ইমাম আবু হানীফা হাদীসের বিরোধিতা করে রায়-ক্বিয়াসকে এর উপর প্রাধান্য দেওয়া প্রসঙ্গে

ইমাম আবু হানীফা (রহিঃ) হাদীসের বিরোধিতা করে রায়-ক্বিয়াসকে এর উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। এই বক্তব্য কতটুকু সঠিক? বিস্তারিত বর্ননা সহ।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
চার ইমামের একজন ইমাম আবু হানীফা (রহিঃ) প্রচলিত আছে তিনি হাদীসের বিরোধিতা করে রায়-ক্বিয়াসকে এর উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। এটা ইমাম আবু হানীফা (রহিঃ)-এর উপর অপবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি নিজেই এ অপবাদের জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, كَذَبَ وَاللهِ وَافْتَرَى عَلَيْنَا مَنْ يَّقُوْلُ إِنَّنَا نُقَدِّمُ الْقِيَاسَ عَلَى النَّصِّ، وَهَلْ يُحْتَاجُ بَعْدَ النَّصِّ إِلَى قِيَاسٍ ‘আল্লাহর কসম! যে বলে যে, আমরা কুরআন-সুন্নাহর বক্তব্যের উপর ক্বিয়াসকে প্রাধান্য দেই, সে আমাদের উপর মিথ্যারোপ করে। কুরআন-সুন্নাহর বক্তব্য পাওয়া গেলে ক্বিয়াসের কোনো দরকার আছে কি?(শা‘রাবী, আল-মীযানুল কুবরা, (তা.বি), ১/৭১)

তিনি আরো বলেন, لَيْسَ لِأَحَدٍ أَنْ يَّقُوْلَ بِرَأْيِهِ مَعَ كِتَابِ اللهِ تَعَالَى، وَلَا مَعَ سُنَّةِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَا مَعَ مَا أَجْمَعَ عَلَيْهِ الصَّحَابَةُ ‘আল্লাহর কিতাব, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাত এবং সাহাবায়ে কেরামের ইজমা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় কেউ তার নিজের মতানুযায়ী কথা বলতে পারে না।’(উকূদুল জিমান ফী মানাক্বিবিল ইমামিল আ‘যম আবী হানীফা আন-নু‘মান,বাদশা আব্দুল আযীয বিশ্ববিদ্যালয়, তা.বি, পৃঃ ১৭৮)।
.
সহীহ হাদীসের উপর ক্বিয়াসকে প্রাধান্য দেওয়া তো অনেক দূরের কথা,এমনকি অগ্রহণযোগ্য হাদীসের উপরও তিনি ক্বিয়াসকে প্রাধান্য দিতেন না। তিনি বলেন, اَلْخَبَرُ الْمُرْسَلُ وَالضَّعِيْفُ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَوْلَى مِنَ الْقِيَاسِ وَلَا يَحِلُّ الْقِيَاسُ مَعَ وُجُوْدِهِ ‘রাসূল (ﷺ) থেকে বর্ণিত মুরসাল ও যঈফ হাদীস ক্বিয়াস করার চেয়েও উত্তম। এমন হাদীস থাকা অবস্থায় ক্বিয়াস করা বৈধ নয়।'(ইবনে হাযম, আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম,তাহক্বীক্ব: আহমাদ শাকের, দারুল আফাক্ব আল-জাদীদাহ, বৈরূত, তা. বি.,৭/৫৪)।

বরং কুরআন-হাদীসের বক্তব্য থাকা অবস্থায় ক্বিয়াসকে বা কুরআন ও হাদীসের উপর ভিত্তিশীল নয় এমন ক্বিয়াসকে তিনি নিন্দা করেছেন। ওয়াকী‘ (রহিঃ) বলেন, আমি আবু হানীফা (রহিঃ)-কে বলতে শুনেছি, اَلْبَوْلُ فِي الْمَسْجِدِ أَحْسَنُ مِنْ بَعْضِ الْقِيَاسِ ‘কিছু কিছু ক্বিয়াসের চেয়ে মসজিদে পেশা করা ভালো।’(ইবনে আদী, আল-কামেল ফী যু‘আফাইর রিজাল, তাহক্বীক্ব: আদেল আহমাদ ও আলী মুহাম্মাদ, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরূত, ১ম প্রকাশ: ১৪১৮ হি./১৯৯৭ খৃ.), ৮/২৪১)।
.
কোনো যুগের উলামায়ে কেরামও ইমাম আবু হানীফা (রহিঃ)-এর উপর আরোপিত এ অপবাদ মেনে নেননি, বরং কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আবু হানীফা (রহিঃ)-এর সমসাময়িক মুহাদ্দিস সুফিয়ান সাওরী (রহিঃ) বলেন, كَانَ أَبُو حَنِيفَةَ شَدِيدَ الأَخْذِ لِلْعِلْمِ ذَابًّا عَنْ حَرَمِ اللَّهِ أَنْ تُسْتَحَلَّ يَأْخُذُ بِمَا صَحَّ عِنْدَهُ مِنَ الأَحَادِيثِ الَّتِي كَانَ يَحْمِلُهَا الثِّقَاتُ وَبِالآخَرِ مِنْ فِعْلِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وَبِمَا أَدْرَكَ عَلَيْهِ عُلَمَاءَ الْكُوفَةِ ثُمَّ شَنَّعَ عَلَيْهِ قَوْمٌ يَغْفِرُ الله لنا وَلَهُم ‘আবু হানীফা ইলম গ্রহণের ব্যাপারে কঠোর ছিলেন। আল্লাহর হালালকৃত কোনো বিষয়কে হারাম করে নেওয়াকে তিনি শক্তহস্তে দমন করতেন। বিশ্বস্ত রাবীগণের বর্ণিত সহীহ হাদীস, রাসূল (ﷺ)-এর কর্ম এবং কূফার আলেমগণের বিশুদ্ধ নীতি তিনি গ্রহণ করতেন। এতদসত্ত্বেও কিছু মানুষ তার নিন্দা করে! আল্লাহ আমাদেরকে এবং তাদেরকে ক্ষমা করুন।’(আল-ইনতিক্বা, পৃঃ ১৪২)।
.
ইমাম আবু হানীফা (রহিঃ)-এর ছাত্র যুফার (রহিঃ) বলেন, ‘বিরোধীদের কথার দিকে ভ্রুক্ষেপ করবেন না। কেননা আবু হানীফা এবং আমাদের অনুসারীরা কোনো মাসআলাতেই কিতাব, সুন্নাহ ও বিশুদ্ধ বক্তব্যের বাইরে কথা বলেননি। অতঃপর (সেগুলোতে না পেলে) এর উপর ক্বিয়াস করেছেন।’(মান্না‘ আল-কাত্তান, তারীখুশ তাশরী‘ আল-ইসলামী, (মাকতাবাতু ওয়াহবাহ, ৫ম প্রকাশ: ১৪২২ হি./২০০১ খৃ.), পৃঃ ১৪২)।
.
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহিঃ) বলেন, وَمَنْ ظَنَّ بِأَبِي حَنِيفَةَ أَوْ غَيْرِهِ مِنْ أَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ أَنَّهُمْ يَتَعَمَّدُونَ مُخَالَفَةَ الْحَدِيثِ الصَّحِيحِ لِقِيَاسِ أَوْ غَيْرِهِ فَقَدْ أَخْطَأَ عَلَيْهِمْ وَتَكَلَّمَ إمَّا بِظَنِّ وَإِمَّا بِهَوَى فَهَذَا أَبُو حَنِيفَةَ يَعْمَلُ بِحَدِيثِ التوضي بِالنَّبِيذِ فِي السَّفَرِ مُخَالَفَةً لِلْقِيَاسِ وَبِحَدِيثِ الْقَهْقَهَةِ فِي الصَّلَاةِ مَعَ مُخَالَفَتِهِ لِلْقِيَاسِ؛ لِاعْتِقَادِهِ صِحَّتَهُمَا وَإِنْ كَانَ أَئِمَّةُ الْحَدِيثِ لَمْ يُصَحِّحُوهُمَا. ‘যে ব্যক্তি আবু হানীফা বা মুসলিমদের অন্য কোনো ইমামের ব্যাপারে ধারণা করে যে, তারা ক্বিয়াসের কারণে বা অন্য কোনো কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে সহীহ হাদীসের বিরোধিতা করেন, সে ব্যক্তি তাদের ব্যাপারে ভুল কথা বলে এবং ধারণা প্রসূত বা প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলে। এই ধরুন আবু হানীফা, যিনি ক্বিয়াসের বিরোধিতা করে সফর অবস্থায় ‘নাবীয’(লওখেজুর, কিশমিশ বা অন্য কোনো শস্যদানা পানিতে ভিজালে যে পানীয় প্রস্তুত হয়, তা-ই হচ্ছে নাবীয। এটা হালাল হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে, তিন দিনের বেশী সময় ভিজিয়ে রাখা যাবে না এবং মাদকতা সৃষ্টি হওয়া চলবে না। দ্বারা ওযুর হাদীসের উপর আমল করেছেন। অনুরূপভাবে সালাতের অট্টহাসির হাদীসের উপর আমল করেছেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এ হাদীস দু’টি সহীহ; যদিও মুহাদ্দিসগণ হাদীস দু’টিকে সহীহ বলেননি।'(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়াহ, ২০/৩০৫)।
.
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহিঃ) বলেন, وَأَصْحَابُ أَبِي حَنِيفَةَ رَحِمَهُ اللَّهُ مُجْمِعُونَ عَلَى أَنَّ مَذْهَبَ أَبِي حَنِيفَةَ أَنَّ ضَعِيفَ الْحَدِيثِ عِنْدَهُ أَوْلَى مِنْ الْقِيَاسِ وَالرَّأْيِ، وَعَلَى ذَلِكَ بَنَى مَذْهَبَهُ ‘আবু হানীফা (রহিঃ)-এর অনুসারীগণ ইজমা পোষণ করেছেন যে, আবু হানীফার মাযহাব হচ্ছে, তার নিকট ক্বিয়াস ও ব্যক্তিমতের চেয়ে দুর্বল হাদীস ভালো। এর উপরেই তিনি তার মাযহাবের ভিত্তি রচনা করেছেন।'(ইবনুল ক্বাইয়িম, এ‘লামুল মুওয়াক্বে‘ঈন আন রব্বিল আলামীন, তাহক্বীক্ব: মুহাম্মাদ আব্দুস সালাম, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ: ১৪১১ হি./১৯৯১ খৃ., ১/৬১)।
.
ইবনু আবিল ইয হানাফী (রহিঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বলে, আবু হানীফা রাসূলগণ (ﷺ)-এর সরদারের বিরোধিতা করেছেন, তাকে একথা বলা ওয়াজিব যে, (তার) এই বক্তব্য এই মহামতি ইমামের উপর মিথ্যা অপবাদ ও গালি। এই মিথ্যা অপবাদ থেকে তাকে বিরত রাখা যরূরী। বিশেষ করে ঐ ব্যক্তি যদি মনে করে যে, তিনি (আবু হানীফা) ইচ্ছাকৃতভাবে রাসূল (ﷺ)-এর বিরোধিতা করেছেন। তবে, এর দ্বারা যদি তার উদ্দেশ্য হয় যে, ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম আবু হানীফার (কোনো কোনো ক্ষেত্রে) এমন বিরোধিতা হয়ে গেছে, তাহলে সেটা কিছুটা হালকা। আর এমনটা তো ইজতেহাদী মাসআলাতে অন্যদেরও হয়ে থাকে। ইচ্ছাকৃতভাবে কুরআন-হাদীসের বিরোধিতা করলে তা হবে কুফরী। আর ইজতেহাদ বশতঃ হয়ে গেলে তা ক্ষমাযোগ্য ভুল হিসাবে গণ্য হবে। অতএব, ইমাম আবু হানীফা হোক বা অন্য কোনো আলেম হোক, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে রাসূল (ﷺ)-এর বিরোধিতা করেছেন এমন কথা বলা জায়েয নেই। বরং বলতে হবে, হয়তোবা তার কাছে দলীল পৌঁছেনি অথবা তার কাছে দলীল স্পষ্ট হয়নি বা বাহ্যতঃ বিরোধপূর্ণ অন্য কোনো দলীল তার কাছে আছে বা অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে।'(ইবনু আবিল ইয, আল-ইত্তিবা‘, (তাহক্বীক্ব: মুহাম্মাদ আতাউল্লাহ ও আছেম ইবন আব্দুল্লাহ, আলামুল কুতুব, লেবানন, ২য় প্রকাশ: ১৪০৫ হি., পৃঃ ২৮-২৯)।

আবু হামযা আস-সুক্কারী (রহিঃ) বলেন, আমি আবু হানীফাকে বলতে শুনেছি, ‘রাসূল (ﷺ) থেকে সনদ সহকারে যখন সহীহ হাদীস আসে, তখন সেটাকেই আমরা গ্রহণ করি; সেটাকে আমরা ডিঙ্গিয়ে যাই না’। (আল-জাওয়াহিরুল মুযিয়্যাহ, ২/২৪৯)।

ইমাম আবু হানীফা (রহিঃ)-এর এ বক্তব্য স্পষ্ট প্রমাণ করে, রাসূল (ﷺ) থেকে যা কিছু সহীহ সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে, তার সবটার প্রতিই তিনি ঈমান এনেছেন, সত্যায়ন করেছেন এবং গ্রহণ করেছেন। এ ব্যাপারে কোনটা মুতাওয়াতির আর কোনটা আহাদ তার কোনো তোয়াক্কা তিনি করেননি। অতএব, ইমাম আবু হানীফা (রহিঃ)-এর নিকটে গ্রহণযোগ্য সব ধরনের হাদীস দ্বারাই আক্বীদার বিষয়গুলো সাব্যস্ত হয়েছে। কেনইবা হবে না, তিনি নিজেই তো বলেছেন, إِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ ‘যখন কোন হাদীস সহীহ প্রমাণিত হবে, তখন (জেনো যে,) সেটাই আমার মাযহাব।’(হাশিয়া ইবনু আবেদীন, ১/৬৮)।

তিনি তো একথাও বলেছেন যে, ‘দাজ্জাল ও ইয়া’জূজ-মা’জূজের আবির্ভাব, পশ্চিম দিগন্ত থেকে সূর্যোদয়, আসমান থেকে ঈসা আঃ-এর অবতরণ এবং ক্বিয়ামতের সমস্ত আলামত, যেগুলো সহীহ হাদীসে এসেছে, সবগুলোই হক্ব এবং ঘটবে।’ (আবু হানীফা, আল-ফিক্বহুল আকবার, মাকতাবাতুল ফুরক্বান, আরব আমিরাত, ১ম প্রকাশ: ১৪১৯ হি./১৯৯৯ খৃ., পৃঃ ৭২)।

তাহলে ইমাম আবু হানীফা (রহিঃ)-এর অনুসরণের নাম নিয়ে যারা আজ আক্বীদা প্রমাণ করতে গিয়ে হাদীসকে দুই ভাগ করে এক ভাগ গ্রহণ করেন আর অন্য ভাগ পরিত্যাগ করেন, তারা কোথায় আর ইমাম আবু হানীফা (রহিঃ) কোথায়?! এমকি তার বিখ্যাত দুই শিষ্য আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ ইবনুল হাসানও (রহিঃ) তাদের উস্তাদের অনুসৃত এ নীতিই গ্রহণ করেছিলেন। আবু ইউসুফ (রহিঃ) বলেন, وَقَدْ أَمَرَكَ اللَّهُ أَنْ تُؤْمِنَ بِكُلِّ مَا أَتَى بِهِ نَبِيُّهُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘নবী যা কিছু নিয়ে এসেছেন, তার সবটুকুর প্রতি ঈমান আনতে আল্লাহ আপনাকে আদেশ করেছেন(ক্বওওয়ামুস সুন্নাহ, আল-হুজ্জাহ ফী বায়ানিল মাহাজ্জাহ তাহক্বীক্ব: মুহাম্মাদ ইবন রবী‘ আল-মাদখালী, দারুর রায়াহ, রিয়াদ, ২য় প্রকাশ: ১৪১৯ হি./১৯৯৯ খৃ., ১/১২৪-১২৫)।

মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান (রহিঃ) আল্লাহর কিছু গুণ সম্পর্কিত কয়েকটি হাদীসের পরে বলেন, إِنَّ هَذِهِ الْأَحَادِيثَ قَدْ رَوَتْهَا الثِّقَاتُ، فَنَحْنُ نَرْوِيهَا وَنُؤْمِنُ بِهَا وَلَا نُفَسِّرُهَا ‘এই হাদীস গুলো ‘ছিক্বাহ’ বা নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীগণ বর্ণনা করেছেন। অতএব, আমরাও সেগুলো বর্ণনা করি এবং বিশ্বাস করি। এগুলোর অপব্যাখ্যা করি না।’(লালকাঈ, শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ,তাহক্বীক্ব: আহমাদ ইবন সা‘দ আল-গামেদী, দারু ত্বইবাহ, সঊদী আরব, ৮ম প্রকাশ: ১৪২৩ হি./২০০৩ খৃ., ৩/৪৮০)। সালফে সালেহীনের মূলনীতিও ছিলো এটাই এবং এটাই হক্ব। কেননা মুতাওয়াতির ও আহাদ-এর মধ্যে পার্থক্য করা একটি বিদ‘আত, যা পরবর্তীতে ইসলামে প্রবেশ করেছে।

অনুরূপভাবে কুরআন-হাদীসের পাশাপাশি ইমাম আবু হানীফা (রহিঃ)-এর আক্বীদা ও আমল গ্রহণের আরেকটি উৎস হলো, স্বভাবজাত প্রকৃতি। যেমন তিনি মহান আল্লাহর ঊর্ধ্বে অবস্থানের বিষয়টি প্রমাণ করতে গিয়ে স্বভাবজাত প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেন, وَاللهُ تَعَالَى يُدْعَى مِنْ أَعْلَى لَا مِنْ أَسْفَلَ لَيْسَ مِنْ وَصْفِ الرُّبُوْبِيَّةِ وَالْأُلُوْهِيَّةِ فِيْ شَيْءٍ ‘মহান আল্লাহকে উপরে ভেবেই ডাকা হয়; নীচের দিকে ভেবে নয়। কারণ নিচে অবস্থান কোনোভাবেই রব ও মা‘বুদের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।’(আল-ফিক্বহুল আকবার, পৃঃ ১৩৫)।

প্রিয় পাঠক! আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের নিকট আক্বীদার উৎস হচ্ছে, পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস এবং এতদুভয়ের সমর্থক হিসাবে স্বভাবজাত প্রকৃতি। অতএব, আক্বীদা ও আমলের উৎসের ক্ষেত্রে অন্য সালাফে সালেহীনের যে নীতি, ইমাম আবু হানীফা (রহিঃ)-এরও সেই একই নীতি। আল্লামা মু‘আল্লিমী (রহিঃ) বলেন, যিনি কুরআন গবেষণা করেন এবং হাদীস ও ইতিহাস ঘাঁটাঘাটি করেন, তিনি নিশ্চিতভাবে জানতে পারেন যে, সালাফে সালেহীনের নিকট কুরআন-হাদীস ছাড়া আক্বীদা গ্রহণের আর কোনো উৎস ছিলো না। এ দু’টোর প্রতি তাদের আস্থা ছিলো অটুট এবং এর বাইরে অন্য কিছু থেকে তারা ছিলেন বিমুখ। মূলতঃ শরী‘আত তাদেরকে এপথে আহ্বান করেছে। পবিত্র কুরআনের প্রায় প্রত্যেকটি আয়াতেই এ ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। …সালাফে সালেহীনের আক্বীদার ব্যাপারে পূর্বসূরী আলেমগণের বক্তব্যও এটা। বড় বড় গবেষকগণও তাদের সমর্থক।’(আব্দুর রহমান আল-মু‘আল্লিমী, আল-ক্বয়েদ ইলা তাছহীহিল আক্বাইদ, তাহক্বীক্ব: মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আল-আলাবানী, আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৩য় প্রকাশ: ১৪০৪ হি./১৯৮৪ খৃ, পৃঃ ১৩৫)।
.
ইমাম আবু হানিফা রহঃ সম্পর্কে ইমাম যাহাবী রহিমাহুল্লাহ লিখেন, তিনি একজন পরহেজগার, আমলওয়াল একজন আলেম, ইবাদতগুজার একজন বড় মাপের আলেম, তিনি বাদশাহের উপহার গ্রহণ করতেন না বরং নিজে ব্যবসা বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। [তাজকিরাতুল হুফফাজ ১/১৬৮]
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ভাষায় বলেন, ‘দ্বীনের ইমামদের ইজ্জত-সম্মান, হক্ব, মর্যাদা জানা এবং তাদের শ্রেষ্ঠত্ব, জ্ঞান এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ব্যাপারে আন্তরিক হওয়াটা, ঢালাওভাবে তাদের সকল বক্তব্য গ্রহণ করা আবশ্যক করে না। অনেক সময় তাদের ফাতাওয়া প্রদানের ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসিত বিষয়ে তাদের নিকট রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আনীত সমাধানটি গোপন থাকার কারণে তাঁরা তাঁদের ‘ইলমের বহরের উপর নির্ভর করে ফৎওয়া প্রদান করেছেন। অথচ পরবর্তীতে দেখা গেল হক্ব তাঁর উল্টো। (তবে এ জাতীয় ভুলের কারণে) একবাক্যে তাঁদের সকল বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা, তাদের মানহানি করা বা তাদের সাথে আক্রমণাত্মক আচরণ করা মোটেও সমীচীন নয়’। (মুহাম্মাদ ইবনু আবি বকর ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওযী, ই‘লামুল মুয়াক্কি‘ঈন, ৩য় খণ্ড (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১৪১১ হি.), পৃ. ২২০ আল ইতিসাম)।

قال الخريبي : ما يقع في أبي حنيفة إلا حاسد أو جاهل .
ইমাম মুহাদ্দিছ আব্দুল্লাহ বিন দাউদ আল খুরাইবী (মৃ: ২১৩ হিজরী) রাঃ বলেছেন: জাহেল অথবা হিংসুক ছাড়া কেউ আবু হানীফার কুৎসা রটাতে পারে না।

উপমহাদেশের আহলে হাদিসের বড় একজন আলেম, যাকে শাইখুল কুল ফিল কুল লকব দেওয়া হয়েছিল, তিনি বলেন,আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহর বিষয় নিয়ে আহলে ইলমদের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য ছিলো, কিছু উলামাগণ কয়েকটা বিষয়ের উপর ভিত্তি করে ওনার উপর খুব কঠিন জারাহ করেন যা বিভিন্ন কিতাবে লিপিবদ্ধ করে ফেলা হয়, আবার অন্যদিকে কিছু লোক ওনার ব্যাপারে এমন গুলু করেন কথা বা কাজের মাধ্যমে যা ওনাকে দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া হয় আর ওনার প্রশংসায় বিভিন্ন রেওয়ায়েত রচনা করে ফেলেন। এই দুটো রায় ইনসাফওয়ালা আহলে ইলমদের নিকট অগ্রহণযোগ্য। তার ব্যাপারে ইনসাফ ভিত্তিক রায় হচ্ছে তিনি আহলে সুন্নত ওয়ালা জামায়াতের বড় একজন ইমাম। কুরআন সুন্নাহর অনুসারী আর দ্বীন ইসলামের একজন বড় খাদেম এবং ওনাকে যারা দিফা করেছেন তারা আলেম। তিনি না দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে ছিলেন, আর না ফাসেক কুফর বিদাতের দাঈ ছিলেন। [মুকাদ্দিমা মিয়ারুল হক্ব শাইখুল কুল মিয়া নজির হোসাইন দেহলভী]

আল্লামা মুহাম্মদ ইব্রাহিম সিয়ালকুটি রহিমাহুল্লাহ তার প্রখ্যাত কিতাব তারিখে আহলে হাদিসে ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহর ব্যাপারে খুব সুন্দর আলোচনা করেন, তিনি বলেন ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ আহলে সুন্নাহর একজন বুজুর্গ ইমাম, তাঁর জীবন অনেক বড় তাকওয়াপূর্ণ হিসেবে কেটেছে যা কেউ অস্বীকার করে না।[তারিখে আহলে হাদিস, পৃষ্ঠা ৭৭] এরপর তিনি ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহর উপর আরোপিত সমস্ত অভিযোগের জবাব দেন আর প্রায় বারো পৃষ্ঠা অবধি ইমাম রহিমাহুল্লাহর সীরাত লিখেন। [পৃষ্ঠা, ৫৪-৬৫]।
.
অতএব, ইমাম আবু হানীফা (রহিঃ)-এর নিকট পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসই ছিলো আক্বীদা ও আমলের উৎস।সুতরাং ইমাম আবু হানীফা (রহিঃ)-এর আক্বীদা ও আমলের উৎস হোক আমাদেরও আক্বীদা-আমলের উৎস। তাহলে যাবতীয় বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুক। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।