প্রশ্ন: ১৫ই শাবানের রাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ঘোষণার হাদিসটি কি সহীহ? এই হাদিস থেকে কি এই রাতে নির্দিষ্ট কোনো ইবাদত করা প্রমাণিত হয়?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে আরবী শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রিতে ‘শবেবরাত’ উদযাপন করা হয়। শবেবরাতের পক্ষে কিছু দলীল উপস্থাপন করে থাকে, যা সঠিক নয়।
.
❑প্রথমত: মধ্যবর্তী শাবানে (১৫ই শাবান) সালাত পড়া, রোযা রাখা ও ইবাদত করার ব্যাপারে যে হাদিসগুলো বর্ণিত হয়েছে সেগুলো শুধুমাত্র যয়ীফ (দুর্বল) শ্রেণীর হাদিসই নয়; বরং সেগুলো মাওযু (বানোয়াট) ও বাতিল শ্রেণীয়। এমন হাদিস গ্রহণ করা ও এর উপর আমল করা জায়েয নয়; সেটা ফযিলতের হোক কিংবা অন্য ক্ষেত্রে হোক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি এই বানোয়াট রেওয়ায়েতগুলো বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ অনেক দেশে প্রসিদ্ধ লাভ করেছে যে দেশগুলোতে অজ্ঞতার সয়লাব বেশি। এমনকি সে রেওয়ায়েতগুলোতে রয়েছে যে, এ রাত্রিতে মানুষের মৃত্যুর সময়ক্ষণ ও আয়ুষ্কাল লিপিবদ্ধ করা হয়…।অথচ এ বিষয়ে উদ্ধৃত রেওয়ায়েতগুলো বাতিল হওয়ার ব্যাপারে বহু আলেম হুকুম দিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ইবনুল জাওযি তাঁর রচিত ‘আল-মাওযুআত’ গ্রন্থে খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৪৪০-৪৪৫), ইবনুল কাইয়্যেম তাঁর রচিত ‘আল-মানার আল-মুনিফ’ গ্রন্থে; ১৭৪ নং থেকে ১৭৭), আবু শামা আস-শাফেয়ি তাঁর রচিত ‘আল-বায়িছ আলা ইনকারিল বিদা ওয়াল হাওয়াদিছ’ গ্রন্থ: ১২৪-১৩৭), আল-ইরাক্বি তাঁর রচিত ‘তাখরিজু ইহইয়ায়ি উলুমিদ দ্বীন’ গ্রন্থ: নং-৫৮২) এবং শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া ‘মাজমুউল ফাতাওয়া’ গ্রন্থ: খণ্ড: ২৮; পৃষ্ঠা: ১৩৮) এ বর্ণনাগুলো বাতিল হওয়ার ব্যাপারে আলেমদের (ইজমা) ঐক্যমত উদ্ধৃত করেছেন।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] মধ্য শাবানের রাত্রি (শবে বরাত) উদযাপনের হুকুম সম্পর্কে বলেন: إن الاحتفال بليلة النصف من شعبان بالصلاة أو غيرها وتخصيص يومها بالصيام: بدعة منكرة عند أكثر أهل العلم، وليس له أصل في الشرع المطهر “নামায কিংবা অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে মধ্য শাবানের রাত্রি উদযাপন করা এবং ঐ দিনে বিশেষ রোযা রাখা: অধিকাংশ আলেমের নিকট গর্হিত বিদআত। পবিত্র শরিয়তে এর পক্ষে কোন দলিল নেই। তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেন:ليلة النصف من شعبان ليس فيها حديث صحيح، كل الأحاديث الواردة فيها موضوعة وضعيفة لا أصل لها، وهي ليلة ليس لها خصوصية لا قراءة ولا صلاة خاصة ولا جماعة، وما قاله بعض العلماء أن لها خصوصية: فهو قول ضعيف، فلا يجوز أن تُخصَّ بشيءٍ، هذا هو الصواب، وبالله التوفيق .”মধ্য শাবানের রাত (শবে বরাত) এর ব্যাপারে কোন সহিহ হাদিস নেই। এ বিষয়ে উদ্ধৃত সকল হাদিস মাওযু (বানোয়াট) ও যয়ীফ (দুর্বল); যেগুলোর কোন ভিত্তি নেই। এই রাত্রির কোন বিশেষত্ব নেই; না তেলাওয়াত, না বিশেষ কোন নামায,না সমাবেশ। কোন কোন আলেম যে বিশেষত্বের কথা বলেছেন সেটা দুর্বল অভিমত। অতএব, এ রাতে বিশেষ কোন ইবাদত করা জায়েয নয়। এটাই সঠিক।আল্লাহ্ই তাওফিকদাতা।(ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৫১১)
❑দ্বিতীয়ত: অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ঘোষণার হাদিসটির মান কি?
.
আমাদের সমাজে বিদআতের পথে আহবানকারী অনেক ভাই অর্ধ (১৫ই) শাবানের রাতে বিশেষ কিছু ইবাদত-বন্দেগির জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছেন এর পক্ষে তাদের জন্য নিম্নোক্ত হাদিসটি দলিল হিসেবে পেশ করা হয়।জেনে রাখা ভাল যে এটি হল এ মতের লোকদের সবচেয়ে শক্তিশালী দলিল। হাদীসটি হচ্ছে প্রখ্যাত সাহাবী আবু মুসা আল-আশআরি (রাঃ) রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন:إن الله ليطلع في ليلة النصف من شعبان ، فيغفر لجميع خلقه ، إلا لمشرك أو مشاحن “নিশ্চয় আল্লাহ্ অর্ধ শাবানের রাত্রিতে সৃষ্টিকুলের দিকে দৃষ্টি দেন। অতঃপর মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।”(সুনানে ইবনে মাজাহ হা/১৩৯০; জামি সগীর হা/১৮১৯; সিলসিলা সহীহা হা/১৫৬৩ সুনানে আবী দাউদ হা/১১৪৪, ১৫৬৩)
.
❖ হাদিসটির সনদ পর্যালোচনা:
হাদিসটি মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক বর্ণনা করেছেন, আবূল আসওয়াদ থেকে, তিনি নাযর ইবনু আবদুল জাব্বার থেকে, তিনি ইবনু লাহীআহ থেকে, তিনি যুবায়র ইবনু সুলায়ম থেকে, তিনি দাহ্হাক ইবনু আবদুর রহমান থেকে, তিনি তার পিতা থেকে এই হাদিস বর্ণনা করেছেন তার পিতা আবূ মূসা আশআরী থেকে আর আবূ মূসা আশাবরী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূত্রে হাদিসটি বর্ননা করেছেন। পাশাপাশি এ অর্থের হাদীস কাছাকাছি শব্দে ৭-৮ জন সাহাবী: আবূ মূসা আশআরী, আউফ ইবনু মালিক, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর, মুয়ায ইবনু জাবাল, আবু সা’লাবা আল-খুশানী, আবূ হুরাইরা,আয়েশা ও আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে”।(সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহাহ; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৩৫)
.
এখন উক্ত হাদিসটি সহীহ নাকি জঈফ এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসগনের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। তবে এটিসহ এ অর্থের হাদীস কাছাকাছি শব্দে যতগুলো হাদিস বর্নিত হয়েছে তার প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা ভাবে জয়ীফ অথবা জাল এ বিষয়ে সবাই একমত কিন্তু যেহেতু কাছাকাছি শব্দে একাধিক হাদিস বর্নিত হয়েছে তাই সবগুলো সমন্বয়ে করে বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি.] সহ একদল মুহাদ্দিস আবু মূসা আল-আশআরি (রাঃ) থেকে বর্নিত হাদিসটিকে বিভিন্ন সনদের সমন্বয়ে হাসান/সহীহ বলেছেন। পক্ষান্তরে অন্য একদল মুহাদ্দিস এটিকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে হাদীসটি দুর্বল এটাই বিশুদ্ধ মত। ইমাম বূসীরী (রাহিমাহুল্লাহ) তার আল-যাওয়ায়েদ’ গ্রন্থে বলেন, আবু মূসার সনদে বর্ণিত উক্ত হাদিসটি জঈফ। কারণ এর সনদে দুটি সমস্যা রয়েছে: (১).আব্দুল্লাহ বিন লাহীআহ একজন সুপ্রসিদ্ধ জঈফ বর্ণনাকারী।(২).ওলীদ বিন মূসা তাদলীস করেছেন। (তাদলীস হাদিস জঈফ হওয়ার একটি অন্যতম কারণ। বিস্তারিত মুস্তালাহুল হাদিসের গ্রন্থাদি দ্রষ্টব্য) তাছাড়া হাদিসটিতে ‘ইযতিরাব’ও রয়েছে। যেমন ইমাম দ্বারাকুতনি (রাহিমাহুল্লাহ) ‘আল-ইলাল’ গ্রন্থে সেটা তুলে ধরেছেন এবং বলেছেন: হাদিসটি সাব্যস্ত হয়নি।(আল-ইলাল’ খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৫০, ৫১)
.
এমনকি বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) ও হাদিসটি দুর্বল বলেছেন। ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,وهذا إسناد ضعيف؛ من أجل ابن لهيعة، وعبد الرحمن، وهو ابن عرزب، والد الضحاك: مجهول، وأسقطه ابن ماجه في رواية له عن ابن لهيعة“এই হাদিসের সনদ দুর্বল, কারণ এতে ইবনু লাহীআহ রয়েছেন, যিনি নির্ভরযোগ্যতার দিক থেকে দুর্বল হিসেবে পরিচিত। এছাড়া এতে আবদুর রহমান অর্থাৎ আদ-দাহহাকের পিতা অন্তর্ভুক্ত আছেন যিনি ইবনু আরজাব নামে পরিচিত এবং মজহুল (অজ্ঞাত) বর্ণনাকারী। তবে ইবনু মাজাহ তার এক বর্ণনায় ইবনু লাহীআহকে বাদ দিয়ে এই হাদিসটি উল্লেখ করেছেন।”(সিলসিলা আস-সহীহাহ, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২১৮) অতঃপর ইমাম আলবানী (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর গ্রন্থ আল-সিলসিলা সহীহাহ (হাদিস নং ১১৪৪)-তে এই হাদিসের বিভিন্ন সূত্র ও প্রমাণ বিশ্লেষণ করে এটিকে সহীহ বলেছেন।
.
প্রিয় পাঠক! বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ইলম, মর্যাদা এবং গ্রহণযোগ্যতা সত্ত্বেও এই হাদীসটিতে তাঁর ইজতিহাদ বা গবেষণাকে অন্যান্য আলেমসহ আমাদের কাছে অগ্রাধিকারযোগ্য মনে হয়নি। কারণ হাদীসটির অন্যান্য সনদ ও শাওয়েদ এতটাই ত্রুটিপূর্ণ যে যা পরস্পর মিলেও ‘গ্রহণযোগ্য’ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। বরং শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কিত হাদীছগুলো হয় জাল,না হয় দুর্বল এটাই বিশুদ্ধ কথা। যেমন হাফিয যাইনুদ্দীন আবুল ফারজ ‘আব্দুর রহমান বিন শিহাব যিনি ইবনু রজব আল-হাম্বালী আল-বাগদাদী নামে প্রসিদ্ধ রাহিমাহুল্লাহ [জন্ম: ৭৩৬ হি.মৃত:৭৯৫ হি:] বলেছেন, “وفي فضل ليلة نصف شعبان أحاديث متعددة، وقد اختُلف فيها، فضعّفها الأكثرون، وصحّح ابن حبان بعضها “অর্ধ শাবানের রাত্রির ফযিলতের ব্যাপারে কয়েকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যে হাদিসগুলোর ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম সে হাদিসগুলোকে দুর্বল বলেছেন। ইবনে হিব্বান কোন কোন হাদিসকে সহিহ বলেছেন”।(ইবনু রজব; লাতায়েফুল মাআরিফ পৃষ্ঠা-২৬১; বিন বায: মাজমূ‘উ ফাতাওয়া খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৮৭)
.
সম্মানিত পাঠক বিন্দৃ! যদি তর্কের খাতিরে আমরা ধরে নিই যে শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কে কিছু ‘গ্রহণযোগ্য’ হাদীস রয়েছে কিন্তু ঐ দিনে বা রাতে অতিরিক্ত বা বিশেষ কোনো ইবাদত সম্পর্কে ‘সহীহ’, ‘হাসান’, কিংবা এমনকি ‘অল্প যঈফ’ হাদীসও বর্ণিত হয়নি। বরং এ সম্পর্কিত যত হাদিস বর্নিত হয়েছে সেগুলো হয় অত্যন্ত দুর্বল আর না হয় জাল।তাছাড়া উক্ত হাদিসটি সহীহ ধরে নেওয়া হলেও এখান থেকেও আমরা শিক্ষা পাই যে, আমরা যদি মহান রবের ক্ষমা লাভে ধন্য হতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে শিরক-বিদআত মুক্ত জীবন এবং মুসলিম জামাআতের সাথে বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। হাদীসের মূল বক্তব্য এটাই।কিন্তু এই হাদীসটি থেকে কোনভাবেই অর্ধ শাবানে বিশেষ কোন ইবাদত প্রমাণিত হয় না। আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামও এ রাতে বিশেষ কোন এবাদত করেন নি বা করতে বলেন নি এজন্য সালাফি, আহালুল হাদিস আলেমগনই শুধু নয় বরং সর্বযুগের জগদ্বিখ্যাত ওলামায়ে কেরাম শবে বরাত উপলক্ষ্যে বিশেষ ইবাদত-বন্দেগীকে বিদ‘আত বলেছেন।(যা আমি ইতিপূর্বে আগের পর্বে উল্লেখ করেছি) এমনকি আমাদের সন্মানিত ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) ইবনু মাজাহর উপর্যুক্ত হাদীসকে সহীহ’ বলেছেন, খোদ তিনিই বলেছেন, نعم لا يلزم من ثبوت هذا الحديث اتخاذ هذه الليلة موسمًا يجتمع الناس فيها، ويفعلون فيها من البدع “তবে “হ্যাঁ, এই হাদীসের সঠিকতা প্রমাণিত হওয়ার মানে এই নয় যে এই রাতটিকে এমন একটি মৌসুম হিসেবে গ্রহণ করতে হবে যেখানে মানুষ একত্রিত হয়ে মসজিদে উপস্থিত হবে এবং সেখানে বিদ‘আত (নতুন আবিষ্কৃত কার্যাবলী) করবে।”(আল-ক্বাসেমী, ইসলাহুল মাসাজিদ মিনাল বিদা‘ ওয়াল আওয়ায়েদ,পৃষ্ঠা: ৯৯; টীকা নং ২) আবু শামা বলেন, لَيْسَ فِىْ حَدِيْثِ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ حَدِيْثٌ يَصِحُّ. ‘মধ্য শা‘বানের ফযীলত সম্পর্কে একটি হাদীসও সহীহ নেই’।আবু বকর ইবনুল আরাবী বলেন, لَيْسَ فِىْ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ حَدِيْثٌ يُعَوَّلُ عَلَيْهِ. ‘মধ্য শা‘বান সম্পর্কে কোন নির্ভরযোগ্য হাদীস নেই”।(বিন বায, আত-তাহযীর মিনাল বিদা‘ পৃষ্ঠা: ১১; ড. সুলায়মান বিন সালিম আস-সুহায়মী, আল-আইয়াদ; পৃষ্ঠা: ৩৭৩)
.
তাছাড়া আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের প্রসিদ্ধ আলেমগণের বিশুদ্ধ মতে যয়ীফ (দুর্বল) হাদিসের উপর সাধারণভাবে আমল করা জায়েজ নয়; এমনকি যদি সেটা আমলের ফযিলতের ক্ষেত্রে হয় কিংবা উৎসাহ প্রদান ও নিরুৎসাহিত করণের ক্ষেত্রে হয় তবুও। সহিহ হাদিসে যা পাওয়া যায় সেটা গ্রহণ করাই একজন মুসলিমের জন্য যথেষ্ট। এ রাতকে ও দিনকে বিশেষত্ব প্রদান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যেমন জানা যায় না; তাঁর সাহাবীবর্গ থেকেও জানা যায় না। আল্লামা আহমাদ শাকির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:لا فرقَ بين الأحكام وبين فضائل الأعمال ونحوها في عدم الأخذ بالرواية الضعيفة، بل لا حجةَ لأحدٍ إلا بما صحَّ عن رسول الله صلى الله عليه وسلم من حديث صحيحٍ أو حسنٍ”যয়ীফ (দুর্বল) হাদিস গ্রহণ না করার ক্ষেত্রে বিধিবিধান সংক্রান্ত বিষয়াবলী কিংবা ফযিলতপূর্ণ বিষয়াবলীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যা সাব্যস্ত হয়েছে; ‘সহিহ হাদিস’ হিসেবে কিংবা ‘হাসান হাদিস’ হিসেবে; সেটা ছাড়া যা সহিহ সাব্যস্ত হয়নি সেটা দিয়ে কারো দলিল দেয়ার অধিকার নেই”।(আল-বায়িস আল-হাসিস; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৭৮)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি.] বলেন, وَهَذَا وَالَّذِىْ أُدَيِّنُ اللهَ بِهِ وَأَدْعُوْ النَّاسَ إِلَيْهِ أَنَّ الْحَدِيْثَ الضَّعِيْفَ لاَ يُعْمَلُ بِهِ مُطْلَقًا لاَفِىْ الْفَضَائِلِ وَالْمُسْتَحَبَّاتِ وَلاَ فِىْ غَيْرِهِمَا. “এই অভিমত ও বিশ্বাস রেখেই আমি আল্লাহর আনুগত্য করি এবং এই অভিমতের প্রতিই মানুষকে আহবান করি যে, যঈফ হাদীসের উপর কোন ক্ষেত্রেই আমল করা যায় না। না ফযীলতের ক্ষেত্রে, না মুস্তাহাবের ক্ষেত্রে।কিংবা অন্য কোন ক্ষেত্রে।”(সহীহুল জামে‘ আস-সগীর ওয়া যিয়াদাতুহু, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৪৫, ৫০) তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) অন্য জায়গায় আরো বলেন; “যঈফ হাদীস অতিরিক্ত ধারণার ফায়েদা দেয় মাত্র। তবে এ বিষয়ে সকল বিদ্বান একমত যে, আহকাম ও ফাযায়েল কোন বিষয়েই যঈফ হাদীছের উপর আমল করা বৈধ নয়”।(তামামুল মিন্নাহ পৃষ্ঠা: ৩৪)
.
▪️শাবান মাসে মুসলিম উম্মাহর করনীয় কি?
.
শা‘বান মাসে মুসলিমদের করনীয় সুন্নাতী আমল হচ্ছে, বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা এবং রমজানের রোজার প্রস্তুতিস্বরূপ শাবান মাসে কিছু রোজা রাখা যেমন: আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,”রামাযান ব্যতীত অন্য কোন মাসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে পূর্ণ মাস ছিয়াম পালন করতে দেখিনি। আর শা‘বান মাস ব্যতীত অন্য মাসে অধিক পরিমাণে নফল সিয়াম পালন করতে দেখিনি”।(সহীহ বুখারী, হা/১৯৬৯)। অপর বর্ননায় উসামা ইবনু যায়েদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, শা‘বান মাসে আপনি যে পরিমাণ সিয়াম রাখেন, অন্য কোন মাসে আপনাকে এত ছিয়াম রাখতে দেখি না! তিনি বললেন, ‘রজব ও রামাযান মাসের মধ্যবর্তী শা‘বান মাস সম্পর্কে লোকজন গাফেল থাকে; অথচ এ মাসে মানুষের আমল আল্লাহ তা‘আলার নিকটে উপস্থাপন করা হয়, আর আমি এটাই ভালোবাসি যে, আমার আমল এমন অবস্থায় উপস্থাপিত হোক যখন আমি ছিয়াম পালনকারী’ (নাসাঈ, হা/২৩৫৭, সনদ হাসান)। এ হাদিসে শাবান মাসে রোজা পালনের হেকমত (গুঢ় রহস্য) বর্ণনা করা হয়েছে। সে হেকমত হচ্ছে- এ মাসে বান্দার আমলগুলো উত্তোলন করা হয়। জনৈক আলেম আরো একটি হেকমত উল্লেখ করেছেন সেটা হচ্ছে- শাবান মাসের রোজা যেন ফরজ নামাজের আগে সুন্নত নামাজের তুল্য। এই্ সুন্নতের মাধ্যমে ফরজ পালনের জন্য আত্মাকে প্রস্তুত করা হয় এবং ফরজ পালনের জন্য প্রেরণা তৈরী করা হয়। একই হেকমত রমজানের পূর্বে শাবানের রোজার ক্ষেত্রেও বলা যেতে পারে। এছাড়া আরেক হাদিসে এসেছে,শা‘বান মাসের একদিনের নফল সিয়াম অন্য মাসের দুই দিনের সিয়ামের সমান। ইমরান বিন হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে বা অন্য কাউকে বলেছেন, ‘তুমি কি শা‘বানের গোপনভাগে (শেষে) সিয়াম রেখেছ? তিনি বললেন, না। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, যখন তুমি (রামাযানের সিয়াম) শেষ করবে, তখন দুইদিন সিয়াম রেখে দিবে”(সহীহ বুখারী, হা/১৯৮৩;সহীহ মুসলিম, হা/১১৬১; ত্বাবারাণী কাবীর, হা/২২০; সহীহ মুসলিম, হা/১১৬১; ফাৎহুল বারী, হা/১৯৮৩-এর আলোচনা দ্র.)। অতএব এমাসে বেশি বেশি সিয়াম পালন করতে হবে। তবে যারা শা‘বানের প্রথম থেকে নিয়মিত ছিয়াম পালন করেন, তাদের জন্য শেষার্ধে সিয়াম পালন করা উচিত নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যখন শা‘বান মাস অর্ধেক অতিবাহিত হয়, তখন তোমরা আর (নফল) সিয়াম রেখ না”(আবূ দাঊদ, হা/২৩৩৭; মিশকাত, হা/১৯৭৪)। অবশ্য যদি কেউ অভ্যস্ত হন বা মানত করে থাকেন, তারা শেষের দিকেও সিয়াম পালন করতে পারবেন”।(সহীহ বুখারী, হা/১৯১৪; মিশকাত, হা/১৯৭৩, ২০৩৮)।
উল্লেখ যে চলতি মাসের আইয়ামে বীজের তৃতীয় সিয়াম আগামী ১৫ শাবান প্রচলিত শবেবরাত দিন পড়ে তাই আইয়ামে বীজের নিয়তে ঐ দিন সিয়াম পালন করতে কোন সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ।যেমন সৌদি ফতোয়া বোর্ড (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ) এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে জিবরীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪৩০ হি./২০০৯ খ্রি.] বলেন: যদি কেউ বছরের অন্য রাতের মত এ রাতেও কিয়ামুল লাইল আদায় করতে চায়, অতিরিক্ত কোন আমল বা শ্রম ব্যতিরেকে, কিংবা বিশেষ কোন ইবাদত খাস না করে তাহলে তাতে কোন অসুবিধা নেই। অনুরূপভাবে কেউ যদি ১৫ই শাবান রোযা রাখতে চায় এই হিসেবে যে, এটা বীযের দিন এবং ১৪ ও ১৩ তারিখেও রোযা রাখে তাতে কোন অসুবিধা নেই। কিংবা এই হিসেবে রোযা রাখে যে, ১৫ তারিখ সোমবারে পড়েছে বা বৃহস্পতিবারে পড়েছে তাতেও কোন অসুবিধা নেই; যদি এমন কোন ফযিলতের বিশ্বাস না করে যে ফযিলত সাব্যস্ত নয়।আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।(ইসলাম সাওয়াল জবাব ফাতাওয়া নং-৮৯০৭)
.
পরিশেষে বলা যায় যে, শাবান মাসে অধিক হারে নফল ছিয়াম পালন করা সুন্নাত। কিন্তু শুধু ১৫ই শাবান একদিন শবেবরাতের নিয়তে সিয়াম পালন করা বিদ‘আত। আল্লাহ সবাইকে শিরক বিদআত মুক্ত জীবন যাপন করার তৌফিক দান করুন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬
আপনাদের দ্বীনি ভাই জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: উস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফি.
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি আবহা, সৌদি আরব।