জানাযার সালাত আদায়ের পর সবাই মিলে হাত তুলে সম্মিলিত মুনাজাত করার বিধান কি

শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা ভাবনা করলে যা প্রমানিত হয় তা হলো, একজন মানুষের মৃত্যুর পর তিনটি আমল ব্যতীত কোন আমল কাজে আসে না।

(১).সাদাক্বায়ে জারিয়া,

(২).উপকারী ইলম ও

(৩).নেক সন্তানের দো‘আ। (সহীহ মুসলিম হা/১৬৩১ মিশকাত হা/২০৩) অপর বর্ননায় উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর নবী করীম (ﷺ) যখন অবসর গ্রহণ করতেন তখন তিনি সেখানে দাঁড়াতেন এবং উপস্থিত লোকদেরকে বলতেন, তোমাদের ভাইয়ের জন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং ঈমানের উপর দৃঢ় রাখার জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ কর। কারণ এখনই তাকে প্রশ্ন করা হবে’। (আবুদাঊদ হা/৩২২১; মিশকাত হা/১৩৩; সহীহুল জামে‘ হা/৪৭৬০ সনদ সহীহ) উক্ত হাদীস থেকে আমরা বুঝতে পারি, দাফন শেষে মৃত ব্যক্তির জন্য দু‘আ করা এবং তার অবিচলতার জন্য আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করা শার‘ঈ নিয়ম এটি বিদ‘আত নয়। আর জীবিত ব্যক্তির দু‘আ মৃত ব্যক্তিদের উপকারে আসে।
.
এখন প্রশ্ন হল এই দো‘আর পদ্ধতি কেমন হবে তা নিয়ে কিছু মানুষ বিভ্রান্তিতে পতিত হয়ে নানা রকমের বিদআত চালু করেছে। অথচ দ্বীনের মধ্যে বিদআত গর্হিত কাজ। একজন মুসলিম হিসাবে আমাদের করণীয় হ’ল রাসূল ﷺ)-এর সুন্নাতের অনুসরণ। আর তা হ’ল মাইয়েতের জন্য সবাই একাকী ক্ষমা প্রার্থনা করা ও তার দৃঢ় থাকার জন্য দো‘আ করা। রাসূল (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণ লাশ দাফনের পর কখনো দলবদ্ধভাবে অর্থাৎ সম্মিলিত মুনাজাত করেছেন এর কোন প্রমান নেই।এর কারন হলো জানাযার সালাতই মাইয়েতের জন্য শ্রেষ্ঠ মুনাজাত। রাসূল (ﷺ) জনৈক সাহাবীর জানাযার সালাত সমাপ্তকালে যখন ওয়াক্বিহী ফিতনাতাল কবরি ওয়া ‘আযা-বান না-র’’ (অর্থাৎ কবরের ফিতনাহ্ এবং জাহান্নামের আগুন থেকে তাকে বাঁচাও) দু’আর এই অংশটুকু শুনার পর আরেক সাহাবী আকাঙ্ক্ষা করে বলেছিলেন, আমি যদি এই মাইয়েত হ’তাম। কারণ জানাযায় তিনি মাইয়েতের জন্য হৃদয় স্পর্শী ও সুন্দর দো‘আ পাঠ করেছিলেন। (সহীহ মুসলিম হা/৯৬৩; মিশকাত হা/১৬৫৫) পাশাপাশি মৃতব্যক্তিকে দাফন করার পর মৃতব্যক্তি যেন মুনকার ও নাকীরের প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হন, সেজন্য সকল মুছল্লীকে ব্যক্তিগত ভাবেও দো‘আ করতে বলা হয়েছে। যেমন, اَللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ وَثَبِّتْهُ ‘আল্লা-হুম্মাগফির লাহূ ওয়া সাবিবতহু’ (হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করুন ও তাকে দৃঢ় রাখুন। (মিশকাত; হিসনুল মুসলিম, দোয়া নং ১৬৪)। এই হাদীসগুলো থেকে বুঝা যায়, দো‘আর মূল স্থান জানাযার সালাত। মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার যে প্রথা সমাজে চালু আছে শরী‘আতে তার কোন সহীহ ভিত্তি নেই। প্রচলিত পদ্ধতিকে বৈধ করার জন্য যে সকল বর্ণনা পেশ করা হয় তার কিছু জাল কিছু যঈফ একটিও সহীহ নয়।

▪️এবার যুগ শ্রেষ্ঠ ইমামদের কয়েকটি ফটো দেখুন:
_______________________________________
(১). সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন,ليس هذا من سُنة الرسول عليه الصلاة والسلام ولا من سنة الخلفاء الراشدين رضي الله عنهم وإنما كان الرسول عليه الصلاة والسلام يرشدهم إلى أن يستغفروا للميت، ويسألوا له التثبيت، كل بنفسه وليس جماعة- ‘দলবদ্ধ মুনাজাত রাসূল ﷺ) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের কোন সুন্নাত নয়। রাসূল ﷺ) কেবল মাইয়েতের জন্য ইস্তিগফার ও তার সুদৃঢ় থাকার জন্য প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রত্যেকে নিজে নিজে দু’আ পাঠ করবে, দলবদ্ধভাবে নয়’।(ফাতাওয়াল জানায়েয ১/২২৮; উসাইমীন,মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল,খন্ড:১৭ পৃষ্ঠা:১৪০, প্রশ্ন নং ১৩২) অন্যত্র তিনি আরো বলেন,لا يجتمع الجميع على دعاءٍ واحد لأن ذلك من البدع حيث إن رسول الله صلى الله عليه وعلى آله وسلم لم يرشد إلى ذلك ولم يفعله بنفسه ‘একজনের দো‘আয় সকলে অংশগ্রহণ করবে না। কেননা তা বিদ‘আত। কারণ নবী করীম (ﷺ) এই পদ্ধতিতে নির্দেশনা দেননি এবং তিনি নিজেও এভাবে করেননি’।(ফাতাওয়া নুরুন আলাদ দারব ১৩/১৯৬)
.
(২). বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, কবরের নিকটে দলবদ্ধভাবে দো‘আর কোন ভিত্তি নেই (الدعاء الجماعي عند القبر ليس له أصل)। দাফনকারীরা যদি একজনের উপর নির্ভর করে। আর সে বলে, তোমরা একত্রিত হও। আমি দো‘আ করব আর আপনারা আমীন বলবেন, এর কোন ভিত্তি আমি জানি না। সালাফে সালেহীন থেকে এর কোন ভিত্তি আমার জানা নেই। তবে কেউ যদি কারো অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য ছাড়া কবরের পাশে দো‘আ করে আর তার দো‘আয় আমীন বলে তবে এতে কোন বাধা নেই। যেমন কেউ দাফনের সময় তার ভাইয়ের জন্য ‘আল্লাহুম্মাগফির লাহু ওয়া সাবিবতহু বিল কাওলিছ ছাবিত’ দো‘আ বলার সময় উপস্থিত কিছু ব্যক্তি বলল আমীন, আমীন। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে একত্রিত হয়ে কেউ দো‘আ করল আর অন্যরা আমীন আমীন বলল। সালাফে ছালেহীনদের থেকে এর কোন ভিত্তি আমার জানা নেই। অতএর এরূপ কর্ম ত্যাগ করা উত্তম ও নিরাপদ। (ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ্ দারব ইবনে বায, অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-১১৬০ এবং মাজাল্লাত আল-বুহুত আল-ইসলামিয়া, ৬৮/৫৩)
.
(৩). সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হ’লে উত্তরে বলা হয়-‘দো‘আ অন্যতম ইবাদত। আর ইবাদত দলীলের উপর নির্ভরশীল। অতএব কারো জন্য শরী‘আত বহির্ভূত পন্থায় ইবাদত করা জায়েয হবে না। আর নবী করীম ﷺ) থেকে সাব্যস্ত হয়নি যে, তিনি জানাযার সালাতের পরে ছাহাবীদের নিয়ে দো‘আ করেছেন। তাঁর থেকে যা সাব্যস্ত হয়েছে তা হ’ল- তাঁর সাথীদের কবর সমান করা হ’লে তিনি কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘তোমাদের ভাইয়ের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং ঈমানের উপর দৃঢ় রাখার জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ কর। কারণ এখনই তাকে প্রশ্ন করা হবে’। পূর্বের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, মাইয়েতের জন্য ছালাত আদায় করার পর দলবদ্ধভাবে মুনাজাত করা জায়েয না হওয়াই সঠিক। কারণ তা বিদ‘আত’। (আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৩৩ ফাতাওয়া লাজনাহ দায়েমাহ খন্ড: ৯ পৃষ্ঠা: ১৬, ফাতওয়া নং ২২৫১)
.
(৪). শাইখ ইবরাহীম আলে শায়খকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হ’লে তিনি বলেন, من السنة أن يقف المشيعون عند القبر بعد الدفن ويدعوا للمية فرادى بالرحمة والمغفرة والةثبية أما الدعاء الجماعى والةأمين على دعاء واحد من الحضور فهذا ليس من السنة ‘সুন্নাত হ’ল-দাফনের পর শোকার্তরা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ব্যক্তিগতভাবে মাইয়েতের জন্য রহমত, মাগফিরাত ও তার দৃঢ় থাকার জন্য দো‘আ করবে। কিন্তু দলবদ্ধ দো‘আ এবং একজনের দো‘আয় উপস্থিত লোকদের আমীন আমীন বলা- এটি কোন সুন্নাতী আমল নয়’।(আদ-দাওয়াত ১৫৭৬)
.
(৫). মিসরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুসতফা মুরাদ বলেন, أنه من بدع الدفن الدعاء الجماعي بعد دفن الميت ‘দাফন সংশ্লিষ্ট বিদ‘আত হ’ল-দাফনের পর দলবদ্ধভাবে মুনাজাত করা’। (আখতা’উনা ফিল ইবাদাতে ওয়াল মু‘আমিলাত ৩৮২ পৃষ্টা ফাতওয়াগুলো আত তাহরীক থেকে সংকলিত) সুতরাং আমাদের উচিত সুন্নতের অনুসরণ করা এবং যাবতীয় বিদআত পরিহার করা। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।