আশুরার দিনের বিদ’আত সমূহ

■ হুসাইন (রাঃ) শোক পালনের উদ্দেশ্যে সিয়াম পালন করাঃ
এ দিনের সিয়াম রাখা শরীয়ত সম্মত। তবে এ সিয়ামের নিয়্যাত কি তার ব্যাপারে পরিষ্কার ইমান থাকতে হবে। অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের কবল থেকে মূসা (আঃ)-এর নাজাতের শুকরিয়া স্বরূপ ৯ ও ১০ই মুহাররম সিয়াম পালন করাই হলো সহীহ হাদীসের উক্তি।
.
হুসাইনের (রাঃ) এর শোক পালনের উদ্দেশ্যেই অনেকে এদিন সিয়াম পালন করে থাকে যা সম্পূর্ণরূপে সহীহ হাদীস বিরোধী এবং স্পষ্ট বিদ‘আত। কেননা এই সিয়ামের সূচনা হয়েছে মূসা (আঃ)-এর সময় থেকে। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর জীবদ্দশাতেই মুহাররমের সিয়াম পালন করেছেন। আর কারবালার ঘটনা ঘটেছে রাসূল ﷺ এর মৃত্যুর ৫০ বছর পরে ৬১ হিজরীতে। তাহলে কি করে আল্লাহর রাসূল ﷺ হুসাইন (রাঃ) -এর শাহাদতের কারণে এই সিয়াম পালন করলেন?
.
অতএব এসব নিছক ভিত্তিহীন কথা মাত্র। রাসূল ﷺ আশূরার ছিয়াম পালন করেছিলেন অত্যাচারী শাসক ফেরাঊনের কবল থেকে মূসা (আঃ)-এর নাজাতের আনন্দে আল্লাহর শুকরিয়া স্বরূপ। পক্ষান্তরে আমরা আজ তা পালন করছি হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদতের শোক স্বরূপ। অর্থাৎ আমরা বর্তমানে যে উদ্দেশ্যে আশূরার ছিয়াম পালন করছি তা শী‘আদের থেকে গৃহীত; যা অবশ্যই বর্জনীয়।
.
■ এই দিনকে আনন্দ উৎসবে পরিণত করাঃ
রাফেযীরা (কট্টর শী‘আ) হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদতের শোক স্বরূপ শোক দিবস পালন করে। পক্ষান্তরে একটি গোষ্ঠী রাফেযীদের বিরোধিতা করার লক্ষ্যে এ দিনটিকে আনন্দ উৎসবে পরিণত করে। এ দিনে রাফেযীদের শোক দিবস যেমন বিদ‘আত; তেমনি তাদের বিরোধিতার লক্ষ্যে এ দিনে আনন্দ উৎসব করাও বিদ‘আত। এটা যেন বিদ‘আত দিয়ে বিদ‘আত এবং মিথ্যা দিয়ে মিথ্যা প্রতিহত করার চেষ্টা। অথচ উচিৎ ছিল সুন্নাত দিয়ে বিদ‘আত প্রতিহত করা। সত্য দিয়ে মিথ্যা প্রতিহত করা। রাসূল ﷺ ও সাহাবায়ে কেরাম এ দিনটিকে শোক দিবস হিসাবেও পালন করেননি। আবার আনন্দ উৎসবেও পরিণত করেননি। তাঁরা শুধুমাত্র ফেরাউনের কবল থেকে মূসা (আঃ)-এর নাজাতের শুকরিয়া স্বরূপ ছিয়াম পালন করেছেন।[১]
.
■ তা‘যিয়া মিছিলঃ
তা‘যিয়া অর্থ বিপদে সান্ত্বনা দেওয়া। যেটা বর্তমানে শাহাদাতে হোসাইনের শোক মিছিলে রূপ নিয়েছে। অথচ ইসলামে কারো মৃত্যুতে তিন দিনের অধিক শোক পালন করা নিষেধ।[২] কিন্তু বাগদাদের গোঁড়া শী’আ আমীর মুইযযুদ্দৌলা ৩৫২ হিজরীর ১০ই মুহাররমকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করেন এবং শহর ও গ্রামের সকলকে তাযিয়া মিছিলে যোগদানের নির্দেশ দেন। সেদিন থেকেই এই বিদ‘আতী প্রথা চালু হয়েছে। শী‘আদের উদ্ভাবিত এই বিদ‘আতী প্রথার অনুসরণেই বাংলাদেশের বিদ‘আতীরা ১০ই মুহাররমে মিছিল বের করে থাকে। প্রত্যেক আল্লাহ ভীরু মুসলমানের এই সব বিদ‘আত হতে দূরে থাকা আবশ্যক।
.
■ চোখে সুরমা লাগানোঃ
বিশেষ ফযীলতের আশায় অনেকে এ দিন চোখে সুরমা লাগিয়ে থাকে, যা সুস্পষ্ট বিদ‘আত। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ ও ছাহাবায়ে কেরাম আশূরার দিনে চোখে সুরমা লাগাননি এবং এর কোন ফযীলত বর্ণনা করেননি। আশূরার দিনে চোখে ইছমিদ সুরমা লাগালে কখনোই চোখে রোগ হবে না মর্মে যে হাদীসটি আছে তা বানোয়াট। [৩]
.
■ ফযীলতের আশায় ছালাত আদায় করাঃ
এদিন বিশেষ পদ্ধতিতে ছালাত আদায় করা হয়ে থাকে বিশেষ ফজিলতের আশায়, যা সুস্পষ্ট বিদ‘আত। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ ও ছাহাবায়ে কেরাম এ দিনে বিশেষ কোন সালাত আদায় করেছেন মর্মে কোন সহীহ দলীল পাওয়া যায় না। এ সম্পর্কে যা পাওয়া যায় তার সবগুলিই জাল বা বানোয়াট। যেমন-
☞ আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল ﷺ বলেছেন,
-“আশূরার দিনে যে ব্যক্তি চার রাকআত সালাত আদায় করবে এবং প্রত্যেক রাক‘আতে একবার সূরা ফাতিহা ও পঞ্চাশবার সূরা ইখলাছ তেলাওয়াত করবে, আল্লাহ তাআলা তার অতীতের পঞ্চাশ বছরের গুনাহ এবং ভবিষ্যতের পঞ্চাশ বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন”
→ উল্লিখিত হাদীছটি জাল বা বানোয়াট।[৪]
.
☞ রাসূল ﷺ বলেছেন,
-“যে ব্যক্তি আশূরার দিনে যোহর ও আছরের সালাতের মাঝখানে চল্লিশ রাকআত সালাত আদায় করবে। প্রত্যেক রাকআতে একবার সূরা ফাতিহা, দশবার আয়াতুল কুরসী, দশবার সূরা ইখলাছ, পাঁচবার সূরা ফালাক্ব এবং পাঁচবার সূরা নাস তেলাওয়াত করবে আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করবেন”।
→ অত্র হাদীছটিও জাল বা বানোয়াট।[৫]
.
☞ শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,
-“সিয়াম ব্যতীত আশূরা সম্পর্কিত কোন সহীহ হাদীস নেই। এই দিনে নির্দিষ্ট সালাতের ফযীলত সম্পর্কে যে বর্ণনা এসেছে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিছগণের ঐক্যমতে তার সবগুলিই মিথ্যা ও বানোয়াট। মুহাক্কিক আলেমদের কেউই তাদের কিতাব সমূহে এ সমস্ত হাদীস সংকলন করেননি।[৬]
→ অতএব এ উপলক্ষে আশূরার দু’টি ছিয়াম ব্যতীত অন্য কোন ইবাদত রাসূলুল্লাহ ﷺ, ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম, ইমাম চতুষ্টয়ের কেউ কখনোই করেননি। আর তাঁরা সিয়াম দু’টি পালন করেছেন কেবল ফেরাউনের কবল থেকে মূসা (আঃ)-এর নাজাতের শুকরিয়া স্বরূপ; শাহাদতে হুসাইনের শোক স্বরূপ নয়। সুতরাং বর্তমানে আশূরা উপলক্ষে যা হচ্ছে তার সবগুলিই পরবর্তী যূগের বিদ‘আতীদের আবিষ্কার; যা অবশ্যই বর্জনীয়।
.
■ তাবেঈ ইয়াযীদ বিন মুআবিয়া-কে ‘মালঊন’ বা অভিশপ্ত বলে গালি দেওয়াঃ
ইয়াযীদ বিন মুআবিয়াকে ‘মালঊন’ বা অভিশপ্ত বলে গালি দেওয়া আদৌ ঠিক নয়। বরং সকল মুসলমানের ন্যায় তার মাগফেরাতের জন্য দোআ করা উচিত। কারন কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার জন্য তিনি দায়ী নন। এজন্য মূলতঃ দায়ী বিশ্বাসঘাতক কূফাবাসী ও নিষ্ঠুর গভর্ণর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ। কেননা ইয়াযীদ কেবল হুসাইন (রাঃ)-এর আনুগত্য চেয়েছিলেন, তাঁর খুন চাননি। হুসাইন (রাঃ) সে আনুগত্য দিতেও প্রস্ত্তত ছিলেন। ইয়াযীদ স্বীয় পিতার অছিয়ত অনুযায়ী হুসাইনকে সর্বদা সম্মান করেছেন এবং তখনও করতেন। হুসাইন (রাঃ)-এর ছিন্ন মস্তক ইয়াযীদের সামনে রাখা হলে তিনি কেঁদে বলে ওঠেন এবং বলে,
-“ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের উপর আল্লাহ লানত করুন। আল্লাহর কসম! যদি হুসাইনের সাথে ওর রক্তের সম্পর্ক থাকত, তাহলে সে কিছুতেই তাঁকে হত্যা করত না।” তিনি আরো বলেন,
-“হুসাইনের খুন ছাড়াও আমি ইরাকীদেরকে আমার আনুগত্যে রাযী করাতে পারতাম।”[৭]

কূফার নেতাদের লিখিত ১৫০টি পত্র পেয়ে হুসাইন (রাঃ) কূফায় আসলে বসরার গভর্ণর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ কূফার গভর্ণর মুসলিম বিন আকীলকে গ্রেফতার করে হত্যা করে। এদিকে হুসাইন (রাঃ) প্রদত্ত তিনটি প্রস্তাবের কোনটি গ্রহণ না করায় দুষ্টমতি ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের সাথে সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। এতে হুসাইন (রাঃ) সপরিবারে নিহত হন।[৮]
.
►►উপসংহারঃ
============
সময় এসেছে এ দিনে ﷺ রাসূল কি করেছেন আর আমরা কি করছি তা মিলিয়ে দেখতে হবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর সাথে। কারবালার ঘটনা সম্পর্কে সকল প্রকার আবেগ ও বাড়াবাড়ি হতে দূরে থাকতে হবে এবং আশূরা উপলক্ষে প্রচলিত শিরক ও বিদ‘আতী আক্বীদা-বিশ্বাস ও রসম-রেওয়াজ পরিহার করতে হবে।
.
_______
১। ড. সুলাইমান ইবনে সালেম আস-সুহাইমী, আল-আ‘ইয়াদ ওয়া আছারুহা, পৃঃ ২৭৩।
২। আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৪৪৬৩ ‘চুল অাঁচড়ানো’ অনুচ্ছেদ।
৩। ইবনুল জাওযী, আল-মাওযূ‘আত পৃঃ ২/২০৩; মোল্লা আলী ক্বারী, আসরারুল মারফূ‘আহ, পৃঃ ৪৪।
৪। আল-মাওযূ‘আত পৃঃ ২/১২২ ।
৫। আল-মাওযূ‘আত পৃঃ ২/১২২-১২৩; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদুল মাজমূ‘আহ পৃঃ ৪৮ ।
৬। শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ ৪/১১৬ ।
৭। ইবনু তায়মিয়া, মুখতাছার মিনহাজুস সুন্নাহ, ১/৩৫০; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/১৭৩; আশূরায়ে মুহাররম ও আমাদের করণীয়, পৃঃ ৭-১০।
৮। ইবনু হাজার, আল-ইছাবাহ ২/২৫২; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ৮/১৫৪, ১৭১।