◼️প্রথমত: সৎ কাজের আদেশ করা এবং অন্যায় কাজ হতে নিষেধ করা এটি ইসলামের একটি মহৎ নিদর্শন এবং ঈমানের পূর্ণতার পরিচায়ক। এমনকি কিছু ওলামাগণ এটিকে দ্বীনের আরকান তথা স্তম্ভ হিসেবে গণ্য করেছেন। অতএব প্রত্যেক মুসলিমের উপর ওয়াজিব হলো ভালো কাজের আদেশ করা এবং অন্যায় কাজ হতে নিষেধ করা। আর এটি মুসলমানদের কোন একটি দলের ওপরে ওয়াজিব আর অন্য দলের ওপর ওয়াজিব নয় বিষয়টি এমন না। বরং এটা প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির উপরে ওয়াজিব যার সক্ষমতা আছে এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে কোনটা ভাল এবং কোনটি খারাপ এমন কিছু জানে অর্থাৎ ঐ ব্যক্তির ওপর থেকে সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধের দায়িত্ব রহিত হবে না যার ওপর শারী‘আতের বিধান অর্পিত হয়েছে। এটা তার জন্য অত্যাবশ্যক। অন্যথায় সে গুনাহগার হবে।আর এই মর্মে কুরআন সুন্নাহয় অসংখ্য দলিল রয়েছে যেমন: মহান আল্লাহ বলেন,كُنۡتُمۡ خَیۡرَ اُمَّۃٍ اُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ تَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡكَرِ وَ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ ؕ وَ لَوۡ اٰمَنَ اَهۡلُ الۡكِتٰبِ لَكَانَ خَیۡرًا لَّهُمۡ ؕ مِنۡهُمُ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ وَ اَكۡثَرُهُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ”তোমরাই সর্বোত্তম উম্মাত, মানবজাতির (সর্বাত্মক কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভুত করা হয়েছে, তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজ হতে নিষেধ কর ও আল্লাহর প্রতি ঈমান রক্ষা করে চল। যদি আহলে কিতাব ঈমান আনত, তাহলে নিশ্চয়ই তাদের জন্য ভাল হত, তাদের মধ্যে কেউ কেউ মু’মিন এবং তাদের অধিকাংশই ফাসেক”।(সূরা আলে ইমরান:৩/১১০) তিনি আরো বলেছেন,وَلۡتَكُنۡ مِّنۡكُمۡ اُمَّۃٌ یَّدۡعُوۡنَ اِلَی الۡخَیۡرِ وَ یَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ یَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡكَرِ ؕ وَ اُولٰٓئِكَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ”আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল যেন থাকে যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে; আর তারাই সফলকাম।(সূরা আলে ইমরান: ৩/১০৪) অপর আয়াতে আরো বলেন,”ইসরাঈল বংশধরদের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল তারা দাউদ ও মারইয়াম পুত্র ঈসার মুখে অভিশপ্ত হয়েছিল। তা এ জন্যে যে, তারা তারা অবাধ্যতা করেছিল আর তারা সীমালঙ্ঘন করত। তারা যে অন্যায় কাজ করেছিল তা হতে একে অপরকে নিষেধ করতনা; বাস্তবিকই তাদের কাজ ছিল অত্যন্ত গর্হিত”।(সূরা মায়েদা: ৭৮, ৭৯) উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইবনে আতিয়া (রা:) বলেন,والإجماع منعقد على أن النهي عن المنكر فرض لمن أطاقه وأمن الضرر على نفسه وعلى المسلمين ، فإن خاف فينكر بقلبه ويهجر ذا المنكر ولا يخالطه”ইজমা রয়েছে যে, অন্যায় কাজ হতে নিষেধ করা ঐ ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব যে এটি করতে সক্ষম এবং সে নিজের ও মুসলমানদের ক্ষতি হওয়া থেকে নিরাপদ থাকে।কিন্তু যে ব্যক্তি (ক্ষতির) ভয় করে তবে সে তার অন্তর থেকে ঘৃণা করবে এবং অন্যায়কারীকে বর্জন করবে এবং তার সাথে মেলামেশা পরিহার করবে”।(তাফসিরে কুরতুবি; খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ২৫৩)
.
হাদীসে এসেছে, আবূ সা‘ঈদ আল খুদরী (রাঃ) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فبقلبه وَذَلِكَ أَضْعَف الْإِيمَان “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোন শারী‘আত বিরোধী কার্যকলাপ হতে দেখে, সেটাকে যেন নিজ হাতে পরিবর্তন করে দেয়। যদি নিজ হাতে সেগুলো পরিবর্তন করার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে মুখে নিষেধ করবে। আর যদি মুখে নিষেধ করারও সাধ্য না থাকে, তাহলে অন্তরে সেটা ঘৃণা করবে। এটা সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক।(সহীহ মুসলিম, আবূ দাঊদ হা/ ১১৪০, তিরমিযী হা/২১৭২, ইবনু মাজাহ হা/৪০১৩) অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘এর পরে সরিষা পরিমাণ ঈমানও বাকী নেই’।(সহীহ মুসলিম হা/৪৯, আবু দাউদ হা/১১৪০) অন্য এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যার হাতে আমার জীবন তার শপথ করে বলছি, অবশ্যই তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে। নতুবা অচিরেই আল্লাহ তোমাদের উপর তার পক্ষ থেকে শাস্তি নাযিল করবেন। তারপর তোমরা অবশ্যই তার কাছে দোআ করবে, কিন্তু তোমাদের দোআ কবুল করা হবে না।(সুনানে তিরমিযী হা/২১৬৯, মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৩৯১) অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক লোক জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল, কোন লোক সবচেয়ে বেশী ভাল? তিনি বললেন,”সবচেয়ে ভাল লোক হল যে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে, সৎকাজে আদেশ দেয় ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখে।(মুসনাদে আহমাদঃ ৬/৪৩১)
.
উপরোক্ত হাদীসের আলোকে শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,
( ثم إن الأمر بالمعروف والنهى عن المنكر فرض كفاية إذا قام به بعض الناس سقط الحرج عن الباقين وإذا تركه الجميع أثم كل من تمكن منه بلا عذر ولا خوف . ثم إنه قد يتعين كما إذا كان في موضع لا يعلم به إلا هو، أولا يتمكن من إزالته إلا هو ، وكمن يرى زوجته أو ولده أو غلامه على منكر أو تقصير في المعروف )
“অতঃপর সৎ কাজের আদেশ করা এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখা ফরজে কেফায়া (সাম্প্রদায়িক বাধ্যবাধকতা); যদি কিছু লোক তা সম্পাদন করে তাহলে বাকিদের থেকে তা মওকুফ হয়ে যায়। আর যদি সকলেই তা বর্জন করে তবে ওই সকল ব্যক্তিদের পাপ হবে যাদের কোন অজুহাত বা ভয় ছাড়াই এই হুকুম পালন করা সম্ভব ছিল (কিন্তু তা করেনি)। তবে এটি একটি স্বতন্ত্র বাধ্যবাধকতাও হতে পারে। যেমন একজন ব্যক্তি এমন অবস্থায় থাকে যেখানে সে ছাড়া অন্য কেউ এটি সম্পর্কে জানে না বা তাকে ছাড়া কেউ এটি অপসারণ করতে পারে না বা যেমন একজন ব্যক্তি তার স্ত্রী, সন্তান বা
ক্রীতদাস একটি খারাপ কাজ করে কিংবা ভাল কিছু করতে ব্যর্থ হয়।(নববী, শরহ সহীহ মুসলি, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ২৩)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন:
الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر فرض كفاية , إذا قام به مَن يكفي سقط عن الناس , وإذا لم يقم به من يكفي : وجب على الناس أن يأمروا بالمعروف وينهوا عن المنكر , لكن لابد أن يكون بالحكمة ، والرفق ، واللين ؛ لأن الله أرسل موسى وهارون إلى فرعون وقال : ( فَقُولا لَهُ قَوْلاً لَيِّناً لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى )طه/44 ، أما العنف : سواء كان بأسلوب القول ، أو أسلوب الفعل : فهذا ينافي الحكمة , وهو خلاف ما أمر الله به .
ولكن أحياناً يعترض الإنسان شيء يقول : هذا منكر معروف , كحلق اللحية مثلاً , كلٌّ يعرف أنه حرام – خصوصاً المواطنون في هذا البلد – , ويقول : لو أنني جعلتُ كلما رأيت إنساناً حالقاً لحيته – وما أكثرهم – وقفتُ أنهاه عن هذا الشيء : فاتني مصالح كثيرة , ففي هذه الحال : ربما نقول بسقوط النهي عنه ؛ لأنه يفوِّت على نفسه مصالح كثيرة , لكن لو فرض أنه حصل لك اجتماع بهذا الرجل في دكان أو في مطعم أو في مقهى : فحينئذٍ يحسن أن تخوفه بالله , وتقول : هذا أمر محرم ، وأنت إذا أصررت على الصغيرة صارت في حقك كبيرة , وتقول الأمر المناسب .
“সৎ কাজের আদেশ করা আর মন্দ কাজের নিষেধ করার হুকুম হলো ফরযে কিফায়াহ। যদি কোন ব্যক্তি এগুলো প্রতিহত করে তাহলে সকল মানুষের পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে। আর যদি কেউ তা না করে তাহলে সকল মানুষের উপর সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। কিন্তু হিকমতের সাথে এবং সহনশীল ও নম্রতার সাথে করা আবশ্যক। কারণ আল্লাহ তায়ালা মুসা ও হারুন আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ফেরাউনের নিকট পাঠিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন: “তোমরা তার সাথে নরম কথা বলবে। হয়তোবা সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে”। (সুরা ত্বহা: ৪৪)। অতঃপর কঠোর আচরণ করা প্রসঙ্গে: চাই তা কথার পদ্ধতি গুলোর মাধ্যমে হোক কিংবা কর্মের পদ্ধতি গুলোর মাধ্যমে হোক। সুতরাং এটি হিকমতের বিরোধী। আর তা আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তার বিপরীত। কিন্তু কখনও কখনও একজন ব্যক্তি এমন কিছুর সম্মুখীন হতে পারে এবং বলতে পারে যে এটি একটি সুপরিচিত নিষিদ্ধ কাজ। উদাহরণস্বরূপ দাড়ি মুন্ডন করা। প্রত্যেক ব্যক্তি জানে যেটা হারাম। বিশেষ করে এই দেশের (সৌদি আরব) বসবাস করে এবং তিনি বলেন: আমি যখনই কোন মানুষকে তার দাড়ি মুন্ডন (শেভ) করতে দেখি (এমনকি তাদের অধিকাংশ ব্যক্তি) তখন এই ধরনের কর্ম থেকে তাকে নিষেধ করার পক্ষে অবস্থান নিই। যার জন্য আমি অনেক ধরনের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হই। অতএব এ রকম অবস্থায় আমরা বলে থাকি কোন ব্যক্তিকে এ ধরনের অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করার সে ব্যক্তির ওপর যে দায়িত্ব ছিল তা বাতিল (অকেজো) হয়ে যাবে। কারন সে তার নিজের জন্য অনেক কল্যাণ হারিয়ে ফেলছে। এরপরও যদি এই ব্যক্তির সাথে আপনার কোন দোকানে, রেঁস্তোরায় কিংবা ক্যাফেতে সাক্ষাৎ করা/একত্রিত হওয়া সম্ভাব হয় তবে সেই পরিস্থিতিতে ঐ ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে আপনার ভয় দেখানো অনেক উত্তম হবে। আপনি বলবেন এটি একটি হারাম কাজ। আর আপনি যদি সাগিরা গুণাহ (ছোট পাপ) স্থায়ীভাবে করতে থাকেন তবে আপনার ক্ষেত্রে তা কাবিরা গুনাহতে (বড় পাপ) পরিণত হবে। এভাবে আপনি উপযুক্ত বিষয়গুলো বলে দিবেন।(উসাইমীন: লিক্বায়াতুল-বাবিল মাফতুহ: ১১০/প্রশ্ন নং/৫)
.
◼️দ্বিতীয়ত: সামাজিক ভাবে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ বিষয়ক মূলনীতিটি বাস্তবায়িত করার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে যা পূরণ করা আবশ্যক। আর এই শর্তগুলোর অধিকাংশই আদেশ-নিষেধের সাথে সম্পর্কিত এবং কিছু নিয়মের সাথে সম্পর্কিত। মন্দ কাজে বাধা প্রদান ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলি:
প্রথমত: আদেশদান ও বাধা প্রদানকারীর সাথে সংশ্লিষ্ট শর্তাবলি।
(১) ঈমান। অর্থাৎ ব্যক্তি মুসলিম হবে, অমুসলিমদের উপর এ দায়িত্ব ওয়াজিব নয়। (২) মুকাল্লাফ বা শরিয়ত কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়া। অর্থাৎ সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজে বাধা প্রদানকারীকে বুদ্ধিমান (عاقل) ও প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। নির্বোধ ও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের উপর আদেশ ও নিষেধ করা ওয়াজিব নয়।
(৩) সামর্থ্য। যিনি এ কাজে ক্ষমতা রাখেন তার উপরই ওয়াজিব। আর যার ক্ষমতা নেই, অক্ষম ও অসমর্থ তার উপর ওয়াজিব নয়। তবে তাকে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করতে ও অপছন্দ করতে হবে। করা আবশ্যক।
.
দ্বিতীয়ত: অসৎ কাজ (যা প্রতিহত করা হবে তার সাথে) সংশ্লিষ্ট শর্তাবলি।
(১) নিষেধকৃত কাজটি মন্দ ও নিষিদ্ধ এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। ধারণা ও সম্ভাবনার উপর নির্ভর করে বাধা প্রদান বা প্রতিহত করণ জায়েজ হবে না।
(২) যে মন্দ কাজ প্রতিহত করার ইচ্ছা তাকে সম্পাদনকারী সহ প্রতিহত করার সময় কাজে লিপ্ত অবস্থায় পাওয়া যেতে হবে।
(৩) প্রতিরোধ উদ্দিষ্ট অসৎকর্মটি স্পষ্ট ও দৃশ্যমান হতে হবে। অনুমান নির্ভর হলে প্রতিহত করণ জায়েজ হবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “তোমরা দোষ ও গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না।” [সূরা হুজুরাত: ১৩] তাছাড়া ঘর ও এ জাতীয় (সংরক্ষিত) জিনিসের একটি স্বকীয় মর্যাদা আছে। শরয়ি কোন কার্যকারণ ব্যতীত সেটি বিনষ্ট কর বৈধ হবে না। সৎ কাজের আদেশ অসৎ কাজের নিষেধ সংক্রান্ত বিষয়ে সত্যগুলো উল্লেখ করে বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন,
الشرط الأول : أن يكون عالماً بحكم الشرع فيما يأمر به أو ينهي عنه ، فلا يأمر إلا بما علم أن الشرع أمر به ، ولا ينهي إلا عما علم أن الشرع نهي عنه ، ولا يعتمد في ذلك على ذوق ، ولا عادة .
الشرط الثاني : أن يعلم بحال المأمور : هل هو ممن يوجَه إليه الأمر أو النهي أم لا ؟ فلو رأى شخصاً يشك هل هو مكلف أم لا : لم يأمره بما لا يؤمر به مثله حتى يستفصل .
الشرط الثالث : أن يكون عالماً بحال المأمور حال تكليفه ، هل قام بالفعل أم لا ؟
فلو رأى شخصاً دخل المسجد ثم جلس ، وشك هل صلى ركعتين : فلا يُنكر عليه ، ولا يأمره بهما ، حتى يستفصل .
الشرط الرابع : أن يكون قادراً على القيام بالأمر بالمعروف والنهي عن المنكر بلا ضرر يلحقه ، فإن لحقه ضرر : لم يجب عليه ، لكن إن صبر وقام به : فهو أفضل ؛ لأن جميع الواجبات مشروطة بالقدرة والاستطاعة ؛ لقوله تعالى : ( فاتقوا الله ما استطعتم ) التغابن/16 ، وقوله : ( لا يكلف الله نفساً إلا وسعها ) البقرة/286 .
الشرط الخامس : أن لا يترتب على الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر مفسدة أعظم من السكوت ، فإن ترتب عليها ذلك : فإنه لا يلزمه ، بل لا يجوز له أن يأمر بالمعروف أو ينهي عن المنكر .
প্রথম শর্ত: ব্যক্তি যে বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছে বা নিষেধ করছে সে বিষয়ে তার শরীয়তের হুকুম সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। তাই তাকে শুধুমাত্র সেই বিষয়ে আদেশ-নিষেধ করতে হবে যে বিষয়ে তিনি শরীয়তের হুকুম আহকাম জানে। এসকল ক্ষেত্রে তিনি তার নিজস্ব পছন্দ এবং অভ্যাসের উপর নির্ভর করবে না।
দ্বিতীয় শর্ত: তাকে আদেশকৃত ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যে সে আদেশ-নিষেধের বিষয়ে এখন উপযুক্ত নাকি উপযুক্ত নয়? যদি সে এমন কোন ব্যক্তিকে দেখে সন্দেহ করে যে সে আদেশকৃত বিষয়ে মানবে নাকি মানবে না। তাহলে তার কাছে যতক্ষণ পর্যন্ত স্পষ্ট না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে কোন কিছু আদেশ করা যাবেনা।
তৃতীয় শর্ত: আদেশকৃত ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে যে সে কাজটি করতে পারবে নাকি পারবে না। যদি সে কোন ব্যক্তিকে দেখে যে মাসজিদে প্রবেশ করল অতঃপর বসে গেল। সে সন্দেহ করে যে সে দুই রাকাআত সালাত আদায় করেছে নাকি করেনি? এমন সন্দেহ হলে তাকে বসতে বাধা প্রদান করা থেকে বিরত থাকবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা আদেশকারীর কাছে পরিষ্কার না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে কোন কিছু আদেশ করবে না। বরং তিনি আরও খোঁজ নিবেন।
চতুর্থ শর্ত: সৎ কাজের আদেশ এবং অন্যায় কাজ করতে নিষেধ করার কাজটি তার কোন ক্ষতি হওয়া ছাড়াই বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা থাকতে হবে। যদি তার কোন ক্ষতি হয় তাহলে একাজ তার উপর আবশ্যক নয়। তবে সে যদি ধৈর্য ধারণ করে এবং তা বাস্তবায়ন করে তাহলে তা অতি উত্তম। কেননা সকল আবশ্যক বিষয়গুলো সক্ষমতা এবং শক্তির সাথে শর্তারোপ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন: সুতরাং তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর,(সূরা তাগাবুন: ১৬) অপর আয়াতে আরো বলেছেন: “আল্লাহ কাউকেও তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করেন না।(সূরা বাকারা: ২৮৬)
পঞ্চম শর্ত: ভালো কাজের আদেশ এবং অন্যায় কাজের নিষেধ করাটা চুপ থাকার চেয়ে অধিক ফাসাদকৃত হবে না। যদি সেটা তার চাইতে বেশি ফাসাদ সৃষ্টি করে তাহলে সেটা আবশ্যক নয়। এমনকি সেখানে ভালো কাজের আদেশ কিংবা অন্যায় কাজের নিষেধ করাও জায়েজ নয়।(উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খণ্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ৬৫২-৬৫৪)
.
◼️তৃতীয়ত: ভালো কাজের আদেশ এবং অন্যায় কাজের নিষেধ কারার এই দায়িত্ব কারা পালন করবে? এবং এই কাজ সম্পাদন কারীর আদব/বৈশিষ্ট্য কেমন হবে?
.
সৎ কাজের আদেশ অসৎ কাজে নিষেধ সম্পাদনকারীর যেসকল বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে তনুধ্যে অন্যতম হচ্ছে:
(১) ইখলাস ও আন্তরিকতা। কারণ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের বাধা প্রধান একটি অন্যতম শীর্ষ ইবাদত। আর ইবাদত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন: অতএব আপনি নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর ইবাদত করুন।
(২) ইলম তথা প্রয়োজনীয় জ্ঞান। ইলম ব্যতীত অসৎ কাজে বাধা প্রদান করতে যাবে না। কারণ এতে শরয়ি নিষিদ্ধ কাজ সমূহে পতিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন: (হে নবী আপনি) “বলুন, এটাই আমার পথ আমি আল্লাহর দিকে বুঝে শুনে সজ্ঞানে আহ্বান করি আমি এবং আমার অনুসারীরা।”[সূরা ইউসুফ: ১০৮]
(৩) আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকারের ক্ষেত্রে হক স্পষ্ট করার পাশাপাশি হিকমত ও সুকৌশল, সদুপদেশ এবং সূক্ষ্ম পন্থার সাহায্য নেয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন: “অর্থাৎ আপনি মানুষদের আপনার প্রতিপালকের পথে হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে আহ্বান করুন।” [সূরা নাহল: ১২৫] আল্লাহ তাআলা মূসা ও হারুন আ.কে ফেরআউনকে দাওয়াত দেয়ার কৌশল শিক্ষা দিয়ে বলেছেন: “অত:পর তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে এতে করে হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।” [ত্ব-হা: ৪৪] আমাদের নবী মুহম্মদ সা.কে লক্ষ্য করে বলেন: “আপনি যদি রূঢ় ও কঠোর হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যেত।” [সূরা আল ইমরান: ১৫৯]
(৪) আমর বিল মারূফ ও নেহি আমিল মুনকার এর ক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য সর্বাপেক্ষা জরুরি বিষয় হচ্ছে: সবর ধৈর্য এবং সহনশীলতা। লোকমান আ. স্বীয় পুত্রকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন: “হে বৎস ! সালাত কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও। মন্দকাজে নিষেধ কর এবং বিপদাপদে সবর কর, এটিই তো দৃঢ় সংকল্পের কাজ।” [সূরা লোকমান: ১৭]
(৫) কল্যাণ ও অকল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রাখা। সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ তখনই করবে যখন অকল্যাণের চেয়ে কল্যাণের দিকটি প্রবল থাকে আর যদি অবস্থা বিপরীত হয় যে এটি করতে গেলে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণের সম্ভাবনাই বেশি তাহলে আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকার জায়েজ হবে না। কারণ এতে অপেক্ষাকৃত ছোট মুনকার দূর করতে গিয়ে আরো বড় মুনকারে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে।
(৬) মুনকার ও অসৎকাজ দূর করার ক্ষেত্রে সবচে সহজ কাজের সাথে সংগতিপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করা। সুতরাং, সংগতি পূর্ণ পন্থা ও মাধ্যম বাদ দিয়ে আরো বড় মাধ্যম গ্রহণ করা জায়েজ হবে না।
(৭) আবু সাইদ খুদরী রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদিসের বিন্যাস অনুযায়ী ধারাবাহিকতা ও স্তর বিবেচনায় রেখে মন্দ ও অসৎ কাজে বাধা প্রদানের পদক্ষেপ নেয়া। আবু সাইদ খুদরী রা. বলেন. আমি রাসূল সা.কে বলতে শুনেছি। তোমাদের কেউ মন্দ কাজ হতে দেখলে (শক্তি প্রয়োগ করে) প্রতিহত করবে, সম্ভব না হলে (মুখের মাধ্যমে) প্রতিবাদ করবে। এও সম্ভব না হলে (মনে মনে) ঘৃণা করবে। আর এটি হচ্ছে ঈমানের সর্ব নিম্ন স্তর। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, সহজ পন্থা ও পদ্ধতিতে কাজ সম্ভব হলে কঠোর পদ্ধতি অবলম্বনের প্রয়োজন নেই। বরং এটি ঠিকও হবে না। যেমন যে মন্দ কাজ প্রতিবাদের মাধ্যমে দূর করা সম্ভব সেখানে শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিহত করা শরিয়তের দৃষ্টিতে ঠিক নয়। এ নীতিমালা সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সুতরাং যখন আপনি জানবেন যে, ভালো কাজের আদেশ করা এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা শরীয়তের দুটি আবশ্যকীয় কর্তব্য এবং তা বাস্তবায়িত করার জন্য শরীয়তের শর্ত পূরণ হয়েছে তাহলে অবশ্যই মন্দ কিছু দেখলে সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিরোধ করতে হবে কিন্তু সক্ষমতা থাকার পরেও যদি অবহেলা করা হয় তাহলে গুনাহ হবে। কারন মন্দ কাজে বাঁধা প্রদান করা মৌলিকভাবে ফরজে কেফায়া হলেও কখনো কখনো ফরজে আইন হয়ে যায়।যেমন: যখন আপনি কোন অন্যায় কাজ দেখছেন এবং সেখানে সেটাকে প্রতিরোধ করার মত আপনি অন্য কাউকে দেখছেন না এবং সেটা প্রতিরোধ করার মত সক্ষমতা আপনার রয়েছে তাহলে আপনার উপর তা প্রতিরোধ করা আবশ্যক এবং তাতে আপনি বাধা প্রয়োগ না করলে আপনার পাপ হবে।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,واشترط قومٌ كون المنكِر مأذوناً فيه من جهة الإمام أو الوالي ، ولم يجيزوا لآحاد الرعية الحسبة ، وهذا فاسد ؛ لأن الآيات والأخبار تدل على أن كل مَن رأى منكراً فسكت عنه : عصى ، فالتخصيص بإذن الإمام تحكم “একটি দল শর্ত করেছেন যে, খারাপ কাজকে প্রতিহত করার জন্য প্রতিহতকারী ব্যক্তির জন্য ইমাম কিংবা শাসকের পক্ষ থেকে অনুমতি থাকতে হবে। এমনকি তারা এটি সাধারণ জনগোষ্ঠীর কারো জন্য বৈধ মনে করেন না (অনুমোদন দেয় না)। অথচ এটি একটি ভ্রান্ত (ফাসেদ) কথা। কারণ কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও হাদিস সমূহ দ্বারা প্রমাণিত যে, যে কোন ব্যক্তি কোন ঘৃণিত কাজ দেখবে, অতঃপর তা থেকে সে নীরব থাকবে; তবে সে পাপী/গুনাহগার হিসাবে গণ্য হবে।সুতরাং শাসকের অনুমতির সাথে খাস/সীমাবদ্ধ করে হুকুম দেওয়া অবান্তর।(মুখতাসার মিনহাজুল-ক্বাসিদীন, পৃষ্ঠা: ১২৪)।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,وقد يكون الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر فرضَ عينٍ ، وذلك في حق من يرى المنكر وليس هناك من ينكره وهو قادر على إنكاره ، فإنه يتعين عليه إنكاره لقيام الأدلة الكثيرة على ذلك ، ومن أصرحها قول النبي صلى الله عليه وسلم : ( مَن رأى منكم منكراً فليغيره بيده ، فإن لم يستطع فبلسانه فإن لم يستطع فبقلبه وذلك أضعف الإيمان ) أخرجه مسلم في صحيحه “কখনো ভালো কাজের প্রতি আদেশ করা এবং মন্দ জিনিস থেকে নিষেধ করার বিধান হয় ফরজে আঈন। আর এটা হবে কোন ব্যক্তি কাউকে খারাপ কাজ করতে দেখছে আর সেখানে সেটা প্রতিরোধ করার মত কেউ নাই এবং সে সেটাকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম তাহলে তার জন্য অধিক দলিলের ভিত্তিতে সেটাকে প্রতিরোধ করা আবশ্যক। এ বিষয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট করে দিয়েছেন: তোমাদের মধ্যে কেউ যদি খারাপ কাজ দেখে তাহলে সে তার হাত দ্বারা প্রতিহত করবে। যদি হাত দ্বারা প্রতিহত করতে সক্ষম না হয় তাহলে মুখ দ্বারা বাধা প্রদান করবে যদি মুখ দ্বারাও বাধা প্রদান করতে সক্ষম না হয় তাহলে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে আর এটাই হচ্ছে ঈমানের দুর্বল স্তর। এটি ইমাম মুসলিম তার সহিহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন”।(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ৪: পৃষ্ঠা: ২১২)
.
◼️চতুর্থত: সৎ আদেশ এবং অন্যায় কাজের নিষেধ কারার বিধান কিভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে?
.
আমরা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি, প্রত্যেক মুসলিমের উপর সাধ্যানুযায়ী সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধের দায়িত্ব পালন করা ওয়াজিব। আর এ বিষয়ে অসংখ্য কুরআনের আয়াত ও সহীহ হাদীছ এসেছে। এগুলোর প্রতিটিই প্রমাণ করে যে, যে কেউ অন্যায় কাজ হতে দেখবে, তার সক্ষমতার উপর সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ করা ওয়াজিব। সে এই ওয়াজিব পালন থেকে রেহাই পাবে না, যতক্ষণ না অন্য কেউ এ দায়িত্ব পালন করবে। প্রত্যেকেই সামর্থ অনুযায়ী এ দায়িত্বে আঞ্জাম দিবে। যে বান্দা যত অধিক সামর্থ রাখবে, তার উপর তত অধিক সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধের দায়িত্ব পালন করা ওয়াজিব। পাপী ও গুনাহগারদের উপর আল্লাহর আযাব নাযিল হলে পাপ কাজে বাধা দানকারীগণই কেবল আযাব থেকে পরিত্রাণ পাবে। অন্যথায় সকলেই আযাবে গ্রেফতার হবে। এখন অসৎ কাজে বাধা কিভাবে দিতে হবে? সে বিষয়ে আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যাতে বলা হয়েছে, تغيير المنكر له مراتب ، إذ يتدرج من التنبيه والتذكير إلى الوعظ والتخويف ، ثم الزجر والتأنيب ، ثم التغيير باليد ، ثم إيقاع العقوبة بالنكال والضرب ، وأخيراً الاستعداء ورفع الأمر إلى الحاكم “অসৎ কাজে বাধা দেয়ার কয়েকটি ধাপ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ক্রমধারা অবলম্বন করতে হবে। প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সাবধান করা, (হুকুম) স্মরণ করিয়ে দেয়া। এরপর জান্নাতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা ও জাহান্নাম থেকে সাবধান করা। তারপর ধমকি দেয়া ও তিরস্কার করা। এরপর হাত দিয়ে প্রতিরোধ করা। অতঃপর বেত্রাঘাত ও শাস্তির ব্যবস্থা করা। সর্বশেষ তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা ও বিচারের সম্মুখীন করা। আল্লাহই ভাল জানেন।(আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যা, খণ্ড: ৩৯, পৃষ্ঠা-ম:১২৭)
..
এ প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে,মুসলিমের অন্তরকে জীবিত রাখতে হবে যখন সে হাত দিয়ে কিংবা মুখ দিয়ে প্রতিরোধ করতে অক্ষম হবে তখন যাতে করে অন্তর দিয়ে ঘৃনার মাধ্যমে সেটা প্রতিরোধ করে।যেমন: শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেন: والإنكار بالقلب فرض على كل واحد ؛ لأنه مستطاع للجميع ، وهو بغض المنكر ، وكراهيته ، ومفارقة أهله عند العجز عن إنكاره باليد واللسان ؛ لقول الله سبحانه : ( وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ ) الأنعام/68 ، وقال تعالى في سورة النساء : ( وَقَدْ نَزَّلَ عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ أَنْ إِذَا سَمِعْتُمْ آيَاتِ اللَّهِ يُكْفَرُ بِهَا وَيُسْتَهْزَأُ بِهَا فَلَا تَقْعُدُوا مَعَهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ إِنَّكُمْ إِذًا مِثْلُهُمْ ) الآية ، النساء/140 ، وقال تعالى : ( وَالَّذِينَ لَا يَشْهَدُونَ الزُّورَ وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا ) الفرقان/72 ، ومعنى لا يشهدون الزور لا يحضرونه .”অন্তরে ঘৃণা করা প্রত্যেকের জন্য ওয়াজিব। কারণ এটি প্রত্যেকের পক্ষে সম্ভব,আর এটি হ’ল মন্দকে ঘৃণা করা, অপছন্দ করা। যখন মুখ দিয়ে কিংবা হাত দিয়ে তা ঘৃণা করা সম্ভব হবে না তখন যারা খারাপ কাজ করে তাদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,”আর আপনি যখন তাদেরকে দেখেন, যারা আমাদের আয়াতসমূহ সম্বন্ধে উপহাসমূলক আলোচনায় মগ্ন হয়, তখন আপনি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন, যে পর্যন্ত না তারা অন্য প্রসংগ শুরু করে। আর শয়তান যদি আপনাকে ভুলিয়ে দেয় তবে স্মরণ হওয়ার পর যালিম সম্প্রদায়ের সাথে বসবেন না”(সূরা আনআম: ৬৮) অপর আয়াতে বলেন,”কিতাবে তোমাদের প্রতি তিনি তো নাযিল করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে, আল্লাহর আয়াত প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে এবং তা নিয়ে বিদ্রুপ করা হচ্ছে, তখন যে পর্যন্ত তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত না হবে তোমরা তাদের সাথে বসো না, নয়তো তোমরাও তাদের মত হবে। মুনাফিক এবং কাফের সবাইকে আল্লাহ তো জাহান্নামে একত্র করবেন।(সূরা নিসা: ১৪০) তিনি আরো বলেন,”আর যারা মিথ্যার সাক্ষ্য হয় না এবং অসার কার্যকলাপের সম্মুখীন হলে আপন মর্যাদা রক্ষার্থে তা পরিহার করে চলে”।(সূরা ফুরকান: ৭২) “তারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না”এই কথাটির অর্থ হলো “তারা সেখানে উপস্থিত থাকে না”।(ফাতাওয়া শায়েখ ইবনে বায ৩/২১২-২১৩)
.
আর এই অসৎ কাজে বাধা দেয়ার বিধান সক্ষমতা অনুসারে সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মোটকথা রাস্তায়, বাড়িতে কিংবা কর্মক্ষেত্রে যেখানেই এই মন্দ ঘটনা ঘটুক বাধাঁ প্রদনের ক্ষেত্রে তাতে কোনো পার্থক্য নেই; যদি কোন মুসলমান তা ক্ষতি ছাড়াই প্রতিহত করতে সক্ষম হয় তাহলে তা প্রতিহত করবে। তার ক্ষতি প্রত্যাখ্যান করতে কোন আপত্তি করা হবে না।যেমন: বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেন,
فالمؤمنون والمؤمنات يأمرون بالمعروف وينهون عن المنكر , المؤمن لا يسكت ، إذا رأى مِن أخيه منكراً : ينهاه عنه , وهكذا إن رأى مِن أخته أو عمته أو خالته أو غيرهن , إذا رأى منهن منكراً : نهاهنَّ عن ذلك , وإذا رأى مِن أخيه في الله أو أخته في الله تقصيراً في الواجب : أنكر عليه ذلك , وأمره بالمعروف , كل ذلك بالرفق والحكمة ، والأسلوب الحسن .
فالمؤمن إذا رأى أخاً له في الله يتكاسل عن الصلوات أو يتعاطى الغيبة أو النميمة أو شرب الدخان أو المسكر أو يعصي والديه أو أحدهما أو يقطع أرحامه : أنكر عليه بالكلام الطيب ، والأسلوب الحسن , لا بالألقاب المكروهة والأسلوب الشديد , وبين له أن هذا الأمر لا يجوز له … .
كل هذه المنكرات يجب على كل واحد من المؤمنين والمؤمنات والصلحاء إنكارها , وعلى الزوج والزوجة ، وعلى الأخ ، والقريب ، وعلى الجار ، وعلى الجليس ، وعلى غيرهم القيام بذلك كما قال الله تعالى في وصف المؤمنين والمؤمنات : ( يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ ) التوبة/71 ، وقال المصطفى عليه الصلاة والسلام : ( إن الناس إذا رأوا المنكر فلم يغيروه أوشك أن يعمهم الله بعقابه ) ، , ويقول عليه الصلاة والسلام : (من رأى منكم منكرا فليغيره بيده فإن لم يستطع فبلسانه فإن لم يستطع فبقلبه وذلك أضعف الإيمان ) .
وهذا عام لجميع المنكرات ، سواء كانت في الطريق , أو في البيت ، أو في المسجد ، أو في الطائرة ، أو في القطار ، أو في السيارة ، أو في أي مكان , وهو يعم الرجال والنساء جميعاً , المرأة تتكلم ، والرجل يتكلم بالأمر بالمعروف والنهي عن المنكر ؛ لأن في هذا صلاح الجميع ونجاة الجميع .
ولا يجوز السكوت عن ذلك من أجل خاطر الزوج أو خاطر الأخ أو خاطر فلان وفلان , لكن يكون بالأسلوب الحسن والكلمات الطيبة , لا بالعنف والشدة , ومع ملاحظة الأوقات المناسبة , فقد يكون بعض الناس في وقت لا يقبل التوجيه ولكنه في وقت آخر يكون متهيئا للقبول , فالمؤمن والمؤمنة يلاحظان للإنكار والأمر بالمعروف الأوقات المناسبة ولا ييأس إذا لم يقبل منه اليوم أن يقبل منه غدا , فالمؤمن لا ييأس , والمؤمنة لا تيأس , بل يستمران في إنكار المنكر , وفي الأمر بالمعروف وفي النصيحة لله ولعباده مع حسن الظن بالله والرغبة فيما عند الله عز وجل .
মু’মিন নর-নারী ভালো কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে, মুমিন চুপ থাকবে না। যখন সে তার ভাইয়ের মাঝে খারাপ কিছু দেখবে,তখন সে তাকে তা হতে নিষেধ করবে। অনুরূপভাবে যখন সে তার বোনের মাঝে, ফুফুর মাঝে, খালার মাঝে অথবা অন্য কারো মাঝে খারাপ কিছু দেখবে তখন তাদেরকে তা থেকে নিষেধ করবে। যখন সে তার ভাইয়ের বা বোনের মাঝে আল্লাহর ক্ষেত্রে কোনো খারাপ কিছু দেখবে বা ওয়াজিবি বিষয়ে কোনো ঘাটতি দেখবে তখন সে তা প্রতিহত করবে এবং তাকে ভালো কাজের আদেশ করবে আর এ প্রত্যেক কিছু হবে বন্ধুত্বের সাথে,হিকমার সাথে এবং উত্তম পদ্ধতিতে।কোন মমিন যখন তার দ্বীনি ভাইকে দেখবে যে সে সলাতে গাফলতি করছে,গীবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে, ধূমপান, নেশা , পিতা মাতার সাথে অবাধ্য এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করছে তখন তাকে উত্তম কথার মাধ্যমে প্রতিহত করতে হবে কঠিন কথার মাধ্যমে বা অন্তরে আঘাত পায় এমন কথা বার্তা দিয়ে প্রতিহত করা জায়েজ নাই। এই প্রত্যেক ঘৃণিত কাজগুলো প্রত্যেক মুমিন মুমিনা এবং সৎ ব্যক্তিদের ওপর প্রতিহত করা আবশ্যক স্বামী স্ত্রী এবং ভাই নিকট আত্মীয় প্রতিবেশী এমনকি অন্তরঙ্ক সঙ্গে সাথিদের ওপরেও এরা ছাড়া আর অন্য অন্যের ওপর এগুলো নিয়ে তারা দাঁড়াবে যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,”মুমিন মুমিনা নারীদের গুনের ব্যাপারে বলেন, আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু,তারা সৎকাজের নির্দেশ দেয় ও অসৎকাজে নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে; তারাই, যাদেরকে আল্লাহ্ অচিরেই দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।(সুরা তাওবা: ৭১) হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “নিশ্চয় মানুষ যখন খারাপ কাজ দেখবে সে যেন তা প্রতিহত করে। আমি ভয় করছি যে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে তার শাস্তিতে শামিল করে দেবেন। তিনি আরো বলেন যে ব্যক্তি মন্দ কাজ দেখবে সেটা তার হাত দ্বারা প্রতিহত করবে যদি সে সক্ষম না হয় তাহলে মুখ দ্বারা প্রতিহত করবে যদি সেটাও সক্ষম না হয় তাহলে অন্তরে ঘৃণা করবে আর এটাই হল ঈমানের দুর্বলতম স্তর”।(সহীহ মুসলিম) এটি সাধারণ অর্থে এবং সমস্ত অন্যায় কাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সেটা রাস্তায় হোক বাড়িতে হোক অথবা মসজিদে হোক কিংবা বিমানে হক অথবা ট্রেনে হোক বা গাড়িতে হোক অথবা যে কোন স্থানেই হোক না কেন সকল পুরুষ ও সকল নারী তা অন্তর্ভুক্ত করে। মহিলা কথা বলবে,পুরুষ কথা বলবে ভালো কাজের ব্যাপারে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে নিশ্চয় এটা সকলের কল্যাণ ও সকলের নাজাতের উপায়। স্বামীর বা ভাইয়ের স্বার্থে বা অমুক অমুকের খাতিরে এ বিষয়ে চুপ থাকা জায়েজ নয়, তবে তা করা উচিত ভালোভাবে, উত্তম আচরণে বা ভালো কথার মাধ্যমে। সহিংসতা এবং তীব্রতার সাথে নয়, আর উপযুক্ত সময় লক্ষ্য করা উচিত। কিছু লোক এক সময় নির্দেশনা গ্রহণ করতে পারে না, কিন্তু অন্য সময়ে তারা তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকে। কিছু মানুষ রয়েছে যাদের উপদেশ দেওয়া হয় হয়তো সেই সময়টি তার জন্য উপযুক্ত নয় তখন সেটা সে গ্রহণ করে না অন্য সময় সেটা সে গ্রহণ করে। তাই এখানে হতাশ হওয়ার কোন কারণ নাই যে আজকে সেটা সে গ্রহণ করল না হয়তো বা আগামীকালকে গ্রহণ করবে। মুমিন পুরুষ এবং মুমিনা নারী কখনো এ ব্যাপারে হতাশ হয় না তারা অন্যায়কারী ব্যক্তিকে প্রতিহত করতে থাকে”।(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ৪: পৃষ্ঠা: ৫০) মহান আল্লাহ আমাদেরকে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ করার তৌফিক দান করুন (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।