হুন্ডি ব্যবসা কী এবং বিদেশ থেকে বিশেষ করে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠানো কি জায়েজ

ভূমিকা: হুন্ডি ব্যাবসা বলতে যা বুঝায় তা হচ্ছে, একজন ব্যক্তি তার অর্থ-সম্পদ অন্য কোনো ব্যক্তিকে বা হুন্ডি-ব্যাবসায়িকে (ব্যাংকের মাধ্যমে নয়) এমন পদ্ধতিতে প্রদান করা যাতে সে ঐ ব্যক্তির অর্থ সম্পদ নিদিষ্ট অর্থের বিনিময়ে চুক্তি অনুযায়ী পারিশ্রমিক গ্রহণ করার মাধ্যমে নিরাপদে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। মূলত এটি হচ্ছে, মুদ্রা বিনিময় তথা এক দেশের মুদ্রাকে অন্য দেশের মুদ্রার বিনিময় ক্রয়-বিক্রয়। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাংক সেবা বাস্তবায়িত হওয়ার পর পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ হুন্ডি ব্যাবসাকে অবৈধ অর্থ চালান হিসাবে আইন প্রনয়ন করেছে। কেননা ব্যাংক ব্যবস্থা চালু থাকার পরেও হুন্ডির মাধ্যমে টাকা প্রেরণের ফলে যে দেশ থেকে প্রেরণ করা হচ্ছে এবং যে দেশে প্রেরণ করা হচ্ছে উভয় দেশ রেমিটেন্স থেকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাছাড়া হুন্ডি করলে আপনি প্রকারান্তরে অর্থ পাচারে জড়িত হলেন। কারণ এ টাকাগুলো মূলত রাঘব-বোয়ালরা বিদেশে অট্টালিকা ও বড় বড় ইনভেস্টে কাজে লাগাবে। অনেক অবৈধ কাজে তা ব্যবহার করা হবে। যেগুলোর সাথে অনেক অপরাধী চক্র এমনকি সরকারের অনেক এমপি-মন্ত্রীও জড়িত।
.
অতএব হুন্ডিতে টাকা পাঠালে দেশের দূর্নীতিবাজ ও টাকা পাচারকারীদের সবচেয়ে বেশি লাভ হবে। এখন যদি প্রশ্ন করেন সেটা কিভাবে? এটা বুঝতে হলে আপনাকে আগে বুঝতে হবে হুন্ডি কিভাবে হয়। ধরুন কোন এক দূর্নীতিবাজ x সাহেব বাংলাদেশে দূর্নীতি করে অবৈধভাবে ১০০ কোটি টাকা বানিয়েছে। এটা সে দুবাইয়ে কিংবা কানাডা পাচার করবে। সে এটা কিভাবে করবে? সে কিন্তু এত টাকা ব্যাগে করে ডুবাই কিংবা কানাডা নিতে পারবে না কিংবা বৈধ পথে ব্যংকেও দুবাই, কানাডা পাঠাতে পারবে না। এখানে থেকে আসে হুন্ডি। দুবাইয়ের হুন্ডি দালালরা আপনার মতো বাংলাদেশের ১০০ জন প্রবাসীকে কানেক্ট করবে। তারা দূর্নীতিবাজ x বাংলাদেশী ১০০ কোটি টাকা তাদের বাংলাদেশের এজেন্টের মাধ্যমে আপনাদের পরিবারের একাউন্টে জমা করবে এবং আপনাদের ১০০০, ২০০০ কিংবা ৩০০০ জনের কাছ থেকে নেওয়া সমপরিমাণ দুবাইয়ের মুদ্রা, দুবাইয়ে x এর একাউন্টে দিয়ে দিবে। এর মাধ্যমে কি হবে? বাংলাদেশের দূর্নীতিবাজ x তার ১০০ কোটি টাকা দুবাইয়ে পাচার করতে সক্ষম হবে। আপনি আপনার ভুল এক্টিভিজমের কারনে কি করলেন? দূর্নীতিবাজদের দূর্নীতি করতে টাকা পাচার করতে সাহায্য করলেন। যা দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী অপরাধ। আর ইসলামে সব কাজে সহযোগিতা করাও হারাম কেননা মহান আল্লাহ বলেন,وَ تَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡبِرِّ وَ التَّقۡوٰی ۪ وَ لَا تَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡاِثۡمِ وَ الۡعُدۡوَانِ ۪ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ ‘নেককাজ ও তাক্বওয়ায় তোমরা পরস্পরের সাহায্য কর এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না। আর আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর’ (সূরা আল-মায়িদাহ: ২)। সুতরাং প্রবাস থেকে সরকারী অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান যেমন ব্যাংকের মাধ্যমে ছাড়া অবৈধ পদ্ধতি যেমন হুন্ডি দিয়ে দেশে টাকা পাঠানো সরকারী আইনের লঙ্ঘণ এবং রাষ্ট্রের সাথে প্রতারণা করার শামিল। আর ইসলামে ধোকা প্রতারণা দেওয়া নিষিদ্ধ। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّ “যে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত নয়”(সহীহ মুসলিম হা/১০১) তবে যেসব দেশে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক সেবা নেই কিংবা ব্যক্তি একান্ত জরুরী পরিস্থিতিতে হুন্ডি করতে বাধ্য হয় তাহলে সেটা ভিন্ন বিষয়।
.
এবার আসি বৈধ পন্থায় ব্যাংকে টাকা পাঠালে কি হয়? আপনি বিদেশী মুদ্রা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক তার সব বিনিময় পরিমাণ মুদ্রা আপনার পরিবারকে দিবে,আর আপনার পাঠানো,ডলার, রিয়াল দিয়ে কি হবে? বৈদেশিক বানিজ্য, আরো সহজ করে বললে ঐ মুদ্রা দিলে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশ পণ্য কিনবে। আপনি ব্যাংকে টাকা না পাঠলে দেশের যে কোন ক্ষতি হবে না তা কিন্তু না। রেমিটেন্স না আসলে সরকারের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমবে, দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে চাপ বাড়বে। এর ফল? এর ফলে বাড়বে মূদ্রাস্ফীতি! আমদানি ব্যয় বাড়বে, রপ্তানি আয় কমবে। পণ্যের খরচ বাড়বে,ফলে দ্রব্যমূল্যের আরও বেশি ঊর্ধ্বগতি হবে। ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করতে জনগন হিমশিম খাবে, আপনার পরিবার হিমশিম খাবে। সেন্ট্রাল ব্যাংক টাকা ছাপাবে, বারবার মূদ্রা তার মান হারাবে, আবার টাকা ছাপাবে, আবার মান হারাবে, আবার ছাপাবে, এভাবে চলতে থাকবে! এর ফলে সরকারের এমপি মন্ত্রী কিংবা বড় বড় দুর্নীতিবাজদের কোন সমস্যা হবে না। সমস্যা হবে সাধারন জনগণের। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত হবে এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী।
তাদের খেতে কষ্ট হবে, পরতে কষ্ট হবে, জীবন-যাপন করতে কষ্ট হবে।
.
এবার আসি রাষ্ট্রীয় আইন কানুন সংক্রান্ত বিষয়ে। ইসলামী শরীয়তের একটি মূলনীতি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন প্রতিটি নাগরিকের জন্য মান্য করা আবশ্যক-যতক্ষণ না তা শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক বা শরীয়ত বিরোধী হয়। কারণ রাষ্ট্র কিছু আইন করে জনকল্যাণের স্বার্থে। শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক না হলে এ সব আইন নাগরিকদের জন্য পালন করা আবশ্যক এবং ইচ্ছাকৃতভাবে তা লঙ্ঘন করা নিষিদ্ধ। কেউ আইন লঙ্ঘন করলে গুনাহগার হবে। কারণ ইসলাম সব সময় সঠিক ও কল্যাণকর বিষয়ে উৎসাহিত করে। সুতরাং জনগণের জন্য রাষ্ট্রীয় আইন বিরোধী কাজ করা জায়েয নয় যতক্ষণ তা শরীয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক হয়। আর যেহেতু রাষ্ট্রের আইন তৈরি করেন রাষ্ট্রের শাসক তাই শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমন সকল রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে যেহেতু নাবী (ﷺ) পাপকাজ ব্যতীত সবক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় শাসকদের আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেনবিযতক্ষণ না তাদের দ্বারা সুস্পষ্ট বড় কুফরি সংঘটিত হয়। সুতরাং শাসক কুফরী ব্যতীত অন্যান্য অবাধ্যতায় লিপ্ত হলেও তার কথা শ্রবণ করতে হবে ও তার অনুগত থাকতে হবে, যদি তার নের্তৃত্ব ও তার প্রতি অনুগত থাকা মুসলিমদের জন্য কল্যাণকর হয়। তবে ফাসিকী বা পাপের ফল শাসকের উপরই বর্তাবে। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেছেন,“হে মু’মিনগণ, তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহ’র, আনুগত্য করো রাসূলের, এবং তোমাদের মধ্যকার কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের।” [সূরাহ নিসা: ৫৯] আর নাবী ﷺ বলেছেন,“আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতির এবং শ্রবণ ও আনুগত্যের উপদেশ দিচ্ছি, যদিও সে (শাসক) একজন হাবশী গোলাম হয়।” [আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭; তিরমিযী, হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ, হা/৪২; সনদ: সাহীহ] আব্দুল্লাহ‌ ইবনু মাসঊদ (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, ‘আমার পরে তোমরা অবশ্যই ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার প্রবণতা লক্ষ‍্য করবে এবং এমন কিছু বিষয় দেখতে পাবে, যা তোমরা অপসন্দ করবে। তখনও তোমরা তাদের হক্ব পূর্ণরূপে আদায় করবে, আর তোমাদের হক্ব আল্লাহর কাছে চাইবে” (সহীহ বুখারী, হা/৭০৫২; তিরমিযী, হা/২১৯০)। অন্যত্র রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘যে লোক নিজ আমীরের কাছ থেকে অপসন্দনীয় কিছু দেখবে সে যেন তাতে ধৈর্যধারণ করে। কেননা যে লোক সুলতানের আনুগত্য হতে এক বিঘতও বিচ্ছিন্ন হবে তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়্যাতের মৃত্যু” (সহীহ বুখারী, হা/৭০৫৩, ৭০৫৪, ৭১৪৩;সহীহ মুসলিম, হা/১৮৪৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৮৭)।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,أن القوانين إذا كانت لا تخالف الشرع فلا بأس بها، النظم تسمى بالقوانين وتسمى بالنظم، فكل قانون ونظام ينفع المسلمين ولا يخالف شريعة الله لا بأس به، من المرور أو في القضاء أو في أي الدوائر الحكومية أو في أي مكان. “আইন-কানুন যদি শরিয়ত বিরোধী না হয় তাহলে তাতে কোনও সমস্যা নাই। শৃঙ্খলাকে আইন বলা হয়। সুতরাং (রাষ্ট্রের) যে সকল আইন-শৃঙ্খলা মুসলিমদের উপকার করে ও আল্লাহর আইন লঙ্ঘন করে না তাতে কোনও সমস্যা নাই। যেমন: ট্রাফিক, বিচার বিভাগ, সরকারি অফিস বা অন্য যে কোন স্থানে হোক না কেন।”(বিন বায,অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-১০১৭) আর হা! আমরা কাউকে সব ধরনের ব্যাংকে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত করছি না বরং হুন্ডি ব্যবসা কেন জায়েজ নয় সেটাই বুঝানোর চেষ্টা করছি। আর এটাও বলছি যে আপনারা সুধী ব্যাংকগুলা বর্জন করে অপেক্ষাকৃত ভালো এবং ইসলামী শরীয়ার অধীনে পরিচালিত ব্যাংকগুলোতে অর্থ প্রেরণ করুন।
.
পরিশেষ প্রিয় পাঠক! মূল কথা হচ্ছে, মুসলিম রাষ্ট্রের যে সকল আইন-কানুন জনমানুষের কল্যাণ এবং বিশৃঙ্খলা রোধের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। কোনও নাগরিকের জন্য এ সকল আইন লঙ্ঘন করা বৈধ নয়। অন্যথায় গুনাহগার হতে হবে। কেননা এ সব আইন অনুসরণ না করলে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, জান-মালের ক্ষতি এবং নানা দুর্ভোগে পতিত হয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর মানুষের নিরাপত্তা, কল্যাণ সাধন এবং বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব-যা শরিয়তের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া কেউ যদি এসব আইন লঙ্ঘন করে তাহলে সে নিজেকে নানা বিপদাপদ, শাস্তি ও লাঞ্ছনার মধ্যে নিক্ষেপ করবে-যা ইসলামে নিষেধ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, لا ينبغِي للمؤمنِ أن يُذلّ نفسهُ قالوا : وكيف يُذلّ نفسهُ ؟ قال : يتعرّضُ من البلاءِ لمَا لا يطيقُ- رواه الترمذي، وصححه الألباني. “কোনও ইমানদারের জন্য নিজেকে লাঞ্ছিত করা উচিৎ নয়। তারা (সাহাবিগণ) প্রশ্ন করলেন, মানুষ কিভাবে নিজেকে লাঞ্ছিত করে? তিনি বললেন, সে নিজেকে এমন বিপদের মুখোমুখি করে যা তার সহ্য ক্ষমতার বাইরে।”(সুনানে তিরমিযি,হা/২২৫৪) শাইখ আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন দেখুন সিলসিলা সহীহা হা/৬১৩) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_____________________
উপস্থাপনায়:
আপনাদের দ্বীনি ভাই,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: