ইমাম আবু হানিফা রাহ. এর নামে মিথ্যাচার বন্ধ হোক

ইমাম আবু হানিফা রাহ. এর নামে মিথ্যাচার বন্ধ হোক: টানা চল্লিশ বছর ইশার ওজুতে ফজরের নামাজ আদায়!
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
সম্মানিত ইমাম আবু হানিফা রাহ. কর্তৃক টানা চল্লিশ বছর ইশার ওজুতে ফজরের নামাজ আদায় করার ঘটনাটি খুবই প্রসিদ্ধ। বিশেষ করে হানাফি মাজহাবের অনুসারী আলেম-ওলামাগণ ইমাম আবু হানিফা রাহ .এর বুজর্গির প্রমাণ হিসেবে এই ঘটনাটি উপস্থাপন করে থাকেন। কিন্তু তা মূলত: কতটা নির্ভরযোগ্য ও বাস্তব সম্মত তা উদ্ঘাটন করা জরুরি। আল হামদুলিল্লাহ নির্ভরযোগ্য আলেমগণ এ বিষয়ে ত্রুটি করেন নি। তারা যথাযথ তদন্ত ও বিশ্লেষণ পূর্বক এর প্রকৃত অবস্থা উম্মোচন করেছেন।

নিম্নে এ বিষয়ে সম্মানিত গবেষক আলেমদের গবেষণার সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরার চেষ্টা করা হল: وبالله التوفيق

খতিব বাগদাদি রহ. তার বিখ্যাত তারিখে বাগদাদ (বাগদাদের ইতিহাস) গ্রন্থে [১৫/৪৮৪] সনদ সহকারে এ বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন। অনুরূপভাবে ইমাম যাহাবী তার সিয়ার এবং তারিখে ইসলাম গ্রন্থেও তা উল্লেখ করেছেন।

তারিখে বাগদাদে উল্লেখিত বর্ণনাটি নিম্নরূপ:
أَخْبَرَنَا علي بن المحسن المعدل، قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو بكر أَحْمَد بن مُحَمَّد بن يَعْقُوب الكاغدي، قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو مُحَمَّد عبد الله بن مُحَمَّد بن يَعْقُوب بن الحارث الحارثي البخاري ببخارى، قَالَ: حَدَّثَنَا أَحْمَد بن الحسين البلخي، قَالَ: حَدَّثَنَا حماد بن قريش، قال: سمعت أسد بن عمرو، يقول: صلى أَبُو حنيفة فيما حفظ عليه صلاة الفجر بوضوء صلاة العشاء أربعين سنة، فكان عامة الليل يقرأ جميع القرآن في ركعة واحدة، وكان يسمع بكاؤه بالليل حتى يرحمه جيرانه، وحفظ عليه أنه ختم القرآن في الموضع الذي توفي فيه سبعة آلاف مرة

….আবু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন ইয়াকুব ইবনুল হারিস আল হারেসি আল বুখারী বলেন, আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন, আহমদ বিন হুসাইন আল বালখি। তিনি বলেন, আমাদেরর নিকট বর্ণনা করেছেন হাম্মাদ বিন কুরাইশ। তিনি বলেন, আমি আসাদ বিন আমর এর নিকট শুনেছি। তিনি বলেছেন,

“আবু হানিফা এর ব্যাপারে যতটুকু (ইতিহাস) সংরক্ষিত হয়েছে তাতে তিনি চল্লিশ বছর যাবত ইশার সালাতের ওজু দ্বারা ফজরের সালাত আদায় করেছেন আর তিনি অধিকাংশ রাতে এক রাকআত সালাতে সম্পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করতেন! রাতে তার কান্নার আওয়াজ শোনা যেত। ফলে তার প্রতিবেশীরা তার উপর দয়া করতেন।
আরও সংরক্ষিত হয়েছে যে, তিনি যে স্থানে মারা গেছেন সে স্থানে ৭,০০০ (সাত হাজার) বার কুরআন খতম করেছেন!”

❑ উক্ত ঘটনার গ্রহণযোগ্যতা:

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস (হাদিস বিশারদ) শাইখ আলবানি রাহ. তারিখে বাগদাদে উল্লেখিত এই বর্ণনাটিকে ইমাম আবু হানিফা রাহ. এর নামে বানোয়াট ও মিথ্যাচার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন,
وهذا موضوع ؛ آفته عبد الله بن محمد بن يعقوب – وهو الحارثي -؛ قال أبو سعيد الرواس:”يتهم بوضع الحديث” وهو الذي جمع مسنداً لأبي حنيفة رحمه الله تعالى. ] اهـ
“এ বর্ণনাটি মাওযু বা বানোয়াট। এর আপদ হল, (এর একজন বর্ণনাকারী) আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন ইয়াকুব (আল হারেসি)। তার ব্যাপারে আবু সাঈদ রাওয়াস বলেন, يتهم بوضع الحديث “এ ব্যক্তি হাদিস তৈরির অভিযোগে অভিযুক্ত। তিনিই আবু হানিফা রাহ. এর মুসনাদ (মুসনাদে আবু হানিফা রাহ.) সংকলন করেছেন।” [সিলসিলা যাঈফা ওয়াল মাওযুআহ, হা/৩৫০০]”

❑ এই বর্ণনাকারীর ব্যাপারে অন্যান্য রিজাল শাস্ত্রবিদগণের অভিমত:

◈ ১. ইবনুল জাওযী বলেন,
قال أبو سعيد الرواس: يتهم بوضع الحديث

“আবু সাঈদ রাওয়াস বলেন, তিনি হাদিস বানানোর অভিযোগে অভিযুক্ত।”

◈ ২. আহমদ সুলাইমানী বলেন,
كان يضع هذا الإسناد على هذا المتن وهذا المتن على هذا الإسناد وهذا ضرب من الوضع
“তিনি বানিয়ে বানিয়ে এই হাদিসের সনদকে ওই হাদিসের মতনে এবং ওই হাদিসের মতনকে এই হাদিসের সনদে লাগিয়ে দিতেন। এটাও এক প্রকার হাদিস তৈরির শামিল।”

◈ ৩. হামযা আস সাহমি বলেন,
سألت أبا زرعة أحمد بن الحسين الرازي عنه فقال: ضعيف
“আমি আবু যুরায়াহ আহমদ বিন হুসাইন আর রাযী-কে তার ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “তিনি জইফ (দুর্বল)।”

◈ ৪. হাকিম বলেন,
هو صاحب عجائب وأفراد عن الثقات سكتوا عنه
“এ লোক নির্ভরযোগ্য লোকদের নামে অদ্ভুত এবং ব্যতিক্রমী এমন সব হাদিস বলতো যেগুলোর ব্যাপারে তারা কোনও কথা বলেন নি।”

◈ ৫. খাতিব বাগদাদি বলেন, لاَ يُحْتَجُّ به “এই ব্যক্তিকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না।”
তিনি আরও বলেন,
كان صاحب عجائب ومناكير وغرائب وليس بموضع الحجة.
“তিনি অদ্ভুত অদ্ভুত এবং আপত্তিকর হাদিসের বর্ণনাকারী ছিলেন। তিনি প্রামাণ্য ব্যক্তি নন।”

◈ ৬. খালিলী বলেন,
يعرف بالأستاذ له معرفة بهذا الشأن وهو لين ضعفوه
“তিনি ‘উস্তায’ নামে পরিচিত। হাদিস বিষয়ে তার জ্ঞান আছে কিন্তু তিনি দুর্বল। মুহাদ্দিসগণ তাকে দুর্বল বলেছেন।” তিনিও আরও অভিযোগ করেছেন যে, এ লোক তাদলীস করতেন। [উৎস: ইবনে হাজার আসকালানী রহ. রচিত লিসানুল মীযান]

– চল্লিশ বছর যাবত ইশার সালাতের ওজু দ্বারা ফজরের সালাত আদায় করার ঘটনাটি ইমাম যাহাবিও তার সিয়ারু আ’লামিন নুবালা [৬/৩৯৯] এবং তারিখুল ইসলাম কিতাবে উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি আমর বিন আসাদ এর সূত্র উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ইমাম যাহাবি এবং আমর বিন আসাদের মধ্যে কয়েক শতাব্দীর ব্যবধান। এ ছাড়াও তার ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের পক্ষ থেকে ভালো-মন্দ দু ধরণের মতামত পাওয়া যায়।

❂ শাইখ আলবানি তার বিখ্যাত সিফাতু সালাতিন্নাবী (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সালাত এর বিবরণ) এর মূল গ্রন্থে [২/৫৩১-মাকতাবুল মাআরিফ থেকে প্রকাশিত] সবসময় সারারাত ব্যাপী ইবাদত করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত ও আদর্শ পরিপন্থী হওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে আবু হানিফা রাহ. এর নামে প্রচলিত উক্ত ঘটনাকে ‘মিথ্যাচার’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেন,
ولا تغتر بما روي عن أبي حنيفة رحمه الله أنه مكث أربعين سنة يصلي الصبح بوضوء العشاء ؛فإنه مما لا أصل [له] عنه
“আর আবু হানিফা রাহ. এর ব্যাপারে ইশার ওজুতে ফজরের নামাজ পড়ার বর্ণনা শুনে ধোঁকা খাবে না। কারণ তার কোনও ভিত্তি নাই।”

❂ আল্লামা ফিরোজাবাদী (আর রাদ্দু আলাল মুতারিয ১/৪৪) গ্রন্থে বলেন,
هذا من جملة الأكاذيب الواضحة التي لا يليق نسبتها إلى الإمام ، فما في هذا فضيلة تُذكر، وكان الأولى بمثل هذا الإمام أن يأتي بالأفضل، ولا شك أن تجديد الطهارة لكل صلاة أفضل وأتم وأكمل . هذا إن صح أنه سهر طوال الليل أربعين سنة متوالية ! وهذا أمر بالمحال أشبه، وهو من خرافات بعض المتعصبين الجهال قالوه في أبي حنيفة وغيره ، وكل ذلك مكذوب. ]
“এটি এমন সব স্পষ্ট মিথ্যাচারের অন্তর্ভুক্ত যেগুলো ইমামের দিকে সম্বন্ধ করা শোভনীয় নয়। কারণ এতে উল্লেখ করার মত কোনও ফজিলত নেই। এ সব ক্ষেত্রে সম্মানিত ইমাম সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আমলটি করবেন- এটি তার জন্য সর্বাধিক সমীচীন। আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে, প্রত্যেক নামাজের জন্য পবিত্রতা নবায়ন করা উত্তম এবং অধিকতর পরিপূর্ণ। যদি সঠিকও হয় যে, তিনি টানা চল্লিশ বছর সারারাত জাগ্রত থেকেছেন তাহলে এটা প্রায় অসম্ভব। এটা কতিপয় অজ্ঞ ও গোঁড়া লোকের বানোয়াট কল্পকাহিনীর মধ্যে একটি-যারা এটি আবু হানিফা এবং অন্যান্যদের সম্পর্কে বলেছে। এগুলো সর্বৈব মিথ্যা।”

এছাড়াও আলেমগণ এ ঘটনা যে নির্ভরযোগ্য নয় তার একাধিক কারণ উল্লেখ করেছেন।

❑ মোটকথা:

এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, ইমাম আবু হানিফা রা. একজন নির্ভরযোগ্য ফকিহ ও মাজহাবের ছিলেন। তার জ্ঞান, ফিকাহ, ইবাদত-বন্দেগি ও পরহেজগারিতার ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নাই। কিন্তু তার নামে মিথ্যা কল্পকাহিনী বর্ণনা করে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধির চেষ্টা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এতে তার সম্মানহানি হয়। কারণ সারারাত ইবাদত করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ পরিপন্থী। আল্লাহর নবী দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ইবাদত গুজার হওয়ার পরও তিনি রাতের কিয়দংশ ঘুমাতেন এবং বাকি রাত তাহাজ্জুদের সালাত ও ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাতেন। কিন্তু তার একনিষ্ঠ অনুসারী এবং একজন অনুসরণীয় ইমাম হয়ে কিভাবে তাঁর বিপরীত কাজ করতে পারেন?!

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عَبْدُ اللهِ بْنُ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ قَالَ لِي رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَا عَبْدَ اللهِ أَلَمْ أُخْبَرْ أَنَّكَ تَصُومُ النَّهَارَ وَتَقُومُ اللَّيْلَ فَقُلْتُ بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ فَلاَ تَفْعَلْ صُمْ وَأَفْطِرْ وَقُمْ وَنَمْ فَإِنَّ لِجَسَدِكَ عَلَيْكَ حَقًّا وَإِنَّ لِعَيْنِكَ عَلَيْكَ حَقًّا وَإِنَّ لِزَوْجِكَ عَلَيْكَ حَقًّا وَإِنَّ لِزَوْرِكَ عَلَيْكَ حَقًّا
আমর ইবনুল আস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে আবদুল্লাহ! আমি এ খবর পেয়েছি যে, তুমি প্রতিদিন রোজা রাখো এবং সারা রাত নফল নামাজ পড়ো।
আমি বললাম, হ্যাঁ, ঠিক (শুনেছেন) হে আল্লাহর রাসূল!
তিনি বললেন, “এরূপ করবে না। (মাঝে-মাঝে) রোজা রাখবে আর আবার (মাঝে-মাঝে) ছেড়েও দিবে। (রাতে) সালাত আদায় করবে আবার ঘুমাবে। কেননা তোমার উপর তোমার শরীরের হক রয়েছে, তোমার চোখের হক রয়েছে, তোমার উপর তোমার স্ত্রীর হক আছে। তোমার মেহমানের হক আছে..।” [সহীহ বুখারি, অধ্যায়: ৩০/ রোজা, পরিচ্ছেদ: ৩০/৫৫. নফল রোজায় শরীরের হক]

আবু হানিফা রাহ. এর মত একজন মহামতি ইমাম এ ক্ষেত্রে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদর্শকে উপেক্ষা করতেন-এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর যদি তাঁর ব্যাপারে এ ঘটনা প্রমাণিত হয়েও থাকে তারপরও বলব, মুসলিমগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহকে অনুসরণ করতে নির্দেশিত। সুতরাং আমাদের করণীয়, ইবাদত-বন্দেগি সহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নি:শর্ত অনুসরণ করা। কেননা আল্লাহ বলেন,
لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّـهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ
“নিশ্চয় তোমাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।” [সূরা আহযাব: ২১] এর মধ্যেই মানবতার সার্বিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে এবং সুন্নাহ পরিপন্থী সব ধরণের ইবাদত-বন্দেগি ও কার্যক্রম বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য-তা যত বড় আলেম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুজতাহিদ ও ফকিহ করুক না কেন।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ ও আলোকময় মহান আদর্শকে বুকে ধারণ করার এবং সব ধরণের সুন্নাহ পরিপন্থী ও ভ্রান্তি পূর্ণ কথা, কার্যক্রম ও আচরণ থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।।