সালাফি মানহাজ অনুসারের হুকুম কী এবং নিজেকে মুসলিমের পাশাপাশি আহালুল হাদিস বা সালাফি পরিচয় দেওয়া যাবে কি

প্রথমত: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর: আরবী السلف শব্দটি السالف শব্দের বহুবচন। সালাফ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ পূর্ববর্তী, পূর্বসূরি, অগ্রবর্তী, পূর্বপুরুষ ইত্যাদি।পারিভাষিক অর্থে, সাহাবী, তাবিঈ ও তাবি‘ তাবিঈগণকে ‘সালাফ’ বলা হয়। আর যারা নিষ্ঠার সাথে তাঁদের অনুসরণ করেন, তাঁদের পথ ও পদ্ধতির উপর অটল থাকেন, তাঁদেরকে ‘সালাফী’ বলা হয়।আর সালাফদের মানহাজ বলতে উদ্দেশ্য হল, যে আদর্শের উপর সাহাবায়ে কিরামগণ, তাবিঈগণ ও তাবি‘ তাবিঈগণ ছিলেন এবং দ্বীনের সেই ইমামগণ, যাদের ইমাম হওয়ার ব্যাপারে সাক্ষী প্রদান করা হয়েছে, দ্বীনে তাঁদের বিশাল মর্যাদা বিদিত হয়েছে এবং তাঁদের বাণীকে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল যুগের মানুষই সাদরে গ্রহণ করেছে। তারা নয়,যাদেরকে বিদ‘আতী আখ্যায়িত করা হয়েছে অথবা যারা অসন্তোষজনক উপাধি নিয়ে প্রসিদ্ধ হয়েছে। যেমন: খাওয়ারিজ, রাওয়াফিয, ক্বাদারিয়্যাহ, মুরজি‘আহ্, জাবারিয়্যাহ্, জাহমিয়্যাহ, মু‘তাযিলাহ, কারামিয়্যাহ প্রভৃতি সম্প্রদায়’।(লাওয়ামিউল আনওয়ার, খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২০)। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‏خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِيْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ “আমার যুগের লোকেরাই সর্বোত্তম ব্যক্তি (অর্থাৎ সাহাবীরা)। অতঃপর যারা তাঁদের নিকটবর্তী (অর্থাৎ তাবিঈরা)। অতঃপর যারা তাঁদের নিকটবর্তী (অর্থাৎ তাবি‘ তাবিঈরা)…”(সহীহ বুখারী, হা/২৬৫২; সহীহ মুসলিম, হা/২৫৩৩)। অর্থাৎ সাহাবীদের যুগ, তাবিঈদের যুগ এবং তাবি‘ তাবিঈদের যুগের ব্যক্তিদেরই সালাফে সালিহীন বুঝানো হয়েছে। অনুরূপভাবে পরবর্তী যুগের হিদায়াতপ্রাপ্ত, সত্যবাদী ও ন্যায়পরায়ণ ইমামগণও শামিল। মোটকথা যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কিরাম এবং তাঁদের অনুগামী তাবিঈন এবং তাঁদের অনুগামী তাবি‘-তাবিঈন ও দ্বীনের ইমামগণের অনুসরণ করে কুরআন ও সহীহ হাদীসের সিদ্ধান্তকে মাথা পেতে গ্রহণ করে, কুরআন ও হাদীসকে তাঁদের বুঝ অনুযায়ী বোঝে এবং সেই মত আমল করে। তাওহীদে, ধর্মবিশ্বাসে, ইবাদতে, আচার-আচরণে, দাওয়াত ও তাবলীগে, শুধু তাঁদেরই অনুসরণ করে, সেই হল প্রকৃত সালাফী। সেই-ই হল সালাফী মানহাজ ও আদর্শের অনুসারী। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, এ ব্যাপারে সে নির্দিষ্টভাবে কোন একজনের অন্ধানুকরণ করে না, বরং আলেমদের অনুসরণ করে এবং দলীলপুষ্ট ও যুক্তিযুক্ত মতটিকে গ্রহণ করে। শাইখুল ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ইমাম আবুল মুযাফফার সাম‘আনী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, আমরা সুন্নাতের অনুসরণ করতে আদিষ্ট হয়েছি এবং বিদ‘আত হতে আমাদেরকে নিষেধ ও তিরষ্কার করা হয়েছে। সুতরাং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের প্রতীক হল, সালাফে ছালিহীনদের অনুসরণ করা এবং প্রত্যেক নব উদ্ভূত ও বিদ‘আতকে বর্জন করা (সাওনুল মানত্বিক, পৃষ্ঠা: ১৫৮)। সালাফদের বুঝের আলোকে শরী‘আত বুঝা অপরিহার্য। তাই প্রত্যেক মুসলিমের জন্য সালাফী মানহাজ অনুসরণ করা ওয়াজিব। এ ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহ’র সুস্পষ্ট দলিল বিদ্যমান রয়েছে। যেমন: মহান আল্লাহ বলেছেন, وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ۚ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ “যে আমার অভিমুখী হয়, তুমি তার পথ অনুসরণ করবে। তারপর আমারই নিকট তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন আমি তোমাদেরকে তা জানিয়ে দেব, যা তোমরা করছিলে।”(সূরাহ লুক্বমান: ১৫) ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন, كل الصحابة منيب إلى الله تعالى؛ فيجب اتباع سبيله، وأقواله و أفعاله واعتقاداته. “প্রত্যেক সাহাবীই মহান আল্লাহ’র অনুবর্তী। সুতরাং তাঁদের পথ এবং তাঁদের কথা, কাজ ও বিশ্বাসের অনুসরণ করা ওয়াজিব।”(ইবনুল কাইয়ুম;ই‘লামুল মুওয়াক্বক্বি‘ঈন, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১৩০)
.
অপর আয়াতে মহান আল্লাহ আরও বলেছেন, وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَىٰ وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ ۖ وَسَاءَتْ مَصِيرًا “যে ব্যক্তি সত্য পথ প্রকাশিত হওয়ার পরও রসূলের বিরোধিতা করে এবং মু’মিনদের পথ বাদ দিয়ে ভিন্ন পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে সে পথেই ফিরাব যে পথে সে ফিরে যায়, আর তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করব, কতইনা মন্দ সে আবাস!”(সূরাহ নিসা: ১১৫) যারাই এ দলের বিরোধিতা করবে, তারাই বিদ‘আতী হিসেবে পরিগণিত হবে। রাসূল (ﷺ) ও জানিয়ে দিয়েছেন, যারা সাহাবী তথা সালাফদের মানহাজে চলবে তারা সঠিক পথের উপর অবিচল থাকবে। তিনি বলেন, ‘আমার উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। শুধু একটি দল ছাড়া তাদের সব দলগুলোই জাহান্নামী হবে। সাহাবীগণ বললেন,”হে আল্লাহ্‌র রাসূল (ﷺ)! সে দল কোন্টি? তিনি বললেন,”আমি ও আমার সাহাবীগণ যার উপর প্রতিষ্ঠিত”।(তিরমিযী, হা/২৬৪১; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৩৪৮; সহীহুল জামি‘, হা/৫৩৪৩)‌
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু কুদামাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন, فمن أحب الكون مع السلف في الآخرة، وأن يكون موجودا بما وعدوا به من الجنات والرضوان؛ فليتبعهم بإحسان، ومن اتبع غير سبيلهم؛ دخل في عموم قوله تعالى: وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَىٰ وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ ۖ وَسَاءَتْ مَصِيرًا. “যে ব্যক্তি পরকালে (ন্যায়নিষ্ঠ) সালাফদের সাথে থাকতে এবং তাঁদেরকে যে জান্নাত ও সন্তুষ্টির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তা নিজের জন্য প্রস্তুত পেতে পছন্দ করে, সে যেন যথাযথভাবে তাঁদের অনুসরণ করে। আর যে তাঁদের পথ ভিন্ন অন্য কোনো পথের অনুসরণ করে, সে আল্লাহ তা‘আলার এই ব্যাপক কথার মধ্যে প্রবেশ করবে, “যে ব্যক্তি সত্য পথ প্রকাশিত হওয়ার পরও রাসূলের বিরোধিতা করে এবং মু’মিনদের পথ বাদ দিয়ে ভিন্ন পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে সে পথেই ফিরাব যে পথে সে ফিরে যায়, আর তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাব; কতই না মন্দ সে আবাস!” (সূরাহ নিসা: ১১৫)” [ইমাম ইবনু কুদামাহ (রাহিমাহুল্লাহ), যাম্মুত তা’উয়ীল, পৃষ্ঠা: ১০; দারুল বাসীরাহ, আলেকজান্দ্রিয়া কর্তৃক প্রকাশিত; সন তারিখ বিহীন]
.
রাসূল (ﷺ) বলেছেন,قَدْ تَرَكْتُكُمْ عَلَى الْبَيْضَاءِ لَيْلُهَا كَنَهَارِهَا، لَا يَزِيْغُ عَنْهَا بَعْدِيْ إِلَّا هَالِكٌ “আমি তোমাদের আলোকিত দ্বীনের উপর রেখে যাচ্ছি, তার রাত তার দিনের মতই (উজ্জ্বল)। আমার পরে নিজেকে ধ্বংসকারীই কেবল এ দ্বীন ছেড়ে বিপথগামী হবে”।(ইবনু মাজাহ, হা/৪৩) অপর হাদীসে তিনি বলেছেন,إِنِّىْ قَدْ تَرَكْتُ فِيْكُمْ مَا إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ فَلَنْ تَضِلُّوْا أَبَدًا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ”নিশ্চয় আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস ছেড়ে যাচ্ছি যা আঁকড়ে ধরে থাকলে তোমরা কখনই পথ হারাবে না, আর তা হল আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবীর সুন্নাহ’।(মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন, হা/৩১৮)
.
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, সৌদি ফাতাওয়া বোর্ডের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেন, “নারী হোক কিংবা পুরুষ হোক সকল মুসলিমের উপর ফরয এই পদ্ধতি অনুসারে চলা এবং হকপন্থী আলিমদের থেকে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহ অনুধাবন করা। যেমন মালিক ইবনু আনাস (রাহিমাহুল্লাহ) এবং পরবর্তীতে তার অনুসরণে আরও অনেকে বলেছেন যে, لَنْ يُصْلِحَ آخِرَ هَذِهِ الْأُمَّةِ إلَّا مَا أَصْلَحَ أَوَّلَهَا ‘এই উম্মাতের প্রথম যুগের মানুষেরা যে পদ্ধতিতে সংশোধিত হয়েছে শেষ যুগের মানুষেরাও তা অবলম্বন না করা পর্যন্ত সংশোধিত হতে পারবে না’। তিনি আরো বলেন, ‘উম্মতের প্রথম যুগের লোকেদের আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা, কুরআন ও সুন্ন্হাকে ধরে থাকার জন্য একে অপরকে উপদেশ দেয়া, এ কাজে পরস্পরে সহযোগিতা করা এবং কুরআন ও সুন্নাহর পথে জীবন পরিচালনার মাধ্যমে সংশোধন ঘটেছিল। সুতরাং ভাইয়েরা আমার, আমাদেরও সকলের কর্তব্য হবে ক্বুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার জন্য একে অপরকে উপদেশ দেয়া ও এ কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করা এবং আমাদের রবের কিতাব ও আমাদের নবীর সুন্নাহকে সবকিছুর উপর স্থান দেয়”।(মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২০শ খণ্ড, পৃ. ৩৭৫)
.
দ্বিতীয়ত: প্রত্যেক মুমিন-মুত্তাক্বির প্রথম ও গর্বের পরিচয় মুসলিম। কোন মুসলিমই এই লকবটি তাদের নামের আগে-পরে বসাই না। সালাফি বা আহলে হাদিস নামটিও এমনই।পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের নিশঃর্ত অনুসারীকে ‘আহলে হাদীস বা সালাফি বলা হয়। আহল অর্থ অনুসারী, পরিবার ইত্যাদি। আর আল্লাহ তা‘আলা যেমন: কুরআনকে অনেক স্থানে ‘হাদীস’ বলে উল্লেখ করেছেন। (সূরা যুমার;২৩),তেমনি রাসূল (ﷺ) ও কুরআনকে ‘হাদীস’ বলে উল্লেখ করেছেন।(সহীহ মুসলিম হা/৮৬৭)। আর হাদীসকে তো বহু স্থানে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘হাদীস’ বলে উল্লেখ করেছেন। (সহীহ বুখারী হা/৯৯)। তাই যারা সার্বিক জীবনে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসকে অগ্রাধিকার দেন তাদেরকেই ‘আহলেহাদীছ’ বলা হয়।সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সকল যুগেই এই নামটি সুপ্রসিদ্ধ। যদিও বৈশিষ্ট্যগত নাম হিসাবে আরো কতগুলো নাম বর্ণিত হয়েছে। যেমন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, আহলুস সুন্নাহ, আসহাবুল হাদীস, ত্বায়েফাতুল মানসূরাহ, ত্বায়েফাতুয যাহেরাহ, সালাফী, ফের্কায়ে নাজিয়াহ প্রভৃতি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উক্ত নামসমূহ সুপরিচিত। ফালিল্লাহিল হামদ। জেনে রাখা ভাল যে,আহলে হাদীস’ কোন দল, মাযহাব বা মতের নাম নয়। কুরআন ও সহীহ হাদীছ ভিত্তিক এক অনন্য আক্বীদা ও বৈশিষ্ট্যগত নাম।
.
তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি কতিপয় বিদ‘আতী একটি অদ্ভুত অভিযোগ উত্থাপন করে থাকে বর্তমান যুগের কেউ নিজেকে আহলে হাদিস পরিচয় দিতে পারবে না কেননা আহলে হাদিস বলতে শুধুমাত্র মুহাদ্দিসদেরকে বুঝায়, কিন্তু সঠিক কথা হল একজন ব্যক্তি নিজেকে মুসলিমের পাশাপাশি আহলে হাদীস বা সালাফি পরিচয় দেওয়াতে প্রকৃতপক্ষে শরীয়ঈ কোন বাধা নেই ইনশাআল্লাহ।কারণ সালাফী পরিভাষা হুবহু আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ পরিভাষার মতই। আর উভয় পরিভাষা সাহাবীগণের উপর একত্রে ব্যবহার হয়। একটু চিন্তা করলে উক্ত বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়। যেমন ভাবে একটি মানুষ একাধারে ছাত্র, শিক্ষক, আলেম, আনসার এই ধরনের নাম ধারণ করে, ঠিক তেমনি আহলে হাদীস বা সালাফি এমনই একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম মুসলিমদের মধ্যে। মুসলিম হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া নাম, যাকে ইংরেজীতে আমরা Noun বলি । আর আহলেহাদীছ , আহলুল হাদীস বা সালাফি এইগুলা একজন মুসলিমদের বৈশষ্ট্য।যাকে আমরা Adjective বা গুণ/বৈশিষ্ট্য বলে জানি। আহলে হাদীস এর অর্থ হাদীছের অনুসারী কিন্তু ব্যাপক অর্থে পরাভাষিক অর্থেঃ কুর’আন এবং হাদীসের নিরপেক্ষ অনুসারী।কারণ হাদিসের অর্থ বাণী এবং কুর’আন কে খইরাল হাদীস বা উৎকৃষ্ট বাণী বলা হয়েছে।আস-সাম‘আনী তাঁর ‘আল আনসাব’ গ্রন্থে বলেছেন, السلفي هذع النسبة إلى السلف و انتحال مذاهبهم على ما سمعت منهم ‘সালাফী’ এটি সালাফদের সাথে নিসবত বা সম্পৃক্ততা এবং যেভাবে সালাফদের থেকে শ্রুত হয়েছে সেভাবে তাদের মাযহাবকে অনুসরণ করা’।
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেছেন, ولا عــيبَ على من أظهر مذهب الـسـلـف، وانتسب إليه، واعتزى إليه؛ بل يجب قبول ذلك منه بالإتفاق؛ فإن مذهب السلف لا يكون إلا حقًا. “যে ব্যক্তি সালাফদের মাযহাব প্রকাশ করে, তার দিকে নিজেকে সম্পৃক্ত করে (অর্থাৎ, নিজেকে ‘সালাফী’ বলে) এবং ওই মাযহাবের সাথে নিজেকে যুক্ত করে, তার কোনো দোষ নেই। বরং সর্বসম্মতিক্রমে এই মাযহাব গ্রহণ করা ওয়াজিব। কেননা সালাফদের মাযহাব হক ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।” [ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১৪৯; বাদশাহ ফাহাদ প্রিন্টিং প্রেস; বাদশাহ ফাহাদ (রাহিমাহুল্লাহ)’র রাজকীয় ফরমানে মুদ্রিত; সন: ১৪২৫ হি./২০০৪ খ্রি.]
.
শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যে নিজেকে সালাফী বা আসআরী বলে তার সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? এটা কি প্রশংসার অন্তর্ভুক্ত? তিনি উত্তরে বলেন: إذا كان صادقا أنه أثري أو سلفي لا بأس مثل ما كان السلف يقولون فلان سلفي فلان أثري تزكية لا بد تزكية واجبة ‘যখন সে সত্যই আসআরী কিংবা সালাফী হবে তখন এটাতে কোন অসুবিধা নেই। যেমন সালাফগণ বলতেন অমুক ব্যক্তি সালাফী; অমুক ব্যক্তি আসআরী। এ প্রশংসার অবশ্যই দরকার রয়েছে। এ প্রশংসার আবশ্যকতা রয়েছে’। শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ)-কে আরো জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সবাই তো নিজেকে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ দাবি করে। এর চেয়ে সালাফী বলাই উত্তম, এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন? উত্তরে তিনি বলেন, ‘সালাফিরা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং সালাফী কারো নামের সাথে সম্পৃক্ত করাতে কোন দোষ নেই। তারা সাহাবী, তাবেঈর অনুসারী, আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস করে। তারা তো বাতিলের দিকে নিসবাত করেনি; সত্য ও উপযুক্ত সম্বন্ধের দিকেই সম্পৃক্ত করেছে”।(ইবনু বায, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ২৮তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৫০)।
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] তার লিখিত ‘আল-আজওয়াবাতুল মুফীদাহ’ গ্রন্থে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল: সালাফিয়্যাহ কী? এবং সালাফী মানহাজে চলা এবং সেটা আঁকড়ে ধরা কি অবশ্যক?

তিনি জবাবে বলেন, السلفية هي السير على منهج السلف من الصحابة والتابعين والقرون المفضلة في العقيدة والفهم والسلوك ويجب على المسلم سلوك هذا المنهج. ‘সালাফিয়্যাহ হলো বিশ্বাস, বুঝ ও আচরণে সালাফদের তথা ছাহাবী, তাবেঈ ও শ্রেষ্ঠ শতাব্দীসমূহের লোকদের মানহাজের উপর চলা এবং প্রতিটি মুসলিমের উপর এই মানহাজের উপর চলা আবশ্যক’। এসব শীর্ষ উলামায়ে কিরাম ও অন্যান্যরা কখনো সালাফী, সালাফিয়্যাহ ও সালাফিয়্যিন উপাধি ব্যবহারে কোন সমস্যা মনে করেননি। কেননা এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এমন সব লোক, যারা সালাফদের মানহাজ ও তরীকায় চলে, তা আঁকড়ে ধরে থাকে। সুতরাং সালাফদের দিকে নিজেকে সম্পৃক্ত করে সালাফি লকব ধারণ করা ও তা দ্বারা পরিচয় দেয়া বৈধ।(আল-আজওয়াবাতুল মুফীদাহ’ পৃষ্ঠা: ১০৩)
.
উল্লেখ্য যে মাযহাব পন্থি অনেক আলেম বলেন আহলুল হাদীস বলতে শুধুমাত্র মুহাদ্দিসদের কে বুঝানো হয়েছে। তাদের বক্তব্য খণ্ডন করে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃ.৭২৮হি:] এ বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট করে বলেন,

وَنَحْنُ لَا نَعْنِي بِأَهْلِ الْحَدِيثِ الْمُقْتَصِرِينَ عَلَى سَمَاعِهِ أَوْ كِتَابَتِهِ أَوْ رِوَايَتِهِ بَلْ نَعْنِي بِهِمْ: كُلَّ مَنْ كَانَ أَحَقَّ بِحِفْظِهِ وَمَعْرِفَتِهِ وَفَهْمِهِ ظَاهِرًا وَبَاطِنًا وَاتِّبَاعِهِ بَاطِنًا وَظَاهِرًا وَكَذَلِكَ أَهْلُ الْقُرْآنِ. وَأَدْنَى خَصْلَةٍ فِي هَؤُلَاءِ: مَحَبَّةُ الْقُرْآنِ وَالْحَدِيثِ وَالْبَحْثِ عَنْهُمَا وَعَنْ مَعَانِيهِمَا وَالْعَمَلِ بِمَا عَلِمُوهُ مِنْ مُوجِبِهِمَا. فَفُقَهَاءُ الْحَدِيثِ أَخْبَرُ بِالرَّسُولِ مِنْ فُقَهَاءِ غَيْرِهِمْ وَصُوفِيَّتُهُمْ أَتَبَعُ لِلرَّسُولِ مِنْ صُوفِيَّةِ غَيْرِهِمْ وَأُمَرَاؤُهُمْ أَحَقُّ بِالسِّيَاسَةِ النَّبَوِيَّةِ مِنْ غَيْرِهِمْ وَعَامَّتُهُمْ أَحَقُّ بِمُوَالَاةِ الرَّسُولِ مِنْ غَيْرِهِمْ ‘

“আমরা আহলুল হাদীস বলতে কেবল তাদেরকে বুঝি না যারা কেবল হাদীস শ্রবণ, লিখন অথবা বর্ণনায় সীমাবদ্ধ। বরং প্রত্যেক যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে ও গোপনে হাদীস সংরক্ষণ, হাদীসের জ্ঞানার্জন কিংবা হাদীস অনুধাবনকর্মে নিরত রয়েছেন এবং প্রকাশ্যে ও গোপনে হাদীসের অনুসরণ করেন (তারা আহলুল হাদীস)। এমনিভাবে যারা কুরআন বিশেষজ্ঞ তারাও। এদের সর্বনিম্ন বৈশিষ্ট্য হ’ল যে, তারা কুরআন ও হাদীসের প্রতি ভালবাসা রাখেন, এতদুভয়ের জ্ঞানান্বেষণে এবং মর্মার্থ অনুধাবনে চেষ্টিত থাকেন। তারা যে আমল করেন তা কুরআন ও হাদীসের ভিত্তিতেই করেন। ফলে আহলুল হাদীস ফকীহগণ অন্যান্য ফকীহদের চেয়ে রাসূল (ﷺ)-এর হাদীস সম্পর্কে অধিক অবগত। তাদের মধ্যকার সূফী তথা দুনিয়াবিমুখগণ অন্যান্য সূফীদের চেয়ে রাসূল (ﷺ)-এর অধিক অনুসরণ করেন। তাদের শাসকগণ অন্যান্যদের চেয়ে রাসূল (ﷺ)-এর রাজনীতি সম্পর্কে অধিক অবগত। তাদের সাধারণ লোকেরা অন্যদের চেয়ে রাসূল (ﷺ)-এর অধিকতর অনুসরণকারী”।(ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৯৫)
.
আল্লাহ তা‘আলা চিরকালই আহলে হাদীসদেরকে যাবতীয় চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র থেকে হেফাযত করেছেন এবং তাঁর অঙ্গীকার পূরণ করেছেন। তাই তিনিই ফায়সালা নাযিল করবেন ইনশাআল্লাহ। কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ভবিষ্যদ্বাণী চিরদিন আহলে হাদীসদেরকে শক্তি সঞ্চার করে থাকে। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে গেছেন: “আমার উম্মতের মধ্যে চিরদিন একটি দল হক্বের উপরে বিজয়ী থাকবে। বিরোধীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত এসে যাবে, অথচ তারা ঐভাবেই থাকবে”। (সহীহ মুসলিম হা/১৯২০)। মহান আল্লাহ আমাদেরকে আকীদা, আমল, কথা, দাওয়াত, চরিত্র ইত্যাদিসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রকৃত সালাফী ও আহলে হাদীস হওয়ার তৌফিক দান করুন এবং এই বিজয় কাফেলাকে সার্বিকভাবে সর্বত্র নিরাপত্তা দান করুন। আমীন! (আল্লাহই ভাল জানেন)।
____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তাদ ইব্রাহিম বিন হাসান (হাফি:)।
শিক্ষক, চর বাগডাঙ্গা সেরাজুল হুদা লতিফিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া ও হাফিজিয়া মাদরাসা‌ চাঁপাইনবাবগঞ্জ।

Share: