প্রশ্ন: অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য চেয়ারে বসে সালাত আদায়ের নিয়ম নীতি কেমন হবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর আলোচনার শুরুতেই একটি জরুরি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই আজকাল মসজিদের ভেতরে চেয়ারে বসে সালাত আদায় যেন এক প্রায়-উৎসবমুখর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সুযোগ পেলেই কেউ না কেউ কোনো শারঈ বৈধতা যাচাই না করে চেয়ারে বসে পড়ছেন। সারাদিন দৌঁড়ঝাপ করে,বাইরের সব পাহাড় ভেঙে এসে মসজিদে প্রবেশ করা মাত্রই চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ে এ যেন অলিখিত রীতি। চেয়ারে বসে সালাত আদায় করার জন্য যেসব ওজর-আপত্তি থাকা লাগে, তা দেখার কোনোই প্রয়োজন নেই। অথচ শরিয়ত সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, চেয়ারে বসে সালাত আদায়ের জন্য কয়েকটি নির্দিষ্ট ওজর ও শর্ত পূরণ আবশ্যক; এগুলো ছাড়া এ পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য নয়। বাস্তবে দেখা যায় অনেকেই এসব শর্তের খোঁজ-খবর নেওয়ার প্রয়োজনই মনে করেন না। তাদের ভাবনা ‘সালাতই তো পড়ছি আর কী এত জটিলতা!’ কিন্তু কঠিন সত্য হলো যারা আজকে চেয়ারে বসে সালাত আদায় করছেন তাদের অধিকাংশের সালাত বাতিল হয়ে যাচ্ছে।কারন চেয়ারে বসে সালাত আদায় করতে গিয়ে সালাতের একাধিক রুকন ও ওয়াজিব তরক করে চলেছেন তারা হরহামেশা। তবে হয়তো জাহালাত বা অজ্ঞতার কারণে আল্লাহ কবুল করছেন। এটি তাঁর অফুরন্ত করুণার বিষয়। তারপরও আমাদের দায়িত্ব হলো সালাত এমনভাবে আদায় করা, যা সহীহ ও গ্রহণযোগ্য হয়, যেন ইবাদত শুদ্ধ থাকে এবং কবুল হওয়ার আশা বাঙ্ময় থাকে।
.
প্রথমত: মূলনীতি হল: কিয়াম, রুকু ও সেজদা সলাতে রুকন (আবশ্যকীয় কাঠামো)। যে ব্যক্তির সক্ষমতা আছে তার জন্য শরিয়তের বর্ণিত কাঠামো অনুযায়ী এগুলো পালন করা ওয়াজিব (আবশ্যকীয়)। শরিয়ত অনুমোদিত ওজর ছাড়া যে ব্যক্তি সলাতের তাকবীরে তাহরীমার শুরু থেকে সালাম ফেরানো পর্যন্ত দাঁড়াবে না তার সলাত বাতিল। দাঁড়ানোটা’ সলাতের রুকন হওয়া ফরয ও সলাতের জন্য খাস। দলিল হল: আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমরা আল্লাহ্র জন্য বিনয়াবনত হয়ে দাঁড়াও”(সূরা বাক্বারাহ: ২৩৮) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস: “তুমি দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করো”।(সহিহ বুখারী হা/১০৬৬) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সওয়ারীর ওপর নফল সলাত আদায় করতেন। যখন ফরয সলাত পড়তে চাইতেন তখন তিনি সওয়ারী থেকে নেমে যেতেন।(সহিহ বুখারী হা/৯৫৫) ও সহিহ মুসলিম হা/৭০০) তিনি (ﷺ) এটি করতেন দাঁড়ানোর রুকন আদায় করা ও কিবলামুখী হওয়ার জন্য। তবে নফল সলাতের দাঁড়ানো ওয়াজিব নয়। বরং নফলের ক্ষেত্রে বসে সলাত আদায় করা জায়েয।’ কারো দাঁড়ানোর সক্ষমতা থাকার পরেও সে যদি বসে নফল সলাত আদায় করে তাহলে সে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে সলাত আদায়কারীর অর্ধেক সওয়াব পাবে। যেহেতু আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) এর হাদিসে এসেছে: “তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম: ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আমাকে হাদিস বলা হয়েছে যে, আপনি বলেছেন বসে সলাত আদায়কারী অর্ধেক সওয়াব পাবে। কিন্তু আপনি তো বসে সলাত আদায় করেন। তিনি বললেন: ঠিকই। কিন্তু আমি তোমাদের কারো মত নই।”(ইমাম মুসলিম হা/৭৩৫; বর্ণিত হাদিসের অংশবিশেষ) উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে যেই ব্যক্তি দাঁড়াতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও বসে সলাত আদায় করে তার সলাত বাতিল।
.
দ্বিতীয়ত: অসুস্থ ব্যক্তির সলাতের ক্ষেত্রে নীতি হল: সলাতের যে যে রুকন ও ওয়াজিব তার পক্ষে আদায় করা সম্ভবপর সেগুলো সে আদায় করবে। আর যেগুলো আদায় করা তার সাধ্যে নেই সেগুলো তার জন্য মওকুফ হবে। অতএব তিনি যদি দাঁড়িয়ে সলাত শুরু করতে সক্ষম হন তাহলে দাঁড়িয়ে সলাত শুরু করা তার উপর ওয়াজিব। এরপর যদি দাঁড়িয়ে থাকা তার জন্য কষ্টকর হয় তাহলে তিনি বসে পড়বেন। যেমন এমন একজন অসুস্থ ব্যক্তি, যিনি মেঝেতে বসে সালাত আদায় করলে সাজদাহ দিতে পারেন কিন্তু চেয়ার থেকে নেমে মেঝেতে বসতে পারেন না বা মেঝে থেকে উঠে চেয়ারে বসতে পারেন না এবং কিয়ামও করতে পারেন না। এমন অসুস্থ ব্যক্তিকে মেঝেতে বসেই সালাত আদায় করবেন। কারণ, সে কিয়ামের (দাঁড়িয়ে সালাত পড়ার) সামর্থ্য হারিয়েছে, তাই তার জন্য কিয়াম মাফ। তবে যেহেতু তিনি সাজদাহ দিতে পারেন এবং মেঝেতে বসে থাকতে পারেন তাই সাজদাহ, দুই সাজদাহর মাঝের বৈঠক, তাশাহহুদের বৈঠক তার জন্য ওয়াজিব ও রুকন। তিনি যদি চেয়ারে বসে সালাত আদায় করেন তবে তার সালাত বাতিল হয়ে যাবে। কারণ এ অবস্থায় সে ইচ্ছাকৃতভাবে এমন রুকনগুলো পরিত্যাগ করছে যেগুলো সে করতে সক্ষম ছিল যেমন সিজদা ও বৈঠক।
.
আবার যিনি সিজদাহ দিতে ও মেঝেতে বসতে অক্ষম; কিন্তু কিয়াম করতে সক্ষম এমন ব্যক্তি যদি চেয়ারে বসে সালাত আদায় করেন, তবে তার সালাত বাতিল হয়ে যাবে। কারণ তিনি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কিয়াম বাদ দিয়ে দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ ধরুন চার রাকাআত বিশিষ্ট সালাতের দুই রাকাআত দাঁড়িয়ে পড়তে সক্ষম এমন ব্যক্তি যদি গোটা চার রাকাআতই বসে আদায় করে তার সালাত বাতিল হয়ে যাবে। কারণ তিনি সক্ষমতা রাখা সত্ত্বেও দুই রাকাআতের কিয়াম বাদ দিয়ে দিয়েছেন। সারসংক্ষেপে: সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে শরীয়তের মূলনীতি হলো যে যতটুকু সক্ষম, ততটুকুই তাকে বাস্তবায়ন করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই নিজের পক্ষ থেকে ছাড় দেওয়া বা অবহেলা করা বৈধ নয়। পূর্বোক্ত আলোচনার সপক্ষে শরয়ি দলিল হচ্ছে ফিকাহশাস্ত্রের দুটো সাধারণ নীতি; যে নীতিদ্বয়ের পক্ষে কুরআন ও সহিহ সুন্নাহর দশ দশ দলিলের সাক্ষ্য রয়েছে। প্রথম নীতিটি হচ্ছে: المشقة تجلب التيسير (কাঠিন্য সহজায়ন আনে)। এর সপক্ষে দলিল হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী: لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا (আল্লাহ্ কারো উপর এমন কোন দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না যা তার সাধ্যাতীত)[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২৮৬] দ্বিতীয় নীতিটি হচ্ছে: الميسور لا يسقط بالمعسور (কষ্টসাধ্য সহজসাধ্যকে মওকুফ করে না)। এর দলিল হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী: فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ (অনুবাদ: তোমরা সাধ্যমত আল্লাহ্কে ভয় কর)[সূরা তাগাবুন, আয়াত: ১৬] এটি একটি মহান নীতি। এ নীতি সম্পর্কে আলেমগণ বলেন: “এটি এত ব্যাপক একটি নীতি; যতদিন শরিয়তের মৌলিক বিধানগুলো কায়েম থাকবে ততদিন এটি ভুলে যাওয়া যাবে না”(সূয়ূতী-এর ‘আল-আশবাহ ওয়ান নাযায়ের’ পৃষ্ঠা-২৯৩) হাদিসেও এসেছে, ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: “আমার অর্শ রোগ ছিল। সে প্রসঙ্গে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সলাতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন: তুমি দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করবে; যদি দাঁড়াতে না পার তাহলে বসে পড়বে। যদি বসতে না পার তাহলে কাত হয়ে শুয়ে সলাত আদায় করবে ।”(সহিহ বুখারী হা/১০৬৬) শাওকানী বলেন:“ইমরান (রাঃ) এর হাদিস প্রমাণ করে যে, যে ব্যক্তির কোন ওজর ঘটেছে, যার কারণে সে দাঁড়াতে পারে না; তার জন্য বসে সলাত আদায় করা জায়েয এবং যে ব্যক্তির এমন কোন ওজর ঘটেছে যার কারণে সে বসতে পারে না; তার জন্য কাত হয়ে শুয়ে সলাত আদায় করা জায়েয।”(শাওকানী; নাইলুল আওতার; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২৪৩)
.
তৃতীয়ত: যেসকল ব্যক্তি (নারী -পুরুষ) রোগের কারণে কিংবা বয়সের কারণে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে অক্ষম সেই সকল ব্যক্তিদের নিয়ে শারঈ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে চিন্তা ভাবনা করলে মাত্র তিন ক্ষেত্রে চেয়ারে বসে সালাত আদায়ের সুযোগ রয়েছে। যথা: (১).যিনি মেঝেতে বসে থাকতে পারেন না এবং দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না এমন ব্যক্তি চেয়ারে বসে সালাত আদায় করতে পারেন। (২).যিনি মেঝেতে বসে থাকতে পারেন না, তবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন। তিনি কিয়ামের সময় দাঁড়িয়ে থাকবেন আর সাজদাহর সময় চেয়ারে বসে সাজদাহ দিতে পারবেন। (৩). দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না, তবে চেয়ার থেকে নেমে মেঝেতে সাজদাহ দিতে পারেন। তিনি কিয়ামের সময় চেয়ারে বসতে পারবেন, তবে সাজদাহ অবশ্যই মেঝেতে দিতে হবে। মোটকথা এ বিষয়ে সতর্ক থাকা বাঞ্চনীয়। যেমন যে ব্যক্তি দাঁড়ানো ত্যাগ করার ক্ষেত্রে ওজরগ্রস্ত; তার এই ওজর তার জন্য রুকু-সেজদাকালে চেয়ারে বসাকে বৈধ করবে না। সলাতের ওয়াজিবসমূহের ক্ষেত্রে বিধি হলো: মুসল্লি যতটুকু করার সক্ষমতা রাখেন ততটুকু করা তার উপর ওয়াজিব। আর যা করতে অক্ষম ততটুকু তার উপর থেকে মওকুফ হবে।যে ব্যক্তি দাঁড়াতে অক্ষম তার জন্য দাঁড়ানোর সময় চেয়ারে বসা জায়েয হবে; সে রুকু-সিজদা সঠিক কাঠামোতে আদায় করবে। আর যদি দাঁড়াতে সক্ষম হয়; কিন্তু রুকু-সেজদা দিতে কষ্ট হয়; তাহলে দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করবে, এরপর রুকু-সেজদাকালে চেয়ারে বসবে এবং সেজদাকালে মাথাকে রুকুর চেয়ে বেশি নোয়াবে।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেন:ومن قدر على القيام وعجز عن الركوع أو السجود : لم يسقط عنه القيام ، ويصلي قائماً فيومئ بالركوع ، ثم يجلس فيومئ بالسجود ، وبهذا قال الشافعي …لقول الله تعالى : ( وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ ) ، وقول النبي صلى الله عليه وسلم : ( صل قائماً ) ؛ ولأن القيام ركن لمن قدر عليه ، فلزمه الإتيان به كالقراءة ، والعجز عن غيره لا يقتضي سقوطه كما لو عجز عن القراءة“যে ব্যক্তি দাঁড়াতে সক্ষম, রুকু কিংবা সেজদা দিতে অক্ষম: তার জন্য দাঁড়ানো মওকুফ হবে না। সে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করবে । ইশারাতে রুকু করবে। এরপর বসবে এবং ইশারাতে সেজদা করবে। এটি ইমাম শাফেয়ি বলেছেন…। আল্লাহ্ তাআলার এ বাণী: “আর আল্লাহ্র প্রতি বিনয়বনত হয়ে দাঁড়াও”। এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “তুমি দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করবে”-র প্রেক্ষিতে। তাছাড়া যে ব্যক্তির দাঁড়ানোর সক্ষমতা আছে তার জন্য এটি রুকন (আবশ্যকীয় কাঠামো)। তাই তেলাওয়াতের মতো এটি পালন করা আবশ্যকীয়। অন্য কোনোটি পালনে অক্ষম হওয়া এটি মওকুফ হওয়াকে অনিবার্য করে না; যেমনিভাবে কেউ যদি তেলাওয়াত করতে অক্ষম হয়।”(ইবনু কুদামাহ,আল-মুগনী, খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪৪৪ থেকে সংক্ষেপে সমাপ্ত)।
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন:
” الشريعة طافحة بأن الأفعال المأمور بها مشروطة بالاستطاعة والقدرة ، كما قال النبي صلى الله عليه وسلم لعمران بن حصين : ( صَلِّ قَائِمًا ، فَإِن لَم تَستَطِع فَقَاعِدًا ، فَإِن لَم تَستَطِع فَعَلَى جَنبٍ ) رواه البخاري (1117) .وقد اتفق المسلمون على أن المصلي إذا عجز عن بعض واجباتها – كالقيام أو القراءة أو الركوع أو السجود أو ستر العورة أو استقبال القبلة أو غير ذلك – سقط عنه ما عجز عنه . وإنما يجب عليه ما إذا أراد فعله إرادة جازمة أمكنه فعله . بل مما ينبغي أن يعرف ، أن الاستطاعة الشرعية المشروطة في الأمر والنهي لم يكتف الشارع فيها بمجرد المكنة ولو مع الضرر ، بل متى كان العبد قادرا على الفعل مع ضرر يلحقه جُعل كالعاجز في مواضع كثيرة من الشريعة ، كالتطهر بالماء ، والصيام في المرض ، والقيام في الصلاة ، وغير ذلك ، تحقيقا لقوله تعالى : ( يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ اليُسرَ وَلا يُرِيدُ بِكُمُ العُسرَ ) ولقوله تعالى : ( مَا جَعَلَ عَلَيكُم فِي الدِّينِ مِن حَرَجٍ ) ولقوله تعالى : ( مَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيَجعَلَ عَلَيكُم مِن حَرَجٍ ) . وفى الصحيح عن أنس عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : ( إِنَّمَا بُعِثتُم مُيَسِّرِينَ وَلَم تُبعَثُوا مُعَسِّرِينَ )
“নির্দেশিত আমলগুলো সাধ্য ও সক্ষমতার শর্তযুক্ত এর উদাহরণ শরিয়তে ভরপুর। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) কে বলেন: তুমি দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করো, যদি তা না পার তাহলে বসে বসে আদায় কর, যদি সেটাও না পার তাহলে শুয়ে শুয়ে আদায় কর।”[সহিহ বুখারী (১১১৭) মুসলিমগণ এ মর্মে একমত যে, সলাত আদায়কারী যদি সলাতের কিছু ওয়াজিব পালনে অক্ষম হন; যেমন- দাঁড়ানো, ক্বিরাত পড়া, রুকু করা, সিজদা করা, সতর ঢাকা, কিবলামুখী হওয়া কিংবা অন্য কোন ওয়াজিব তাহলে সে যা পালন করতে অক্ষম সেটা তার উপর থেকে মওকুফ হবে। তার উপর সেটা পালন করা ওয়াজিব যেটা পালন করার সে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সেটা পালন করার সাধ্য তার রয়েছে। বরং জেনে রাখা উচিত যে, শরয়ি নির্দেশ ও নিষেধের ক্ষেত্রে সামর্থ্য থাকার যে শর্ত রয়েছে সে ক্ষেত্রে শরিয়তপ্রণেতা ক্ষতিসমেত সামর্থ্য থাকাকে বুঝাননি। বরং বান্দার যদি আমল করার সক্ষমতা থাকে; কিন্তু এতে তার কিছু ক্ষতি সাধিত হয়; এমন সক্ষমতাকে শরিয়তের অনেক আমলের ক্ষেত্রে অক্ষমতা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে; উদাহরণত: পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করা, রোগ নিয়ে রোযা রাখা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামায পড়া ইত্যাদি। সেটা আল্লাহ তাআলার এ বাণী বাস্তবায়নার্থে: “আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তিনি তোমাদের জন্য কঠিন করতে চান না” এবং তাঁর এ বাণীর বাস্তবায়নার্থে: “দ্বীনি ক্ষেত্রে তিনি তোমাদের ওপর কাঠিন্য আরোপ করেননি”। এবং তাঁর এ বাণীরও বাস্তবায়নার্থে: “আল্লাহ্ তোমাদের ওপর কাঠিন্য আরোপ করতে চান না”। এবং সহিহ বুখারীতে আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমরা সহজকারীরূপে প্রেরিত হয়েছ; কাঠিন্য আরোপকারী হিসেবে নয়।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৪৩৮-৪৩৯)
.
শাইখ মুহাম্মদ মুখতার আল-শানক্বিতি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “ওজরগ্রস্ত ব্যক্তি যিনি দাঁড়াতে পারেন না তিনি বসে বসে সলাত আদায় করবেন। যদি কেউ দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরীমা বলতে সক্ষম হয় তাহলে সে এসে সরাসরি বসে পড়ে তাকবীরে তাহরীমা বলবে না; বরং দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরীমা বলবে। কেননা তার পক্ষে দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরীমা বলা সম্ভব। এরপর তার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হলে বসে পড়বে। যদি তার পক্ষে দাঁড়ানো সম্ভবপর না হয় কিংবা কঠিন হয় যেমন পক্ষাঘাত গ্রস্তের অবস্থা তাহলে সেক্ষেত্রে সে ব্যক্তি বসে বসে তাকবীরে তাহরীমা বলবে। আর যদি তার পক্ষে দাঁড়ানো সম্ভবপর হয় তাহলে সে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করবে এবং চেয়ারটিকে তার পিছনেই রাখবে; এতে কোন অসুবিধা নেই। যদি তার কষ্ট হয় তাহলে সে ব্যক্তি বসে পড়বে। যেহেতু ফিকাহ-এর একটি সূত্র হচ্ছে— أن الضرورة تقدر بقدرها” (জরুরী অবস্থা বা অনন্যোপায় অবস্থাকে তার সীমায় সীমিত রাখা হবে)। এই সূত্রের আরেকটি উপ-সূত্র হচ্ছে— ما أبيح للحاجة يُقَدَّر بقدْرِها (প্রয়োজনের তাগিদে যা বৈধ করা হয়েছে সেটা তার সীমাতে সীমাবদ্ধ থাকবে) সুতরাং তার জরুরী অবস্থা হচ্ছে— দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হওয়া; তাই আমরা বলব: আপনি দাঁড়িয়ে তাকবীর দিয়ে বসে পড়ুন। যদি কারো জরুরী অবস্থা এমন হয় যে, তিনি দাঁড়াতেই পারেন না; তাহলে আমরা বলব: আপনি বসে বসেই তাকবীর দিন; কোন অসুবিধা নেই। এটির বিধান এর অবস্থাভেদে। ওটির বিধান সেটির অবস্থাভেদে। এ ব্যাপারে মানুষকে সাবধান করতে হবে। কেননা কখনও কখনও আপনি দেখবেন যে, যে ব্যক্তি দাঁড়াতে সক্ষম তিনি বসে বসে তাকবীর দিচ্ছেন। অথচ তিনি দাঁড়াতে পারেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে চেয়ার নিতে পারেন, চেয়ার বহন করে বের হতে পারেন এমন ব্যক্তির পক্ষে তাকবীরে তাহরীমার রুকনটি বসে বসে পালন করার রুখসত (ছাড়) দেয়া যায় না। তাকে এ বিষয়ে সাবধান করতে হবে। যদি কেউ দাঁড়াতেই না পারে আমরা বলব: তিনি বসে পড়ুন।”(শারহু যাদিল মুস্তাকনি; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৯১; শামেলার নম্বর অনুযায়ী)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেন:الواجب على من صلى جالسا على الأرض ، أو على الكرسي ، أن يجعل سجوده أخفض من ركوعه ، والسنة له أن يجعل يديه على ركبتيه في حال الركوع ، أما في حال السجود فالواجب أن يجعلهما على الأرض إن استطاع ، فإن لم يستطع جعلهما على ركبتيه ، لما ثبت عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال : ( أمرت أن أسجد على سبعة أعظم : الجبهة – وأشار إلى أنفه – واليدين ، والركبتين ، وأطراف القدمين ) .ومن عجز عن ذلك وصلى على الكرسي فلا حرج في ذلك ، لقول الله سبحانه : ( فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ ) وقول النبي صلى الله عليه وسلم : ( إِذَا أَمَرْتُكُمْ بِأَمْرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ ) متفق على صحته”যে ব্যক্তি ভূমিতে বসে বা চেয়ার বসে সলাত আদায় করে তার উপর আবশ্যক হলো: তার সেজদাকে রুকুর চেয়ে নীচু করা। সুন্নাহ হলো রুকুর সময় সে তার হাতদ্বয় তার হাঁটুর উপর রাখবে। আর সেজদা অবস্থায় ওয়াজিব হলো: সক্ষম হলে হাতদ্বয় ভূমিতে রাখা। আর সক্ষম না হলে হাতদ্বয় হাঁটুর উপর রাখা। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি বলেন: “আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে সাতটি হাড্ডির উপর সেজদা করতে: কপাল, তিনি নাকের দিকে ইশারা করেন, হাতদ্বয়, হাঁটুদ্বয় এবং পায়ের আঙ্গুলের উপর।”যে ব্যক্তি এভাবে করতে অক্ষম হওয়ায় চেয়ারে বসে সলাত আদায় করে তাতে কোনো আপত্তি নেই। দলিল হলো আল্লাহ্ তাআলার বাণী: “তোমরা আল্লাহকে সাধ্যানুযায়ী ভয় কর”। এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “আমি যখন তোমাদেরকে কোনো আদেশ করি তখন তোমরা সাধ্যানুযায়ী সেটি পালন করো।”(সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম; বিন বায; মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ১৪৫, ১৪৬)
.
চতুর্থত: জামআতে সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে চেয়ার কাতারে রাখা: আলেমগণ উল্লেখ করেছেন যে, যে ব্যক্তি বসে সলাত আদায় করে তার ক্ষেত্রে ধর্তব্য হলো: তার নিতম্ব কাতারের সমান্তরালে হওয়া; কাতার থেকে আগে বা পিছে না হওয়া। কেননা এটাই হলো সেই স্থান যেখানে তার দেহ স্থিতিশীল হয়। দেখুন আসনাল মাতালিব; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২২২; তুহফাতুল মুহতাজ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১৫৭ এবং শারহু মুনতাহাল ইরাদাত; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৭৯)।
.
আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যাতে এসেছে:يُشْتَرَطُ لِصِحَّةِ الاقْتِدَاءِ (أي اقتداء المأموم بالإمام) أَلا يَتَقَدَّمَ الْمُقْتَدِي إمَامَهُ فِي الْمَوْقِفِ عِنْدَ جُمْهُورِ الْفُقَهَاءِ ( الْحَنَفِيَّةِ وَالشَّافِعِيَّةِ وَالْحَنَابِلَةِ ) . . .وَالاعْتِبَارُ فِي التَّقَدُّمِ وَعَدَمِهِ لِلْقَائِمِ بِالْعَقِبِ , وَهُوَ مُؤْخِرُ الْقَدَمِ لا الْكَعْبِ , فَلَوْ تَسَاوَيَا فِي الْعَقِبِ وَتَقَدَّمَتْ أَصَابِعُ الْمَأْمُومِ لِطُولِ قَدَمِهِ لَمْ يَضُرَّ . . . . . وَالْعِبْرَةُ فِي التَّقَدُّمِ بِالأَلْيَةِ لِلْقَاعِدِينَ , وَبِالْجَنْبِ لِلْمُضْطَجِعِينَ “ইক্বতিদা শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত হলো (অর্থাৎ ইমামের পেছনে মোক্তাদির ইক্বতিদা): মোক্তাদি দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে ইমামের অগ্রবর্তী না হওয়া; এটি জমহুর ফিকাহবিদ (হানাফি, শাফেয়ি ও হাম্বলি) এর অভিমত।অগ্রবর্তী হওয়া বা না হওয়ার ক্ষেত্রে ধর্তব্য হলো: দণ্ডায়মান ব্যক্তির পায়ের গোড়ালি; আর তা হলো পায়ের পাতার পশ্চাদ্ভাগ; টাখনু নয়। যদি পায়ের গোড়ালি সমান্তরালে হয়; কিন্তু মোক্তাদির আঙ্গুল লম্বা হওয়ায় সামনে চলে যায়; এতে অসুবিধা নেই। আর উপবিষ্টের ক্ষেত্রে ধর্তব্য হলো নিতম্ব। আর শয়নরত ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার পার্শ্বদেশ।”(আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যাতে; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ২১) তাই মুসল্লি যদি সলাতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চেয়ারে বসে সলাত আদায় করেন তাহলে তিনি তার বসার স্থানকে কাতারের সমান্তরাল করবেন। যদি তিনি দাঁড়িয়ে সলাত দায় করেন ; কিন্তু রুকু ও সেজদাকালে বসেন; এ সম্পর্কে আমরা ফাযিলাতুশ শাইখ আব্দুর রহমান আল-বার্রাককে জিজ্ঞেস করেছি: তিনি বলেন:عن هذا فأفاد بأن العبرة بالقيام . فيحاذي الصف عند قيامه, وعلى هذا سيكون الكرسي خلف الصف ، فينبغي أن يكون في موضع بحيث لا يتأذى به من خلفه من المصلين .والله تعالى أعلم .”ধর্তব্য হবে দাঁড়ানো অবস্থা। অতএব সেই ব্যক্তি দাঁড়ানো অবস্থাকে কাতারের সমান্তরাল করবেন। এই অভিমতের ভিত্তিতে তখন চেয়ার কাতারের পেছনে থাকবে। তবে এমন স্থানে হওয়া উচিত যাতে করে পেছনের মুসল্লিরা কষ্ট না পায়। আল্লাহ তাআলাই সর্বজ্ঞ।”(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৫০৬৮৪)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।