ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং তাঁর আখলাক, ইলমী মর্যাদা ও গুণাবলী

আহলে সুন্নাহর অন্যতম ইমাম আবু হানীফা নু’মান (রাহিমাহুল্লাহ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং তাঁর আখলাক, ইলমী মর্যাদা ও গুণাবলী।
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬
▪️বংশ পরিচয়: ইমাম আবু হানীফা (রাহ) এর পূর্ণ নাম ‘আবূ হানীফা নু’মান ইবন সাবিত ইবন যূতা।চার মুজতাহিদ ইমামদের মধ্যে তাঁর জন্মই সর্বপ্রথম।পারস্যের অধিবাসী ছিলেন। কিন্তু তাঁর পিতৃপুরুষ ছিল কাবুলের বাসিন্দা। তাঁর পৌত্র ইসমাঈল তাঁর বংশ বর্ণনায় বলেন, আমি ইসমাঈল ইবন হাম্মাদ ইবন নুমান ইবন সাবিত ইবন নুমান ইবন মারযুবান। আমরা পারস্য বংশোদ্ভূত এবং কখনো দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হই নি। আমার দাদা ৮০ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। সাবিত শৈশবকালে আলী (রা)-এর নিকট উপস্থিত হন এবং তিনি তাঁর ও তাঁর বংশের মঙ্গলের জন্য দুআ করেছিলেন। আমরা আশা করি তাঁর ঐ দুআ নিষ্ফল হয় নি।(সাইমারী, আখবারু আবী হানীফাহ ওয়া আসহাবিহী, পৃ. ১৫-১৬; ইবন হাজার হাইতামী, আল-খাইরাতুল হিসান ফী মানাকিবি আবী হানীফাহ নুমান, পৃ. ৩০)।

◾জন্ম ও শৈশবকাল: তাঁর জন্ম তারিখ সম্পর্কে মতানৈক্য রয়েছে কেউ বলেছেন তিনি ৬০ হি.জন্মগ্রহণ করেছেন।আবার কেউ বলেছেন ৭০ হি.।তবে অধিকাংশ বর্ণনা মতে হিজরী ৮০ (৬৯৯ খৃ.) আবু হানীফা কূফাতে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তাঁর শৈশবকাল কাটে এবং সেখানেই তিনি বড় হন। ইলম অর্জন ও বিতরণের মহানব্রতে জীবনের বেশিরভাগ অংশ তিনি কূফাতেই কাটান।তাঁর পিতা ‘সাবিত’ও মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বলা হয় ছোটবেলায় তিনি আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। তখন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তার জন্য এবং তার অনাগত বংশধরদের জন্য বরকত লাভের দো‘আ করেছিলেন। আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ বেড়ে উঠেছেন সম্পূর্ণ ইসলামী পরিবেশে। তিনি তাঁর জীবনযাত্রা শুরু করেন একজন ব্যবসায়ী হিসেবে। তাঁর প্রখর স্মৃতিশক্তি ও চিন্তার তীক্ষ্ণতা দেখে ‘ফিকহুল হাদীসের’ উপর পণ্ডিতব্যক্তি ইমাম শা‘বী তাকে ব্যবসায়ের সাথে সাথে আলেমদের মজলিসে হাজির হওয়ার পরামর্শ দেন। এভাবে তিনি ইলমের পথে অগ্রসর হন। কিন্তু সাথে সাথে ব্যবসার কাজও চালিয়ে যান। (সম্পাদনা পরিষদ, ইসলামী বিশ্বকোষ, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৭২-১৭৭)।

◾ইলম অর্জন: তাঁর সময়কালে ইসলামী জ্ঞানের যেসব শাখা বিদ্যমান ছিল সেগুলোর জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে তিনি তার ইলমী জীবন শুরু করেন। ইমাম আবু হানীফা তাঁর শিক্ষা জীবনের শুরুতে কুরআন কারীম মুখস্থ করেন। ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে,তিনি কুরআন কারীমের প্রসিদ্ধ ৭ কারীর অন্যতম কারী। আসিম ইবন আবিন নাজূদ (১২৮ হি) এর নিকট ইলমুল কিরাআত শিক্ষা করেন।পরবর্তী সময়ে তিনি ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বুৎপত্তি অর্জন করেন। এছাড়া ইসলামী-আকীদা ও তৎসংশ্লিষ্ট মাসয়ালা-মাসায়েল নিয়ে তিনি বাতিল ফেরকাবাজদের সাথে বিতর্কসভায় অংশ গ্রহণ করতেন। এরপর ফিকহের (ইসলামী আইন শাস্ত্র) জ্ঞান অর্জনে নিমগ্ন হন এবং ফিকহের সাথে লেগে থাকেন। এমনকি তাঁর সকল চেষ্টা-সাধনা এ জ্ঞান অর্জনে ব্যয় করে যান। গভীরভাবে পড়াশুনার জন্য তিনি ফিকহশাস্ত্রকে কেন বেছে নিয়েছেন সে সম্পর্কে তাঁর একটি উক্তি রয়েছে। তিনি বলেন,“আমি এ ইলমকে নিয়ে যতবেশী নাড়াচাড়া করি, যতবেশী পড়াশুনা করি এর মর্যাদা ততবেশী স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে আর আমি দেখতে পাচ্ছি এ জ্ঞান ছাড়া ফরয ইবাদত আদায় করা সম্ভব নয়, দ্বীনে ইসলাম কায়েম করা সম্ভব নয়, ইবাদত-বন্দেগী করা সম্ভব নয়। এমনকি এই জ্ঞান ছাড়া দুনিয়া-আখেরাত কোনোটাই পাওয়া সম্ভব নয়।” এরপর আবু হানীফা সে যামানার বড় বড় আলেমদের সান্নিধ্যে থেকে ‘ফতোয়া’ নিয়ে গবেষণাকর্ম চালিয়ে যান। ২২ বছর বয়স থেকে তিনি তাঁর ওস্তাদ হাম্মাদ ইবন আবু সুলাইমানের সান্নিধ্যে থাকেন। আবু হানীফার বয়স যখন ৪০ বছর তখন শায়েখ হাম্মাদ মারা যান। ততদিন পর্যন্ত আবু হানীফা তাঁর সান্নিধ্যে ছিলেন।(বিস্তারিত দেখুন শীরাযী, আন-নুকাতু ফিল মাসায়িলিল মুখতালাফ ফীহা, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৬৮)।
.
ইমাম আবু হানীফা ৮০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সাহাবীদের কেউ কেউ ১১০ হিজরী সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। কাজেই ইমাম আবু হানীফার জন্য কোনো কোনো সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ করা ও শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না বরং খুবই সম্ভব ছিল। বাস্তবে কতজন সাহাবীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল সে বিষয়ে আহালুল আলেমগনের মধ্য মতানৈক্য রয়েছে।এ প্রসঙ্গে সপ্তম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও শাফিয়ী ফকীহ ইবন খাল্লিকান আহমদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন ইব্রাহীম (৬০৮-৬৮১ হি) বলেন: আবু হানীফা চার জন সাহাবীর (রা) সময় পেয়েছিলেন:

১. (বসরায়) আনাস ইবন মালিক (৯২ হি),

২. কূফায় আব্দুল্লাহ ইবন আবী আওফা (৮৭ হি),

৩. মদীনায় সাহল ইবন সা’দ সায়িদী (৮৮ হি) এবং

৪. মক্কায় আবুত তুফাইল আমির ইবন ওয়াসিলা (১১০ হি)। তাঁদের কারো সাথেই তাঁর সাক্ষাৎ হয় নি এবং কারো থেকেই তিনি কিছু শিক্ষা গ্রহণ করেন নি। তাঁর অনুসারীরা বলেন যে, কয়েকজন সাহাবীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং তিনি তাঁদের থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসগণের নিকট এ বিষয় প্রমাণিত হয় নি।’’ (ইবন খাল্লিকান, ওয়াফাইয়াতুল আ’ইয়ান, খ ৫/পৃ ৪০৬)।
.
তবে বাস্তবে প্রায় সকল জীবনীকার, রিজালবিদ ও ঐতিহাসিক একমত যে, সাহাবী আনাস ইবন মালিক (রা) এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। আল্লামা আইনী বলেন: আবু‌ হানীফা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাবিয়ীগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি আনাস ইবন মালিককে দেখেছেন। এ বিষয়ে একমাত্র কোনো মুর্খ বা হিংসুক ছাড়া কেউ সন্দেহ করেন নি। ইবন কাসীর তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে বলেন: আবু হানীফা সাহাবীদের যুগ পেয়েছিলেন। তিনি আনাস ইবন মালিককে দেখেছেন। বলা হয় যে, তিনি অন্য সাহাবীকেও দেখেছেন। খাতীব বাগদাদী তারীখ বাগদাদ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আবু হানীফা আনাস ইবন মালিককে দেখেছেন। মিয্যী তাঁর তাহযীবুল কামাল গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি আনাস ইবন মালিককে দেখেছেন। যাহাবী তাঁর ‘আল-কাশিফ’ গ্রন্থে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য আলিমও একই কথা লিখেছেন।’ (আইনী, মাগানীল আখইয়ার, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৩৬ শায়খ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ), ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং,৪৬৯৯২) আর তাবেঈ যুগ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ আমার সাহাবীদের ব্যাপারে আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি (তাদের জমানা শ্রেষ্ঠ জমানা), তারপর তাদের পরবর্তী জমানা, তারপর তাদের পরবর্তী জমানা, তারপর মিথ্যাচারের বিস্তার ঘটবে (ইবনু মা-জাহ: ২৩৬৩; তিরমিজি, ২১৬৫)।
.
◾তাঁর আখলাক: আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন অত্যন্ত দ্বীনদার-পরহেযগার, খুব বেশী ইবাদতগুজার। তিনি দিনে রোজা রাখতেন, রাতে তাহাজ্জুদ পড়তেন এবং প্রচুর কুরআন তেলাওয়াত করতেন। তিনি ছিলেন আল্লাহ্‌র ভয়ে কম্পিত ব্যক্তি। কুরআন ছিল তার সবসময়ের সাথী, একান্ত বন্ধু। তাঁর অন্যতম গুণ ছিল সহিষ্ণুতা ও বদান্যতা। ব্যবসার মাধ্যমে তাঁর হাতে প্রচুর অর্থ আসত। যদিও তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার এবং যৎসামান্য লাভে ব্যবসায়িক লেনদেন করতেন। তাঁর সম্পদের বেশীরভাগ অংশ তিনি আলেম-ওলামা ও মুহাদ্দিসদের জন্য ব্যয় করতেন। তাঁর প্রতি আল্লাহ্‌ পাকের অনুগ্রহের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি এ দান করতেন। (খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ খন্ড ১৩, পৃষ্ঠা ৩৫৪)।

ফুযাইল ইবন ইয়ায তাঁর ব্যাপারে বলেন,“আবু হানীফা ছিলেন একজন বিজ্ঞ লোক, ফিকহ শাস্ত্রে নামকরা আলেম, অঢেল সম্পদের মালিক। তাঁর কাছে তশরীফ নেয়া কাউকে কিছু না-দিয়ে বিদায় করতেন না। অত্যন্ত ধৈর্য্যের সাথে রাতদিন ইলম অর্জনে মশগুল থাকতেন। তিনি ছিলেন রাতগুজার, অল্পভাষী, অতি নীরব। কিন্তু হালাল-হারামের সাথে সম্পৃক্ত কোনো মাসয়ালা উত্থাপিত হলে তিনি মুখ খুলতেন এবং সঠিক মতের পক্ষে সুন্দরভাবে দলীল পেশ করতেন। রাজা-বাদশাহ্‌র সম্পদ থেকে তিনি দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন।

ইমাম আবু হানীফার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল হৃদয়ের প্রশস্ততা। তিনি বলতেন: اللهم من ضاق بنا صدره فان قلوبنا قد اتسعت له ‘‘হে আল্লাহ, আমাদের বিষয়ে যার অন্তর সংকীর্ণ হয়েছে, তার বিষয়ে আমাদের অন্তর প্রশস্ত হয়েছে।’’ (খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৫২)।

ইয়াযিদ ইবনু হারূন বলেন: ما رأيت أحداً أحلم من أبي حنيفة… إن إنساناً استطال على أبي حنيفة وقال له: يا زنديق، فقال أبو حنيفة: غفر الله لك هو يعلم مني خلاف ما تقول ‘‘আমি আবু হানীফার চেয়ে অধিক স্থিরচিত্ত ও প্রশস্তহৃদয় আর কাউকে দেখিনি। একবার এক ব্যক্তি তাঁর সাথে দুর্ব্যবহার করে এবং তাঁকে বলে: হে যিন্দীক। তিনি উত্তরে বলেন: আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন, তিনি জানেন যে তুমি যা বলেছ আমি তা নই।’ (যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ৯/৩১০)।

পাশাপাশি তিনি ছিলেন হক্কের বিষয়ে আপোষহীন। ইমাম আবু হানীফার প্রকৃতি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন ইমাম আবু ইউসুফ। খলীফা হারূন রাশীদ (খিলাফাত ১৭০-১৯৩ হি) বিচারপতি আবু ইউসুফকে বলেন: আবু হানীফার আখলাক ও প্রকৃতির একটি বিবরণ আমাকে বলনু তো। তখন ইমাম আবু ইউসুফ বলেন: أنه كان شديد الذب عن محارم الله أن تؤتى، شديد الورع أن ينطق في دين الله بما لا يعلم، يحب أن يطاع الله ولا يعصى، مجانبا لأهل الدنيا في زمانهم، لا ينافس في عزها، طويل الصمت، دائم الفكر، على علم واسع، لم يكن مهذارا، ولا ثرثارا، إن سئل عن مسألة كان عنده فيها علم، نطق وأجاب فيها بما سمع، وإن كان غير ذلك قاس على الحق واتبعه، صائنا نفسه ودينه، بذولا للعلم والمال، مستغنيا بنفسه عن جميع الناس، لا يميل إلى طمع، بعيدا عن الغيبة، لا يذكر أحدا إلا بخير ‘‘আল্লাহর দীন বিরোধী সকল কিছুকে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপোষহীন। তিনি অত্যন্ত পরহেযগার ও আল্লাহভীরু ছিলেন। দীনের বিষয়ে না জেনে কিছুই বলতেন না। তিনি চাইতেন যে, আল্লাহর আনুগত্য করা হোক এবং তার অবাধ্যতা না হোক। তিনি তাঁর যুগের দুনিয়ামুখি মানুষদেরকে পরিহার করে চলতেন। জাগতিক সম্মান-মর্যাদা নিয়ে তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করতেন না। গভীর জ্ঞানের অধীকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি অধিকাংশ সময় নীরব থাকতেন এবং চিন্তা-গবেষণায় রত থাকতেন। বেশি কথা বলা বা বাজে কথা বলার কোনো স্বভাব তাঁর ছিল না। কোনো মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি শ্রুতি বা হাদীসের ভিত্তিতে তার জবাব দিতেন। সে বিষয়ে কোনো শ্রুতি না থাকলে সঠিক কিয়াসের মাধ্যমে উত্তর দিতেন ও তা অনুসরণ করতেন। তিনি তাঁর নিজেকে ও তাঁর দীনকে সংরক্ষণ করতেন। তাঁর জ্ঞান ও সম্পদ তিনি অকাতরে খরচ করতেন। তিনি সকল মানুষের থেকে নিজেকে অমুখাপেক্ষী রাখতেন। কোনো লোভ তাকে স্পর্শ করতো না। তিনি গীবত বা পরচর্চা থেকে দূরে থাকতেন। কারো কথা উল্লেখ করলে শুধু ভাল কথাই বলতেন।’ (সাইমারী, আখবারু আবূ হানীফা, পৃষ্ঠা ৩১, ৩২)।

◾তাঁর ইল্মী মর্যাদা ও গুণাবলী: আবু হানীফা ছিলেন একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ ফিকহবিদ। ফিকহের ক্ষেত্রে তিনি একটি স্বতন্ত্র পথে চলেছেন এবং এ অঙ্গনে গভীরতা অর্জন করেছেন। এ কারণে প্রজন্মের পর প্রজন্মের মুখে তাঁর স্তুতির প্রতিধ্বনি শোনা যায়। জনৈক আলেম বলেন, ‘আমি আবু হানীফার সান্নিধ্যে পাঁচ বছর কাটিয়েছি। তাঁর চেয়ে বেশী সময় নীরব থাকে এমন আর কাউকে আমি দেখিনি। কিন্তু যখন ফিকহের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করা হত তখন তিনি ছিলেন উপচেপড়া পানিতে ভেসে যাওয়া উপত্যকার মত। তাঁর গুনগুনানি শব্দ এবং উচ্চকণ্ঠ দুটোই আমি শুনেছি।” তাঁর সমসাময়িক পরহেজগার, তাকওয়াবান আলেম আব্দুল্লাহ্‌ ইবন মুবারক বলেন, “তিনি হচ্ছেন ইলমের মস্তিষ্ক। তিনি ইলমের নির্যাস পেয়েছেন এবং তার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে পেরেছেন।” তার ছাত্র আবু ইউসুফ তার বর্ণনা দিয়ে বলেন, كان أبو حنيفة ربعا من الرجال، ليس بالقصير ولا بالطويل، وكان أحسن الناس منطقا وأحلاهم نغمة، وأنبههم على ما يريد ‘‘আবু হানীফা ছিলেন মাঝারি আকৃতির মানুষ, বেঁটেও নন এবং বেশি লম্বাও নন। মানুষদের মধ্যে কথাবার্তায় তিনি ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর, তাঁর কথার মাধুর্য্য ছিল সবচেয়ে বেশি এবং তিনি তাঁর মনের উদ্দেশ্য সবার চেয়ে ভাল বুঝাতে পারতেন।’’ (খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ, খন্ড ১৩, পৃষ্ঠা ৩৩০-৩৩১)।
.
আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদীস, ইমাম ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ ) সম্পর্কে কতিপয় লোক বিদ্বেষের আশ্রয় লইয়াছে, আর কতকগুলো লোক মূর্খতার পথ অবলম্বন করিয়াছে।” (তাহযীবুত তাহযীব)।

ইমাম আবু হানীফার উপরে আরোপিত অভিযোগগুলো খন্ডন করে আহলে সুন্নতের কাছে এটা এখন সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয় যে, ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহর ভুল থাকা সত্ত্বেও, ফিকহের ব্যপারে তিনি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের একজন অবিস্বরণীয় ইমাম, অত্যন্ত দানশীল ও মুত্তাক্বী একজন ব্যক্তি। ইমাম আয-যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ মুসলিম জাতির জন্যে একজন উস্তাদ (মহান শিক্ষক), অত্যন্ত মুত্তাক্বী (পরহেজগার ব্যক্তি), আল্লামাহ (মহাবিদ্বান), যাহিদ (দুনিয়া বিমুখ ও পরকালমুখী), আ’রিফ (আল্লাহর জন্যে নিজেকে একনিষ্ঠভাবে উৎসর্গীকৃত বান্দা) ছিলেন। তিনি জীবনে কোনদিন সরকারী ভাতা বা পুরষ্কার গ্রহণ করেন নাই,ব্যবসা দ্বারা স্বীয় জীবিকা নির্বাহ করতেন।” (তাযকিরাতুল হুফফাজঃ ১ম খন্ড, ১৫১পৃষ্ঠা)।

ইমাম আবু হানীফার জীবনী প্রসঙ্গে সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও হাম্বালী ফকীহ আল্লামা যাহাবী (৭৪৮ হি) প্রসিদ্ধ একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন: ইলমুল ফিকহ ও এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে নেতৃত্বের মর্যাদা এ ইমামের জন্য সংরক্ষিত। এতে কোনোই সন্দেহ নেই। ‘‘যদি দিবসকে প্রমাণ করতে দলিলের প্রয়োজন হয়, তবে আর বুদ্ধি-বিবেক বলে কিছুই থাকে না’’ (যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/৪০৩)।অর্থাৎ দিবসের দিবসত্বে সন্দেহ করা বা দিবসকে দিবস বলে প্রমাণ করতে দলিল দাবি করা যেমন নিশ্চিত পাগলামি, তেমনি ইমাম আবু হানীফার মর্যাদার বিষয়ে সন্দেহ করা বা তাঁর মর্যাদা প্রমাণের জন্য বিস্তারিত আলোচনা করাও জ্ঞান জগতের পাগলামি বলে গণ্য হওয়া উচিত। তারপরও কিছুটা ‘পাগলামি’ করতে বাধ্য হলাম।

আমীরুল মুমিনীন ফিল হাদীস নামে প্রসিদ্ধ দ্বিতীয় হিজরী শতকের জারহ-তা’দীলের শ্রেষ্ঠতম ইমাম শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ। তিনি ইমাম আবূ হানীফাকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর প্রশংসায় তিনি কবিতা পাঠ করতেন: মানুষেরা যখন আমাদেরকে কোনো কঠিন কিয়াসের ফাতওয়া দিয়ে আটকায়,আমরা তখন তাদেরকে আবু হানীফার পদ্ধতির সুদৃঢ় বিশুদ্ধ কিয়াসের শর দিয়ে আঘাত করি।’ (ইবন আদী, আল-কামিল ৭/৭-৯)।

ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে শুবা বলেন:আল্লাহর কসম! তাঁর অনুধাবন সুন্দর এবং তাঁর মুখস্থ শক্তি ভাল ছিল।’’ (সাইমারী, আখবারু আবী হানীফা, পৃ. ২৩)।

ইমাম আবু হানীফার সমসাময়িক কূফার অন্য একজন প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ও সমালোচক ইসরাঈল ইবন ইউনুস। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন: নুমান খুবই ভাল মানুষ ছিলেন। যে সকল হাদীসের মধ্যে ফিকহ রয়েছে সেগুলি তিনি খুব ভালভাবে ও পরিপূর্ণভাবে মুখস্থ রাখতেন, সেগুলির বিষয়ে সর্বোচ্চ অনুসন্ধান করতেন এবং সেগুলির মধ্যে বিদ্যমান ফিকহী নির্দেশনাও তিনি সবেচেয়ে ভাল জানতেন। এ বিষয়ে তাঁর স্মৃতি, অনুসন্ধান ও জ্ঞান ছিল অবাক করার মত। তিনি হাম্মাদ ইবন আবী সুলাইমান থেকে ফিকহ সংরক্ষণ করেন এবং খুব ভালভাবেই সংরক্ষণ করেন। ফলে খলীফাগণ, আমীরগণ ও উযীরগণ তাঁকে সম্মান করেছেন।’’ (খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৩৯)।

আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (১১৮-১৮১ হি) দ্বিতীয় শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুজাহিদ, যাহিদ ও ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক খুরাসানী (১১৮-১৮১ হি), তিনি ইমাম আবু হানীফার ছাত্র ছিলেন। তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং ফিকহী বিষয়ে তাঁর মত অনুসরণ করতেন। ইসমাঈল ইবন দাউদ বলেন: ইবনুল মুবারাক আবু হানীফা সম্পর্কে সবসময়ই ভাল বলতেন, তাঁর বিশ্বস্ততা ও বুজুর্গির কথা বলতেন এবং তাঁর প্রশংসা করতেন।’’ (ইবন আব্দুল বার্র, আল-ইনতিকা, পৃ. ১৩৩)।

আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলতেন: আমাদের নিজেদের বিষয়ে আল্লাহকে মিথ্যা বলব না!ফিকহের বিষয়ে আমাদের ইমাম আবু হানীফা এবং হাদীসের বিষয়ে আমাদের ইমাম সুফইয়ান সাওরী। আর যখন দুজন কোনো বিষয়ে একমত হন তখন আমরা তাঁদের বিপরীতে আর কাউকে পরোয়া করি না।’’ ‘‘আল্লাহ যদি আমাকে আবু হানীফা এবং সুফইয়ান সাওরী দ্বারা উদ্ধার না করতেন তাহলে আমি সাধারণ মানুষই থাকতাম।’’ ‘‘আবু হানীফা মানুষদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ।’’ (সাইমারী, আখবারু আবী হানীফা, পৃ. ১৪০; খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৩৭; যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৩৯৮)।

তৎকালীন সময়ের অন্যতম প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, সমালোচক ও বুজুর্গ ইমাম ফুদাইল ইবন ইয়াদ খুরাসানী মাক্কী (১৮৭হি), বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস তাঁর গ্রহণযোগ্যতার স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন: আবু হানীফা সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ ছিলেন। তাঁর তাকওয়া ছিল অতি প্রসিদ্ধ। তিনি সম্পদশালী ছিলেন এবং বদান্যতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। রাতদিন সার্বক্ষণিক ইলম শিক্ষা দানে তিনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল ছিলেন। রাতের ইবাদতে মাশগুল থাকতেন। অধিকাংশ সময় নীরব থাকতেন এবং কম কথা বলতেন। তবে যখন হালাল-হারামের কোনো মাসআলা তাঁর কাছে আসত তখন তিনি কথা বলতেন এবং খুব ভালভাবেই হক্ক প্রমাণ করতে পারতেন। তিনি শাসকদের সম্পদ থেকে পালিয়ে বেড়াতেন। যখন তাঁর কাছে কোনো মাসআলা আসত তখন তিনি সে বিষয়ে সহীহ হাদীস থাকলে তা অনুসরণ করতেন, অথবা সাহাবী-তাবিয়ীগণের মত। তা না হলে তিনি কিয়াস করতেন এবং তিনি সুন্দর কিয়াস করতেন।’’ (খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৪০)।

কূফার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবন খাযিম আবু মুআবিয়া দারীর বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন: حب أبي حنيفة من السنة‘‘সুন্নাতপন্থী হওয়ার একটি বিষয় আবু হানীফাকে ভালবাসা।’’ (যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৪০১; তারীখুল ইসলাম ৯/৩১০)।

এ সময়ের ইলম হাদীস ও জারহ-তাদীলের অন্য দিকপাল ইবন মাহদী। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বালের পুত্র আব্দুল্লাহ লিখেছেন, আমি আমার পিতার মুখে শুনেছি, তাঁর উস্তাদ ইবন মাহদী বলতেন: একজন মানুষের ইলমের সৌন্দর্য এই যে,সে আবু হানীফার ‘রায়’ বা মাযহাব অধ্যয়ন করবে।’’ (আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ, আস-সুন্নাহ ১/১৮০)।

ইমাম ত্বহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) জনগণের সামনে ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) এর আক্বীদা তুলে ধরেছেন, বই লিখেছেন। আর তার কথা গ্রহণযোগ্য। কারণ:

(১) তিনি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি।

(২) তার আক্বীদা সবাই সাদরে গ্রহণ করেছেন। (৩) ইমাম ত্বহাবী (রহিঃ) আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের যে আক্বীদা পেশ করেছেন, তার বেশীরভাগ ইমাম আবু হানীফা (রহিঃ)-এর দিকে সম্বন্ধিত বই-পুস্তকে বর্ণিত আক্বীদার সাথে মিলে যায়। (উছূলুদ্দীন ইনদাল ইমাম আবী হানীফা, পৃঃ ৬২৩-৬২৪)।

ইমাম আলী বিন আসিম (রাহিমাহুল্লাহ)বলেনঃ যদি আবু হানিফার জ্ঞানকে তার যুগের লোকদের জ্ঞানের সাথে ওজন করা হত, তবে তিনি তাদের চেয়ে ওজন করতেন। ইবনুল মুবারক (রাহিমাহুল্লাহ)বলেনঃ আবু হানিফা মানুষের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী চিলেন। (শায়খ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ হাফিযাহুল্লাহ, ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং১৫৮৭৫৫)।

◾ইমামের মৃত্যু: ইমাম আবু হানীফা (রাহ) ১৫০ হিজরী সালের মধ্য শাবানের রজনীতে বাগদাদের কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। বাগদাদের খাইযুরান কবরস্থানে তাঁর দাফন হয়। প্রসিদ্ধ মত অনুসারে মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৭০ বৎসর। (ইবন আব্দুল বার্র, আল-ইনতিকা, পৃ. ১৭১)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।