নারীদের চুলে সিঁথি করার হুকুম

প্রশ্ন: নারীদের চুলে সিঁথি করার হুকুম কি? মাথার একপাশে কিংবা বাঁকা করে সিঁথি করা যাবে কি?
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: সিঁথি চুলের একটি সৌন্দর্য। চুলে সিঁথি করা রাসূল (ﷺ) থেকে প্রমাণিত সুন্নাহ। রাসূল (ﷺ) সবসময় মাথার চুল গুছিয়ে রাখতেন।তিনি কখনো মাথার মাঝখানে সিঁথি করতেন, কখনো বা চুল ছেড়ে রাখতেন। এমনকি রাসূল (ﷺ) বলেছেন, مَنْ كَانَ لَهُ شَعْرٌ فَلْيُكْرِمْهُ “যে ব্যক্তির চুল আছে,সে যেন তার যত্ন করে।(আবু দাউদ হা/৪১৬৫)। রাসূল (ﷺ) এর স্ত্রী উম্মাহাতুল মুমিনীনরাও চুলে সিঁথি করেছেন। সাহাবীদের কেউ কেউ সিঁথি করতেন, কেউ কেউ সিঁথি করতেন না। উম্মাহর পরবর্তী মুসলিমরাও এ আমলটি করেছেন। অতএব ইসলামে এটি একটি প্রমাণিত মুস্তাহাব আমল। সুতরাং রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহর অনুসরণে মুসলিম নারী-পুরুষদেরও চুলে সিঁথি করে আঁচড়িয়ে সুন্দরভাবে রাখা উচিৎ। বিশেষ করে সিঁথি নারীদের চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। মাথা ও চুল পরিস্কার রাখে। তাই তাদের জন্য সিঁথি করা উত্তম। আর স্বামী যদি স্ত্রীকে সিঁথি করার জন্য আদেশ করে তাহলে স্ত্রীর জন্য বৈধ আদেশ হিসেবে তা পালন করা অত্যাবশক।
.
▪️মাথার একপাশে কিংবা বাঁকা করে সিঁথি করা যাবে কি?
.
ইসলাম মানুষকে অনন্য শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কাজে নানা নিয়ম-কানুন মেনে চলার জন্য ইসলামে যেমন দিক-নির্দেশনা রয়েছে; তেমনি কাজ কর্মে হাত-পায়ের ব্যবহার সম্পর্কে ইসলামী শরীয়তের বিধান হলো, قاعدة الشريعة : تقديم اليمين في كل ما كان من باب الكرامة ، وتقديم الشمال في كل ما كان من باب المهانة ، تنبيها على تعظيم اليمين ، وتميزها ، وزيادة لشرفها .অর্থাৎ ডান হাতকে কেবল সম্মানিত জিনিসগুলোর জন্য ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। আর বাম হাতকে এমন জিনিসগুলোর জন্য ব্যবহার করতে বলা হয়েছে, যা অশুচি বলে গণ্য। (ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৩৮৩৮২)। উক্ত মূলনীতি এবং রাসূল (ﷺ)-এর পছন্দনীয় আমল ছিল ডান দিক থেকে সিঁথি করা। সুতরাং ডান দিক থেকে চুল আঁচড়ানো শুরু করা উত্তম। এই মর্মে দলিল হচ্ছে আম্মাজান আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন; كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُعْجِبُهُ التَّيَمُّنُ فِيْ تَنَعُّلِهِ وَتَرَجُّلِهِ وَطُهُوْرِهِ وَفِيْ شَأْنِهِ كُلِّهِ ‘নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুতা পরিধান, চুল আঁচড়ানো এবং পবিত্রতা অর্জন করা তথা প্রত্যেক কাজই ডান দিক হতে আরম্ভ করতে পছন্দ করতেন।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৬৮)
.
একদল আলেমদের মতে সিঁথি মাথার মাঝখানেই করতে হবে এটা জরুরী নয়,তাদের মতে মাথার মাঝে কিংবা এক পাশে করাতে কোন দোষ নেই। কেননা এগুলো অভ্যাসগত সুন্নাত। তারা আরো বলেন, সিথি বাঁকা হোক বা সোজা হোক তাতে কোন দোষ নেই যতক্ষণ না সরাসরি কাফের-মুশরিকদের অনুকরণে করা হয়। কিন্তু যারা বলেন মাথার একপাশে সিঁথি করা জায়েজ নয়; কেননা এটি কা-ফেরদের অনুকরণ তাদের এই বক্তব্যের পক্ষে সুস্পষ্ট দলিল নেই। কারণ ইহুাহুদি-খ্রিস্টানরা এমনটা করেছেন বলেও আমাদের জানা নেই। কাতার ভিত্তিক বিখ্যাত ওয়েবসাইট ইসলাম ওয়েবের আলেমগন বলেন; وفرق الرأس من جانب لا يعتبر تشبها باليهود بل ثبت أن أهل الكتاب من اليهود والنصارى في زمنه صلى الله عليه وسلم كانوا يرسلون شعورهم ولا يفرقونها، অর্থাৎ চুল একপাশে পৃথক/সিঁথি করাটা ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হিসেবে গণ্য হবে না। বরং এটা প্রমানিত যে রাসূল (ﷺ)-এর সময়ে আহলে কিতাব, ইহুদি-খ্রিস্টা-নরা তাদের চুল নামিয়ে রাখত কিন্তু পার্থক্য করত না। (ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং-৫০১৮৩)। অতঃপর তারা দলিল হিসেবে উল্লেখ করেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীস। তিনি বলেন, আহলে কিতাব সম্প্রদায় তাদের মাথার চুল পিছনের দিকে ছেড়ে দিতো এবং মুশরিকরাা মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি কাটতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত) কিতাবীদের সাথে সামঞ্জস্য পছন্দ করতেন। রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাঁর মাথার সামনের দিকের চুল স্ব-অবস্থায় পিছনের দিকে ছেড়ে দিতেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে সিঁথি কাটতেন। (সহীহ বুখারী হা/৫৯১৭, সহীহ মুসলিম হা/২৩৩৬-৯০, আবু দাঊদ হা/৪১৮৮, ইবনু মাজাহ হা/৩৬৩২, মুসনাদে আহমাদ হা/২৩৬৪)
.
উক্ত হাদীসের আলোকে শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, ‘উলামায়ে কিরাম বলেন; চুলের ক্ষেত্রে ‘সাদল’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, চুলকে কপালের উপর ছেড়ে দেয়া এবং তাকে বাটির মতো বানিয়ে ফেলা। আর ‘ফারক’ তথা সিঁথি হলো চুলকে একে অপর থেকে পৃথক করা। কেউ কেউ বলেন, ‘সাদল’ হচ্ছে, চুলকে দ্বিখন্ড- বণ্টন না করে পিছন দিকে ছেড়ে দেয়া। আর ‘ফারক’ বা সিঁথি হলো তাকে দ্বিখন্ড- ভাগ করা। (فَسَدَلَ النَّبِىُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَاصِيَتَهٗ)। তাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুলে ‘সাদল’ করতেন। অর্থাৎ মদীনায় এসে আহলে কিতাবদের সাথে ঐকমত্য পোষণ করতে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাদ্ল করেন। (ثُمَّ فَرَّقَ بَعْدُ) এরপর সিঁথি করেন। অর্থাৎ মদীনার আসার পর কিছুকাল যাওয়ার পর সিঁথি করেন। ইবনুল মালিক বলেন; জিবরীল (আ:) এসে রাসূল (ﷺ) সিঁথি করার নির্দেশ দেন। তাই তিনি সিঁথি করেন এবং মুসলিমরাও তাদের মাথা সিঁথি করতেন। সুতরাং সহীহ ও গ্রহনযোগ্য বক্তব্য হলো; جَوَاز السَّدْل وَالْفَرْق ، وَأَنَّ الْفَرْق أَفْضَل চুল ঝুলিয়ে রাখা এবং সিঁথি কাটা উভয়টি জায়েজ। তবে সিঁথি কাটা উত্তম/মুস্তাহাব। (নববী শরহে সহিহ মুসলিম; খন্ড: ১৫ পৃষ্ঠা: ৯০ হা/২৩৩৬)
.
উল্লেখ্য যে, চুলে ‘সাদল’ তথা সিঁথি না করে ছেড়ে দেয়া অথবা ‘ফার্ক’ তথা সিঁথি করা কোনটি শার‘ঈ দিক নির্দেশনা হিসেবে ছিল না। তাই রসূলের সিঁথির আমলের মাধ্যমে ‘সাদল’ এর হুকুম রহিত হয়ে গেছে এমন নয়। এই মর্মে ইবনে হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সাদল’ মানসূখ বা রহিত হলে সব সাহাবা বা অধিকাংশরা তা ছেড়ে সিঁথি করতেন। আর সাহাবীদের থেকে বর্ণিত যে, তাদের কেউ কেউ সিঁথি করতেন, কেউ কেউ সিঁথি করতেন না। অথচ কেউ কাউকে দোষারোপ করতেন না। আর সহীহ বর্ণনায় রয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চুল বাবরী ছিল, তাতে সিঁথি হলে তিনি তা সিঁথি করতেন, না হলে ছেড়ে দিতেন। فالصحيح : أن الفَرْقَ مستحبٌّ لا واجب ، وهذا الذي اختاره مالك ، وهو قول جُلِّ أهل المذاهب অতএব বিশুদ্ধ মত হলো; সিঁথি করা মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়। এটি ইমাম মালিকসহ বেশিরভাগ মাযহাবের মতামত।(ফাতহুল বারী ১০ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩৬২ হা/ ৫৯১৭)
.
অপর বর্ননায় মুজাহিদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, উম্মু হানী (রাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কায় প্রবেশ করেন তখন তাঁর মাথার চুলে চারটি বেণী ছিলো। (মুসনাদে আহমেদ হা/২৬৮৯০, তিরমিযী হা/১৭৮১, আবু দাউদ হা/৪১৯১, ইবনে মাজা হা/৩৬৩১, মুসান্নাফ ইবনু আবূ শায়বাহ্ হা/৩৬৯১৭, আল মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী হা/২০৪৮৪, সনদ বিশুদ্ধ )
.
উক্ত হাদীসের ব্যাখায় ভারতবর্ষের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, সুনানুত তিরমিযীর বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ তুহফাতুল আহওয়াযী’র সম্মানিত মুসান্নিফ (লেখক), আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান বিন আব্দুর রহীম মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, উক্ত হাদীসে শব্দ ضفائر কোন কোন বর্ননায় (غَدَائِرَ) যার অর্থ হলো, চুলের কিছু অংশকে অন্য কিছু অংশের ভিতর প্রবেশ করানো। এর মাধ্যমে চুলকে খোপা বা বেনী/সিঁথি আকারে করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো, চুলের ভিতর ময়লা বা ধুলা-বালু প্রবেশ করতে না দেয়া। (তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৫ম খন্ড, হা/১৭৮২)
.
অপর বর্ননায় আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাথায় সিঁথি কাটতাম, তাঁর মাথার মধ্যস্থল হতে সিঁথি কাটতাম এবং মাথার সম্মুখের চুল উভয় চক্ষুর মাঝামাঝি স্থান বরাবর হতে (উভয় পার্শ্বে) ছেড়ে দিতাম। (আবু দাঊদ ৪১৮৯, ইবনু মাজাহ ৩৬৩৩,মুসনাদে আহমাদ ২৬৩৫৫, মুসনাদে আবু ইয়া‘লা ৪৮১৭, মুসান্নাফ ইবনু আবু শায়বাহ্ ২৫৪৬০, শারহুস্ সুন্নাহ হা/ ৩১৮৩)। এই হাদীসটিতে আয়িশাহ্ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চুলের সিঁথির বর্ণনা দিচ্ছেন।হাদীসের শব্দ “يافوخ” যার অর্থ মাথার তালু বা চাঁদি। অর্থাৎ সিঁথির এক মাথা তালু আরেক মাথা কপাল। সিঁথিটি তালু থেকে শুরু করে দুই চোখের মাঝখানে কপাল পর্যন্ত এসে শেষ হতো। আর এই লম্বা সিঁথির দুই পাশে চুল থাকতো। একভাগ চুল সিঁথির ডান পার্শ্বে এবং আরেক ভাগ সিঁথির বাম পার্শ্বে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হা/৪১৮৫)
.
এখন আসি আহালুল আলেমগনের মধ্যে যারা নিন্মোক্ত হাদীসের আলোকে বলেন, বাঁকা করে সিঁথি করা নিষেধ। হাদীসটি হচ্ছে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; “দুই প্রকার জাহান্নামী লোক আমি (এখন পর্যন্ত) প্রত্যক্ষ করি নি। (অর্থাৎ, আমার পরে তাদের আবির্ভাব ঘটবে):

(১). এমন এক সম্প্রদায় যাদের কাছে গরুর লেজের মতো চাবুক থাকবে, যা দিয়ে তারা জনগণকে প্রহার করবে।

(২). এমন এক শ্রেণীর মহিলা, যারা (এমন নগ্ন) পোশাক পরবে যে, (বাস্তবে) উলঙ্গ থাকবে, (পর পুরুষকে) নিজেদের প্রতি আকর্ষণ করবে ও নিজেরাও (পর-পুরুষের প্রতি) আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথা হবে উটের হেলে যাওয়া কুঁজের মতো। এ ধরনের মহিলারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং তার সুগন্ধও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধ এত এত দূরত্বের পথ থেকে পাওয়া যাবে। (সহীহ মুসলিম, হা/২১২৮)
.
উক্ত হাদীসের مائلات ‘মাইলাত’ (আকৃষ্টা) শব্দের ব্যাখ্যায় কেউ কেউ মাথার একপাশে বাঁকা সিঁথি কাটার উদ্দেশ্য নিয়েছেন। আবার কেউ বলেছেন, এর অর্থ হলো- আল্লাহর আনুগত্য এবং গুপ্তাঙ্গ ও প্রবৃত্তিকে হিফাযাত করা থেকে বিচ্যুত, তারা অন্যদেরকে তাদের কর্মকান্ড শিক্ষা দেয়। আবার কেউ বলেন, مائلات এর অর্থ হচ্ছে ঘাড় ঝুকানো মহিলা। কেউ কেউ বলেন এর অর্থ পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট এবং তাদের প্রকাশিত সৌন্দর্য দ্বারা আকর্ষণকারিণী। তবে বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে, المائلات (মাইলাত)-এর দ্বারা উদ্দেশ্য, যে সব মহিলা তাদের উপর যে লজ্জাশীলতা ও দ্বীনদারিতা থাকা আবশ্যক তা থেকে সরে গিয়ে বাঁকা পথে চলে। পাশাপাশি অন্যদেরকেও বাঁকা পথে নিয়ে যায়।” উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন; হাদীসটির সাধারণ অর্থ হলো- যে সব মহিলা তাদের পোশাক-আশাক, আচার- আচরণ, কথাবার্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সঠিক পথ থেকে অন্য দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং যারা অন্যদেরকেও ভিন্ন পথে ধাবিত করে ফিতনা-ফ্যাসাদে তাদেরকে ব্যবহার করার মাধ্যমে। ফলে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা তাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার তারা তাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। (উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল পৃষ্ঠা: ১২ প্রশ্ন নং-১৮৮, উসাইমীন রিয়াদুস সালেহীনের ব্যাখ্যা: ৬/৩৭২)
.
সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণ-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল; মহিলারা তাদের চুলকে এক পার্শ্বে বেনী করে রাখতে পারবে কি? তারা এর মাধ্যমে তাদের স্বামীকে সৌন্দর্য প্রকাশ করতে পারবে কি? অথবা তাদের যে সৌন্দর্য সেটা কি প্রকাশ্য করতে পারবে?
.
জবাবে স্থায়ী কমিটির আলেমগণ বলেন,
أما عمل الرأس فرقة من الجنب ففي ذلك تشبه بنساء الكفار، وقد ثبت تحريم التشبه بالكفار عن رسول الله صلى الله عليه وسلم . وأما عمله ضفيرة واحدة أو أكثر وسدله على ظهرها مضفورا أو غير مضفور فلا حرج فيه ما دام مستورا . وأما عمله كعكعة فلا يجوز؛ لما فيه من التشبه بنساء الكفار، والتشبه بهن حرام، ولتحذير النبي صلى الله عليه وسلم عن ذلك بقوله : ” ” صنفان من أهل النار لم أرهما بعد : قوم معهم سياط كأذناب البقر يضربون بها الناس ، ونساء كاسيات عاريات مائلات مميلات، على رؤوسهن مثل أسنمة البخت المائلة ، لا يدخلن الجنة ولا يجدن ريحها وإن ريحها ليوجد من مسيرة كذا وكذا”
وبالله التوفيق
অর্থাৎ মহিলারা তাদের চুলকে এক পার্শ্বে বেনী করে রাখাটা কাফের মহিলাদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাফেরদের সাথে সাদৃশ্য করতে নিষেধ করেছেন। একটি বেনী হোক বা একাধিক হোক তাদের পিঠের ওপরে রাখা থাকলে আর সেটা যদি ঢাকা থাকে তাহলে তাতে কোন সমস্যা নাই। এটাকে কেকের মত বানানো জায়েয নয়। কারণ এতে কাফের নারীদের অনুকরণ করা হয়ে যায় আর তাদের অনুকরণ করা হারাম । কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “দুই প্রকার জাহান্নামী লোক আমি (এখন পর্যন্ত) প্রত্যক্ষ করি নি (অর্থাৎ, আমার পরে তাদের আবির্ভাব ঘটবে)…..। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। (সহীহ মুসলিম, হা/২১২৮; ফাতওয়া লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা; খন্ড: ১৭ পৃষ্ঠা: ১২৬)
.
শায়খ মোহাম্মদ বিন ইব্রাহিম রহিমাহুল্লাহ বলেন; কিছু মুসলিম মহিলা এ জামানায় তাদের চুলগুলো একপাশে করে রাখে, একসাইডে জমা করে রাখে অথবা মাথার উপরে খোপার মতো করে রাখে যেমনটি জাহিলিয়াতের জামানায় মহিলারা করত; এটা জায়েজ নাই এটা কাফেরদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে যায়। (মাজমুউ ফাতাওয়ায়ে শায়েখ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম: খন্ড: ১পৃষ্ঠা: ৪৭)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে: মহিলারা তাদের চুলগুলোকে মাথার ওপরে একত্রিত করে রাখার হুকুম কি?
.
জবাবে শাইখ বলেন, الشعر إذا كان على الرأس على فوق فإن هذا عند أهل العلم داخل في النهي أو في التحذير الذي جاء عن النبي صلى الله عليه وسلم في قوله : “صنفان من أهل النار لم أرهما بعد” وذكر الحديث وفيه ” ونساء كاسيات عاريات مائلات مميلات رؤوسهن كأسنمة البخت المائلة” . فإذا كان الشعر فوق ففيه نهي . أما إذا كان على الرقبة مثلا فإن هذا لا بأس به إلا إذا كانت المرأة ستخرج إلى السوق فإنه في هذه الحال يكون من التبرج لأنه سيكون له علامة من وراء العباءة تظهر ، ويكون هذا من باب التبرج ومن أسباب الفتنة فلا يجوز ) অর্থাৎ যদি মাথার উপরে (উটের কুঁজের মতো) চুল বেঁধে রাখে তাহলে আলেমদের নিকটে তা নিষিদ্ধতার অন্তর্ভুক্ত এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওই কথার অন্তর্ভুক্ত যেটি তিনি বলেছেন; দুই প্রকার জাহান্নামী লোক আমি (এখন পর্যন্ত) প্রত্যক্ষ করি নি (অর্থাৎ, আমার পরে তাদের আবির্ভাব ঘটবে): এই হাদিসটির মধ্যে রয়েছে: “যারা (এমন নগ্ন) পোশাক পরবে যে,(বাস্তবে) উলঙ্গ থাকবে,(পর পুরুষকে) নিজেদের প্রতি আকর্ষণ করবে ও নিজেরাও (পর পুরুষের প্রতি) আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথা হবে উটের হেলে যাওয়া কুঁজের মতো। ” এভাবে চুল রাখা নিষিদ্ধ। কিন্তু যদি চুলগুলো ঘাড়ের ওপরে থাকে আর মহিলারা যদি বাজারে না যায় তাহলে তাতে কোন সমস্যা নাই। কেননা তাতে জাহেলিয়াতের অবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। সেটা দিবালোকের সামনে প্রকাশ হয়ে যাবে তাই এ জাহেলিয়াতের আচরণ এবং ফেতনার কারণ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকাই এটি জায়েজ নয়। (ফাতাওয়া আল-মারআহ জামউল মুসনাদ পৃষ্ঠা: ২১৮)
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আহালুল আলমগণের উভয় পক্ষের মতামত থেকে একথা পরিস্কার যে,নারীরা তাদের চুল একপাশে বাঁকা সিঁথি কিংবা সোজা উভয় প্রকার সিঁথি করা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। যেহেতু যুগশ্রেষ্ঠ অনেক আলেম এটিকে নিষিদ্ধ বলেছেন, তাই মতানৈক্য এড়াতে নারীরা এটি এড়িয়ে চলাই অধিক নিরাপদ। চাইলে ডানদিক থেকে বা মাঝ বরাবর সিঁথি করতে পারেন।আল্লাহ আমাদেরকে কুরআন সুন্নাহর আলোকে জীবন পরিচালনা করার তৌফিক দান করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।