ওয়াহদাতুল উজুদ বা সবকিছুতে মহান আল্লাহর উপস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত

ওয়াহদাতুল উজুদ’ বা সবকিছুতে মহান আল্লাহর উপস্থিতি বলতে কী বুঝায় এবং এটি কি কোন মুসলিমের আক্বীদা বিশ্বাস হতে পারে কি?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬ওয়াহদাতুল উজুদ দুটি আরবি শব্দের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে। আরবি শব্দ ওয়াহেদ (এক) থেকে ওয়াহেদ/ওয়াহদাতুল, যার অর্থ এক হয়ে যাওয়া। আরবি শব্দ উজুদ অর্থ অস্তিত্ব। ওয়াহদাতুল উজুদ এর শাব্দিক অর্থ হলঃ সব কিছুর (সৃষ্টি ও স্রষ্টার) অস্তিত্ব এক হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ সবকিছুতেই আল্লাহর উপস্থিতি বা আল্লাহর বিলীন হওয়াকে ‘ওয়াহদাতুল উজুদ’ বলে। (খালেদ ইবনু আব্দুল্লাহ, শারহুল আক্বীদাহ আত-ত্বাহাবিয়াহ, পৃঃ ৬)।
.
ওয়াহদাতুল উজুদ এর বাংলা হচ্ছে ‘সর্বেশ্বরবাদ’।যা বান্দার সত্তাকে আল্লাহর সত্তায় বিলীন করে দেয়। এই আক্বীদার অনুসারী ছূফীরা তাদের এক শ্রেনী বিশ্বাস করে, স্রষ্টা ও সৃষ্টি একই, কোন পার্থক্য নেই (নাঊযুবিল্লাহ) তাদের দৃষ্টিতে সবই আল্লাহ এবং সব সৃষ্টিই আল্লাহর অংশ। তাদের মতে, আল্লাহ নিরাকার। তিনি আরশে নন, বরং সর্বত্র বিরাজমান। অতএব যে ব্যক্তি মূর্তিপূজা করে কিংবা গাছ, পাথর, মানুষ, তারকা ইত্যাদি পূজা করে, সে মূলতঃ আল্লাহকেই পূজা করে। সবকিছুর মধ্যে আল্লাহর নূর বা জ্যোতির প্রকাশ রয়েছে। সুতরাং মানুষের মধ্যে মুমিন ও কাফের-
মুশরিক বলে কোন পার্থক্য নেই। তাদের ধারণায় খৃষ্টানরা কাফের এজন্য যে, তারা কেবল ঈসা (আঃ)-কেই প্রভু বলেছে। যদি তারা সকল সৃষ্টিকেই আল্লাহ বলত, তাহ’লে তারা কাফের হ’ত না। বলা বাহুল্য এটাই হ‘ল হিন্দুদের ‘সর্বেশ্বরবাদ’। বর্তমানে এই আক্বীদাই মা‘রেফাতপন্থী ছূফীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত অথচ এটা পরিষ্কার কুফরী আক্বীদা। তারা মনে করে কেউ আল্লাহর মাঝে বিলীন হওয়ার মর্যাদা লাভ করলে, তাকে আর শরী‘আতের বিধি-বিধান পালন করতে হয় না (আল-ফিছাল ফিল মিলাল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৪৩)।
.
মূলত উক্ত বিশ্বাস হিন্দুদের সংস্কৃতি থেকে এসেছে, গ্রীস ও হিন্দুদের বিশ্বাস থেকে জানা যায়, এই পৃথিবীতে যা কিছুর অস্তিত্ব আছে, সব দেখতে ভিন্ন ভিন্ন রকন হলেও প্রকৃতপক্ষে সবকিছু অস্তিত্ব এক। তাই স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য নেই, যিনি ‘খালিক্ব’ তিনিই ‘মাখলুক’ অর্থাৎ যা সৃষ্টি তাই স্রষ্টা। এই আক্বীদাহ বা বিশ্বাস গ্রীকদের হলেও, এই আক্বীদার উপরে সবচেয়ে বেশী আমলকারী হচ্ছে হিন্দুরা। তাদের মতে পৃথিবীতে যা আছে সবই মাবুদ। অর্থাৎ সবই সৃষ্টি এবং সবই মাবুদ। এ অর্থে কুকুর, শুকর, বানর এবং অন্যান্য নাপাক সৃষ্টিও মাবুদ হতে কোন বাঁধা নেই। সুতরাং তাদের মতে যারা মূর্তি পূজা করে তারা ঈশ্বরেরই (আল্লাহরই) ইবাদত করে (নাউযুবিল্লাহ)। তাই তারা পৃথিবীর প্রায় সবকিছুরই পূজা করে থাকে, যেমনঃ গাছ, পাথর, মাটি, সাপ-বিচ্ছু, হনুমান, হাতী, পশু, পাখি, নদ-নদী, সমুদ্র, নারী, এমনকি পরুষের লিঙ্গেরও পুজা করে। কারন তাদের বিশ্বাস সৃষ্টির মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।
.
হিন্দুদের সংস্কৃতি থেকে আকিদার আবির্ভাব হলেও, ছূফীদের মধ্যে উক্ত আক্বীদা ব্যাপকভাবে প্রচলিত। ছূফীদের পুরোধা হচ্ছে সিরিয়ার দামেস্ক-এ সমাহিত ‘ইবনুল আরাবী’। সে বলে,العبد رب والرب عبـــد يــا ليت شعري من المكلــف؟إن قلت عبد فذاك حـــق أو قلت رب فأنَّى رب يكلف؟ ‘বান্দাই রব, আর রবই বান্দা, আহা যদি জানতাম কে মুকাল্লাফ (শরী‘আতের নির্দেশ মানতে বাধ্য)? যদি বলি বান্দা, তাহলে তা-ই সত্য। অথবা যদি বলি রব, তবে কোথায় সে রব, যে মুকাল্লাফ (আদেশ পালনের জন্য বলা) হবে’? (ইবনুল আরাবী, আল-ফুতূহাতুল মাক্কিয়্যাহ) ইবনুল আরাবী আরো বলে,فَيَحْمَدُنِىْ وَأَحْمَدُهُ وَيَعْبُدُنِىْ وَأَعْبُدُهُ‘তিনি (আল্লাহ) আমার প্রশংসা করেন এবং আমিও তার প্রশংসা করি। আর তিনি আমার ইবাদত করেন এবং আমিও তার ইবাদত করি’(ড. মুহাম্মাদ জামীল গাযী, আছ-ছূফিয়্যাতু ওয়াল ওয়াজহুল আখর, পৃ. ১২; ড. মাহমূদ আব্দুর রাাযযাক (সংকলক), আল-মু‘জামুছ ছূফী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৬২; আব্দুর রহমান আল-উকীল, হাযিহি ইয়াছ ছূফীয়্যাহ, পৃ. ৩৯) সে তার ‘ফুছূছুল হুকম’ গ্রন্থে বলেছে,إِنَّ الرِّجَالَ حِيْنَمَا يُضَاجِعُ زَوْجَتَهُ إِنَّمَا يُضَاجِعُ الْحَقَّ ‘নিশ্চয় কোন ব্যক্তি যখন তার স্ত্রীর সাথে আলিঙ্গন করে, তখন সে ‘হক’ তা‘আলাকেই আলিঙ্গন করে’। (ড. মুহাম্মাদ জামীল গাযী, আছ-ছূফিয়্যাতু ওয়াল ওয়াজহুল আখর, পৃ. ৪৪) ছূফী নাবলুসী উক্ত কথার ব্যাখ্যায় বলে, إِنَّمَا يَنْكِحُ الْحَقَّ অর্থাৎ ‘সে অবশ্যই ‘হক’ তা‘আলার সাথে সহবাস করে’। নাউযুবিল্লাহ (ড. মুহাম্মাদ জামীল গাযী, আছ-ছূফিয়্যাতু ওয়াল ওয়াজহুল আখর, পৃ. ৪৫; একদল উলামা কর্তৃক লিখিত, মাওসূ‘আতুর রাদ্দি আলাছ ছূফিয়্যাহ, ৫৮তম খণ্ড, পৃ. ৪৬)
.
দেওবন্দ মতবাদের আধ্যাত্মিক গুরু ইমদাদুল্লাহ (১৮১৪-১৮৯৬ খ্রি.) বলেন, ‘মা‘রেফতের অধিকারী ব্যক্তি সমগ্র পৃথিবীর উপর কর্তৃত্বশীল হয়। আল্লাহ তা‘আলার যে কোন রশ্মিকে নিজের জন্য ধরে নিতে পারে। আল্লাহর যে কোন গুণে ও ইচ্ছায় নিজেকে বিভূষিত করে তার প্রকাশ ঘটাতে পারে। যেহেতু তার মধ্যে আল্লাহর গুণাবলী বিদ্যমান এবং সে আল্লাহর চরিত্রে বিলীন’ (যিয়াউল কুলূব (উর্দূ), পৃ. ২৭-২৮; (বাংলা), পৃ. ৫১)। অন্য এক জায়গায় বলেন, ‘কোনরূপ আড়াল ছাড়াই সে আল্লাহকে দেখতে পাবে। আল্লাহকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সে সুযোগ পাবে’ (যিয়াউল কুলূব (উর্দূ), পৃ. ৭ ও ২৫; (বাংলা), পৃ. ২০ ও ৪৪)। তিনি আরেক জায়গায় বলেন, ‘তাওহীদে জাতি হল এই যে, বিশ্বজগতের সবকিছুকে আল্লাহ বলে ধারণা করা’ (যিয়াউল কুলূব (উর্দূ), পৃ. ৩৫; (বাংলা), পৃ. ৬২)।

পরিশেষে, প্রিয় পাঠক, দেওবন্দী মতবাদে বিশ্বাসী ইলিয়াসী তাবলীগের লোকেরা উপমহাদেশে উক্ত আক্বীদা বেশী প্রচার করে থাকে। অথচ যদি কোন ব্যক্তি উক্ত কুফরী আক্বীদা পোষণ করে তাহলে তার ঈমান, আমল ও ইসলাম কিছুই থাকবে না (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়েমাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫১৬)। কারণ এর মাধ্যমে আল্লাহর মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে এবং তাঁকে সৃষ্টির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা। আল্লাহর বাণী, ‘আল্লাহ সবকিছুরই স্রষ্টা এবং তিনি সবকিছুর উপর কর্তৃত্বশীল’ (সূরা আয-যুমার : ৬২) শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ ওয়াহদাতুল উজুদ ও সর্বেশ্বরবাদে বিশ্বাসী মতবাদের প্রকাশ্যে বিরোধিতা করাকে তাতারীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের মতই সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। মহান আল্লাহ উক্ত আক্বীদা থেকে মুসলিম উম্মাহকে হেফাযত করুন। আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
________________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।