এ কথা অনস্বীকার্য যে, সালাতুয যাওয়াল তথা সূর্য ঢলার সালাত নামে কোন সালাতের অস্তিত্ব আছে এ বিষয়টি অধিকাংশ মানুষের কাছে অপরিচিত। অথচ
রাসূল সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্য ঠিক মাথা বরাবর থেকে পশ্চিম দিগন্তে একটু ঢলে গেলে নিয়মিতভাবে চার রাকআত সালাত আদায় করতেন। এ সময় আসমানের দরজাগুলো খোলা হয় এবং বান্দাদের আমলগুলো উপরে উত্তোলন করা হয়।
হাদিসের কিতাবগুলোতে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত হাদিস বর্ণিত হয়েছে আছে আর মুহাদ্দিস ও ফকিহগণ সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
নিম্নে এ প্রসঙ্গে কয়েকটি হাদিস পেশ করা হল:
🔹 ১ম হাদিস:
عَنْ أَبيِْ أَيُّوْبَ الْأَنْصَارِيْ رَضِيَ اللهُ عَنهُ : أُنَّ النَّبِيَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كاَنَ يُدْمِنُ أَرْبَعُ رَكْعَاتٍ عِنْدَ زَوَالِ الشَّمْسِ فَقُلْتُ : يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّكَ تُدْمِنُ هَذِهِ الأْرْبَعَ رَكَعَاتٍ عِنْدَ زَوَالِ الشَّمْسِ ؟ فَقَالَ إِنَّ أَبْوَابِ السَّمَاءِ تُفْتَحُ عِنْدَ زَوَالِ الشَّمْسِ فَلاَ تُرَتِّجُ حَتَّى يُصَلِّى الظُّهْرَ فَأُحِبُّ أَنْ يَّصْعَدَ لِيْ فِيْ تِلْكَ السَّاعَةِ خَيْرٌ قُلْتُ : أَفِيْ كُلِّهِنَّ قِرَاءَةٌ ؟ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ : هَلْ فِيْهِنَّ تَسْلِيْمٌ فَاصِلٌ ؟ قَالَ لاَ
আবু আইয়ুব আনসারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতিনিয়ত সূর্য ঢলার সময় চার রাকআত নামায পড়তেন।
একদা আমি বললাম: ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনি সূর্য ঢলার সময় এই চার রাকআত প্রতিনিয়তই পড়ছেন?’
তিনি বললেন: “সূর্য ঢলার সময় আসমানের দরজাসমূহ খোলা হয় এবং যোহরের নামায না পড়া পর্যন্ত বন্ধ করা হয় না। অতএব আমি পছন্দ করি যে, এই সময় আমার নেক আমল (আকাশে আল্লাহর নিকট) উত্তোলন করা হোক।”
আমি বললাম: এ সালাতের প্রত্যেক রাকআতেই কি কিরাআত আছে?’
তিনি বললেন: “হ্যাঁ।”
আমি বললাম: ‘তার মাঝে কি পৃথককারী সালাম আছে?’
তিনি বললেন: “না।” (শাইখ আলবানী রচিত মুখতাসারুশ শামাইলিল মুহাম্মাদিয়াহ, হা/২৪৯, তিনি এটিকে সহিহ বলেছেন)
🔹 ২য় হাদিস:
عَن عَبْدِ اللهِ بْنِ السَّائِبِ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم كَانَ يُصَلِّي أَرْبَعاً بَعْدَ أَنْ تَزُولَ الشَّمْسُ قَبْلَ الظُّهْرِ وَقَالَ إِنَّهَا سَاعَةٌ تُفْتَحُ فِيهَا أَبْوَابُ السَّمَاءِ فَأُحِبُّ أَنْ يَصْعَدَ لِي فِيهَا عَمَلٌ صَالِحٌ رواه التِّرمِذِيُّ وَقَالَ حَدِيثٌ حَسَنٌ
আব্দুল্লাহ ইবনুস সায়েব রা. হতে বর্ণিত, সূর্য (পশ্চিম দিগন্তে) ঢলে যাবার পর, যোহরের ফরযের পূর্বে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চার রাকআত সালাত পড়তেন। আর বলতেন, “এটা এমন সময়, যখন আসমানের দ্বারসমূহ খুলে দেওয়া হয়। তাই আমার পছন্দ যে, সে সময়েই আমার সৎকর্ম ঊর্ধ্বে উঠুক।” (তিরমিযী ৪৭৮, হাসান, সহিহুত তারগিব হা/ ৫৮৭)
🔹 ৩য় হাদিস:
عَن أَبِى أَيُّوبَ عَن النَّبِىِّ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم قَالَ أَرْبَعٌ قَبْلَ الظُّهْرِ لَيْسَ فِيهِنَّ تَسْلِيمٌ تُفْتَحُ لَهُنَّ أَبْوَابُ السَّمَاءِ
আবু আইয়ুব রা. হতে বর্ণিত, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “যোহরের পূর্বে চার রাকআত-যার মাঝে কোন সালাম নেই-তার জন্য আসমানের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হয়।” (আবু দাউদ ১২৭০, ইবনে মাজাহ ১১৫৭, ইবনে খুযাইমা ১২১৪, সহীহুল জামে’ ৮৮৫নং)
🔹 ৪র্থ হাদিস:
أنهُ كان يُصلِّي أربعَ ركعاتٍ بعدَ الزوالِ لا يُسلِّمُ إلا في آخرِهنَّ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্য ঢলার পর চার রাকআত পড়তেন। এ ক্ষেত্রে তিনি চার রাকআত শেষ করার পূর্বে সালাম ফেরাতেন না।” [সিলসিলা সহিহাহ ৭/১১৯৭, শাইখ আলবানী বলেন, এর সনদ সহিহ মুসলিমের শর্তানুযায়ী جيد (ভালো)। এছাড়াও তিনি তাখরীজু মিশকাতিল মাসাবিহ গ্রন্থে এটিকে সহিহ বলেছেন। হা/১২২৬]
উপরোক্ত হাদিস সমূহ থেকে স্পষ্ট যে, এ চার রাকআত সালাতে দু রাকআত পড়ে সালাম ফেরানো যাবে না বরং চার রাকআত শেষ করে সালাম ফিরাতে হবে।
🔹 ৫ম হাদিস:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
أربعُ ركعاتٍ قبلَ الظهرِ يعْدِلْنَ بصلاةِ السَّحَرِ
“যোহরের পূর্বে চার রাকআত সালাত ভোররাতের সালাত (তাহাজ্জুদ) সমতুল্য।” (সহিহুল জামে, হা/৮৮২)
♦ এই চার রাকআত কোন সালাত?
এখন এই চার রাকআত কোন সালাত? এগুলো কি যোহরের পূর্বের চার রাকআত সুন্নতে রাতেবা (নিয়মিত সুন্নত) না কি তা স্বতন্ত্র সালাত? এ বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমগণের মাঝে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। কতিপয় আলেম বলেন, এই চার রাকআত মূলত: যোহরের চার রাকআত সুন্নত সালাত আর কতিপয় বিদ্বানের মতে, এটি যোহরের পূর্বের চার রাকআত সুন্নত নয় বরং এটি স্বতন্ত্র সালাত।
নিম্নে এ বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমদের কয়েকটি অভিমত তুলে ধরা হল:
▪ ইমাম ইবনুল কাইয়েম রাহ. বলেন:
قَدْ يُقَالُ إنّ هَذِهِ الْأَرْبَعَ لَمْ تَكُنْ سُنّةَ الظّهْرِ، بَلْ هِيَ صَلَاةٌ مُسْتَقِلّةٌ كَانَ يُصَلّيهَا بَعْدَ الزّوَالِ
“এটাও বলা যেতে পারে যে, এই চার রাকআত যোহরের সুন্নত নয় বরং তা আলাদা সালাত-যা তিনি যাওয়াল তথা সূর্য আকাশের মধ্যভাগ থেকে পশ্চিম দিগন্তে ঢলে যাওয়ার পর আদায় করতেন।” (যাদুল মাআদ)
এ ছাড়াও তিনি এটিকে স্বতন্ত্র আমল বলার পেছনে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, সকল প্রকার সুন্নত সালাত দু রাকআত দু রাকআত করে পড়া উত্তম। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
صَلاَةُ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ مَثْنَى مَثْنَى
“দিন ও রাতের নামায দুই দুই রাকাত।” (সূনান আবু দাউদ অধ্যায়ঃ ২/ সালাত (নামায) (كتاب الصلاة) হাদিস নম্বরঃ [1295] ইসলামিক ফাউন্ডেশন। তিরমিযী, নাসাঈ, ইবন মাজা প্রমূখ-সনদ সহীহ)
অর্থাৎ রাত ও দিনের সকল সালাত (ফরয ছাড়া) দু রাকআত করে পড়াই উত্তম। অথচ এখানে চার রাকআত পড়ার হাদিসগুলোতে স্পষ্টভাবে এসেছে যে, এই চার রাকআত পড়ার সময় কেবল শেষে একবারই সালাম ফেরাতে হবে। মাঝখানে দু রাকআত পড়ে সালাম ফেরানো যাবে না।
তাতে বুঝা যায, এটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি আমল। তার কারণ হল, এটি দিনের মধ্যভাগ ও সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ঢলার সময়। (যাদুল মাআদ থেকে ভাবার্থ)
▪ এরপর তিনি আরও বলেন:
هذه الأربع صلاة مستقلة كان يصليها بعد الزوال، وورد مستقل سببه انتصاف النهار وزوال الشمس، وسر هذا ـ والله تعالى أعلم ـ أن انتصاف النهار مقابل لانتصاف الليل، وأبواب السماء تفتح بعد زوال الشمس ويحصل النزول الإلهي بعد انتصاف الليل، فهما وقتا قرب ورحمة، هذا يفتح فيه أبواب السماء، وهذا ينزل فيه الرب تبارك وتعالى إلى سماء الدنيا. انتهى
“এই চার রাকআত স্বতন্ত্র সালাত যা তিনি সূর্য ঢলার পর পড়তেন। আর এই স্বতন্ত্র আমলটি করার পেছনে কারণ হল, এটি দিনের ঠিক মধ্যভাগ ও সূর্য ঢলার সময়। এর রহস্য হল-আল্লাহ ভালো জানেন- এটি দিনের মধ্যভাগ যার অবস্থান রাতের ঠিক মধ্যভাগের বিপরীতে। দিনের মধ্যভাগে সূর্য ঢলার পর আসমানের দরজা সমূহ খোলা হয় আর রাতের মধ্যভাগের পর মহান আল্লাহর অবতরণ ঘটে।
সুতরাং এ দুটি আল্লাহর নৈকট্য ও রহমতের সময়। দিনের মধ্যভাগে আসমানের দরজাগুলো উন্মুক্ত হয় আর রাতের মধ্যভাগে মহান রব দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন।” (যাদুল মাআদ)
▪আল্লামা মুবারকপূরী তার বিখ্যাত ‘আল মিরআতুল মাফাতিহ শারহু মিশকাতিল মাসাবীহ’ গ্রন্থে বলেন:
هذه سنة الزوال، وهي غير سنة الظهر
”এটি যাওয়াল বা সূর্য ঢলার সুন্নত। এটি যোহরের সুন্নত থেকে ভিন্ন।” (মিরআতুল মাফাতীহ)
▪মুনাবী বলেন: “যোহরের পূর্ব চার রাকআত সালাত-যার মাঝে কোন সালাম নাই। এ সময় আসমানের দ্বার সমূহ খোলা হয়। এই চার রাকআতকে বলা হয় যাওয়ালের সুন্নত। এটি যোহরের সুন্নত নয়-যেমনটি (গাযযালী রাহ. তাঁর এহিয়া উলূমিদ্দীন গ্রন্থে স্পষ্টভাবেই বলেছেন।” (ফায়যুল ক্বাদির)
অবশ্য একদল আলেম বলেন যে, এই চার রাকআত যোহরের পূর্বের চার রাকআত; আলাদা কোনও সালাত নয়-যেমনটি মুনাবী রহ. পূর্বোক্ত সায়েব বিন ইয়াযিদের কর্তৃক বর্ণিত হাদিসটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এ মতের পক্ষে বায়যাবী রহ. এর অভিমত উল্লেখ করেছেন।
যাহোক, পূর্বোক্ত হাদিস সমূহের পর্যালোচনা ও বিজ্ঞ আলেমের মতামত ও ব্যাখ্যার আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, এই চার রাকআত স্বতন্ত্র সালাত (যাওয়ালের সালাত) যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়মিত পড়তেন। কারণ, তিনি চাইতেন, এ সময় যেহেতু আসমানের দরজা হয় সেহেতু এ সময় আল্লাহর নিকট তাঁর নেক আমল উত্থাপিত হোক। অর্থাৎ আল্লাহর নিকট এই আমলটি দ্রুত কবুলের আশা করা যায়।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকেও এই আমলটি করার তাওফিক দান করুন। আমীন। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬◢◣▬▬▬▬
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।।