে যেঃ পেশাবের পরে ৪০ কদম হাটতে হবে, হাঁটা ফরয/ওয়াজিব, তাহলে, এটা একটা বেদাত। ধর্মের নামে নতুন কোন কথা বা কাজ, যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেন নি সেটাই হচ্ছে বেদাত।
পেশাবের পরে লজ্জাস্থান ধরে ৪০ কদম হাঁটাহাঁটি করা দেখতে এতোটাই দৃষ্টিকটু, লজ্জা শরমের মাথা না খেয়ে কেউই এই নিকৃষ্ট বেদাতী কাজটা করতে পারবেনা। তারপরেও বেদাত করতে করতে যাদের ঘাড় ত্যাড়া হয়ে গেছ, তাদেরকে অনুরোধ করবো, দয়া করে বলবেন কুরআনের কোন আয়াতে, অথবা কোন হাদীসে অথবা কোন সাহাবী এই বেহায়াপনার কাজটা করেছেন, তাঁর দলীল-প্রমান দিন। যদি দলীল দিতে পারেন তাহলে, ইন শা’আল্লাহ, আমরা এই বেহায়াপনাকে মেনে নেবো। আর যদি দলিল দিতে না পারেন, তাহলে দ্বীনি ভাই হিসেবে অনুরোধ, এইসমস্ত বেহায়াপনা ও নোংরামি কাজ বাদ দিন।
____________________________________
পেশাব করার পর মনে হয় কয়েক ফোঁটা বের হয়েছে?
শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায রাহিমাহুল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ একটি ফতোয়াঃ
প্রশ্নঃ জনৈক ব্যক্তি পেশাব শেষ করে পেশাবের স্থান ধৌত করে নেয়। কিন্তু যখনই সে নড়াচড়া করে ও দাঁড়ায়, তখন অনুভব হয় যে, কয়েক ফোঁটা পেশাব বের হয়েছে। এ জন্য সে দীর্ঘ সময় পেশাবের স্থানে বসে থাকে, আর বলে কি করব? সে কি তার এ অনুভূতি ও ধারণা ত্যাগ করে ওযু পূর্ণ করে নেবে? নাকি, পরিপূর্ণ পেশাব বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? আশা করি উত্তর দিয়ে বাধিত করবেন। আল্লাহ আপনাদের কল্যাণ করুন।
উত্তরঃ আল-হামদুলিল্লাহ। এ বিষয়টি ওয়াসওয়াসা (শয়তানের কুমন্ত্রনা) ও সন্দেহ থেকে সৃষ্টি হয়। আর এগুলো তৈরী হয় শয়তানের পক্ষ থেকে। তবে কারো কারো ব্যাপারে প্রকৃত পক্ষেই (অসুস্থতার কারণে) পেশাবের পরে দুয়েক ফোঁটা বের হয়।
কারো যদি সত্যিই এমন হয়, তাহলে সে তাড়াহুড়ো করবে না, বরং পেশাব বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, অতঃপর পানি দ্বারা পেশাবের স্থান ধৌত করবে। এরপর যদি কোন কিছুর আশঙ্কা থাকে, তাহলে লজ্জাস্থানের আশপাশে লুঙ্গি বা পায়জামায় পানি ছিটিয়ে দেবে। অতঃপর অযু শেষ করার পর যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়, সেই দিকে সে কোন ভ্রুক্ষেপ করবে না। ওয়াসওয়াসা ত্যাগ করার জন্য এ পদ্ধতি তার জন্য সহায়ক হবে।
আর যদি শুধুই সন্দেহ ও ওয়াসওয়াসা হয়, যার কোন বাস্তবতা নেই, তবে তার প্রতি মোটেই ভ্রক্ষেপ করবে না। মুমিনদের জন্য এ সমস্ত জিনিসে দৃষ্টি না দেওয়া উচিত। কারণ, এগুলো শয়তানের ওয়াসওয়াসা। শয়তান চায় মানব জাতির সালাত-ইবাদত নষ্ট করতে। অতএব, তার ষড়যন্ত্র ও ওয়াসওয়াসা থেকে সতর্ক থাকা জরুরি। আল্লাহকে আঁকড়ে থাকা এবং তার উপর ভরসা করা। আর এসব যা কিছু সৃষ্টি হয়, তা শয়তানের পক্ষ থেকে মনে করা, যাতে ওযু এবং তার পরবর্তী সালাতে এর প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ সৃষ্টি না হয়। আর নিশ্চিতভাবে কিছু বের হলে, পুনরায় পবিত্র হবে ও অযূ করবে।
আর ধারণার কোনই গ্রহণ যোগ্যতা নেই। যদিও ৯৯% ভাগ ধারণা হয়, তার প্রতিও কোন ভ্রুক্ষেপ করা যাবে না। এগুলো শয়তানের প্ররোচনা। যতক্ষণ পর্যন্ত দৃঢ় বিশ্বাস না হবে, সে তার অযূ, সালাত ও অন্যান্য কাজ করে যাবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করা হয়েছিলঃ হে আল্লাহর রাসূল, কোন ব্যক্তির ধারণা হয় যে, তার সালাতে কিছু বের হয়েছে। উত্তরে তিনি বলেন : (لَا يَنْصَرِفْ حَتَّى يَسْمَعَ صَوْتًا أَوْ يَجِدَ رِيحًا) সালাত ত্যাগ করবে না, যতক্ষণ না সে আওয়াজ শোনে, অথবা গন্ধ পায়। এখানে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, আওয়াজ বা গন্ধ না পাওয়া পর্যন্ত, কেবল ধারণার উপর নির্ভর করে সালাত ত্যাগ করবে না। তদ্রূপ মানুষ যখন অযূ থেকে ফারেগ হয়, অতঃপর কোন কিছু অনুভূত হলে, সে দিকে ভ্রুক্ষেপ করবে না, এবং তার প্রতি ফিরে যাবে না। বরং, সে তার পবিত্রতা, সালাত ও আমল করে যাবে, যতক্ষণ না ১০০% ভাগ ধারণা হয় যে, কিছু বের হয়েছে। কারণ, কিছু বের না হওয়াই নিয়ম। আরো স্মরণ রাখবে যে, শয়তানের ওয়াসওয়াসা, তার প্ররোচনা ও তার সৃষ্ট সন্দেহ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, মুমিনকে ক্লান্ত করা ও তাকে কল্যাণকর এসব কাজ থেকে বিরত রাখা। আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা চাচ্ছি।
সূত্রঃ ফাতওয়া নূর আ’লা আদ-দারবঃ ২/৫৭৭।
____________________________________
পেশাব করার পরে যার সত্যি সত্যিই পেশাব বের হয় সে কি করবে
এই লেখাটা শায়খ মতিউর রাহমান মাদানী হা’ফিজাহুল্লাহর একটি প্রশ্নোত্তর থেকে নেওয়া। এবং তার সাথে আমি কিছুটা সম্পাদনা ও ব্যখ্যা যোগ করেছি।
(১) পেশাব শেষে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি চাপ দিবে, যাতে করে পেশাব পড়া বন্ধ হয়।
(২) এর পরেও যদি পেশাব বের হতে থাকে, তাহলে টিস্যু বা ঢিলা-কুলুখ নিয়ে পেশাব ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে। (সাবধান! কোন হাটাহাটি নয়)। সে শুধু লজ্জাস্থান একটু ঝেড়ে পেশাব ফেলার চেষ্টা করবে, এবং এরপরে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলবে। এটা নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করার দরকার নেই। স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়াবাড়ি করে জীবনটাকে কষ্টকর করে তুলবেন না।
(৩) এর পরেও যদি মনে হয় পেশাব বের হচ্ছে, এটা শয়তানের ওয়াসওয়াসা। এই অবস্থায় সে পেশাব বের হচ্ছে কি না হচ্ছে, সেইদিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ করবেনা। ওযু করার পরে সে কাপড়ের উপর দিয়ে লজ্জাস্থান বরাবর ও তার আশেপাশে সামান্য পানির ছিটা দিবে, এতে পেশাব বের হলো কিনা, এই ওয়াসওয়াসায় সে পড়বেনা। আর ওযু করার পরে বা নামাযে পেশাব বের হয়েছে এমন সন্দেহ হলে, একবার ‘আ’উযুবিল্লাহিমিনাশ শাইত্বানির রাযীম’ পড়বে। এরপরে এনিয়ে আর কোনো চিন্তা করবেনা, যদিওবা পেশাব বের হয়ে যায়! এই অবস্থায় সে মাযুর বা অসুস্থ, তাই তার জন্যে ওযু ভাংবেনা। অসুস্থতার কারণে সে এক ওযু দিয়েই এক ওয়াক্তের সমস্ত ফরয, সুন্নত, নফল নামায পড়তে পারবে।
(৪) আর কেউ যদি নিশ্চিত হয় যে, ওযু করার পরে, নামাযে বা এমনিতে যে কোনো সময় পেশাব পড়ে, তাহলে সে চিকিতসা করাবে কারণ এটা একটা রোগ। আর চিকিৎসা করেও উপকার না পেলে, সে লজ্জাস্থানে তুলা/কাপড় বা আন্ডারওয়ার পড়বে যাতে করে পেশাব গায়ে বা কাপড়ে না লাগে। যদি সম্ভব হয়, তাহলে প্রত্যেক নামাযের পূর্বে এটা পরিবর্তন করে নিবে। আর যদি এই পরিবর্তনকরার মাঝে কিছু পেশাব গায়ে বা কাপড়ে লাগে, অথবা পরিবর্তন করার কোন সুযোগ না থাকে, তাহলে ঐ অবস্থাতেই সেই নামায পড়ে নিবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই নামায ত্যাগ করা যাবেনা।
(৫) আর একটা মাসয়ালা হলো, এই রকম যাদের পেশাব পড়া রোগ, সে প্রত্যেক ওয়াক্তের নামাযের আগে নতুন করে ওযু করে নিবে, কারণ তার জন্য এক ওযুতে দুই ওয়াক্তের নামায হবেনা। একবার ওযু করে শুধু এক ওয়াক্তের ফরয, সুন্নত, নফল সবগুলো নামায পড়তে পারবে। কিন্তু নতুন ওয়াক্তের নামাযের জন্য নতুন করে ওযু করে নিতে হবে।
সর্বশেষঃ উপরের লেখাগুলোতে আমি চেষ্টা করেছি এটা বুঝানোর জন্যে যে, এ ধরনের রোগের ক্ষেত্রে সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করতে হবে, নাপাকী থেকে মুক্ত থাকার জন্য। কিন্তু যেটা ক্ষমতার বাইরে থাকবে, বা যেটা করা খুব কষ্টকর হয়ে যাবে, সেই ব্যপারে আল্লাহ হচ্ছেন অত্যন্ত ক্ষমাশীল। কারণ, আল্লাহ তাআ’লা বলেছেন, “আর আল্লাহ বান্দাদের জন্য সহজ করতে চান, তিনি কঠিন করতে চান না।”
“আল্লাহ সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা কারো উপর চাপিয়ে দেন না।”

____________________________________
গোসল ফরয হওয়ার কারণ সমূহ
(১) জাগ্রত অথবা নিদ্রা অবস্থায় উত্তেজনার সাথে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে বীর্যপাত হওয়া। নিদ্রা অবস্থায় উত্তেজনার অনুভব না হলেও গোসল করা ফরয হবে। কেননা, নিদ্রা অবস্থায় স্বপ্নদোষ হলে মানুষ অনেক সময় তা বুঝতে পারে না।
(২) স্ত্রী সহবাস। সহবাসের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর লজ্জাস্থান একত্রিত হলেই গোসল করা ফরয হয়ে যাবে, স্বামী অথবা স্ত্রীর বীর্যপাত হোক বা নাহোক।
(৩) নারীদের ঋতু বা নেফাস (সন্তান প্রসবের পরের রক্তস্রাব) হওয়া। ঋতুবতী নারীর রক্তস্রাব বন্ধ হলে, গোসল করে তাকে পবিত্রতা অর্জন করতে হবে। এই গোসল ফরয গোসলের অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইস্তেহাজা (অসুস্থতার কারণে রক্তপাত) বিশিষ্ট নারীকে নির্দেশ দিয়েছেন, ঋতুর নির্দিষ্ট দিনসমূহ সে নামায-রোযা থেকে বিরত থাকবে, তারপরে গোসল করবে। নেফাস থেকে পবিত্র হওয়ার ক্ষেত্রেও একই বিধান। তার উপরও গোসল করা ফরয। হায়েয ও নেফাস থেকে গোসল করার পদ্ধতি ‘জানাবাত’ বা নাপাকী থেকে ফরয গোসল করার পদ্ধতির অনুরূপ। ঋতুবতী নারীর পবিত্রতার জন্য ফরয গোসলের জন্য বড়ই পাতা ব্যবহার করা মুস্তাহাব। এতে অধিক পরিস্কার ও পবিত্র হওয়া যায়। বরই পাতার পরিবর্তে সাবান বা শ্যম্পু ব্যবহার করলেও হবে।
(৪) হস্তমৈথুন দ্বারা বা ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্ট যৌন উত্তেজনার কারণে বীর্যপাত হলেও গোসল করা ফরয হয়ে যাবে। উল্লেখ্য হস্তমৈথুন করা হারাম ও কবীরা গুনাহ।
(৫) যৌন উত্তেজনার কারণে মজি (পানির মত পাতলা বীর্যরস, যা অল্প পরিমানে বের হয়, কিন্তু উত্তেজনা হ্রাস হয়না), বের হলে ওযু ভাংবে, কিন্তু গোসল ফরয হবেনা। কারো মজি বের হলে, সে নামাযের আগে লজ্জাস্থান ধৌত করে ওযু করে নামায পড়বে। আর যদি কাপড়ে মজি লাগে আর ভেজা থাকে তাহলে যে জায়গায় লাগে ঐ জায়গা পানি দিয়ে ধুয়ে নেবে। ধৌত করা সম্ভব না হলে হালকা পানি ছিটিয়ে দিবে। আর উত্তেজনার সাথে মজী যা ঘন আঠালো সাদা বীর্য বের হলে গোসল দুটোই ফরয হয়।
____________________________________
সুন্নাহ অনুযায়ী ফরয গোসল করার পদ্ধতি
গোসল করার পরিপূর্ণ পদ্ধতি হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে গোসল করেছেন ঠিক সেইভাবে গোসল করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেইভাবে গোসল করেছেনঃ
(১) পবিত্রতা অর্জনের জন্য প্রথমে গোসল করার “নিয়ত” করে নিতে হবে। এরজন্য কোনো দুয়া পড়তে হবেনা বা মুখে কিছু বলতে হবেনা। শুধু গোসল শুরু করার পূর্বে ‘আমি পবিত্রতা অর্জন করার জন্য গোসল করছি’, এই বিষয়টা অন্তরে খেয়াল থাকলেই হবে।
(২) “বিসমিল্লাহ” বলে শুরু করতে হবে। ওযু বা গোসলের পূর্বে বিসমিল্লাহ বলে শুরু করা কিছু আলেমের মতে সুন্নত, অনেক আলেমের মতে ফরয। তাই সবসময় চেষ্টা করতে শুরুতে বিসমিল্লাহ বলেই ওযু/গোসল শুরু করার জন্য। আর বাথরুমে ওযু করলেও বিসমিল্লাহ বলবে। উল্লেখ্য, শুধু “বিসমিল্লাহ” বলাই সুন্নত, বিসমিল্লাহ-হির রাহমানীর রাহীম – পুরোটা নয়।
(৩) প্রথমে দুই হাত কব্জি পর্যন্ত দুই অথবা তিনবার ধৌত করতে হবে। দুই হাত কবজি পর্যন্ত না ধুয়ে পানির পাত্রের ভেতরে হাত দেওয়া যাবেনা।
(৪) তারপর নাপাকী সংশ্লিষ্ট স্থান এবং লজ্জাস্থান বাঁ হাতে দিয়ে পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে।
(৫) এরপর বাঁ হাত মাটিতে ঘষে অথবা সাবান দিয়ে পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে।
(৬) এরপর নামাযের মতো পরিপূর্ণ পদ্ধতি অনুযায়ী ওযু করে নিবে। যেহেতু আমাদের প্রচলিত বাথরুমগুলো পরিষ্কার থাকে, তাই পূর্ণাংগ ওযু করে নিবে, ওযুর সর্বশেষ পাও ধুয়ে নিবে। কিন্তু গোসল করার জায়গাটা যদি মাটির হয় বা এমন ময়লা থাকে যাতে করে গোসল করার সময় পায়ে ময়লা লাগে, তাহলে এই ওযুর সময় পা ধৌত করবেনা। গোসলের শেষে পায়ে পানি ঢেলে পা ধুবে। ওযু করার সঠিক নিয়ম ওযু অধ্যায়ে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।
উপরোক্ত নিয়মে গোসল করে নামায পড়তে চাইলে পুনরায় ওযু করতে হবেনা, যদিনা গোসলের সময় ওযু ভংগের কোনো কারণ ঘটে থাকে। গোসল করার মাঝখানে যদি ওযু ভংগের কারণ ঘটে তাহলে গোসলের পর নামায পড়তে চাইলে আবার ওযু করতে হবে। গোসলের সময় খেয়াল রাখতে হবে, গোসলের জন্য ওযু করার পরে কোনো কিছুর আড়াল ব্যতীত লজ্জাস্থান স্পর্শ করা যাবেনা। কারণ অনেক আলেমদের ফতোয়া হচ্ছে, লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে ওযু ভেঙ্গে যায়। যদিও অনেক আলেম কামনা ছাড়া এমনি লজ্জাস্থান স্পর্শ করাকে ওযু ভংগের কারণ মনে করেন না, তবে নিরাপদ হচ্ছে আলেমদের মাঝে এই মতবিরোধে না গিয়ে এমনভাবে গোসল করা, যাতে করে ওযু করার পরে আর লজ্জাস্থান স্পর্শ করতে নাহয়। গোসলের পরে কাপড় চেঞ্জ করলে বা হাঁটুর উপরে কাপড় উঠে গেলে ওযু ভাংবেনা, এটা ওযু ভংগের কোন কারণ নয়।
উৎসঃ সহীহ বুখারীঃ ১, ১৬৮, ২৪৩, ২৪৮, ২৫৭, ২৬৬, ২৮০। সহীহ মুসলিমঃ ৬২৫, ৬৩১, ৬৫০, ৬৫৬, ৬৭০, ৬৭৩। নাসায়ীঃ ৪২২, ইবনে মাজাহঃ ৬৩৭, আবু দাউদঃ ২৪৩।
____________________________________

ওযু করার সুন্নতী পদ্ধতি
(১) প্রথমে পবিত্রতা অর্জনের জন্য অন্তরে নিয়ত করতে হবে। এরজন্য কোনো দুয়া পড়তে হবেনা বা, মুখে কোনো কিছু বলতে হবেনা। নিয়ত অর্থ হচ্ছে কোন কাজ করতে ইচ্ছা করা বা সংকল্প করা। “আমি পবিত্রতা অর্জন করার জন্য ওযু করছি”, অন্তরে শুধুমাত্র এই ধারণাটুকু বা ইচ্ছা থাকলেই নিয়ত করা হয়ে যাবে। প্রত্যেক কাজের শুরুতে নিয়ত করা “ফরয”। সহীহ বুখারীঃ ১। নিয়তের জন্য নাওয়াইতু…মুখে উচ্চারণ করে এমন দুয়া পড়া বেদাত, সুতরাং সেটা করা যাবেনা।
(২) অতঃপর “বিসমিল্লাহ” বলে ওযু করা শুরু করতে হবে। ওযু বা গোসলের পূর্বে বিসমিল্লাহ বলে শুরু করা কিছু আলেমের মতে সুন্নত, অনেক আলেমের মতে ফরয। তাই সবসময় চেষ্টা করতে অবশ্যই শুরুতে বিসমিল্লাহ বলেই ওযু/গোসল শুরু করার জন্য। আর বাথরুমে ওযু করলেও বিসমিল্লাহ বলবে। আবু দাউদঃ ১০১, তিরমিযীঃ ২৫। উল্লেখ্য, শুধু “বিসমিল্লাহ” বলাই সুন্নত, বিসমিল্লাহ-হির রাহমানীর রাহীম – পুরোটা নয়।
(৩) ডান হাতে পানি নিয়ে দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত তিনবার ধৌত করতে হবে। এসময় হাতের আংগুলগুলো খিলাল করতে হবে। আবু দাউদ, মিশকাতঃ ৪০১, নাসায়ী মিশকাতঃ ৪০৫।
এসময় হাতে আংটি থাকলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সেটা নাড়িয়ে ধৌত করতেন। ফিকহুস সুন্নাহঃ ১/৬১। উল্লেখ্য, হাত কব্জি পর্যন্ত না ধোয়া পর্যন্ত ওযুর পানিতে হাত দেয়া যাবেনা। কারণ ঘুমের সময় তার হাত কোথায় ছিলো, কেউ জানেনা। অথবা, হাতে কোনো নাপাকী থাকলে ওযুর পানিও নাপাক হয়ে যাবে। এইজন্য, কব্জি পর্যন্ত হাত না ধোয়া পর্যন্ত ওযুর পানিতে হাত দেয়া নিষিদ্ধ। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ নিদ্রা থেকে জাগ্রত হলে, সে যেন তার হাত তিনবার না ধোয়া পর্যন্ত পানিতে না ঢোকায়। কেননা তোমাদের কারো জানা নেই যে, তার হাত রাতে কোথায় পৌঁছেছিল। সুনানে নাসাঈ।
(৪) ডান হাতে এক আজলা পরিমান পানি নিয়ে অর্ধেক পানি দিয়ে কুলি করবে আর বাকি অর্ধেক পানি নাকে দিয়ে নাক পরিষ্কার করবে ও বাম হাতে নাক ঝাড়বে। এসময় ভালো করে কুলি করে মুখের সব অংশে এবং নাকের উপরের নরম অংশ পর্যন্ত পানি পৌঁছাতে হবে। অধিকাংশ মানুষ আগে কুলি করে পরে নাকে পানি দেয়, এটা ঠিকনা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ডান হাতে পানি নিয়ে অর্ধেক পানি দিয়ে কুলি আর বাকি অর্ধেক পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করতেন, অর্থাৎ কুলি করা ও নাক ধোয়া একই সাথে করতেন। আবু দাউদঃ ২৩৬৬, তিরমিযীঃ ৭৮৮।
(৫) কপালের গোড়া থেকে দুই কানের লতি পর্যন্ত ও থুতনীর নিচ পর্যন্ত সমস্ত মুখমন্ডল ধৌত করবে। বুখারী ও মুসলিম। যাদের দাড়ি ঘন, তাদের ভেজা হাতে দাড়ি খিলাল করলেই হবে। আর যাদের দাড়ি হালকা বা মুখের সাদা চামড়া দেখা গেলে পানি পৌছানো ওয়াজিব। আর নারীরা এক অঞ্জলি পানি থুতনীর নিচে দিবে, সেটাও মুখের অন্তর্ভুক্ত, তবে গলা ধৌত করবে না।
(৬) প্রথমে ডান হাত ও পরে বাম হাত কনুইসহ ধৌত করবে। হাতের আঙ্গুলের অগ্রভাগ থেকে অন্তত কনুই পর্যন্ত ধোয়া ওয়াজিব।
(৭) মাথা মাসাহ করা সঠিক নিয়মঃ ইমানের পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো “সালাত” বা নামায। অথচ, আমাদের ব্যক্তিগত উদাসীনতা, স্বল্পশিক্ষিত হুজুরের কাছে থেকে শিখা অথবা “নূরানী নামায শিক্ষা” নামক বইয়ের ভুল শিক্ষার কারণে আমাদের সালাতের মাঝে কত যে ভুল ঢুকে আছে। মাথা মাসাহ করা নিয়ে আমাদের মাঝে যে ভুল গুলো প্রচলিত সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো। প্রথম কথা হচ্ছে, মাথা মাসাহ করতে হবে একবার, তিনবার নয়। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ওযুর অংগসমূহ কখনো একবার, কখনো দুইবার আবার কখনও তিনবারও ধৌত করতেন। কিন্তু মাথা মাসাহ করতেন একবার। মিশকাতঃ ৩৯৩-৩৯৪।
দ্বিতীয়ত, মাথা মাসাহ করার সময় ঘাড় মাসাহ করা বেদাত। ইমাম আন-নববী (রহঃ) বলেন, “এ ব্যপারে হাদীস জাল ও এটা করা সুন্নত নয় বেদাত। ইমাম শওকানী নায়লুল আওতারঃ ১/১৬৩, মাজমু ফাতওয়া ১/৫৬, ইমাম ইবনে কাইয়িম যাদুল মায়া’দঃ ১/১৮৭। রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কখনোই ঘাড় মাসাহ করতেন না, তাই ঘাড় মাসাহ করা নবীর আদর্শ বিরোধী, যা নিঃসন্দেহে পরিত্যাজ্য।
তৃতীয় ভুলঃ নূরানী নামায শিক্ষা, মকসুদুল মুমিনীনসহ কিছু বইয়ে লেখা রয়েছে, মাথার চার ভাগের এক ভাগ বা তিন ভাগের এক ভাগ মাসাহ করা ফরয। এই কথার কোনো ভিত্তি নেই, বরং, রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত মাথাই মাসাহ করতেন। সুতরাং সমস্ত মাথা মাসাহ করাই ফরয।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে মাথা মাসাহ করতেনঃ তিনি সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম দুই হাতের ভেজা আংগুল দিয়ে মাথার সামনে হতে পেছনে ও পুনরায় পেছন থেকে সামনে বুলিয়ে পুরো মাথা একবার মাসাহ করতেন। একই সাথে ভেজা শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে কানের ভেতর অংশ এবং বুড়ো আংগুল দিয়ে কানের বাইরের অংশ মাসাহ করতেন। মাথায় পাগড়ি/স্কার্ফ থাকলে পাগড়ির উপরে ভেজা হাত দিয়ে সমস্ত মাথা মাসাহ করে নিতে হবে।
(৮) এরপর প্রথমে ডান পা ও পরে বাম পা টাখনুসহ ভালোভাবে ধৌত করতে হবে। বাম হাতের আংগুলগুলো দিয়ে পায়ের আঙ্গুলগুলো খিলাল করতে হবে। এসময় খেয়াল রাখতে হবে, পুরো পা যেনো ভালোভাবে ধৌত করা হয়, অনেকের পায়ের গিটের নিচে পুরো অংশ পানি দিয়ে ধৌত করা হয়না। এরকম করলে জাহান্নামে যেতে হবে, কারণ একারণে তার ওযু হয়না।
(৯) শীতকালে বা সফরে ওযু থাকা অবস্থায় মোজা পড়লে মোজা খুলে পা ধৌত করতে হবেনা, মোজার উপরে একবার মাসাহ করলেই হবে। আর চামড়া বা কাপড় যেকোনো মোজাতেই মাসাহ করা যাবে। তিরমিযী।
মোজ়ার উপরে পা মাসাহ করার নিয়মঃ দুই হাতে ভেজা আঙ্গুল পায়ের পাতা হতে টাখনু পর্যন্ত টেনে এনে একবার মাসাহ করতে হবে। মুসলিম, মিশকাতঃ ৫১৮। ডান হাত দিয়ে ডান পা ও বাম হাত দিয়ে বাম পা মাসাহ করতে হবে। ওযু এখানেই সমাপ্ত। ওযুর পরে সুন্নত হচ্ছেঃ
(১) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ওযু শেষে একটু পানি নিয়ে লজ্জাস্থান বরাবর ও তার আশেপাশের কাপড়ে হালকা পানি ছিটিয়ে দিতেন। আবু দাউদ, নাসায়ী, মিশকাত ৩৬১, সহীহঃ আলবানী।
কারণ, শয়তান মানুষকে ওয়াসওয়াসা দেয় যে, তোমার পেশাবের ফোঁটা বের হয়েছে। এই কাজ করলে এই ওয়াসওয়াসা দূর হবে।
(২) ওযু শেষে তিনটি সহীহ দুয়া রয়েছে। সেই দুয়াগুলো “দুয়া” অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
(৩) ওযুর পরে ২ রাকাত নামায পড়া। এই নামায নফল, তবে এর অনেক মর্যাদা রয়েছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার দেখানো এই পদ্ধতিতে ওযু করে মনের মধ্যে অন্য কোনো চিন্তা করা ছাড়া ২ রাকাত নামায পড়ে, ঐ ব্যক্তির আগের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। বুখারীঃ ১৫৯।
মুসলিম অন্য হাদীসে বর্ণনা করেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। মুসলিমঃ ২২৬।
উল্লেখ্যঃ এইখানে সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে ও জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে এর জন্য শর্ত হলো নামাযে নামায ছাড়া অন্য কোনো কিছু চিন্তা করা যাবেনা। তাই এই নামাযের পূর্ণ ফযীলত পেতে হলে সেইদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
____________________________________
ওযু সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়
(১) ওযুর অংগগুলো একবার, দুই বার বা তিনবার ধৌত করতে হবে। একবার ধৌত করা ফরয, সর্বোচ্চ তিনবার করা উত্তম। তবে মাথা মাসাহ বা পায়ে মোজা থাকলে পা মাসাহ একবারই করতে হবে। ওযুর অংগ তিনবারের বেশি ধৌত করা বাড়াবাড়ি, হাদীসে এই কাজের কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত ৩৯৫-৩৯৭।
(২) পানি অপচয় করা যাবেনা। টেপ ছেড়ে ওযু করা পানি অপচয়ের মধ্যে পড়বে। উচিত হচ্ছে মগে বা কোনো পাত্রে পানি নিয়ে ওযু করা। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ওযু করতেন এক মুদ বা ৬২৫ গ্রাম পানি দিয়ে (প্রায় পৌনে এক লিটার)। বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত ৪৩৯।
(৩) ওযু শেষে ভেজা অংগগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছে ফেলা জায়েজ রয়েছে। ইবনে মাজাহ ৪৬৫।
(৪) এক ওযু দিয়ে দুই ওয়াক্তের নামায পড়া জায়েজ, তবে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সবসময় নতুন করে ওযু করে নিতেন। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি একবার এক ওযু দিয়ে দুই ওয়াক্তের নামায পড়েছিলেন।
(৫) কাপড়ের মোজার উপরে মাসাহ করা জায়েজ। তিরমিযীতে এর পক্ষে সহীহ হাদীস রয়েছে। যারা বলে শুধু চামড়ার মোজার উপরে মাসাহ করা যাবে, কাপড়ের মোজ়ার উপরে করা যাবেনা, তাদের ফতোয়া সঠিক নয়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামগণ খুফ (চামড়ার মোজা) ও জাওরাবের (সুতী বা পশমী মোটা মোজার) উপরে মাসাহ করতেন। বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, মিশকাত ৫৩-৫৪।
মুকীম বা গৃহে অবস্থান করলে একদিন একরাত (২৪ঘন্টা) সফরে তিনিদিন ও তিনরাতে পর্যন্ত একবার মোজা পড়ে মাসাহ করে যাবে, এর পরে ওযু করলে মোজা খুলে ধৌত করতে হবে।
এমন জুতা, যা টাখনু ঢাকে সেটা যদি পাক থাকে আর ওযু করা অবস্থায় পড়া হয়, তাহলে তার উপরেও মাসাহ করা জায়েজ। আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাতঃ ৫২৩।
জুতার নিচে নাপাকী থাকলে তা মাটিতে ভালোভাবে ঘষে নিলে পাক হয়ে যাবে এবং ঐ জুতার উপরে মাসাহ করা চলবে। আবু দাউদ, মিশকাত ৫০৩।
(৬) শরীরে কোনো জখম বা ব্যান্ডেজ থাকলে ঐ অংশটুকুর উপরে ভেজা হাতে একবার মাসাহ করলেই হবে, ধৌত করতে হবেনা সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ ১/১৬১।
(৭) ওযুর শুরুতে প্রয়োজনীয় কথা বলতে ও সালাম দিতে বা নিতে হাদীসে কোনো নিষেধ নেই।
(৮) প্রত্যেক অংগ ধোঁয়ার সময় আলাদা আলাদ দুয়া বলতে কিছু নেই, এইগুলো বেদাত। এইগুলো না রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম পড়েছেন, না সাহাবার করেছেন না চার ইমাম থেকে কোনো বক্তব্য আছে। যাদুল মায়া’দঃ ১/৮৮।
(৯) শরীরের যেকোনো স্থান থেকে কম হোক আর বেশি হোক রক্ত বের হলে ওযু নষ্ট হবেনা। বুখারী, ২৯ পৃষ্ঠা।
(১০) কাপড় পরিবর্তন করলে বা হাটুর উপরে কাপড় উঠে গেলে ওযু ভেঙ্গে যায়না।
(১১) বমি হলে, নামাযের ভেতরে বা বাইরে উচ্চস্বরে হাসলে, মৃত ব্যক্তিকে গোসল দিলে বা বহন করলে ওযু ভেঙ্গে যায়না।

***লিখার দুর্বলতার কারণে হয়তোবা বোঝাতে পারলাম না। কারো যদি বুঝতে সমস্যা হয়, তাহলে আপনারা স্থানীয় কোন আলেমের সাথে কথা বলে বিস্তারিত জেনে নিতে পারেন ইন শা আল্লাহ। আল্লাহ আমাদের জন্য সহজ করুন, আমাদের দেহ ও মনকে পবিত্র রাখুন, আমিন।

 

>>>কৃতজ্ঞতাঃ- তোমরা তোমাদের পালনকর্তার অভিমূখী হও এবং তাঁর আজ্ঞাবহ হও<<<