প্রশ্ন: দ্বিতীয় বিবাহের ক্ষেত্রে কি প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেওয়া আবশ্যক? যদি কেউ বলেন যে প্রথম স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া দ্বিতীয় বিবাহ বৈধ নয়, তাহলে এই বিষয়ে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর:
.
প্রথমত দ্বিতীয় বিবাহ করার সময় প্রথম স্ত্রী থেকে অনুমতি নেওয়া আবশ্যক কিনা তা দুইটি ভিন্ন পরিস্থিতিতে বিবেচনা করা যেতে পারে।
.

.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,إذا اشترط لها أن لا يخرجها من دارها أو بلدها ، أو لا يسافر بها ، أو لا يتزوج عليها : فهذا يلزمه الوفاء به ، فإن لم يفعل فلها فسخ النكاح ، روي هذا عن عمر وسعد بن أبي وقاص وعمرو بن العاص رضي الله عنهم “যদি পাত্রী তার জন্য শর্ত দেয় যে বিবাহের পর স্বামী তাকে তার বাড়িতে রাখতে হবে অন্য কোথাও নিতে পারবে না, তার সাথে দূরে কোথাও ভ্রমন করবে না।স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করবেনা এবং সে তার সাথে কোন ষড়যন্ত্র করবেনা তাহলে তাকে অবশ্যই তা পূরণ করুন, এবং যদি তিনি তা না করেন, তবে স্ত্রীর বিবাহ বাতিল করার অধিকার রয়েছে।”(ইমাম ইবনে কুদামাহ আল-মুগনী; খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ৪৮৩)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:إذا اشترطت أن لا يتزوج عليها فإن هذا يجوز .وقال بعض العلماء : إنه لا يجوز ؛ لأنه حجر على الزوج فيما أباح الله له ، فهو مخالف للقرآن : (فَانكِحُوا مَا طَابَ لَكُمْ مِنَ النِّسَاءِ مَثْنَى وَثُلاثَ وَرُبَاعَ) النساء/3 .فيقال في الجواب على ذلك : هي لها غرض في عدم زواجه ، ولم تعتد على أحد ، والزوج هو الذي أسقط حقه ، فإذا كان له الحق في أن يتزوج أكثر من واحدة ، أسقطه ، فما المانع من صحة هذا الشرط ؟! ولهذا ؛ فالصحيح في هذه المسألة ما ذهب إليه الإمام أحمد رحمه الله من أن ذلك الشرط صحيح“যদি স্ত্রী এই শর্ত আরোপ করেন যে স্বামী তার সঙ্গে বিবাহের বাইরে আর কোনো নারীকে বিবাহ করবেন না, তবে এটি বৈধ। যদিও কিছু আলেম বলেছেন যে এটি বৈধ নয়, কারণ এতে স্বামীকে এমন বিষয়ে বাধ্য করা হয়েছে যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য বৈধ। তারা কুরআনের আয়াত উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন:”অতএব তোমরা নারীদের মধ্যে তোমাদের পছন্দমতো বিয়ে করো– দুই, তিন অথবা চারজনকে।”(সূরা নিসা:৩) এই যুক্তির জবাবে বলা যায় যে, বহুবিবাহ না করার বিষয়ে স্ত্রীর আরোপিত শর্তের একটি উদ্দেশ্য রয়েছে এবং এতে তিনি কারও প্রতি কোনো অন্যায় করেননি। বরং স্বামী নিজেই তার বৈধ অধিকার ত্যাগ করেছেন। সুতরাং, যেহেতু স্বামী তার একাধিক স্ত্রীর অধিকার রাখতে পারার ক্ষমতা রাখে, কিন্তু স্বেচ্ছায় তা ত্যাগ করছেন,তাহলে এই শর্তের বৈধ হওয়ার পথে বাধা কোথায়?!অতএব,এই মাসয়ালার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য ও সঠিক মত হলো ইমাম আহমদের (রহঃ) মত: স্ত্রীর দ্বারা আরোপিত এই শর্ত বৈধ ও গ্রহণযোগ্য।”(ইবনু উসাইমীন; আশ-শারহুল মুমতি; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ২৪৩) [এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনাসহ আমরা স্বতন্ত্র একটি আর্টিকেল লিখবো ইনশাআল্লাহ]
.

“আর তারা বলে, ইয়াহুদী অথবা নাসারা ছাড়া অন্য কেউ কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না’। এটা তাদের মিথ্যা আশা। বলুন, “যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে তোমাদের প্রমাণ পেশ কর”।(সূরা বাকারা: ১১১) অপর আয়াতে মহান আল্লাহ আরও বলেন:أَمِ اتَّخَذُوا مِن دُونِهِ آلِهَةً ۖ قُلْ هَاتُوا بُرْهَانَكُمْ ۖ هَٰذَا ذِكْرُ مَن مَّعِيَ وَذِكْرُ مَن قَبْلِي“তারা কি আল্লাহ ছাড়া উপাস্য গ্রহণ করেছে? বলুন: তোমরা তোমাদের প্রমাণ পেশ করো।”(সূরা আম্বিয়া: ২৪) এখানে মূর্তিপূজকদের দাবির খণ্ডনে সরাসরি তাদের কাছ থেকে প্রমাণ চাওয়া হয়েছে।
.
ইমাম তিরমিজি (রাহিমাহুল্লাহ) সুনানে তিরমিজিতে একটি অধ্যায় রচনা করেছেন যার শিরোনাম হলো;باب مَا جَاءَ فِي أَنَّ الْبَيِّنَةَ عَلَى الْمُدَّعِي وَالْيَمِينَ عَلَى الْمُدَّعَى عَلَيْهِ
অর্থ: “বাদীর দায়িত্ব হচ্ছে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাযির করা এবং বিবাদীর দায়িত্ব হচ্ছে শপথ করা। “অতঃপর তিনি হাদিস নিয়ে এসেছেন, আমর ইবনু শুআইব (রাহিমাহুল্লাহ) হতে পর্যায়ক্রমে তার বাবা ও দাদার সূত্রে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এক ভাষণে বলেছেনঃ:الْبَيِّنَةُ عَلَى الْمُدَّعِي وَالْيَمِينُ عَلَى الْمُدَّعَى عَلَيْهِ “বাদীর দায়িত্ব হচ্ছে সাক্ষী-প্রমাণ হাযির করা এবং বিবাদীর দায়িত্ব হচ্ছে শপথ করা।” (সুনানে তিরমিজি হা/১৩৪১; ইমাম আল-আলবানী ইরওয়ুল গালীল হা/১৯৩৮)
.
সহীহ বুখারীর অপর এক বর্ননায় এসেছে, ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: (لَوْ يُعْطَى النَّاسُ بِدَعْوَاهُمْ لاَدَّعَى نَاسٌ دِمَاءَ رِجَالٍ وَأَمْوَالَهُمْ وَلَكِنَّ الْيَمِينَ عَلَى الْمُدَّعَى عَلَيْهِ) “যদি লোকের দাবি অনুসারে তাদের দিয়ে দেয়া হতো তবে কোন কোন লোক অপর ব্যক্তির জান-মাল দাবি করে বসতো। তাই বিবাদীর জন্য শপথ নেয়ার বিধান রয়েছে।”(সহীহ বুখারী হা/৪৫৫২; সহীহ মুসলিম হা/৪৫৬৭)
.
বিশেষত ইসলামি শরিয়ত সুস্পষ্টভাবে বিবাহসংক্রান্ত বহু শর্ত নির্ধারণ করেছে। কিন্তু সেই শর্তগুলোর কোথাও উল্লেখ নেই যে, দ্বিতীয় বিবাহ করতে হলে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি আবশ্যক। বরং বাস্তবে দেখা যায়,রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একাধিক বিবাহ করেছেন, অথচ কোথাও প্রমাণ পাওয়া যায় না যে তিনি তাঁর স্ত্রীদের কারও অনুমতি নিয়েছিলেন। একইভাবে, সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) একাধিক বিবাহ করেছেন, কিন্তু তাঁদের ক্ষেত্রেও এ ধরনের কোনো অনুমতির শর্তের উল্লেখ নেই।অতএব, শরিয়তের দৃষ্টিতে এটি সুস্পষ্ট প্রমাণ যে দ্বিতীয় বিবাহ করতে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেওয়া ফরজ নয়। তবে সন্দেহাতীতভাবে উত্তম ও শোভনীয় হলো—যদি কেউ দ্বিতীয় বিবাহ করতে চায়, তবে সে আগে প্রথম স্ত্রীকে অবহিত করবে এবং তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করবে। কারণ, এতে পারিবারিক শান্তি-সৌহার্দ্য বজায় থাকে এবং পরিণতিও ইতিবাচক হয়। তবে এটিকে ওয়াজিব বা বাধ্যতামূলক বিধান বলা যাবে না।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে যখন দ্বিতীয় বিয়েতে প্রথম স্ত্রীর সম্মতি আবশ্যক কিনা তা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তখন তারা উত্তর দিয়েছিলেন:
ليس بفرض على الزوج إذا أراد أن يتزوج ثانية أن يرضي زوجته الأولى ، لكن من مكارم الأخلاق وحسن العشرة أن يطيِّب خاطرها بما يخفف عنها الآلام التي هي من طبيعة النساء في مثل هذا الأمر ، وذلك بالبشاشة وحسن اللقاء وجميل القول وبما تيسّر من المال إن احتاج الرضى إلى ذلك “
“স্বামী যদি দ্বিতীয় বিয়ে করতে চান, তবে প্রথম স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করা তার জন্য ফরয (আবশ্যিক) নয়। তবে এটি নিঃসন্দেহে সদাচরণ ও উত্তম চরিত্রের অংশ যে, স্বামী এমনভাবে তার মনকে প্রফুল্ল করার চেষ্টা করবেন, যাতে এ ধরনের পরিস্থিতিতে স্ত্রীর স্বাভাবিক দুঃখ-কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। আর তা হতে পারে— হাসিমুখে ভালো ব্যবহার, আন্তরিক ও কোমল কথাবার্তা, এবং প্রয়োজনে সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু আর্থিক অনুগ্রহ প্রদানের মাধ্যমে।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ১৯; পৃষ্ঠা: ৫৩)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: “যদি কোনো পুরুষ দ্বিতীয় বিয়ে করতে চায়, তবে তার কি প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেওয়া শর্ত? এবং তার অজান্তে বিয়ে করলে তার বিধান কী?
উত্তরে শাইখ বলেন:
أعتقد أنه لو استأذن منها لأبت أن يتزوج ، ولكن ليس من شرط النكاح أن يستأذن الزوجة الأولى بل حتى لو استأذنها وأَبَتْ فله الحق أن يتزوج ، ولكن مع هذا أرى أنه ينبغي أن يشاورها ويقنعها حتى تقتنع بذلك وتطمئن ، ويبين العلة التي من أجلها يريد أن يتزوج ، فإذا جاءتها الزوجة الجديدة جاءتها وهي على اطمئنانٍ بها وعلى علمٍ بها وعلى رضىً بها ، وحينئذٍ يمكن أن تعيش الزوجتان عيشةً حميدة بدون تنافرٍ ولا تباغض ، فمن أجل مراعاة هذه الفوائد ينبغي أن يستأذنها ويخبرها ، وأما أن يكون ذلك واجباً فليس بواجب ” .فسئل الشيخ”: لو أخفى عنها هذا الزواج ؟ فأجاب : ” لا حرج عليه ” .
“আমি মনে করি যে, যদি সে (স্বামী) তার কাছ থেকে (প্রথম স্ত্রীর কাছ থেকে) অনুমতি চাইত, তাহলে হয়তো সে (স্ত্রী) তার (স্বামীর দ্বিতীয়) বিয়েতে অসম্মতি জানাতো। তবে প্রথম স্ত্রীর কাছ থেকে অনুমতি চাওয়া বিবাহের শর্ত নয়; বরং স্বামী অনুমতি চাইলেও এবং সে (স্ত্রী) অসম্মতি জানালেও, তার (স্বামীর) বিয়ে করার অধিকার রয়েছে। তা সত্ত্বেও, আমি মনে করি তার উচিত হবে প্রথম স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করা এবং তাকে বোঝানো, যতক্ষণ না সে এতে সন্তুষ্ট ও আশ্বস্ত হয়। এবং সে যেন সেই কারণও পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করে, যার কারণে সে বিবাহ করতে চায়। ফলে, যখন নতুন স্ত্রী তার কাছে আসবে, তখন সে (প্রথম স্ত্রী) তা জানার পর, আশ্বস্ত মনে ও সন্তুষ্টি সহকারে তাকে গ্রহণ করবে।এর ফলে দুই স্ত্রী শান্তিপূর্ণভাবে, কোনো বিরোধ বা বিদ্বেষ ছাড়া একসাথে জীবনযাপন করতে পারবে। সুতরাং এসব কল্যাণকর ফলাফল অর্জনের জন্য স্বামীর উচিত হবে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি চাওয়া ও তাকে জানানো। কিন্তু একে যে ওয়াজিব (অবশ্য কর্তব্য) বলা যাবে না।”এরপর শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করা হলো: “যদি স্বামী দ্বিতীয় বিবাহটি প্রথম স্ত্রীর কাছ থেকে গোপন রাখে? তিনি উত্তর দিলেন: এতে তার উপর কোনো দোষ নেই।”(ইবনু উসাইমীন, ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব, শাইখের ওয়েবসাইট থেকে সংকলি) গৃহীত: ইসলাম সাওয়াল জবাব ফাতওয়া নং-২১৮৭৫৯)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।