ইসলাম নির্দেশিত যে সব চারিত্রিক অধ:পতনের কারণে সমাজিক মূল্যবোধ ধ্বংসের পথে

ইসলাম চায় একটি ভালবাসা পূর্ণ, শান্তিময়, মানবিক ও সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা উপহার দিতে। তাই এর যাবতীয় উপায়-উপকরণ বলে দেয়া হয়েছে। তৎসঙ্গে যে সব কারণে দ্বন্দ্ব-কলহ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সামাজিক অশান্তি, বিদ্বেষ, শত্রুতা এবং মানুষের নৈতিক অধঃপতন ঘটতে পারে সেসব বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য জনক বাস্তবতা হল যে, বর্তমানে বহু মুসলিম কারণে-অকারণে বা ছোটখাটো বিষয়কে কেন্দ্র করে এসব নিকৃষ্ট স্বভাব-চরিত্র এবং নোংরা আচার-ব্যাবহারের পরিচয় দিচ্ছে। যার কারণে সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শান্তি, সম্মান ও শ্রদ্ধবোধ, বন্ধুত্বপূর্ণ সহবস্থানের মনোভাব, আস্থা, বিশ্বাস, সহমর্মিতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। মানুষ হয়ে উঠছে অ সহিষ্ণু, পরস্পরের দুশমন, হিংস্র ও পশুতুল্য। (আল্লাহর নিকট এই পরিস্থিতি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।)

যাহোক, এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হল, ইসলামি শিক্ষার বিস্তার এবং ইসলাম নির্দেশিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, নৈতিকতা এবং আচার-আচরণ চর্চা করা, বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা এবং ইসলাম প্রদত্ত নৈতিক সৌন্দর্যের রঙ্গিন আলোকচ্ছটায় সমাজের প্রতি কোণ, গৃহাঙ্গণ ও হৃদয়কে রাঙ্গিয়ে দেয়া। আল্লাহ তওফিক দান করুন। আমিন।

নিম্নে ইসলামের পারস্পারিক আচরণ বিধি এবং সামাজিক মূল্যবোধ ও চরিত্র বিধ্বংসী বৈশিষ্ট্যগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হল:

✪ ১. কাউকে অনুমান নির্ভর কথা বলে কাউকে কষ্ট দেয়া, কারও প্রতি কু ধারণা পোষণ করা এবং তার অসাক্ষাতে গিবত ও সমালোচনা করা হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيراً مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَّحِيمٌ

“হে মুমিনগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা গোনাহ। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভায়ের মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুত: তোমরা তো তা ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুল কারী ও পরম দয়ালু।” [সুরা হুজুরাত: ১২]

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عن أبي هريرة -رضي الله عنه- عن النبي -صلى الله عليه وسلم- قال: «أتدرون ما الغِيبَةُ؟»، قالوا: الله ورسوله أعلم، قال: «ذكرُك أخاك بما يكره»، قيل: أرأيت إن كان في أخي ما أقول؟ قال: «إن كان فيه ما تقول فقد اغْتَبْتَهُ, وإن لم يكن فقد بَهَتَّهُ».
আবু হুরায়রা রা. থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত, “তোমরা কি জান, গিবত কী?
লোকেরা বলল, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন।’
তিনি বললেন, “তোমার ভাই যা অপছন্দ করে, তাই তার পশ্চাতে আলোচনা করা।”
বলা হল, ‘আমি যা বলি, তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তাহলে আপনার বক্তব্য কী? (সেটাও কি গিবত হবে?)
তিনি বললেন, “তুমি যা বললে, তা যদি তার মধ্যে তা থাকে, তাহলেই তার গিবত করলে। আর তুমি যা বললে, তা যদি তার মধ্যে না থাকে, তাহলে তাকে অপবাদ দিলে।” (সহিহ মুসলিম)

✪ ২. এছাড়াও সলামের দৃষ্টিতে মুসলিমদের মাঝে পারস্পারিক সম্মানহানী, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, হিংসা-বিদ্বেষ, রাগারাগি, মারামারি, গালাগালি, জুলুম করা হারাম।
এ মর্মে কুরআন-হাদিসে যথেষ্ট সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। নিম্নে এ সংক্রান্ত কতিপয় হাদিস তুলে ধরা হল:

আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الحَدِيثِ
وَلاَ تَحَسَّسُوا وَلاَ تَجَسَّسُوا وَلاَ تَنَافَسُوا، وَلاَ تَحَاسَدُوا وَلاَ تَبَاغَضُوا وَلاَ تَدَابَرُوا وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْوَاناً كَمَا أَمَرَكُمْ
المُسْلِمُ أَخُو المُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يَخْذُلُهُ وَلاَ يَحْقِرُهُ التَّقْوَى هاهُنَا التَّقْوَى هاهُنَا وَيُشِيرُ إِلَى صَدْرِهِ
بحَسْبِ امْرِىءٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ المُسْلِمَ كُلُّ المُسْلِمِ عَلَى المُسْلِمِ حَرَامٌ : دَمُهُ وَعِرْضُهُ وَمَالُهُ
إنَّ اللهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى أَجْسَادِكُمْ وَلاَ إِلَى صُوَرِكُمْ وَلكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ
وَفِي رواية لاَ تَحَاسَدُوا، وَلاَ تَبَاغَضُوا وَلاَ تَجَسَّسُوا وَلاَ تَحَسَّسُوا وَلاَ تَنَاجَشُوا وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْواناً
وفي رواية لاَ تَقَاطَعُوا وَلاَ تَدَابَرُوا وَلاَ تَبَاغَضُوا وَلاَ تَحَاسَدُوا وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْواناً .
وَفِي رِواية وَلاَ تَهَاجَرُوا وَلاَ يَبِعْ بَعْضُكُمْ عَلَى بَيْعِ بَعْضٍ.

[رواه مسلم بكلّ هذِهِ الروايات، وروى البخاريُّ أَكْثَرَهَا]

▪‘‘তোমরা কু ধারণা পোষণ করা থেকে বিরত থাক। কারণ কু ধারণা সব চাইতে বড় মিথ্যা কথা।
▪অপরের গোপনীয় দোষ খুঁজে বেড়ায়ও না।
▪গোয়েন্দাগিরি করো না।
▪একে অপরের সাথে (অসৎ কাজে) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করো না,
▪পরস্পরে হিংসা করো না,
▪পরস্পরে বিদ্বেষ পোষণ করো না,
▪একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন হয়ো না।
তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও; যেমন তিনি তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সুতরাং
▪ সে তার প্রতি জুলুম করবে না,
▪ তাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেবে না,
▪ এবং তাকে তুচ্ছ ভাববে না।
“আল্লাহ ভীতি এখানে রয়েছে… আল্লাহ ভীতি এখানে রয়েছে…” (এ কথা বলে তিনি নিজ বুকের দিকে ইঙ্গিত করলেন।)

(রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন,)

▪ কোন মুসলমান ভাইকে তুচ্ছ ভাবা একটি মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
▪ প্রত্যেক মুসলমানের রক্ত, সম্ভ্রম ও সম্পদ অপর মুসলমানের উপর হারাম।
▪ নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের দেহ ও আকার-আকৃতি দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন।’’

💠 অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘তোমরা পরস্পর হিংসা করো না, পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করো না, অপরের গোয়েন্দাগিরি করো না, একে অপরের গোপনীয় দোষ খুঁজে বেড়ায়ও না, পরস্পরের পণ্যদ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়ো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও।’’

💠 আর এক বর্ণনায় আছে, ‘‘তোমরা পরস্পর সম্পর্ক-ছেদ করো না, একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন হইয়ো না, পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করো না, পরস্পর হিংসা করো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও।’’

💠 অন্য আরও এক বর্ণনায় আছে, ‘‘তোমরা একে অন্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করো না এবং অপরের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয় করো না।’’ (এ সবগুলো ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন ৬৭০১-৬৭০৫ এবং এর অধিকাংশ বর্ণনা করেছেন বুখারি ৫১৪৩, ৬০৬৪, ৬০৬৬, ৬৭২৪)

✪ ৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন,

سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ وَقِتَالُهُ كُفْرٌ

“মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসেকি (পাপাচার) এবং তার সাথে লড়াই করা কুফরি।” [সহিহ মুসলিম]

✪ ৪. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেন,

« إنَّ دِماءكُمْ ، وَأمْوَالَكُمْ ، وأعْرَاضَكُمْ ، حَرَامٌ عَلَيْكُمْ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا » . (متفق عَلَيْهِ).

“নিশ্চয়ই তোমার পরস্পরের রক্ত (জীবন), ধন-সম্পদ ও মান-সম্মান পরস্পরের জন্য হারাম ও সম্মানের যোগ্য, তোমাদের আজকের এ দিনের সম্মানের মতই।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

✪ ৫. তিনি আরও বলেন,

لا يَدْخُلُ الجَنَّةَ قَتَّاتٌ » (مُتَّفَقٌ عَلَيهِ)

“চোগলখোর তথা পর নিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

✪ ৬. তিনি আরও বলেছেন,

« سِبَابُ المُسْلِمِ فُسُوقٌ ، وَقِتالُهُ كُفْرٌ » . (مُتَّفَقٌ عَلَيهِ)
“মুসলিম ব্যক্তিকে গালি দেওয়া পাপ এবং তার বিরুদ্ধে লড়াই করা কুফরি।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]
এ মর্মে আরও অসংখ্য হাদিস রয়েছে।
আমাদের উচিৎ, ইসলামের এই রত্নতুল্য দিক-নির্দেশনাগুলো নিজেরা অনুসরণ করা, পরিবারে চর্চা করা, শিশুদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া এবং সমাজে বিভিন্নভাবে প্রচার-প্রসারের ব্যবস্থা করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পারস্পারিক হিংসা-বিদ্বেষ, কু ধারণা, ছিদ্রান্বেষণ, অপবাদ, গিবত, চরিত্র গহন, গোপনীয়তা লঙ্ঘণ, ঝগড়া, মারামারি, কাটাকাটি ইত্যাদি নিকৃষ্ট স্বভাব-চরিত্র থেকে হেফাজত করুন এবং ইসলামি সুন্দর ও চারিত্রিক মাধুরী দ্বারা জীবন ও সমাজ গঠনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬◐◯◑▬▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।