আমাদের নবী (সাঃ) কি গায়েব জানতেন? কুরআন ও হাদীস কি বলে?

নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ‘সীরাহ’ (জীবনী) থেকে শিক্ষাঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কোন এক যুদ্ধের সফরে সংগী-সাথীদের নিয়ে বের হলেন, আর তাঁর সংগিনী হিসেবে আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহা কে সাথে নিলেন। পথিমধ্যে আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহার ‘গলার হার’ (নেকলেস) ছিড়ে পড়ে গেলো, কিন্তু কখন পড়লো তিনি সেটা টের পেলেন না। যখন তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর গলার হার হারিয়ে গেছে, সেটা নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে জানানো হলো। নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহার হার খুঁজে বের করার জন্যে সফরে বিরতি দিলেন, সাথে সাথে কাফেলার সবাই সফরে বিরতি দিতে বাধ্য হলেন। কিন্তু অনেক খুঁজাখুঁজি করেও সেই হার পাওয়া যাচ্ছিলোনা। এইদিকে কাফেলার লোকদের সাথে ওযু-গোসল করা ও অন্যান্য কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় পানি সাথে ছিলোনা এবং যেই জায়গায় কাফেলা থেমে ছিলো তার আশেপাশে কোন কুয়া বা পানির কোন ব্যবস্থাও ছিলনা। আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহার গলার হার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে পুরো কাফেলার সবাই অসুবিধার সম্মুখীন হওয়া এবং পানির অভাবে সকলের সালাত কাযা হওয়ার আশংকায় তাঁর পিতা আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আ’নহু মেয়ের উপর অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন এবং এনিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে অভিযোগ করতে আসলেন। এসময় নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহার কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলেন। আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আ’নহু আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহা কে অনেক কথা শোনালেন এবং ক্রোধের এক পর্যায়ে আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহার কোমরে হাত দিয়ে আঘাত করেন। আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহা অনেক ব্যাথা পেলেন, কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলেন বলে তিনি নাড়াচাড়াও করতে পারছিলেন না, যাতে করে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর ঘুম না ভেঙ্গে যায়। যাই হোক, নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখেন ফযরের সালাত পড়ার জন্যে ওযু করার মতো পানি নেই। তখন আল্লাহ তাআ’লা পানি না থাকা অবস্থায় ‘তায়াম্মুম’ অর্থাৎ পানির পরিবর্তে মাটি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করার বিধান দিয়ে ক্বুরানুল কারীমের এই আয়াত নাযিল করলেন,
“হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতের জন্যে উঠ, তখন স্বীয় মুখমন্ডল ও হস্তসমূহ কনুই পর্যন্ত ধৌত কর, মাথা মাসাহ কর এবং দুই পায়ের গিঁট পর্যন্ত ধৌত কর। যদি তোমরা অপবিত্র হও তবে সারা দেহ পবিত্র করে নাও এবং যদি তোমরা রুগ্ন হও, অথবা প্রবাসে থাক অথবা তোমাদের কেউ প্রসাব-পায়খানা সেরে আসে অথবা তোমরা স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর, অতঃপর পানি না পাও, তবে তোমরা পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও অর্থাৎ, স্বীয় মুখ-মন্ডল ও হস্তদ্বয় মাটি দ্বারা মুছে ফেল। আল্লাহ তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চান না; কিন্তু তোমাদেরকে পবিত্র রাখতে চান এবং তোমাদের প্রতি স্বীয় নেয়ামত পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।”
সুরা আল-মায়ি’দাহঃ ৬।
তখন সবাই ‘তায়াম্মুম’ করে সালাত পড়ে নিলেন। উসাইদ ইবনু হুযাইর রাদিয়াল্লাহু আ’নহু নামক একজন সাহাবী বললেন, “হে আবু বাকর-এর বংশধর (আয়িশাহ)! এটাই আপনাদের কারণে পাওয়া প্রথম বরকত নয়।” (এখানে বরকত দ্বারা পানি না থাকা অবস্থায় তায়াম্মুম করার সহজ বিধান কে বুঝিয়েছেন)।
আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহা বর্ণনা করেন, যেই উটের উপরে আমি ছিলাম, তাকে আমরা যখন উঠালাম, তখন দেখি আমার গলার হার তার নিচে পড়ে আছে।” (একারণেই হারটি খুঁজাখুঁজি করেও পাওয়া যাচ্ছিলোনা।)
সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ ৬৫ – ‘কুরআন মাজীদের তাফসীর’।
হাদিস নম্বরঃ তাওহীদ প্রকাশনীঃ ৪৬০৭; আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪২৪৬; ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৪২৪৯।
___________________________
ঘটনা থেকে শিক্ষাঃ
১. নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও কোমল স্বভাবের মানুষ। তাঁর স্ত্রী মূল্যবান হার হারিয়ে ফেলেছে শুনেও তিনি তাঁকে গাল-মন্দ করলেন বা কোনপ্রকার দোষারোপ করলেন না। অথচ আজকাল যুগের কোন পুরুষের স্ত্রী এই কাজ করলে প্রথমেই একচোট মারপিট করে মনের রাগ নিভাতো। আর মারপিট না করলেও, কতো যে মন্দ কথা বলে হুলস্থূল শুরু করতো আর কটু কথা বলে কষ্ট দিতো! আসলে আমরা মুখে দাবী করি আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর উম্মত, কিন্তু আমরা কথায় ও কাজে অনুসরণ করি নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম দুশমনদের।
২. আল্লাহ মানুষের জন্যে সহজ জীবন বিধান ‘ইসলাম’ নাযিল করেছেন, এইজনে কঠিন অবস্থায় পতিত হলে দ্বীনের বিধানে সহজতা দান করেছেন। আল্লাহ তাআ’লা বলেন,
“আল্লাহ তোমাদের জন্যে (তাঁর বিধান) সহজ করে দিতে চান এবং তিনি তোমাদের জন্যে (তাঁর বিধান) কঠিন-কষ্টকর করতে চান না।”
সুরা আল-বাক্বারাহঃ ১৮৫।
পানি না পাওয়া গেলে মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করার সহজ নিয়ম তারই একটা উদাহরণ। এ ধরণেই সহজতা দ্বারা বান্দার প্রতি আল্লাহর দয়া ও নিয়ামতের কথা উপলব্ধি করা যায়।
৩. উসাইদ ইবনু হুযাইর রাদিয়াল্লাহু আ’নহু নামক একজন সাহাবী বললেন, “হে আবু বাকর-এর বংশধর! এটাই আপনাদের কারণে পাওয়া প্রথম বরকত নয়।”
এই কথার দ্বারা আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহার মর্যাদা বুঝা যায়। আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহা অনিচ্ছাকৃতভাবে হার হারিয়ে যাওয়ায় সমস্ত মুসলিম কাফেলাটা সাময়িক অসুবিধার মাঝে পড়ে যায়। কিন্তু, এই ঘটনার সূত্র ধরেই তায়াম্মুম অর্থাৎ পানি না থাকলে পানির পরিবর্তে মাটি দ্বারা পবিত্রতা অর্জনের সহজ নিয়ম পাওয়া গেলো। যা আজ পর্যন্ত মুসলিমরা উপকৃত হচ্ছে।
৪. আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহা বর্ণনা করেন, “যেই উটের উপর আমি ছিলাম, তাকে আমরা উঠালাম তখন দেখি হারটি তার নিচে পড়ে ছিলো।”
আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহার এই কথা থেকে ‘আক্বীদাগত’ অনেক বড় একটা বিষয় জান যায়, সেটা হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ‘গায়েব’ বা অদৃশ্যের খবর জানতেন না। সেকারণে তাঁর স্ত্রীর মূল্যবান হার হারিয়ে গেলে সেটা কোথায় তিনি বলে দিতে পারেন নি। তিনি যদি গায়েব জানতেন, তাহলে আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহা যখনই বলেছিলেন, আমার গলার হার হারিয়ে গেছে তখনই তিনি বলে দিতেন, তোমার হার উটের নিচে আছে। যেহেতু তিনি জানতেন না, সেইজন্যে যাত্রা বিরতি দিয়েছিলেন হার খুঁজে বের করার জন্যে। আর তিনি যাত্রাবিরতি দেওয়ায় কাফেলার সকলকেও যাত্রা বিরতি দিতে হলো। এমনকি এই ঘটনার রেশ ধরে যাত্রা বিলম্বির কারণে পানির অভাবে সকলের সালাত কাযা হওয়ার আশংকা দেখা দিলো। সকলের সালাত কাযা হয়ে যাবে এ কথা চিন্তা করেই আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আ’নহু তাঁর মেয়ের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং এনিয়ে আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহাকে দোষারোপ ও আঘাত করেন। এতো কিছু হয়ে যাবে, এটাও নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কোনদিন আগে থেকে জানতেন না, বা চিন্তা করেন নি। শেষে যখন উটকে উঠানো হলো, তখনই সকলে জানতে পারলো যে হার উটের নিচে এতোক্ষণ চাপা পড়ে ছিলো। এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, হারটা কোথায় ছিলো নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম জানতেন না। সুতরাং, ভারত, পাকিস্থান ও বাংলাদেশে ‘সুন্নী’ দাবীদার একশ্রেণীর ‘সূফী’ লোকেরা যেই দাবী করে, নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম গায়েব বা অদৃশের খবর, অতীত বর্তমানের সমস্ত খবর জানতেন, এই দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা ও শিরকী একটি আক্বীদাহ। নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সব খবর জানতেন না, তাঁকে আল্লাহ যা ‘ওয়াহী’ করে জানাতেন, শুধুমাত্র ততটুকুই তিনি জানতে পারতেন। কিন্তু গায়বে বা অদৃশ্যের জ্ঞানের মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআ’লা। এই কথা ক্বুরানের আল্লাহ স্পষ্ট করে অনেক জায়গাতে বলেছেন। যেমন,
“(হে নবী!) আপনি ঘোষণা করে দিন যে, একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া আমার নিজের ভাল-মন্দ, লাভ-লোকসান, কল্যাণ-অকল্যাণ ইত্যাদি বিষয়ে আমার কোনই ক্ষমতা নেই। আর আমি যদি গায়েবের খবর জানতাম, তাহলে অনেক কল্যাণ লাভ করতে পারতাম, আর কোন প্রকার অকল্যাণ আমাকে স্পর্শ করতে পারত না।”
সুরা আল-আ’রাফঃ ১৮৮।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআ’লা নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে আদেশ করেছেন, তিনি যেন তাঁর উম্মতকে স্পষ্ট করে বলে দেন যে, তিনি গায়েব জানেন না। নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম যদি গায়েব জানতেন, তাহলে কোনপ্রকার অকল্যাণ তাঁকে স্পর্শ করতোনা। অথচ নবুওতী জীবনে তাঁকে অনেক অকল্যাণ তাঁকে স্পর্শ করেছে। তায়েফে নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে, উহুদের যুদ্ধে মারাত্মক জখম হতে হয়েছে, তাঁর মুবারক দাঁত শহীদ হয়েছে, মুনাফিকরা তাঁর প্রিয় স্ত্রী আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহার বিরুদ্ধে জঘন্য অপবাদ দিয়ে মারাত্মক পেরেশানির মধ্যে ফেলেছিলো।
“(হে নবী!) আপনি বলুন, আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধন-ভান্ডারের চাবি রয়েছে। আর আমি ‘গায়েব’ জানিনা। আমি এমন কথা বলি না যে, আমি একজন ফেরেশতা। আমি তো শুধুমাত্র সেই ওয়াহীর অনুসরণ করি, যা আমার কাছে অবতীর্ণ করা হয়। সুতরাং, আপনি তাদেরকে বলে দিন, অন্ধ ও দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন লোক কি কখনো সমান হতে পারে? তোমরা কি চিন্তা-ভাবনা কর না?”
সুরা আল-আনআ’মঃ ৬।
সর্বশেষ, এতো দীর্ঘ আলোচনা এবং নিচে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট আল্লাহর তাআ’লার এই বাণী পড়ার পরেও কোন ব্যক্তি, যে নিজেকে মুসলমান দাবী করে,
(ক) সে কি কখনো এই কথা বলতে পারে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বা অন্য কেউ ‘গায়েব’ জানেন?
(খ) আর যে ব্যক্তি সেই মিথ্যা দাবী করবে, সে কি হবে? মুসলিম, কাফের নাকি মুশরেক?
“(হে নবী!) আপনি বলুন, আল্লাহ ছাড়া আসমান ও জমীনের কেউ ‘গায়বের খবর’ জানে না।”
সুরা নামলঃ ৬৫।
___________________________
কৃতজ্ঞতাঃ সূফী বেরেলুবী তরিকার অনুসারী আলেম, এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর ভক্ত এক ভাই, যিনি আমাদের ইনবক্সে দাবী করেছেনঃ
=> নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ১০০% গায়েব জানেন!
=> সূরজ পুবদিখ থেকে উঠে এটা জেমন বাছতোব তেমনি হুজুর (সাঃ) নূর ও গায়েব জানেন এটা ও তেমনি বাছতব!!
[নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক!]
সেই ভাইয়ের দাবীর প্রেক্ষিতে আমার এই পোস্ট লিখা, যাতে করে তাকে এবং তার মতো অন্যান্যদেরকে সতর্ক করা যায়। আমি আশা করি, আমাদের এই ভাই আল্লাহর আদেশ মোতাবেক একটু চিন্তা-ভাবনা করবেন এবং শিরকী আক্বীদাহ থেকে তোওবা করে ক্বুরান ও সুন্নাহর দিকে ফিরে আসবেন। ওয়ামা তোওফিক্বি ইল্লা বিল্লাহ।
*যারা কষ্ট করে দীর্ঘ এই লেখাটা পড়েছেন, আমি দুয়া করি তাদের সকলের প্রতি আল্লাহ তাআলা রহম করুন। আমি তাদের প্রতি অনুরোধ করবো, আপনার ক্বুরানের এই বাণী মানুষের মাঝে পৌঁছে দিয়ে তাদেরকে শিরক থেকে সতর্ক করুন।
সংগ্রহঃ তোমরা তোমাদের পালনকর্তার অভিমূখী হও এবং তাঁর আজ্ঞাবহ হও