অনাহারীর মুখে খাবার তুলে দেয়া এবং অসহায় এতিম শিশুর দায়িত্বগ্রহণের অপরিসীম মর্যাদা

অনাহারীর মুখে খাবার তুলে দেয়া এবং অসহায় এতিম শিশুর দায়িত্বগ্রহণের অপরিসীম মর্যাদা:

নিম্নে প্রসঙ্গে মহা গ্রন্থ আল কুরআন এর আয়াত ও কয়েকটি হাদিস এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা তুলে ধরা হল:

🔹 ১. আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সেসব মানুষের প্রশংসা করেছেন যারা নিজেদের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও অন্যকে আহার করায়। তিনি বলেন,
وَیُطۡعِمُونَ ٱلطَّعَامَ عَلَىٰ حُبِّهِۦ مِسۡكِینࣰا وَیَتِیمࣰا وَأَسِیرًا إِنَّمَا نُطۡعِمُكُمۡ لِوَجۡهِ ٱللَّهِ لَا نُرِیدُ مِنكُمۡ جَزَاۤءࣰ وَلَا شُكُورًا)
“খাবারের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বে তারা অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দিদের খাবার দান করে এবং বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদের খাবার দান করি। আমরা তোমাদের কাছ থেকে প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও নয়।’” [সুরা দাহার/ইনসান: ৮-৯]

🔹২. ক্ষুধার্তকে খাদ্য দেওয়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমল:

প্রখ্যাত সাহাবি আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল, সব চেয়ে উত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন,
أفضلُ الأعمالِ أن تُدخِلَ على أخيك المؤمنِ سرورًا ، أو تقضى عنه دَيْنًا ، أو تطعمَه خبزًا

“সবচেয়ে উত্তম আমল হল, তোমার কোন ইমানদার ভায়ের অন্তরে আনন্দ সঞ্চার করা বা তার ঋণ পরিশোধ করা বা তাকে একটি রুটি খাওয়ানো।” [সহীহুল জামে-আলবানি, হা/১০৯৬]

ব্যাখ্যা:

ইমাম মুনাবী রহ. ফযযুল কাদীর কিতাবে এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন,

“ফরজের পরে একজন ঈমানদার অন্যান্য দীনী ভাইদের সাথে যে সব কাজ করে থাকে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম আমল হল, রক্ত বা বংশগত সম্পর্ক না থাকার পরেও শুধু দীনের স্বার্থে অন্য কোন ঈমানদার ভাইয়ের এমন কোন উপকার করা যার কারণে তার অন্তরে আনন্দের সঞ্চার ঘটে। সেটি দীন বা দুনিয়া যে কোন উপকার হতে পারে।
কারো পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ করা হলে, এতে সে ব্যক্তি বড় বিপদ থেকে রক্ষা পায়। রক্ষা পায় লাঞ্ছনার হাত থেকে।
আর রুটি খাওয়ানোর কথা এ জন্য বলা হয়েছে যে, রুটি হল, সবচেয়ে সহজলভ্য জিনিস। কিন্তু কেউ যদি রুটির সাথে গোস্ত দেয় বা যাকে খাবার দেয়া হবে তার চাহিদা ও রুচি মোতাবেক খাবার দেয় তাবে তা নি:সন্দেহে আরও উত্তম কাজ। সবচেয়ে সহজলভ্য জিনিস উল্লেখ করায় মূলত: আমাদের সামনে গরীব ও সহায় মানুষের সাহায্য থেকে দূরে থাকার সুযোগ বাকি থাকল না।”

এই মূল্যবান হাদিসটি যদি আমরা আমল করতে পারতাম তবে নি:সন্দেহে আমাদের সমাজে ক্ষুধা ও দরিদ্রতার অভিযোগ আর শোনা যেতো না। পারস্পারিক সহানুভূতি আর ভ্রাতৃত্ব বোধ সম্পন্ন একটি সুন্দর মানচিত্র আমরা উপহার পেতাম।
আল্লাহ তায়ালা যেন, আমাদের সকলকে উক্ত হাদিসের আলোকে আমল করা তাওফীক দান করেন। আমীন।

🔹৩. খাদ্যদানের মর্যাদা সংক্রান্ত আরেকটি হাদিস:

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَنَّ رَجُلًا سَأَلَ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُّ الْإِسْلَامِ خَيْرٌ قَالَ تُطْعِمُ الطَّعَامَ وَتَقْرَأُ السَّلَامَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
এক ব্যক্তি রাসুল আল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করল, ইসলামের কোন কাজটি উত্তম?
তিনি বললেন, “তুমি খাবার খাওয়াবে এবং পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দিবে।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

🔹 ৪. খাদ্যদান শান্তিতে জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম আমল:

আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন (হিজরত করে মক্কা থেকে) মদিনায় এলেন তখন লোকেরা তাঁর নিকট যেতে লাগলো এবং বলাবলি হতে লাগলো:
”আল্লাহর রাসূল এসেছেন, আল্লাহর রাসূল এসেছেন,আল্লাহর রাসূল এসেছেন।” (তিনবার)।

আমিও লোকজনের সাথে (তাঁকে) দেখতে গেলাম।

আমি তাঁর মুখমণ্ডল ভালোভাবে দেখার পর বুঝতে পারলাম যে, এই চেহারা মিথ্যাবাদীর চেহারা নয়। আর সর্বপ্রথম তাঁর মুখে আমার শোনা কথা হল: তিনি বললেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَفْشُوا السَّلاَمَ وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ وَصِلُوا الأَرْحَامَ وَصَلُّوا بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ بِسَلاَمٍ
“হে লোকসকল! তোমরা সালামের ব্যাপক প্রচলন করো, আহার করাও, আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল রাখো এবং লোকজন যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন রাতের বেলা নামায পড়ো তাহলে শান্তিতে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”

[তিরমিযি ২৪৮৫, দারিমী ১৪৬০, তাহকীক আলবানি: সহীহ]

🔹৫. যার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে সে প্রকৃত ঈমানদার নয়:

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

ليس المؤمن الذي يشبع وجاره جائع إلى جنبه

“সে ব্যক্তি (পূর্ণ) ঈমানদার নয় যে নিজে তৃপ্তি সহকারে আহার করে, অথচ তার প্রতিবেশী অনাহারে থাকে।”

(মুসতাদরাক হাকেম, ইমাম যাহাবী তালখীস কিতাবে এবং ইমাম আলবানী সহীহ আবাদুল মুফরাদ কিতাবে হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন)

🔷 ৬. এতিমের দায়িত্ব গ্রহণ ও প্রতিপালন করা জান্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খুব কাছাকাছি থাকার একটি বিরাট মাধ্যম:

সাহল রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيمِ كَهَاتَيْنِ فِي الْجَنَّةِ وَقَرَنَ بَيْنَ أُصْبُعَيْهِ الْوُسْطَى وَالَّتِي تَلِي الْإِبْهَامَ
“আমি ও এতিমের দায়িত্বগ্রহণকারী ব্যক্তি জান্নাতে এই দুই অঙ্গুলি ন্যায় পাশাপাশি অবস্থান করব।” এ কথা বলার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মধ্যমা ও বৃদ্ধাঙ্গুগুলিকে কাছাকাছি করে দেখালেন। [সুনান আবু দাউদ-সহীহ]

🔷 ৭. এতিম-অনাথ শিশুদের জন্য অর্থ খরচ করা বিশাল মর্যাদাপূর্ণ কাজ:

আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنفِقُونَ ۖ قُلْ مَا أَنفَقْتُم مِّنْ خَيْرٍ فَلِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۗ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ
“তারা তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, তারা কী ব্যয় করবে? বলে দাও, যে বস্তুই তোমরা ব্যয় কর, তা হবে পিতা-মাতার জন্যে, আত্মীয়-আপনজনের জন্যে, এতীম-অনাথদের জন্যে, অসহায়দের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে। আর তোমরা যে কোন সৎকাজ করবে, নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত ভালভাবেই আল্লাহর জানা রয়েছে।” [সূরা বাকারা: ২১৫]

🔷 ৮. এতিমের সম্পদ গ্রাস করা জাহান্নামে যাওয়ার একটি কারণ:

আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَىٰ ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا ۖ وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًا
“যারা এতিমদের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করে এবং অচিরেই তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” [সূরা নিসা: ১০]

♦️ গরিব হলে এতিমের দেখাশোনা ও সম্পদ রক্ষণা-বেক্ষণের পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েজ:

কারও দায়িত্বে এতিম শিশু থাকলে সে যদি আর্থিকভাবে দুর্বল ও অভাবগ্রস্ত হয় তাহলে তার দেখাশোনা ও সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করার পারিশ্রমিক হিসেবে তার সম্পদ থেকে যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য পন্থায় কিছু অর্থ গ্রহণ করা জায়েজ রয়েছে।

যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَابْتَلُوا الْيَتَامَىٰ حَتَّىٰ إِذَا بَلَغُوا النِّكَاحَ فَإِنْ آنَسْتُم مِّنْهُمْ رُشْدًا فَادْفَعُوا إِلَيْهِمْ أَمْوَالَهُمْ ۖ وَلَا تَأْكُلُوهَا إِسْرَافًا وَبِدَارًا أَن يَكْبَرُوا ۚ وَمَن كَانَ غَنِيًّا فَلْيَسْتَعْفِفْ ۖ وَمَن كَانَ فَقِيرًا فَلْيَأْكُلْ بِالْمَعْرُوفِ ۚ فَإِذَا دَفَعْتُمْ إِلَيْهِمْ أَمْوَالَهُمْ فَأَشْهِدُوا عَلَيْهِمْ ۚ
“আর এতিমদের প্রতি বিশেষভাবে নজর রাখবে, যে পর্যন্ত না তারা বিয়ের বয়সে পৌঁছে। যদি তাদের মধ্যে বুদ্ধি-বিবেচনার উন্মেষ আঁচ করতে পার, তবে তাদের সম্পদ তাদের হাতে অর্পণ করো।

এতিমের মাল প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করো না বা তারা বড় হয়ে যাবে মনে করে তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলো না। যারা সচ্ছল তারা অবশ্যই এতীমের মাল খরচ করা থেকে বিরত থাকবে। আর যে অভাবগ্রস্ত সে সঙ্গত পরিমাণ খেতে পারে। যখন তাদের হাতে তাদের সম্পদ প্রত্যর্পণ কর, তখন সাক্ষী রাখবে।” [সূরা নিসা: ৬]

মোটকথা, পিতৃহীন এতিম শিশুর দেখাশোনা করা, তার দায়িত্বগ্রহণ করা, তাকে স্নেহমমতা দেয়া, তার প্রতি দয়া করা, তার সম্পদ রক্ষা করা ইত্যাদি ইসলামের দৃষ্টিতে বিশাল মর্যাদাপূর্ণ কাজ এবং জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম। পক্ষান্তরে তার সম্পদ লুটে খাওয়া বা তার প্রতি অন্যায় আচরণ করা খুবই গর্হিত ও নিন্দনীয় কাজ এবং জাহান্নামে প্রবেশের মাধ্যমে।

পরিশেষে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে দোয়া করি, তিনি যেন আমাদেরকে দারিদ্র্য পীড়িত অনাহারীর মুখে খাবার তুলে দেওয়ার এবং অসহায় পিতৃহীন এতিম শিশুদের দায়িত্ব গ্রহণের তৌফিক দান করেন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।

লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদি আরব।।