হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার এর সংজ্ঞা এবং এদের মধ্যে পার্থক্য ও শারঈ হুকুম

প্রশ্ন: হিজড়া (তৃতীয় লিঙ্গ) ও ট্রান্সজেন্ডারের সংজ্ঞা কি? এদের মধ্যে পার্থক্য কী? ট্রান্সজেন্ডার তথা লিঙ্গ রূপান্তর সম্পর্কে শারঈ হুকুম কী?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: হিজড়া (তৃতীয় লিঙ্গ) ও ট্রান্সজেন্ডারের সংজ্ঞা:

(১). হিজড়া: শরী‘আতের পরিভাষায় হিজড়া বলা হয় যার পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ উভয়টি রয়েছে অথবা কোনটিই নেই। শুধু পেশাবের জন্য একটিমাত্র ছিদ্রপথ রয়েছে। সংক্ষেপে একই দেহে স্ত্রী এবং পুংচিহ্ন যুক্ত অথবা উভয় চিহ্নবিযুক্ত মানুষই হল লিঙ্গ প্রতিবন্ধী বা হিজড়া। তার লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয় পেশাব করার জায়গা দেখে। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পূর্বে সে যদি পুরুষাঙ্গ দিয়ে পেশাব করে তাহলে তার উপর পুরুষের বিধান প্রযোজ্য হবে, আর যদি স্ত্রী অঙ্গ দিয়ে পেশাব করে তাহলে তার উপর নারীর বিধান প্রযোজ্য হবে। দু’টি গোপনাঙ্গের মধ্যে সে একটি দ্বারা পেশাব করে আর অপরটি অতিরিক্ত।(বিস্তারিত জানতে দেখুন ইবনে কুদামাহ আল-মুগনী; খন্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ২২২; কামূসুল ফিক্বহ; খন্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৩৭৭)।
.
তবে যে সকল হিজড়ার মাঝে দাড়ি গোঁফ গজানো, স্বপ্নদোষ জাতীয় নরচিহ্ন প্রকাশিত হয় তারা পুরুষ শ্রেণীভুক্ত হিজড়া। আর যে সকল হিজড়ার মাঝে স্তন, ঋতুস্রাব এবং নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান তারা নারী শ্রেণীভুক্ত হিজড়া। এদের খুনসা গায়ির মুশকিলা অর্থাৎ যাদের সহজে চিনতে পারা যায় বলা হয়। অন্যদিকে যে সকল হিজড়ার মাঝে নারী-পুরুষের কোন নিদর্শনই পরিলক্ষিত হয় না অথবা উভয় ধরনের নিদর্শনই সমানভাবে পরিলক্ষিত হয়, শরী‘আতের পরিভাষায় তাদেরকে খুনসায়ে মুশকিলা তথা জটিল হিজড়া বলা হয় এবং এরাই প্রকৃত হিজড়া।(আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাহ; ২০তম খণ্ড; পৃষ্ঠা: ২১-২৩)।
.
আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতির কাউকে পুরুষ, কাউকে নারী, আবার তাঁর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ কাউকে বানিয়েছেন একটু ভিন্ন করে, যেন বান্দা তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে যে, তিনি সববিষয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি যেমন স্বাভাবিক সুন্দর সৃষ্টি করতে সক্ষম, তেমনি এর ব্যতিক্রম সৃষ্টি করতেও সক্ষম। আর এমনই এক বৈচিত্রময় সৃষ্টি লিঙ্গ প্রতিবন্ধী বা হিজ:ড়া। এরাও পূর্ণাঙ্গদের ন্যায় সমান মর্যাদার অধিকারী মানব। ইসলামের দৃষ্টিতে হি:জড়া, বিকলাঙ্গ বা পূর্ণাঙ্গ হওয়াটা মর্যাদা-অমর্যাদার মাপকাঠি নয়। বরং তাক্বওয়াই হল মান-মর্যাদা আর শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি। মহান আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন, اِنَّ اَکۡرَمَکُمۡ عِنۡدَ اللّٰہِ اَتۡقٰکُمۡ ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তিই সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে বেশী তাক্বওয়া সম্পন্ন’ (সূরা আল-হুজুরাত: ১৩)। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের বাহ্যিক আকার-আকৃতি এবং সহায়-সম্পত্তির প্রতি লক্ষ্য করেন না। বরং তিনি লক্ষ্য করেন তোমাদের অন্তর এবং আমলের প্রতি।(সহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪) অতএব, এই বিষয় আমাদের সকলেরই মনে রাখা উচিত যে, হিজ’ড়ারা সমাজের আর পাঁচটা মানুষের মতই মানুষ, তথা সৃষ্টির অন্যতম সেরা জীব। তারাও আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান, সৎকর্ম, ইবাদত-বন্দেগি ও হালাল-হারাম মেনে চলার ক্ষেত্রে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত। কারণ আল্লাহ তাদেরকে বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন। তারা আল্লাহর বিধান পালন করলে যেভাবে সাওয়াব অর্জন করবে তেমনি আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করলেও গুনাহগার হবে। সুতরাং ইসলামী শরী‘আতে লিঙ্গ প্রতিবন্ধী বা হিজড়ারা অন্যদের ন্যায় সমান মর্যাদার অধিকারী। কেননা মর্যাদা-অমর্যাদার মাপকাঠি পরিপূর্ণ মানুষের উপর নির্ভরশীল নয়। বরং তাক্বওয়াই হল সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি (সূরা আল-হুজুরাত: ১৩; সহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪)। তাদেরকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে আখ্যায়িত করা যাবে না। ভিন্ন সম্প্রদায় হিসাবে আখ্যায়িত করে বঞ্চিত করা যাবে না। তাদের যে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অধিকার রয়েছে, সেগুলো থেকেও তাদেরকে মাহরূম করা যাবে না। তাদেরকে অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, ঘৃণা, তিরস্কার, ভৎর্সনা করার কারণে সবকিছু থেকে তারা বিচ্ছন্ন। ফলে অধিকাংশই অন্যের কাছে হাত পেতে কিংবা চাঁদাবাজি করে জীবনযাপন করে থাকে। অথচ ইসলাম তাদের ন্যায্য অধিকার দিয়েছে। কোনভাবেই ইসলামে তাদের অবহেলা করা হয়নি (ইসলাম ওয়েব ফৎওয়া নং-৩২০০৮৯)।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,”সৃষ্টি হিসাবে প্রত্যেকেই হয় নারী কিংবা পুরুষ। এছাড়া তৃতীয় কোন সৃষ্টি নেই, তাই তাদের কোনভাবেই তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে আখ্যায়িত করা যাবে না (সূরা আন-নাজ্ম: ৪৫; সূরা আন-নিসা: ১)। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান না রাখার কারণে আমরা এদেরকে ভিন্ন একটি লিঙ্গ ও সম্প্রদায় হিসাবে আখ্যায়িত করে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছি, এমনকি তাদের যে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অধিকার রয়েছে, সেগুলো থেকে তাদের বঞ্চিত করছি। যুগ যুগ ধরে অবহেলা, অবমাননা, অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, ঘৃণা, তিরস্কার, ভৎর্সনা আর টিপ্পনি খেয়ে এই ছোট জনগোষ্ঠীটি সমাজে বেঁচে আছে। তাই সমাজে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদের সকলকেই প্রচেষ্টা করতে হবে (ইসলাম ওয়েব ফৎওয়া নং-৩২০০৮৯)

(২). ট্রান্সজেন্ডার: শরী‘আতের পরিভাষায় চিন্তা ভাবনা করলে ট্রান্সজেন্ডার হচ্ছে যারা সৃষ্টিগতভাবে হিজড়া নয় বরং পরবর্তীতে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে কৃত্রিম উপায়ে কিংবা আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচার ও হরমোন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করে আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করে ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত লিঙ্গে পরিণত হয়েছে। যদিও তারা পুরুষ কিন্তু কথা-বার্তায় এবং আচরণে নারীদের বৈশিষ্টের সঙ্গে সাদৃশ্য স্থাপন করে। কিংবা নিজেদেরকে নারী মনে করে তাদেরকেই ট্রান্সজেন্ডার বলে। ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এরা মহাপাপী এবং অভিশপ্ত। কেননা লিঙ্গ পরিবর্তন করা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের সর্বসম্মতিক্রমে হারাম এবং যারা এই কাজ করে তারা সালাত আদায়কারী হলে তাদেরকে নির্বাসন দিতে হবে, অন্যথা হত্যা করতে হবে।(দেখুন আবূ দাঊদ, হা/৪৯২৮; মিশকাত, হা/৪৪৮১, সনদ সহীহ; বিস্তারিত দ্র.: সুবুলুস সালাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯; ইসলাম সাওয়াল জাওয়াব, প্রশ্ন নং-১১৪৬৭০)। পাশাপাশি কেউ যদি জেনে বুঝে সজ্ঞানে ট্রান্সজেন্ডার তথা লিঙ্গ পরিবর্তন করা হালাল মনে করে তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। তওবা করে দ্বীনে ফিরে না আসলে মৃত্যুর পর তাকে গোসল দেওয়া জায়েজ নয়, তাকে মুসলিমদের কবরস্থানে দাফন করা যাবেনা, সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে।
.
ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ মুখান্নাস অর্থাৎ নারীর সাদৃশ্য অবলম্বনকারী ব্যক্তি দুই প্রকারের। যথা:

(১) যে সৃষ্টিগতভাবে কিছুটা নারী প্রকৃতির। সে কৃত্রিমভাবে নারীর সাদৃশ্যতা অবলম্বন করেনি। এতে কোন দোষ, গোনাহ নেই। কেননা সে অপারগ।

(২) যে কৃত্রিমভাবে চাল-চলন, কথা-বার্তা এবং অবয়ব ইত্যাদিতে নারীর আকৃতি অবলম্বন করে, সে ব্যক্তির এ কাজ দোষণীয় যার অভিশাপ হাদীসে এসেছে। (তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৭ম খন্ড,হা/২৭৮৫) সুতরাং বুঝা যাচ্ছে ট্রান্সজেন্ডার মনুষ্য সৃষ্টি যা শরীয়তে নিষিদ্ধ এবং অভিশপ্ত কর্ম।
.
▪️হিজড়া (তৃতীয় লিঙ্গ) ও ট্রান্সজেন্ডারের মধ্যে পার্থক্য কী?
.
দু:খ জনক হলেও সত্যি মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে সুযোগ সন্ধানীরা ট্রান্সজেন্ডারদের হিজড়া হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে। জন্মগত হিজড়াদের ব্যাপারে থাকা সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে বিকৃত যৌনতাকে বৈধতা দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। অথচ হিজড়া (তৃতীয় লিঙ্গ) ও ট্রান্সজেন্ডার সম্পূর্ণ আলাদা দুইটি বিষয়। হিজড়া শারীরিক ত্রুটি। ট্রান্সজেন্ডার মানুষিক সমস্যা। এদের মানুষিক ডাক্তার দেখানো উচিৎ। এদের লিঙ্গ পরিবর্তন নয় বরং মানুষিকতা পরিবর্তন করতে হবে। হিজড়াদের ইসলাম সন্মান করে তাদের জন্য ইসলামী শারিয়াতে সম্পুর্ন মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে যারা নিজেদের ট্র্যান্সজেন্ডার বলে দাবি করছে তাদের সমকামিতার লিপ্ত থাকার বিষয়টি স্পষ্ট। দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে শারমিন আক্তার ঝিনুক ওরফে জিবরান সওদাগর নামে এক নারীর বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। এই নারী নিজেকে ট্র্যান্সজেন্ডার বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। হিজড়া (তৃতীয় লিঙ্গ) ও ট্রান্সজেন্ডার (লিঙ্গ রূপান্তর) এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে:

(১). অভিধান অনুযায়ী হিজড়া শব্দের ইংরেজি Hermaphrodite বা Intersex। জন্মগত ভাবে হিজড়াদের শরীরে কিছু ত্রুটি থাকে।অপরদিকে Transgender/ট্র্যান্সজেন্ডার (পুরুষদের বেশ ধারণকারী নারী আর নারীর বেশ ধারণকারী পুরুষ)। এরা শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের এক ধরণের মানসিক বিকৃতি। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে তার এমন মনে হওয়ার জন্য তার মানসিক চিকিৎসা করা হবে না; বরং তার শরীরকে বদলে দিতে হবে। আর এই পরিবর্তনের স্বীকৃতি দিতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে। হিজড়াদের মতো তারাও সহানুভূতি পাবে সমাজের চোখে। এই লিঙ্গ পরিবর্তনে আইনি জটিলতা ও উত্তরাধিকারী সহ যাবতীয় সুরক্ষা প্রদানে আইন পাশ করানো এটাই এক নজরে ‘ট্রান্সজেন্ডারবাদ।
.
(২). হিজড়া জন্মগত বিষয় যা আল্লাহর নির্ধারিত ফয়সালা আর ট্রান্সজেন্ডার হলো সাবালগ হওয়ার পর কৃত্রিম উপায়ে কিংবা আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচার ও হরমোন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করে আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করার মাধ্যমে মানুষ দ্বারা সৃষ্ট এক মারাত্মক ফিতনা।
.
(৩). মেডিকেল টেস্টের মাধ্যমে একজন মানুষ জন্মগত হিজড়া কিনা তা সনাক্ত করা যায়। কিন্তু ট্র্যান্সজেন্ডার নিছকই মনের দাবী। সে নারী বা পুরুষের পোশাক পরবে, ইচ্ছেমত ওষুধ আর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নিজের দেহকে বদলে নেবে। কেউ যদি অস্ত্রোপচার না করেই নিজেকে বিপরীত লিঙ্গের বলে দাবি করে তাও সবাইকে মেনে নিতে হবে। এ সকল উদ্ভট দাবীর ব্যাপারে রাষ্ট্র ও সমাজ কোনও বাঁধা দিতে পারবে না।
.
(৪). হিজড়ার সম্পর্ক শরীরের সাথে আর ট্রান্সজেন্ডারের সম্পর্ক মনের সাথে। অর্থাৎ নিজেকে সে যা মনে করে সেটাই তার পরিচয়। জন্মগত দেহ যা-ই হোক না কেন। নিজেকে যে নারী দাবি করবে তাকে নারী বলে মেনে নিতে হবে। যদিও তার মাসিক হয়, সে গর্ভবতী হয়, শারীরিকভাবে সে থাকে শতভাগ সুস্থ। নিজেকে যে পুরুষ দাবি করবে তাকে আইনি ও সামাজিকভাবে মেনে নিতে হবে পুরুষ হিসেবে।
.
(৫). হিজড়া হলো তাকদীরের লেখা। পক্ষান্তরে ট্রান্সজেন্ডার হলো তাদবীর তথা পরিকল্পিত রচনা। অর্থাৎ একজন পুরুষের লিঙ্গ পরিবর্তন বা ট্রান্সজেন্ডার হওয়ার অর্থ হল তার পুরুষাঙ্গ ও অন্ডকোষ কেটে ফেলা, বুকে কৃত্রিম স্তন বসানো। অনুরূপ নারীদের লিঙ্গ পরিবর্তন করে ট্রান্সজেন্ডার হওয়ার অর্থ হ’ল তার শরীর থেকে স্তন, জরায়ু এবং গর্ভধারণের প্রয়োজনীয় অংশসমূহ কেটে ফেলা এবং শরীরে বিভিন্ন অংশ থেকে কিছু মাংসপেশী নিয়ে কৃত্রিমভাবে একটি পুরুষাঙ্গ স্থাপন করা। অথচ আল্লাহ বলেন, لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ “অবশ্যই আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম অবয়বে।(সূরা তীন: ৯৫/৪)। তার সৃষ্টির এমন বিকৃতি ঘটানোর অর্থ হ’ল প্রকৃত অর্থে আল্লাহর সঙ্গে বিদ্রোহ করা। আর এটা জঘন্যতম অপরাধ।
.
(৬). হিজড়া তাক্বদীরের ফয়সালা অনুযায়ী মেনে নিতে হয় আর ট্রান্সজেন্ডার শখের বসে আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃতির মাধ্যমে করা হয়। ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদের অপর পিঠ হল সমকামিতা। বাংলাদেশে যারা নিজেদের ট্র্যান্সজেন্ডার বলে দাবি করছে তাদের সমকামিতার লিপ্ত থাকার বিষয়টি স্পষ্ট। দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে শারমিন আক্তার ঝিনুক ওরফে জিবরান সওদাগর নামে এক নারীর বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। এই নারী নিজেকে ট্র্যান্সজেন্ডার বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন।

(৭). হিজড়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। আর ট্রান্সজেন্ডার হলো পরিকল্পিত রচনা। বস্ত্তত ‘ট্রান্সজেন্ডার’ একটি শয়তানী প্রতারণা। বহু পূর্বেই আল্লাহ মানবজাতিকে শয়তানের ধোকা থেকে সতর্ক করে বলেছেন, (শয়তান বলে) আর আমি তাদেরকে আদেশ করব যেন তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে দেয়। (আল্লাহ বলেন) যে ব্যক্তি আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে পতিত হয়।(সূরা নিসা: ১১৯)।
.
ট্র্যান্স জেন্ডার মতবাদ মেনে নেওয়ার পরিণতি হবে বিধ্বংসী। এর ফলাফল হবে:

(১). ঘৃণ্য সমকামী এজেন্ডার আইনি স্বীকৃতি।এটি মেনে নেওয়ার অর্থ হল আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখার চূড়ান্ত লঙ্ঘন। এর মাধ্যমে সৃষ্টির পরিবর্তন, সমলিঙ্গের মধ্যে যৌনতা এবং বিকৃত যৌনাচারের দ্বার উন্মোচিত হবে।
(২). নারী ও পুরুষের সীমারেখা মুছে ফেলা। এর মাধ্যমে মুছে যেতে পারে পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা সহ পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলি।
(৩). পুরুষের সাথে পুরুষের এবং নারীর সাথে নারীর ‘বিয়ে’-কে অর্থাৎ সমকামিতাকে বৈধতা দেওয়া।
(৪). নারীর জন্য নির্ধারিত স্থানে পুরুষের অনুপ্রবেশ।
(৫). কিশোরী ও নারীদের নিরাপত্তা ঝুঁকি বৃদ্ধি, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি বেড়ে যাওয়া।
(৬). নারীদের জন্য নির্ধারিত সুযোগ-সুবিধাগুলো পুরুষদের হাতে চলে যাওয়া।
(৭). উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টনসহ পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে মারাত্মক সামাজিক বিশৃঙ্খলা।
(৮). পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া।
.
▪️ট্রান্সজেন্ডার তথা লিঙ্গ রূপান্তর সম্পর্কে শারঈ হুকুম কী?
.
কুরআন সুন্নাহ এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সর্বসম্মতিক্রমে ট্রান্সজেন্ডার তথা লিঙ্গ রূপান্তর করা হারাম। কারন ট্রান্সজেন্ডারবাদ ইসলাম ও মুসলমানদের মৌলিক আকীদা-বিশ্বাসের পরিপন্থী। কেননা সন্তান হওয়া না হওয়া, সন্তানের ছেলে বা মেয়ে হওয়া একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিয়ন্ত্রণে। এতে কারো কোনো হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। কোনো চিকিৎসা, বিজ্ঞান, ওষুধ-পথ্য কিংবা কোনো ডাক্তার-কবিরাজের এতে কোনো এখতিয়ার নেই। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন―لِلهِ مُلْكُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ یَخْلُقُ مَا یَشَآءُ یَهَبُ لِمَنْ یَّشَآءُ اِنَاثًا وَّ یَهَبُ لِمَنْ یَّشَآءُ الذُّكُوْرَ، اَوْ یُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَّ اِنَاثًا وَ یَجْعَلُ مَنْ یَّشَآءُ عَقِیْمًا اِنَّهٗ عَلِیْمٌ قَدِیْرٌ.”নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের আধিপত্য আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন আবার যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই। আবার যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। (সূরা শূরা: ৪২/ ৪৯-৫০)। পক্ষান্তরে ট্রান্সজেন্ডারবাদে যখন তখন ছেলে বা মেয়ে বনে যাওয়ার ধৃষ্টতা দেখানো হয়। যা সৃষ্টির বিকৃতির পাশাপাশি ঈমান বিধ্বংসীও বটে। তাছাড়া ট্রান্সজে ন্ডারবাদ প্রতিষ্ঠা পেলে আল্লাহর দেওয়া শরীয়ত ও কুরআন সুন্নাহর অসংখ্য বিধানে ব্যাপক পরিবর্তন ও চরম বিকৃতি ঘটবে। এর মাধ্যমে ইসলামের সালাত, হজ্জ, বিয়ে, তালাক, ইদ্দত, বংশপরিচয়,পর্দা, সতর,শাহাদাহ (সাক্ষ্যদান), কাযা, ইমামাত (নামাযের ইমামতি), রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া ও মীরাস-উত্তরাধিকারসহ নারী-পুরুষ সংক্রান্ত কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামের বহু বিধানের পরিবর্তন ও বিকৃতি ঘটবে। সুতরাং কোন মুসলিম যদি সজ্ঞানে বিশ্বাস করে কৃত্রিম উপায়ে কিংবা আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ট্রান্সজেন্ডার করা জায়েজ তাহলে সে কাফের। কেননা সে আল্লাহর হারামকৃত বিষয় নিজের জন্য হালাল করে নিয়েছেন যা ঈমান বঙ্গের সবচেয়ে বড় ১০ টি কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ। অপরদিকে কেউ যদি ট্রান্সজেন্ডার করা হারাম এটি অন্তরে বিশ্বাস করে কিন্তু সয়তানের অনুসরণে পুরুষ হয়েও নারীর বেশ ধারণ করে তাহলে সে মহাপাপী হিসেবে বিবেচিত হবে এবং যতক্ষণ না পর্যন্ত এই ভণ্ডামি ছেড়ে একনিষ্ঠ ভাবে তওবা ইস্তেগফার করে ফিরে না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে কবিরা গুনাহে লিপ্ত থাকবে এবং ঐ অবস্থায় মৃত্যুবরন করলে জাহান্নাম যাবে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিপরীত লিঙ্গের বেশধারনকারীদের উপর লানত তথা আল্লাহর কাছে তাঁর রহমত থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করার দু’আ করেছেন।” অন্য এক হাদিসে তিনি (ﷺ) বলেছেন, তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতে যাবে না তার মধ্যে এক শ্রেনী হচ্ছে, বিপরীত লিঙ্গের বেশধারী। হাদীসগুলো হচ্ছে,
.
ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন,لَعَنَ النَّبِيُّ ﷺ الْمُخَنَّثِيْنَ مِنَ الرِّجَالِ، وَالْمُتَرَجِّلَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَقَالَ‏ أَخْرِجُوْهُمْ مِنْ بُيُوْتِكُمْ.‏ “নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীর বেশধারী পুরুষদেরকে এবং পুরুষের বেশধারী মহিলাদেরকে লানত (আল্লাহর কাছে তাঁর রহমত থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করার দোয়া) করেছেন।” আর তিনি বলেছেন, “ওদেরকে তোমাদের বাড়ি থেকে বিতাড়িত করো।” ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন, “নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অমুককে বিতাড়িত করেছেন এবং উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু অমুককে বিতাড়িত করেছেন।” [সহিহুল বুখারি, হা/ ৫৮৮৬; আবূ দাঊদ, হা/৪৯৩০)। এই হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ আল-কিরমানি রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৭৮৬ হি.) বলেছেন,و﴿المخنث﴾ هو الذي يشبه النساء في أقواله وأفعاله وتارة يكون هذا خلقيا وتارة يكون هذا تكلفيا وهذا هو المذموم الملعون لا الأول.“আর ‘মুখান্নাস’ সেই পুরুষ, যে তার কথাবার্তা ও কাজকর্মে নারীর সাদৃশ্য ধারণ করে। কখনো কখনো এটা কারও সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য হতে পারে। আবার নিজে ভণিতা করেও এমনটা করতে পারে; মূলত এটারই নিন্দা করা হয়েছে এবং এ কাজের কাজিকে লানত করা হয়েছে; প্রথমোক্ত শ্রেণিকে নয় (অর্থাৎ নিন্দা ও লানত তাকে করা হয়নি, যে জন্মগতভাবেই মেয়েসুলভ)।” [মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ আল-কিরমানি, আল-কাওয়াকিবুদ দারারি ফি শারহি সহিহিল বুখারি (বৈরুত : দারু ইহইয়ায়িত তুরাসিল আরাবি, ২য় প্রকাশ, ১৪০১ হি./১৯৮১ খ্রি.), খ. ২১, পৃ. ১০৮-১০৯] আবূ মুলায়কাহ্ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)-কে বলা হলো, জনৈকা মহিলা (পুরুষদের ন্যায়) জুতা পরিধান করেছিল। ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) তাকে বললেনঃ لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَّجُلَةَ مِنَ النِّسَاء “রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন সব মহিলাদের ওপর লা‘নাত করেছেন : যারা পুরুষদের বেশ ধারণ করে”।(আবূ দাঊদ ৪০৯৯, হিজাবুল মার‘আতিল মুসলিমাহ্ ৫/৬৮, মা‘রিফাতুস্ সুনান ওয়াল আসার লিল বায়হাক্বী ৬৩৭৭, শু‘আবুল ঈমান হা/ ৭৮০৪;মিশকাত হা/৪৪৭০) লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে,যেখানে সৃষ্টির সামান্য পরিবর্তনের জন্য রাসূল (ﷺ) অভিসম্পাত করছেন, সেখানে একজন পুরুষ বা নারী লিঙ্গ পরিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টিকে পরিবর্তন করলে তার শাস্তি কেমন হতে পারে সহজেই অনুমেয়।
.
পরিশেষে, ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলে যারা সমকামী ও ট্রান্সজেন্ডার অধিকারের পক্ষ নেয় তাদেরকে আমরা বলতে চাই যে, ‘প্রাণী জগতে রেইপ বা ধর্ষণ একটি ন্যাচারাল বিষয় হিসাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও আমরা যেকারণে ধর্ষণের বিরোধিতা করি, ঠিক একই কারণে ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে সমকামিতা, ট্রান্সজেন্ডার ও সুরক্ষা আইনের বিরুদ্ধে কথা বলি। আমরা কেউ নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসিনি এবং আমাদের এই দেহটাও মূলত আমাদের নয়। এটা আল্লাহ প্রদত্ত আমানত। সুতরাং আল্লাহ যাকে পুরুষ হিসাবে বানিয়েছেন তাকে চিরকাল পুরুষ হিসাবে থাকতে হবে এবং আল্লাহ যাকে নারী বানিয়েছেন তাকে চিরকাল নারীই থেকে যেতে হবে। আল্লাহ বলেন, أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ “সৃষ্টি যার হুকুম ও বিধান চলবে তার”।(সূরা আ‘রাফ: ৭/৫৪)। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ট্রান্সজেন্ডারবাদের অসারতা ও এর ভয়াবহতা অনুধাবন করার তাওফীক দান করুন। বিশ্বের গোটা মুসলিম উম্মাহ্কে এর ভয়াল গ্রাস থেকে হেফাযত করুন। আর আমাদের দেশের দায়িত্বশীল মহলকে বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করার তাওফীক দান করুন এবং ট্রান্সজেন্ডারবাদের মতো একটি কুফরি ও অভিশপ্ত মতবাদকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া থেকে তাদেরকে বিরত রাখুন এবং যাবতীয় ফিৎনা থেকে নিরাপদ করুন। আমীন! আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী।
_____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: