স্বামী কিংবা স্ত্রী একজন অপরজনকে যদি বিছানায় ডাকে কিন্তু স্বামী স্ত্রীকে কিংবা স্ত্রী স্বামীকে সাড়া না দিলে কি গুনাহ হবে

প্রশ্ন: স্বামী কিংবা স্ত্রী একজন অপরজনকে যদি বিছানায় অর্থাৎ সহবাসের জন্য ডাকে কিন্তু স্বামী স্ত্রীকে কিংবা স্ত্রী স্বামীকে সাড়া না দিলে কি গুনাহ হবে?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: এখানে দুটি প্রশ রয়েছে সুতরাং আমরা দুটি বিষয় আলেদা উত্তর লিখার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

▪️প্রথমত: স্বামী যদি স্ত্রীকে বিছানায় অর্থাৎ সহবাসের জন্য ডাকে কিন্তু স্ত্রী স্বামীকে সাড়া না দেয় তাহলে স্ত্রীর কি গুনাহ হবে?
.
বিবাহের পর স্ত্রীর উপর স্বামীর যেসকল প্রাপ্য অধিকার রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অধিকার হচ্ছে,উপভোগ তথা সহবাস করার সুযোগ দেয়া। সুতরাং যখন কোন স্বামী তার স্ত্রীকে বিছানায় সহবাসের জন্য ডাকবে তখন শারঈ কোন ওজর তা থাকলে সে ডাকে সাড়া দেয়া স্ত্রীর উপর ফরজ। দলিল হচ্ছে সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম এ আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদিস: তিনি বলেন:(إِذَا دَعَا الرَّجُلُ امْرَأَتَهُ إِلَى فِرَاشِهِ فَأَبَتْ فَبَاتَ غَضْبَانَ عَلَيْهَا لَعَنَتْهَا الْمَلَائِكَةُ حَتَّى تُصْبِحَ).“যদি কোন স্বামী তার স্ত্রীকে বিছানায় ডাকে কিন্তু স্ত্রী ডাকে সাড়া না দেয় ফলে স্বামী রাগ করে থাকে তখন ভোর হওয়া পর্যন্ত ফেরেশতারা তার উপর লানত করতে থাকে।”(সহীহ বুখারী হা/৩২৩৭ সহীহ মুসলিম হা ১৪৩৬) অপর বর্ননায় আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ! مَا مِنْ رَجُلٍ يَدْعُوْ امْرَأَتَهُ إِلَى فِرَاشِهَا، فَتَأْبَى عَلَيْهِ إِلاَّ كَانَ الَّذِيْ فِيْ السَّمَاءِ سَاخِطًا عَلَيْهَا حَتَّى يَرْضَى عَنْهَا‘‘সে সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার জীবন! কোন ব্যক্তি নিজ স্ত্রীকে তার শয্যার দিকে ডাকলে সে যদি তাতে সাড়া দিতে অস্বীকার করে তা হলে সে সত্তা যিনি আকাশে রয়েছেন (আল্লাহ্ তা‘আলা) তার উপর অসন্তুষ্ট হবেন যতক্ষণ না তার উপর তার স্বামী সন্তুষ্ট হয়’’। (সহীহ বুখারী ৫১৫৩; মুসলিম ১৪৩৬)
.
সুতরাং স্ত্রী যদি কোন বৈধ অজুহাত (স্ত্রীর হা‌য়েজ-নিফাস জনীত সমস্যা কিংবা অসুস্থ বা অন্য কোন শারঈ ওযর) ছাড়াই প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে সে অবাধ্য, পাপী। স্বামীর দায়িত্ব তাকে উপদেশ দেয়া, আল্লাহর শাস্তি সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করা। তাকে বিছানা থেকে আলাদা করে দেয়া। আর প্রয়োজনে সে তাকে মৃদুভাবে প্রহার করবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘আর তোমরা যে নারীদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদেরকে সদুপদেশ দাও, বিছানায় তাদেরকে ত্যাগ কর এবং তাদেরকে (মৃদু) প্রহার কর। এরপর যদি তারা তোমাদের আনুগত্য করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমুন্নত মহান’ (সূরা আন-নিসা: ৩৪)। উক্ত আয়াতে যেসব স্ত্রীলোক স্বামীদের আনুগত্য করে না কিংবা যারা এ ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করে। আল্লাহ তা‘আলা সংশোধনের জন্য পুরুষদেরকে যথাক্রমে তিনটি উপায় বলে দিয়েছেন। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন তার স্ত্রীকে চাকর-বাকরদের মত না মারে, পরে সে দিনের শেষে তার সাথে আবার সহবাস করবে’ (ছহীহ বুখারী, হা/৫২০৪)।
.
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন;

” يجب عليها أن تطيعه إذا طلبها إلى الفراش وذلك فرض واجب عليها .. .. فمتى امتنعت عن إجابته إلى الفراش كانت عاصية ناشزة … ، كما قال تعالى : (وَاللاَّتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلاً)

“যখনি স্বামী স্ত্রীকে বিছানায় ডাকবে তখনি ডাকে সাড়া দেয়া স্ত্রীর উপর ফরজ…। যদি ডাকে সাড়া না দেয় তাহলে স্ত্রী গুনাহগার ও অবাধ্য হবে। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না।”(আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা খন্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৪৫-১৪৬)
.
ইসলাম ওয়েব’-এর আলেমগণ বলেন, আলাউদ্দীন আল-মিরদাবী (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইবনু আবেদীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,”শারঈ কোন কারণ ছাড়া ধারাবাহিকভাবে সহবাসে রাজি না হলে ক্ষতি করা ব্যতীত জোরপূর্বক সঙ্গম করা জায়েয”।(ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-৩৮২১৩২)।
.
▪️দ্বিতীয়ত: স্ত্রী যদি স্বামীকে বিছানায় অর্থাৎ সহবাসের জন্য ডাকে কিন্তু স্বামী সাড়া না দেয় তাহলে স্বামীর কি গুনাহ হবে?
.
বিবাহের পর স্বামীর উপর স্ত্রীর কিছু প্রাপ্য অধিকার রয়েছে। যেমন- ভাল আচরণ করা, ভরণপোষণ ও বাসস্থান দেয়া, সতিত্ব টিকিয়ে রাখানো, আবেগ-অনুভূতির চাহিদা পূরণ। এ অধিকারগুলোর পক্ষে কুরআন-সুন্নাহর দলিল রয়েছে।স্বামী উপর স্ত্রীর চাহিদা পূরণ করাও সদাচারণের অন্তর্ভুক্ত। এটা স্ত্রী হিসেবে তার অধিকার। এই অধিকার পূরণ করা সক্ষম স্বামীর ওপর ওয়াজিব। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেন,وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ ‘আর তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচারণ কর।(সূরা নিসা ১৯)। আল মাউসুয়া’তুল ফিকহিয়্যাতে এসেছে,

من حقّ الزّوجة على زوجها أن يقوم بإعفافها ، وذلك بأن يطأها ، وقد ذهب جمهور الفقهاء – الحنفيّة والمالكيّة والحنابلة – إلى أنّه يجب على الزّوج أن يطأ زوجته

‘স্বামীর ওপর স্ত্রীর অধিকারের মধ্যে অন্যতম হল, স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গমের মাধ্যমে তার পবিত্র জীবন যাপনের প্রতি যত্নশীল হবে। হানাফি, মালেকি ও হাম্বলি মাযহাবের অধিকাংশ ফকিহর মতে স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া স্বামীর জন্য ওয়াজিব।’(আল মাউসুয়া’তুল ফিকহিয়্যা; খন্ড: ৩০; পৃষ্ঠা: ১২৭)।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ)-কে একজন পুরুষ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যদি সে তার স্ত্রীর সাথে এক মাস বা দুই মাস সহবাস না করে তাহলে তার কি কোন গুনাহ আছে কি না? স্বামীর কি তা করা উচিত?

তিনি জবাব বলেন:

يجب على الرجل أن يطأ زوجته بالمعروف ، وهو من أوكد حقها عليه ، أعظم من إطعامها ، والوطء الواجب قيل : إنه واجب في كل أربعة أشهر مرة ، وقيل : بقدر حاجتها وقدرته ، كما يطعمها بقدر حاجتها وقدرته ، وهذا أصح القولين
“স্ত্রীর সঙ্গে ভালোভাবে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া ওয়াজিব। এটা স্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ অধিকার এবং ভরণপোষণের অন্যতম অংশ। কেউ কেউ বলেছেন, চার মাসে (কমপক্ষে) একবার ওয়াজিব। কারো কারো মতে এক্ষেত্রে ভরণপোষণের অন্যান্য বিষয়ের মত স্ত্রীর প্রয়োজন ও স্বামীর সক্ষমতাই মূল বিবেচ্য বিষয়। আর এটাই (দ্বিতীয়টি) বিশুদ্ধ মত”।(মাজমু’আল-ফাতাওয়া, খন্ড: ৩২; পৃষ্ঠা: ২৭১)
.
যে সকল স্বামী তাদের স্ত্রীদের কাছ থেকে দীর্ঘ সময় দূরে থাকেন তাদের (স্বামী-স্ত্রী) পরস্পর দূরে থাকার ক্ষতিকর দিক উল্লেখ করতে গিয়ে বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেন; “এ দীর্ঘসময়ের দূরত্ব আপনার জন্য ও তার জন্য ক্ষতিকর। আপনার উচিত ফাঁকে ফাঁকে স্ত্রীর কাছে যাওয়া ও কিছু সময় তার কাছে থাকা। প্রতি ৩ মাস বা ৪ মাস পর, বেশির চেয়ে বেশি ৬ মাস পর স্ত্রীর কাছে যাওয়া উচিত; এরপর আপনার চাকুরীস্থলে ফিরে আসবেন। যত কম সময় দূরে থাকা যায় তত ভাল। কারণ এটি মারাত্মক ক্ষতিকর ও অকল্যাণকর। এ যুগে ফিতনা ফাসাদ নানা রকমের, নানা ধরনের। তাই স্বামীর উচিত এ বিষয়গুলো মাথায় রাখা। স্বামীর উচিত নিজের চরিত্র ও তার স্ত্রীর চরিত্র নিষ্কলুষ রাখার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা এবং ফিতনার যাবতীয় উপসর্গ থেকে দূরে থাকা”।(বিন বাযের ফতোয়াসমগ্র থেকে সমাপ্ত; ২১/২৩৪) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: