নারী-পুরুষের নির্জনবাস

নারী-পুরুষের নির্জনবাস
বেগানা ([1]) নারী-পুরুষের কোন নির্জন স্থানে একাকী বাস, কিছু ক্ষণের জন্যও লোক-চক্ষুর অন্তরালে, ঘরের ভিতরে, পর্দার আড়ালে একান্তে অবস্থান শরীয়তে হারাম। যেহেতু তা ব্যভিচার না হলেও ব্যভিচারের নিকটবর্তী করে, ব্যভিচারের ভূমিকা অবতারণায় সহায়িকা হয়। আল্লাহর নবী (সাঃ) বলেন, ‘‘কোন পুরুষ যেন কোন নারীর সাথে একান্তে গোপনে অবস্থান না করে। কারণ, শয়তান উভয়ের কুটনী হয়।’’[2]

এ ব্যাপারে সমাজে অধিক শৈথিল্য পরিলক্ষিত হয় দেওর-ভাবী ও শালী-বুনাই-এর ক্ষেত্রে। অথচ এদের মাঝেই বিপর্যয় ঘটে অধিক। কারণ ‘পর চোরকে পার আছে, ঘর চোরকে পার নাই।’ তাই তো আল্লাহর নবী (সাঃ) মহিলাদের পক্ষে তাদের দেওরকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করেছেন।’’[3]

অতএব দেওরের সাথে মায়ের বাড়ি, ডাক্তারখানা, অনুরূপ বুনাই-এর সাথে বোনের বাড়ি, ডাক্তারখানা বা কোন বিলাস-বিহারে যাওয়া-আসা এক মারাত্মক বিস্ফোরক প্রথা বা ফ্যাশন।

তদনুরূপ তাদের সাথে কোন কামরা বা স্থানে নির্জনতা অবলম্বন, বাড়ির দাসী বা দাসের সাথে গৃহকর্তা বা কর্ত্রী অথবা তাদের ছেলে-মেয়ের সাথে নিভৃতবাস, বাগদত্ত বরকনের একান্তে আলাপ বা গমন, বন্ধু-বান্ধবীর একত্রে নির্জনবাস, লিফ্টে কোন বেগানা যুবক-যুবতীর একান্তে উঠা-নামা, ডাক্তার ও নার্সের একান্তে চেম্বারে অবস্থান, টিউটর ও ছাত্রীর একান্তে নির্জনবাস ও পড়াশোনা, স্বামীর অবর্তমানে কোন বেগানা আত্মীয় বা বন্ধুর সাথে নির্জনবাস, ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে বা রিক্সায় রিক্সাচালকের সাথে নির্জনে গমন, পীর ও মহিলা মুরীদের একান্তে বায়াত ও তা’লীম প্রভৃতি একই পর্যায়ের; যাদের মাঝে শয়তান কুট্নী সেজে অবৈধ বাসনা ও কামনা জাগ্রত করে কোন পাপ সংঘটিত করতে চেষ্টা করে।[4]

বারুদের নিকট আগুন রাখা হলে বিস্ফোরণ তো হতেই পারে। যেহেতু মানুষের মন বড় মন্দপ্রবণ এবং দুর্নিবার কামনা ও বাসনা মানুষকে অন্ধ ও বধির করে তোলে। তা ছাড়া নারীর মাঝে রয়েছে মনোরম কমনীয়তা, মোহনীয়তা এবং চপলতা। আর শয়তান তো মানুষকে অসৎ কাজে ফাঁসিয়ে দিয়ে আনন্দবোধ করে থাকে।

অনুরূপ কোন বেগানা মহিলার সাথে নির্জনে নামায পড়াও বৈধ নয়।[5]

তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর নিকট নিজের সন্তান দেখতে গিয়ে বা কোন কাজে গিয়ে তার সাথে নির্জনতাও অনুরূপ। কারণ, সে আর স্ত্রী নেই। আর এমন মহিলার সাথে বিপদের আশঙ্কা বেশী। শয়তান তাদেরকে তাদের পূর্বের স্মৃতিচারণ করে ফাঁসিয়ে দিতে পারে।[6]

বৃদ্ধ-বৃদ্ধার আপোসে বা তাদের সাথে যুবতী-যুবকের নির্জনবাস, কোন হিজড়ে বা খাসি করা নারী-পুরুষের আপোষে বা তাদের সাথে যুবক-যুবতীর, একাধিক মহিলার সাথে কোন একটি যুবক অথবা একাধিক পুরুষের সাথে এক মহিলার, কোন সুশ্রী কিশোরের সাথে যুবকের নির্জনবাসও অবৈধ। প্রয়োজন হলে এবং মহিলার মাহরাম না পাওয়া গেলে কোন মহিলার জামাআতে একজন পুরুষ থেকে সফর আদি করায় অনেকের নিকট অনুমতি রয়েছে।[7]

প্রকাশ যে, মহিলার সাথে কোন নাবালক শিশু থাকলে নির্জনতা কাটে না।

ব্যভিচার থেকে সমাজকে দূরে রাখার জন্যই ইসলামে নারী-পুরুষে অবাধ মিলা-মিশা, একই অফিসে, মেসে, ক্লাশরুমে, বিয়ে ও মরা বাড়িতে, হাসপাতালে, বাজারে প্রভৃতি ক্ষেত্রে উভয় জাতির একত্রে জমায়েত অবৈধ।[8]

মুসলিম নারীর শিক্ষার অর্থ এই নয় যে, তাকে বড় ডিগ্রী, সুউচ্চ পদ, মোটা টাকার চাকুরী পেতে হবে। তার শিক্ষা জাতিগঠনের জন্য, সমাজ গড়ার জন্য, মুসলিম দেশ ও পরিবেশ গড়ার জন্য যতটুকু দরকার ততটুকু শিখতে পারলেই যথেষ্ট; যদিও তা ঘরে বসেই হয়। তা ছাড়া পৃথক গার্ল্স স্কুল-কলেজ না থাকলে মিশ্র শিক্ষাঙ্গনে মুসলিম নারীর শিক্ষায় ‘জল খেতে গিয়ে ঘটি হারিয়ে যাওয়া’র ঘটনাই অধিক ঘটে থাকে; যে সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত হওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু আদর্শ মুসলিম হওয়া যায় না। নারীর সবনির্ভরশীল হয়ে জীবন-যাপন করায় গর্ব আছে ঠিকই, কিন্তু সুখ নেই। প্রকৃতির সাথে লড়ে আল্লাহর আইনকে অবজ্ঞা করে নানান বিপত্তি ও বাধাকে উল্লংঘন করে অর্থ কামিয়ে স্বাধীনতা আনা যায় ঠিকই; কিন্তু শান্তি আনা যায় না। শান্তি আছে স্বামীর সোহাগে, স্বামীর প্রেম, ভালোবাসা ও আনুগত্যে। পরিত্যক্তা বা নিপীড়িতা হলে এবং দেখার কেউ না থাকলে মুসলিম রাষ্ট্র ও সমাজে তার কালাতিপাত করার যথেষ্ট সহজ উপায় আছে। যেখানে নেই সেখানকার কথা বিরল। অবশ্য দ্বীন ও দুনিয়ার প্রকৃত মূল্যায়ন করতে পারলে এ সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে উঠবে। যারা পরকালের চিরসুখে বিশ্বাসী তারা জাগতিক কয়েকদিনের সুখ-বিলাসের জন্য দ্বীন ও ইজ্জত বিলিয়ে দেবে কেন?[9]

ব্যভিচারের প্রতি নিকটবর্তী হওয়ার আর এক পদক্ষেপ মহিলাদের একাকিনী কোথাও বাইরে যাওয়া-আসা। তাই ‘সুন্দরী চলেছে একা পথে, সঙ্গী হইলে দোষ কি তাতে?’ বলে বহু লম্পট তাদের পাল্লায় পড়ে থাকে, ধর্ষণের হাত হতে অনেকেই রক্ষা পায় না, পারে না নিজেকে ‘রিমার্ক’ ও ‘টিস্’ এর শিলাবৃষ্টি হতে বাঁচাতে। এর জন্যই তো সমাজ-বিজ্ঞানী রসূল (সাঃ) বলেন,

وَلاَ تُسَافِرُ المَرْأةُ إِلاَّ مَعَ ذِي مَحْرَمٍ.

‘‘মহিলা যেন এগানা পুরুষ ছাড়া একাকিনী সফর না করে।’’ (বুখারী ৫২৩৩, মুসলিম ১৩৪১ন)

المَرأَةُ عَورَةٌ فَإِذَا خَرَجَتِ اسْتَشْرَفَهَا الشَّيطَان.

‘‘রমণী গুপ্ত জিনিস; সুতরাং যখন সে (বাড়ি হতে) বের হয়, তখন শয়তান তাকে পুরুষের দৃষ্টিতে রমণীয় করে দেখায়।’’[10]

ব্যভিচারের কাছে যাওয়ার আর এক পদক্ষেপ কোন এমন মহিলার নিকট কোন গম্য আত্মীয় বা অন্য পুরুষের গমন যার স্বামী বর্তমানে বাড়িতে নেই, বিদেশে আছে। কারণ এমন স্ত্রীর মনে সাধারণতঃ যৌনক্ষুধা একটু তুঙ্গে থাকে, তাই বিপদ ঘটাই স্বাভাবিক। স্ত্রী বা ঐ পুরুষ যতই পরহেযগার হোক, তবুও না। এ বিষয়ে নীতি-বিজ্ঞানী (সাঃ) বলেন,

لَا تَلِجُوا عَلَى الْمُغِيبَاتِ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ يَجْرِي مِنْ أَحَدِكُمْ مَجْرَى الدَّمِ.

‘‘তোমরা সেই মহিলাদের নিকট গমন করো না যাদের স্বামীরা বিদেশে আছে। কারণ, শয়তান তোমাদের রক্তশিরায় প্রবাহিত হয়।’’[11]

সাহাবী (রাঃ) বলেন, ‘‘আল্লাহর নবী (সাঃ) আমাদেরকে নিষেধ করেছেন যে, আমরা যেন মহিলাদের নিকট তাদের স্বামীদের বিনা অনুমতিতে গমন না করি।’’[12]

অনুরূপ কোন প্রকার সেন্ট বা পারফিউমড্ ক্রিম অথবা পাওডার ব্যবহার করে বাইরে পুরুষদের সম্মুখে (পর্দার সাথে হলেও) যাওয়া ব্যভিচারের নিকটবর্তী হওয়ার এক ভূমিকা। যেহেতু যুবকের প্রবৃত্তি এই যে, মহিলার নিকট হতে সুগন্ধ পেলে তার যৌন-চেতনা উত্তেজনায় পরিণত হয়। যার জন্যই সংস্কারক নবী (সাঃ) বলেন,

كُلُّ عَيْنٍ زَانِيَةٌ وَالْمَرْأَةُ إِذَا اسْتَعْطَرَتْ فَمَرَّتْ بِالْمَجْلِسِ فَهِيَ كَذَا وَكَذَا يَعْنِي زَانِيَةً.

‘‘প্রত্যেক চক্ষুই ব্যভিচারী। আর রমণী যদি সুগন্ধি ব্যবহার করে কোন (পুরুষের) মজলিসের পাশ দিয়ে পার হয়ে যায় তাহলে সে এক বেশ্যা।’’[13]

এমন কি এই অবস্থায় নামাযের জন্য যেতেও নিষিদ্ধ।[14]

প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,

أَيُّمَا امْرَأَة تَطَيَّبَت ثُمَّ خَرَجَت إِلَى المسجِدِ لَم تُقبَل لهَا صَلاَةٌ حَتى تَغتَسِل.

‘‘যে মহিলা সেন্ট্ ব্যবহার করে মসজিদে যায়, সেই মহিলার গোসল না করা পর্যন্ত কোন নামায কবুল হবে না।’’ (সহীহ আল-জা-মিউস সাগীর অযিয়াদাতুহ ২৭০৩নং)

কোন গম্য পুরুষের সাথে মহিলার প্রগল্ভতার সাথে কিংবা মোহনীয় কণ্ঠে সংলাপ ও কথোপকথন করাও ব্যভিচারের নিকটবর্তীকারী পথসমূহের অন্যতম ছিদ্রপথ। এ বিপজ্জনক বিষয়ে সাবধান করে আল্লাহ তা’আলা মহিলাদের উদ্দেশ্যে বলেন,

﴿إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ﴾

‘‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তবে পরপুরুষদের সাথে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না, যাতে ব্যাধিগ্রস্ত অন্তরের মানুষ প্রলুব্ধ হয়।’’[15]

এই জন্যই ইমাম ভুল করলে পুরুষ মুক্তাদীরা তসবীহ বলে স্মরণ করাবে, আর মহিলারা হাততালির শব্দে, তসবীহ বলেও নয়! যাতে নারীর কণ্ঠসবরে কতক পুরুষের মনে যৌনানুভূতি জাগ্রত না হয়ে উঠে। সুতরাং নারী-কণ্ঠের গান তথা অশ্লীল গান যে কি, তা রুচিশীল মানুষদের নিকট সহজে অনুমেয়।

এমন বহু হতভাগী মহিলা আছে, যারা স্বামীর সাথে কর্কশসবরে কথা বলে কিন্তু কোন উপহাসের পাত্রের (?) সাথে মোহন-সূরে সংলাপ ও উপহাস করে। এরা নিশ্চয়ই পরকালেও হতভাগী।

তদনুরূপ বেগানা নারীর সাথে মুসাফাহা বৈধ নয়। হাতে মোজা, দস্তানা বা কাপড়ের কভার রেখেও নয়। কামমনে হলে তা হাতের ব্যভিচার।[16]

করতল চেপে ধরা এবং সুরসুরি দেওয়াও হল তার ইঙ্গিত! কোন গম্য নারীর দেহ স্পর্শ, বাসে-ট্রেনে, হাটে-বাজারে, স্কুলে-কলেজে প্রভৃতি ক্ষেত্রে গায়ে গা লাগিয়ে চলা বা বসা, নারী-পুরুষের ম্যাচ খেলা ও দেখা প্রভৃতি ইসলামে হারাম। কারণ, এ সবগুলিও অবৈধ যৌনাচারের সহায়ক। সমাজ সংস্কারক নবী (সাঃ) বলেন,

لأَنْ يُطْعَنَ فِي رَأْسِ رَجُلٍ بِمِخْيَطٍ مِنْ حَدِيدٍ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَمَسَّ امْرَأَةً لا تَحِلُّ لَهُ.

‘‘কোন ব্যক্তির মাথায় লৌহ সুচ দ্বারা খোঁচা যাওয়া ভালো, তবুও যে নারী তার জন্য অবৈধ তাকে স্পর্শ করা ভালো নয়।’’[17]

বাইরে বের হয়ে রমণীর রমণীয়, মোহনীয় ও সৌন্দর্য-গর্বজনক চপল মধুর চলনও ব্যভিচার ও যৌন উত্তেজনার সহায়ক কর্ম। এরা সেই নারী যাদের প্রসঙ্গে নবী (সাঃ) বলেছেন, ‘‘তারা পুরুষকে আকৃষ্ট করে এবং নিজেরাও আকৃষ্ট হয়; তারা জাহান্নামী।’’ [18]

অনুরূপ খট্খট্ শব্দবিশিষ্ট জুতো নিয়ে চট্পটে চলন, দেহের অলঙ্কার যেমন চুড়ি, খুঁটকাটি, নুপুর, তোরা প্রভৃতির বাজনা বাজিয়ে লাস্যময় চলনও যুবকের মনে যৌন-আন্দোলন আনে। সুতরাং এ কর্ম যে হারাম তা বলাই বাহুল্য। আল্লাহ তা’আলা বলেন,

﴿وَلاَ يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِنْ زِينَتِهِنَّ﴾

‘‘তারা যেন তাদের গোপন আভরণ প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে—-।’’[19]

যেমন পথে চলার সময় পথের মাঝে চলা নারীর জন্য বৈধ নয়।[20]

মহিলাদের জন্য সবগৃহে গোসলখানা (বাথরুম) করা ওয়াজেব (সিমেন্টের হওয়া জরুরী নয়) এবং ফাঁকা পুকুরে, নদীতে, ঝর্ণায়, সমুদ্রতীরে বা সাধারণ গোসলখানায় গোসল করা তাদের জন্য হারাম। যেহেতু সমাজ-বিজ্ঞানী নবী (সাঃ) বলেছেন,

أَيُّمَا امْرَأَةٍ وَضَعَتْ ثِيَابَهَا فِي غَيْرِ بَيْتِهَا فَقَدْ هَتَكَتْ مَا بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ أَوْ سِتْرَ مَا بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ.

‘‘যে নারী সবগৃহ ( স্বামীগৃহ বা মায়ের বাড়ি) ছাড়া অন্য স্থানে নিজের পর্দা রাখে (কাপড় খোলে) আল্লাহ তার পর্দা ও লজ্জাশীলতাকে বিদীর্ণ করে দেন। (অথবা সে নিজে করে দেয়।)[21]

مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلَا يُدْخِلْ حَلِيلَتَهُ الْحَمَّامَ.

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহতে ও পরকালে বিশ্বাস রাখে সে যেন তার স্ত্রীকে সাধারণ গোসলখানায় যেতে না দেয়।’’[22]

সবগৃহ ছেড়ে পরকীয় গৃহে বাস, বান্ধবী বা বান্ধবীর স্বামীর বাড়িতে রাত্রিবাস ইত্যাদিও বিপজ্জনক ব্যভিচারের ছিদ্রপথ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে মহিলা নিজের স্বামীগৃহ ছাড়া অন্য গৃহে নিজের কাপড় খোলে সে আল্লাহ আয্যা অজাল্লা ও তার নিজের মাঝে পর্দা বিদীর্ণ করে ফেলে।’’[23]

একই কারণে অপরের লজ্জাস্থান (নাভি হতে হাঁটু পর্যন্ত স্থান) দেখা এবং একই কাপড়ে পুরুষে-পুরুষে বা মহিলায়-মহিলায় শয়ন করাও নিষিদ্ধ।[24]

পর পুরুষের দৃষ্টিতে মহিলার সর্বশরীর লজ্জাস্থান। বিশেষ করে চক্ষু এমন এক অঙ্গ যার দ্বারা বিপত্তির সূচনা হয়। চোখাচোখি থেকে শুরু হয়, কিন্তু শেষ হয় গলাগলিতে। এই ছোট্ট অঙ্গার টুকরা থেকেই সূত্রপাত হয় সর্বগ্রাসী বড় অগ্নিকান্ডের। দৃষ্টির কথাই কবি বলেন,

‘‘আঁখি ও তো আঁখি নহে, বাঁকা ছুরি গো

কে জানে সে কার মন করে চুরি গো!’’

প্রেম জগতে চক্ষু কথা ব’লে এমন বিষয় বুঝিয়ে থাকে যা জিহ্বা প্রকাশ করতে অক্ষম। চোখের কোণেই আছে যাদুর রেখা।

‘‘নয়না এখানে যাদু জানে সখা এক আঁখি ইশারায়

লক্ষ যুগের মহা-তপস্যা কোথায় উবিয়া যায়!’’

‘নজরবান’ মেরে অনেকে অনেককে ঘায়েল করে থাকে। চোরা চাহনিতে অনেকেই বুঝিয়ে থাকে গোপন প্রণয়ের সূক্ষ্ম ইঙ্গিত।

‘‘–গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি; ছল করে দেখা অনুখন,

–চপল মেয়ের ভালোবাসা তার কাঁকন চুড়ির কন্কন্।’’

সুতরাং এ দৃষ্টি বড় সাংঘাতিক বিপত্তি। যার জন্যই আল্লাহপাক বলেন,

﴿قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ- وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ﴾

‘‘মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে (নজর ঝুকিয়ে চলে) এবং তাদের যৌনাঙ্গকে সাবধানে সংযত রাখে; এটিই তাদের জন্য উত্তম। ওরা যা করে, আল্লাহ সে বিষয়ে অবহিত। আর মুমিন নারীদেরকে বল, তারাও যেন নিজেদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে ও লজ্জাস্থান সংরক্ষা করে—।’’[25]

প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, ‘‘(কোন রমণীর উপর তোমার দৃষ্টি পড়লে তার প্রতি) বারবার দৃক্পাত করো না। বরং নজর সত্বর ফিরিয়ে নিও।’’[26]

যেহেতু ‘‘চক্ষুও ব্যভিচার করে এবং তার ব্যভিচার হল (কাম)দৃষ্টি।’’[27]

সুতরাং এ দৃষ্টিকে ছবি থেকেও সংযত করতে হবে এবং পরপুরুষ থেকে আড়ালে রাখতে হবে। যাতে একহাতে তালি নিশ্চয়ই বাজবে না। আর এই বড় বিপদ সৃষ্টিকারী অঙ্গ চোখটি থাকে চেহারায়। চোখাচোখি যাতে না হয়, তাই তো নারীর জন্য জরুরী তার চেহারাকেও গোপন করা।

অত্যন্ত সখীত্বের খাতিরে হলেও বিনা পর্দায় সখীতে-সখীতে দৃঢ় আলিঙ্গন ও একে অপরকে নিজ নিজ সৌন্দর্য প্রদর্শন করা বৈধ নয়। কারণ এতে সাধারণতঃ প্রত্যেক সখী তার সখীর দেহ-সৌষ্ঠব নিজের স্বামীর নিকট বর্ণনা করলে স্বামী মনের পর্দায় তার স্ত্রীর ঐ সখীর বিলক্ষণ রূপ-দৃশ্য নিয়ে মনোতৃপ্তি লাভ করে থাকে।[28] হয়তো বা মনের অলক্ষ্যেই এই পুরুষ তার হৃদয়ের কোন কোণে ঐ মহিলার জন্য আসন পেতে দেয়। আর পরবর্তীতে তাকে দেখার ও কাছে পাওয়ার মত বাসনাও জাগ্রত করে তোলে।

নোংরা পত্র-পত্রিকা পাঠ, অশ্লীল ছায়াছবি ও থিয়েটার-যাত্রা দর্শনও একই পর্যায়ের; যাতে ধবংস হয় তরুণ-তরুণীর চরিত্র, নোংরা হয়ে উঠে পরিবেশ।

স্বামী-স্ত্রীর মিলন-রহস্য প্রভৃতি জানার জন্য সঠিক সময় হল বিবাহের পর অথবা বিবাহের পাকা দিন হওয়ার পর। নচেৎ এর পূর্বে রতি বা কামশাস্ত্র পাঠ করে বিবাহে দেরী হলে মিলনতৃষ্ণা যে পর্যায়ে পৌঁছায় তাতে বিপত্তি যে কোন সময়ে ঘটতে পারে।

কারো রূপ, দ্বীনদারী প্রভৃতির প্রশংসা শুনে তাকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলা দূষণীয় নয়। তাকে পেতে বৈধ উপায় প্রয়োগ করা এবং বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ করে সুখের সংসার গড়া উত্তম। কিন্তু অবৈধভাবে তাকে দেখা, পাওয়া, তার কথা শোনা ও তার সান্নিধ্যলাভের চেষ্টা করা অবশ্যই সীমালংঘন। অবৈধ বন্ধুত্ব ও প্রণয়ে পড়ে টেলিফোনে সংলাপ ও সাক্ষাৎ প্রভৃতি ইসলামে হারাম।

যুবক-যুবতীর ঐ গুপ্ত ভালোবাসা তো কেবল কিছু দৈহিক সুখ লুটার জন্য। যার শুরুতেও চক্ষে অশ্রু ঝরে এবং শেষেও। তবে শুরুতে ঝরে আনন্দাশ্রু, আর শেষে উপেক্ষা ও লাঞ্ছনার। কারণ, ‘কপট প্রেম লুকোচুরি, মুখে মধু, হূদে ছুরি’ই অধিকাংশ হয়। এতে তরুণী বুঝতে পারে না যে, প্রেমিক তার নিকট থেকে যৌনতৃপ্তি লাভ ক’রে তাকে বিনষ্ট ক’রে চুইংগামের মত মিষ্টতা চুষে নিয়ে শেষে আঠাল পদার্থটিকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।

‘‘বন্ধু গো যেও ভুলে-

প্রভাতে যে হবে বাসি, সন্ধ্যায় রেখো না সে ফুল তুলে।

উপবনে ত্ব ফোটে যে গোলাপ প্রভাতেই তুমি জাগি,

জানি, তার কাছে যাও শুধু তার গন্ধ-সুষমা লাগি।’’

সুতরাং এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিৎ মুসলিম তরুণীকে এবং তার অভিভাবককেও। কারণ, ‘বালির বাঁধ, শঠের প্রীতি, এ দুয়ের একই রীতি।’

([1]) যাদের সহিত চিরতরের জন্য বিবাহ অবৈধ তাদেরকেই মাহরাম, অগম্য বা এগানা এবং এছাড়া অন্যান্য সকলকে গায়র মাহরাম, গম্য বা বেগানা বলা হয়। [2] (তিরমিযী, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩১১৮নং) [3] (বুখারী, মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩১০২নং) [4] (ইলা রাববাতিল খুদূর, আবু আনাস আলী ৩৫পৃঃ, তামবীহাতুল মু’মিনাত, সালেহ আল ফাউযান ১৬৭-১৬৮ পৃঃ) [5] (জামিউ আহকামিন নিসা, মুস্তাফা আল আদাবী ১/৩৬০) [6] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ২৮/২৭০) [7] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ২৮/২৪৫-২৭০) [8] (ইলা রাববাতিল খুদূর ৪১-৪২পৃঃ) [9] (রাকানি ৩১পৃঃ, খামসূনা যুহরাহ মিন হাক্বলিন নুস্হ, আব্দুল আযীয আলমুকবিল১৬পৃঃ) [10] (সহীহ তিরমিযী ৯৩৬নং) [11] (সহীহ তিরমিযী ৯৩৫নং, সহীহ ইবনে মাজাহ, আল্লামা আলবানী ১৭৭৯নং) [12] (সহীহ তিরমিযী ২২৩০নং) [13] (সহীহ তিরমিযী, আল্লামা আলবানী ২২৩৭নং) [14] (সহীহ আল-জা-মিউস সাগীর অযিয়াদাতুহ, আল্লামা আলবানী ২৭০২নং) [15] (সূরা আল-আহযাব (৩৩) : ৩২) [16] (সহীহ আল-জা-মিউস সাগীর অযিয়াদাতুহ ৪১২৬নং) [17] (আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ, আলবানী ২২৬ নং) [18] (মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩৫২৪নং, ফামু ১৯-২০পৃঃ) [19] (সূরা আন-নূর (২৪) : ৩১) [20] (আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ৮৫৬নং) [21] (সহীহ আল-জা-মিউস সাগীর অযিয়াদাতুহ ২৭০৮নং, আদাবুয যিফাফ, শায়খ আলবানী ১৩৯পৃঃ) [22] (হাকেম, মুস্তাদরাক, মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী, নাসাঈ, আদাবুয যিফাফ ১৩৯পৃঃ) [23] (সহীহ আল-জা-মিউস সাগীর অযিয়াদাতুহ ২৭১০নং) [24] (সহীহ তিরমিযী ২২৪৩নং) [25] (সূরা আন-নূর (২৪) : ৩০-৩১) [26] (সহীহ তিরমিযী ২২২৮, ২২২৯নং) [27] (বুখারী, মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ৮৬নং) [28] (সহীহ তিরমিযী ২২৪৩নং)