ইসলামের দৃষ্টিতে সুস্থতার গুরুত্ব এবং দুটি ভ্রান্তি নিরসন

প্রশ্ন: সুস্থতা ও অবসর আল্লাহ তাআলার নিয়ামত। সুস্থ থাকার জন্য দোয়াও আছে। কিন্তু এক জায়গায় পেলাম, “যে ব্যক্তি অসুস্থ হয় না, সে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত নয়…। তাহলে এ দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে? তাহলে কি আমরা অসুস্থতা জন্য দোয়া করব? দয়া করে বুজিয়ে বলবেন। জাজাকাল্লাহ।

উত্তর:
নি:সন্দেহে দুনিয়ায় আল্লাহর নিয়ামত সমূহের মধ্যে অন্যতম সেরা নিয়ামত হল, সুস্থতা। মানুষ অসুস্থ হলেই সুস্থতার মূল্য বুঝতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ সুস্থ অবস্থায় তার যথাযথ সদ্ব্যবহার করে না! তাই তো হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
◈ ১) ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
« ﻧِﻌْﻤَﺘَﺎﻥِ ﻣَﻐْﺒُﻮﻥٌ ﻓِﻴﻬِﻤَﺎ ﻛَﺜِﻴﺮٌ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﺍﻟﺼِّﺤَّﺔُ ﻭَﺍﻟْﻔَﺮَﺍﻍ ».
‘দুটি নেয়ামত এমন যে ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষ উদাসীন। আর তা হল, সুস্থতা (সুস্বাস্থ্য) ও অবসর সময়।'[বুখারী : ৬৪১২]

◈ ২) উবাইদুল্লাহ বিন মিহসান খাত্বমী রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمْ آمِنًا فِي سِرْبِهِ مُعَافًى فِي جَسَدِهِ عَندَهُ قُوتُ يَوْمِهِ فَكَأَنَّمَا حِيزَتْ لَهُ الدُّنْيَا (بحذافيره
“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তার ঘরে (অথবা গোত্রের লোকদের মাঝে) নিরাপদে ও সুস্থ শরীরে সকাল করেছে এবং তার কাছে সে দিনের খাবার আছে, তাকে যেন পার্থিব সমস্ত সম্পদ দান করা হয়েছে।” (তিরমিযী ২৩৪৬, ইবনে মাজাহ ৪১৪১নং, সহিহ)

◈ ৩) তিনি আরও বলেছেন,
اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ : شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ ، وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ ” .
”তোমরা পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিস আসার আগে গনিমতের অমূল্য সম্পদ মনে করো:
১) জীবনকে মৃত্যু আসার আগে।
২) সুস্থতাকে অসুস্থ হওয়ার আগে।
ও) অবসর সময়কে ব্যস্ততা আসার আগে।
৪) যৌবনকে বার্ধক্য আসার আগে এবং
৫) সচ্ছলতাকে দরিদ্রতা আসার আগে।”
(মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৮ম খণ্ড, ৮ম অধ্যায় ১২৭ পৃষ্ঠা। আল্লামা আলবানী রহঃ, হাদিসটি সহীহ বলেছেন।)
◈ ৪) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে সুস্থতার জন্য দুআ করেছেন এবং তার উম্মতকে দুআ শিক্ষা দিয়েছেন। এ মর্মে অনেকগুলো হাদিস রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হল:
اللَّهُمَّ عَافِنِي فِي بَدَنِي ، اللَّهُمَّ عَافِنِي فِي سَمْعِي ، اللَّهُمَّ عَافِنِي فِي بَصَرِي ، لا إِلَهَ إِلا أَنْتَ
উচ্চারণ:
আল্ল-হুম্মা আ-ফিনী ফী বাদানী, আল্ল-হুম্মা আ-ফিনী ফী সাম’ঈ, আল্ল-হুম্মা আ-ফিনী ফী বাসারী, লা-ইলা-হা ইল্লা আনতা।
অর্থ:
“হে আল্লাহ, তুমি আমার শরীর সুস্থ ও নিরাপদ রাখো।
হে আল্লাহ, তুমি আমার কান সুস্থ ও নিরাপদ রাখো।
হে আল্লাহ, তুমি আমার চোখ সুস্থ ও নিরাপদ রাখো। তুমি ছাড়া কোন উপাস্য নাই।”
(আল-আদাবুল মুফরাদ হাদিস নং ৭০৬, অধ্যায়ঃ দোয়া-দরুদ, সনদ হাসান)

◈ ৫) তাছাড়া রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রোগ-ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভের জন্য নিজেও রুকিয়া (ঝাড়ফুঁক) করেছেন ও তার উম্মতকে শিক্ষা প্রদান করেছেন এবং মধু, কালোজিরা, শিঙ্গা লাগানো ইত্যাদি নানাবিধ চিকিৎসা উপায়-উপকরণের দিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন।

🏮 বিভ্রান্তি নিরসন-১: রোগ-ব্যাধী হয় না এমন ব্যক্তির ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য সংক্রান্ত হাদীসগুলো সহীহ নয়:

উপরোল্লিখিত হাদিস সমূহ থেকে সুষ্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় যে, ইসলামে সুস্থতার ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হবে না তার ব্যাপারে বিরূপ বক্তব্য থাকার বিষয়টি উপরোক্ত হাদিসগুলোর সাথে সাঙ্ঘর্ষিক। আর বাস্তবেই এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদিস পাওয়া যায়। তবে হাদিস শাস্ত্রের পণ্ডিতদের দৃষ্টিতে এ সংক্রান্ত হাদিসগুলোর কোনটি বানোয়াট আর কোনটা যইফ যা সনদের বিচারে গ্রহণযোগ্য নয়।

🔴 এ মর্মে নিম্নে তিনটি হাদিসের মূল ইবারত (টেক্সট) তুলে ধরা হল (মুহাদ্দিসদের বক্তব্য অনুযায় -১ম হাদিসটি যঈফ এবং (অনেক মুহাদ্দিসের মতে) ২য়ও যঈফ এবং ৩য়টি আলবানী রহ. এর মতে মাওযু বা বানোয়াট হাদীস।

2465- قَالَ إِسْحَاقُ بْنُ رَاهَوَيْهِ‏:‏ أَنْبَأَ أَبُو عَامِرٍ الْعَقَدِيُّ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ أَبِي حُمَيْدٍ، عَنْ مُسْلِمِ بْنِ عَقِيلٍ مَوْلَى الزَّرَقِيِّينَ، قَالَ‏:‏ دَخَلْتُ عَلَى عَبْدِ اللَّهِ بْنِ إِيَاسِ بْنِ أَبِي فَاطِمَةَ، فَقَالَ‏:‏ يَا أَبَا عَقِيلٍ، حَدَّثَنِي أَبِي، أَنَّ أَبَاهُ أَخْبَرَهُ، فَقَالَ‏:‏ بَيْنَمَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم جَالِسٌ، إِذْ قَالَ‏:‏ مَنْ مِنْكُمْ يُحِبُّ أَنْ لاَ يَسْقَمَ‏؟‏ فَابْتَدَرْنَاهُ، فَقُلْنَا‏:‏ نَحْنُ يَا رَسُولَ اللَّهِ، فَقَالَ‏:‏ أَتُحِبُّونَ أَنْ تَكُونُوا مِثْلَ الْحُمُرِ الضَّالَّةِ، وَتَغَيَّرَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم حَتَّى رَأَيْنَا فِي وَجْهِهِ، ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم‏:‏ أَلاَ تُحِبُّونَ أَنْ تَكُونُوا أَصْحَابَ بَلاَءٍ وَكَفَّارَاتٍ‏؟‏ فقَالُوا‏:‏ بَلَى، يَا رَسُولَ اللَّهِ، قَالَ صلى الله عليه وسلم‏:‏ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، إِنَّ الْمُؤْمِنَ لَيُبْتَلَى بِالْبَلاَءِ، وَذَلِكَ مِنْ كَرَامَتِهِ عَلَى اللَّهِ تَعَالَى، وَإِنَّهُ لَيُبْتَلَى بِالْبَلاَءِ حَتَّى يَنَالَ مِنْهُ مَنْزِلَةً عِنْدَ اللَّهِ تَعَالَى، لاَ يَنَالُهَا دُونَ أَنْ يُبْتَلَى بِذَلِكَ، فَيُبْلِغُهُ اللَّهُ تَعَالَى تِلْكَ الْمَنْزِلَةَ‏.‏

مُحَمَّدُ بْنُ أَبِي حُمَيْدٍ ضَعِيفٌ‏.‏

2465- وقَالَ أَبُو بَكْرٍ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ‏:‏ حَدَّثَنَا مُصْعَبُ بْنُ الْمِقْدَامِ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ هُوَ ابْنُ أَبِي حُمَيْدٍ، بِهِ نَحْوَهُ‏.‏

2466- وَقَالَ أَبُو بَكْرٍ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ‏:‏ حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ بَكْرٍ، عَنْ سِنَانِ بْنِ رَبِيعَةَ الْحَضْرَمِيِّ، عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، أَنَّ امْرَأَةً أَتَتْ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم، فَقَالَتْ‏:‏ يَا رَسُولَ اللَّهِ، بِنْتٌ لِي كَذَا وَكَذَا، فَذَكَرَتْ مِنْ حُسْنِهَا، وَجَمَالِهَا، فَأُوثِرُكَ بِهَا، قَالَ‏:‏ قَدْ قَبِلْتُهَا، فَلَمْ تَزَلْ تَمْدَحُهَا حَتَّى ذَكَرَتْ أَنَّهَا لَمْ تُصَدَّعْ، وَلَمْ تَشْتَكِ شَيْئًا قَطُّ، قَالَ‏:‏ لاَ حَاجَةَ لِي فِي ابْنَتِكِ‏.‏
الراوي:أنس بن مالك المحدث:شعيب الأرناؤوط المصدر:تخريج المسند الجزء أو الصفحة:12580 حكم المحدث:إسناده ضعيف
2466- وَقَالَ أَبُو يَعْلَى‏:‏ حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ‏.‏

2467- وَقَالَ الْحَارِثُ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ أَبِي أُسَامَةَ‏:‏ حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ إِسْحَاقَ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الْوَاحِدِ بْنُ زِيَادٍ، عَنْ عَاصِمٍ الأَحْوَلِ، عَنْ أَبِي عُثْمَانَ، قَالَ‏:‏ دَخَلَ عَلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَعْرَابِيٌّ جَسِيمٌ، ذُو جُثْمَانٍ عَظِيمٍ، فَقَالَ لَهُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم‏:‏ مَتَى عَهْدُكَ بِالْحُمَّى‏؟‏ قَالَ‏:‏ لاَ أَعْرِفُهَا، قَالَ‏:‏ فَالصُّدَاعُ‏؟‏ قَالَ‏:‏ لاَ أَدْرِي مَا هُوَ‏؟‏ قَالَ‏:‏ فَأُصِبْتَ فِي مَالِكَ‏؟‏ قَالَ‏:‏ لاَ، قَالَ‏:‏ فَرُزِئْتَ بِوَلَدِكَ‏؟‏ قَالَ‏:‏ لاَ، فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم‏:‏ إِنَّ اللَّهَ يُبْغِضُ الْعِفْرِيتَ، النِّفْرِيتَ، الَّذِي لاَ يُرْزَأُ فِي وَلَدِهِ، وَلاَ يُصَابُ فِي مَالِهِ‏.‏
الراوي:عبدالرحمن بن مل النهدي أبو عثمان المحدث:الألباني المصدر:السلسلة الضعيفة الجزء أو الصفحة:5821 حكم المحدث:موضوع

 আরেকটি বিভ্রান্তি নিরসন: বিশেষ একটি রোগ থেকে মুক্ত থাকার কারণে রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি কাউকে জাহান্নামী বলেছেেন?
হাদিস:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: جَاءَ أَعْرَابِيٌّ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «هَلْ أَخَذَتْكَ أُمُّ مِلْدَمٍ؟» قَالَ: وَمَا أُمُّ مِلْدَمٍ؟ قَالَ: «حَرٌّ بَيْنَ الْجِلْدِ وَاللَّحْمِ» ، قَالَ: لَا، قَالَ: «فَهَلْ صُدِعْتَ؟» قَالَ: وَمَا الصُّدَاعُ؟ قَالَ: «رِيحٌ تَعْتَرِضُ فِي الرَّأْسِ، تَضْرِبُ الْعُرُوقَ» ، قَالَ: لَا، قَالَ: فَلَمَّا قَامَ قَالَ: «مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَنْظُرَ إِلَى رَجُلٍ مِنْ أَهْلِ النَّارِ» أَيْ: فَلْيَنْظُرْهُ

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিতঃ এক বেদুইন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট উপস্থিত হলে তিনি তাকে বলেনঃ তোমাকে কি উম্মু মিলদাম স্পর্শ করেছে?
সে বললো, উম্মু মিলদাম কি?
তিনি বলেনঃ দেহের চামড়া ও গোশতের মধ্যবর্তী স্থানের উত্তাপ (জ্বর)।
সে বললো, না।
তিনি পুনরায় বলেনঃ তুমি কি সুদা আক্রান্ত হয়েছো?
সে বললো, সুদা কি? তিনি বলেনঃ একটি বায়ু যা মাথায় অনুভূত হয় এবং তা শিরাসমূহে আঘাত করে।
সে বললো, না।
অতঃপর সে ব্যক্তি উঠে চলে গেলে- তিনি বলেনঃ “যে ব্যক্তি কোন দোযখীকে দেখতে আগ্রহী সে যেন এই ব্যক্তিকে দেখে নেয়।” (হাকিম, ইবনে হিব্বান-আল আদাবুল মুফরা প্রমূখ। সনদ হাসান সহিহ)

ব্যাখ্যা:
মুহাদ্দিসগণ বলেন, এ হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যক্তিকে উপরোক্ত রোগ না থাকার কারণে দোযখী/জাহান্নামী হিসেবে আখ্যায়িত করেন নি। বরং তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে জনেছেন যে, তার মধ্য এমন গুনাহ রয়েছে যা তার জন্য জাহান্নাম আবশ্যক করে। তাই তিনি তার ব্যাপারে বলেছেন: “যে ব্যক্তি কোন দোযখীকে দেখতে আগ্রহী সে যেন এই ব্যক্তিকে দেখে নেয়।”

এক দিকে সে গুনাহগার অপর দিকে রোগ-ব্যাধী দূর হয় তার এমন কোন অসুখও হয় নি। অথচ বহু হাদিসে এসেছে যে, অসুখ-বিসুখ, বিপদাপদ দ্বারা বান্দার গুনাহ মোচন করেন এবং তাকে পবিত্র করে দেন।
আল্লাহু আলাম
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী
লিসান্স, মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব