শাম মুসলিমদের জন্য কেন এত গুরুত্বপূর্ণ

প্রশ্ন: বিলাদ আশ-শাম” (بلاد الشام) মুসলিমদের জন্য কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই।
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: “বিলাদ আশ-শাম” বর্তমান সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান ও ফিলিস্তিন অঞ্চল নিয়ে গঠিত।আল্লাহ তাআলা এ পূণ্যভূমিতে অসংখ্য নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। সেখানে রয়েছে পৃথিবীর তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ আল-আকসা। সিরিয়া বা শাম ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত বরকতময় এবং ফজিলতপূর্ণ একটি ভূমি। খলিফা উমর ফারুখ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর যামানায় ১৫ হিজরীর শাওয়াল মোতাবেক ৬৩৬ ঈসায়ী নভেম্বর মাসে শাম দেশে জিহাদ শুরু হয়। উক্ত জিহাদের প্রধান সেনাপতি ছিলেন আবূ উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। যিনি আশারায়ে মুবাশশারার অন্তর্ভুক্ত ছাহাবী। ইসলামের এই বিজয়ের জিহাদ চলতে থাকে ১৬ হিজরীর বরীউল আওয়াল মাস মোতাবেক ৬৩৭ ঈসায়ী এপ্রিল মাস পর্যন্ত। উক্ত হিসাব মতে প্রায় ছয় বছর যাবৎ উক্ত জিহাদ চলে। তারপর আল্লাহ রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে সাহায্য নেমে আসে।ফলে মুসলমানরা বিলাদ আশ-শাম দখল করে, যা ইসলামী সাম্রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। অতঃপর উমার ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সেখানে উপস্থিত হয়ে কাফিরদের সাথে চুক্তি করেন। এ ভূমির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইসলামি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেননা শাম অঞ্চল মুসলমানদের জন্য ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও কৌশলগত প্রায় সকল দিক থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারন শাম ঐতিহাসিকভাবে ইসলামী সভ্যতা, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এবং বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। এটি ইসলামি খেলাফতের সময় গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চলগুলোর একটি ছিল।শাম ভূমি পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর, পূর্বে মরুভূমি, উত্তরে তুরস্ক এবং দক্ষিণে আরব উপদ্বীপের সীমান্তে অবস্থিত। এ অঞ্চলটি তিনটি মহাদেশের (এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ) সংযোগস্থলে অবস্থিত। এ অঞ্চলটি ভূমধ্যসাগর সংলগ্ন হওয়ায় প্রাচীনকাল থেকেই বাণিজ্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল। উমাইয়া খিলাফতের কেন্দ্রস্থল হিসেবে এটি ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দামেস্ক ছিল উমাইয়া খিলাফতের রাজধানী। কুরআন ও হাদিসে এ অঞ্চলের ফজিলত এবং গুরুত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন:
.
মহান আল্লাহ বলেন:سُبۡحٰنَ الَّذِیۡۤ اَسۡرٰی بِعَبۡدِهٖ لَیۡلًا مِّنَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ اِلَی الۡمَسۡجِدِ الۡاَقۡصَا الَّذِیۡ بٰرَكۡنَا حَوۡلَهٗ لِنُرِیَهٗ مِنۡ اٰیٰتِنَا ؕ اِنَّهٗ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ “পবিত্ৰ মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করালেন আল-মসজিদুল হারাম থেকে আল-মসজিদুল আকসা পর্যন্ত যার আশপাশে আমরা দিয়েছি বরকত, যেন আমরা তাকে আমাদের নিদর্শন দেখাতে পারি; তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা”(সূরা বনি ইসরাইল: ১) প্রায় সকল মুফাসসিরিন একমত, উল্লিখিত আয়াতে ‘পবিত্র ভূমি’ এবং ‘বরকতময় ভূমি’ দ্বারা শামের ভূমিই উদ্দেশ্য। আর আয়াতে বরকত দ্বারা কেউ বেলেছেন, এখানে দুনিয়াবি বরকত উদ্দেশ্য। যেমন এই পবিত্র ভূখণ্ড সর্বদা অধিক পরিমাণে আহার্য, ফলমূল, নদী-নালা, খাদ্যশস্য ও রিজিকের প্রশস্ততায় পরিপূর্ণ থাকবে। আর কেউ বলেছেন, এখানে বরকত দ্বারা দ্বিনের বরকতে ধন্য হওয়া উদ্দেশ্য। কারণ এখানে বহুসংখ্যক নবী-রাসুল বসবাস করেছেন, এখানেই ফেরেশতারা তাদের কাছে আসমানি ওহি নিয়ে অবতরণ করেছেন। তবে বিশুদ্ধ মত হলো, এখানে দ্বিন-দুনিয়া উভয় দিকের বরকতই রয়েছে। হাদিস থেকেও একথার দলিল পাওয়া যেমন: রাসূল (ﷺ) শামের জন্য দোয়া করে বলেছেন ‘হে আল্লাহ, আমাদের শাম দেশে ও ইয়েমেনে বরকত দান করুন”।(সহীহ বুখারি, হা/১০৩৭) উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইমাম আত্ব-ত্বাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:” وقوله ( الَّذِي بارَكْنا حَوْلَهُ ) يقول تعالى ذكره: الذي جعلنا حوله البركة لسكانه في معايشهم وأقواتهم وحروثهم وغروسهم আল্লাহর বানী: যার আশপাশে আমরা করেছি বরকতময়, এর অর্থ হলো: আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমরা সেই স্থানের আশেপাশের এলাকাকে বরকতময় করেছি সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য জীবিকা, খাদ্য, ফসল এবং বাগানসমূহে বরকত প্রদান করার মাধ্যমে”।(তাফসিরে তাবারী খন্ড: ১৪ পৃষ্ঠা: ৩৪৮) হাদীসে এসেছে, প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ৭৩ হি.] থেকে বর্ণিত:নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “হে আল্লাহ্‌! আমাদের শামে (সিরিয়া) ও ইয়ামনে বরকত দান করুন। লোকেরা বলল, আমাদের নজদেও। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ হে আল্লাহ্‌! আমাদের শামদেশে ও ইয়ামনে বরকত দান করুন। লোকেরা তখন বলল, আমাদের নজদেও। রাবী বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন বললেনঃ সেখানে তো রয়েছে ভূমিকম্প ও ফিত্‌না-ফাসাদ আর শয়তানের শিং সেখান হতেই বের হবে (তার উত্থান ঘটবে)”। (সহীহ বুখারী হা/১০৩৭) হাদীসটির ব্যাখায় হাফিজ ইবনু রজব আল-হাম্বালী আল-বাগদাদী (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ৭৩৬ হি.] বলেন: “واعلم أن البركة في الشام : تشمل البركة في أمور الدين والدنيا، ولهذا سميت الأرض المقدسة” “এবং এটা বোঝা উচিত যে, শাম অঞ্চলে বরকত রয়েছে: আর তা ধর্মীয় ও পার্থিব উভয় বিষয়েই বরকতকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর এজন্যই এটিকে পবিত্র ভূমি বলা হয়”।(মাজমু’উর রাসায়েল ইবনে রজব: খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ২২৪)
.
▪️এছাড়াও বরকতময় এই ভূমিকে আল্লাহ তাআলা অনেক মর্যাদা দান করেছেন। নিম্নে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
.
(১). শাম পৃথিবীর বরকতময় স্থান: পৃথিবীর একটি পূণ্যময় ভূখণ্ডের নাম শাম। আল-কুরআনে এটিকে পবিত্র ভূমি (‌الْأَرْضُ ‌الْـمُقَدَّسَةُ) ও বরকতময় স্থান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মিরাজের বর্ণনায় আল্লাহ তাআলা বলেন,سُبْحٰنَ الَّذِيْۤ اَسْرٰى بِعَبْدِهٖ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ اِلَى الْمَسْجِدِ الْاَقْصَا الَّذِيْ بٰرَكْنَا حَوْلَهٗ ؕ ۰۰۱
আমি সেই সত্তার পবিত্রতা বর্ণনা করছি, যিনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত রাত্রিকালীন ভ্রমণ করিয়েছেন। যার চারপাশে আমি বরকত দান করেছি।’(সুরা আল-ইসরা, ১৭: ১) ফিলিস্তিন, সিরিয়া, জর্দান ও লেবানন নিয়ে গঠিত অঞ্চলকে তৎকালীন সময়ে শাম বলা হতো।শামের বরকতপূর্ণ সীমানা সম্পর্কে ইবনে আসাকির (রহ.) তাবিয়ী আবুল আগয়াস (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন,وأخْرَجَ ابْنُ عَساكِرَ، عَنْ أبِي الأغْيَسِ، وكانَ قَدْ أدْرَكَ أصْحابَ النَّبِيِّ ﷺ، أنَّهُ سُئِلَ عَنِ البَرَكَةِ الَّتِي بُورِكَ في الشّامِ أيْنَ مَبْلَغُ حَدِّهِ؟ قالَ: أوَّلُ حُدُودِهِ عَرِيشُ مِصْرَ، والـحَدُّ الآخَرُ طَرَفُ الثَّنِيَّةِ، والـحَدُّ الآخَرُ الفُراتُ، والـحَدُّ الآخَرُ جَبَلٌ فِيهِ قَبْرُ هُودٍ النَّبِيِّ ‘তার সীমানা হলো মিসরের তাঁবু থেকে তার শেষপ্রান্ত পর্যন্ত এবং ইউফ্রেটিস নদী (ফোরাত) থেকে নবী হূদ (আ.)-এর কবরসংবলিত পাহাড় পর্যন্ত।(ইবনে আসাকির, তারীখু দিমাশক, দারুল ফিকর লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, দামেস্ক, সিরিয়া (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৫ হি. ১৯৯৫ খ্রি.), খ.১ পৃ.১৯৬) শামের চতুর্সীমানর বর্ণনায় ইবনে আশূরা (রহ.) বলেন,والْأَرْضِ أَرْضُ الشَّامِ وَهِيَ الْأَرْضُ الْـمُقَدَّسَةُ وَهِيَ تَبْتَدِئُ مِنَ السَّوَاحِلِ الشَّرْقِيَّةِ الشَّمَالِيَّةِ لِلْبَحْرِ ‌الْأَحْمَرِ ‌وَتَنْتَهِيْ إِلَىٰ سَوَاحِلِ بَحْرِ الرُّوْمِ وَهُوَ الْبَحْرُ الْـمُتَوَسِّطُ وَإِلَىٰ حُدُوْدِ الْعِرَاقِ وَحُدُوْدِ بِلَادِ الْعَرَبِ وَحُدُوْدِ بِلَادِ التُّرْكِ”শাম হলো পৃথিবীর পবিত্রতম ভূমি। এটি লোহিত সাগরের উত্তর-পূর্ব উপকূল থেকে ভূমধ্য সাগরের তীর পর্যন্ত এবং আরব ও ইরাক সীমান্ত থেকে তুরস্ক পর্যন্ত”।(ইবনে আশূরা, আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর, আদ-দারুত তিউনিসিয়া লিন-নাশর, তিউনিস, তিউনিসিয়া (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৪ হি ১৯৮৪ খ্রি.), খ. ৯, পৃ: ৭৭) পৃথিবীকে আবাদযোগ্য করার প্রক্রিয়া শুরু হয় মক্কা থেকে। বায়তুল্লাহ হলো এ ভূখণ্ডে নির্মিত প্রথম স্থাপনা। মানবমুক্তির সর্বশেষ সনদের গোড়াপত্তন হয় মক্কায়। বিস্তার লাভ করে মদীনায়। বিজয়ের এ ধারা পূর্ণতা লাভ করবে শামে। শেষ যুগে ইসলামের চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে মুসলমানগণ শামে হিজরত করবে। ইমাম মাহদী ও ঈসা (আ.)-এর দারুল খেলাফত হবে ফিলিস্তিনে। আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে ও হাদীসের বিবিধ গ্রন্থে শামের অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। শেষ যুগে ফিতনা-ফাসাদের বিস্তারের সময় এটি হবে ইসলামের কেল্লা ও দীনের খুঁটি। একাধিক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বরকতময় ভূমি (بٰرَكْنَا حَوْلَهٗ ؕ ۰۰۱) বলে শামের কথা উল্লেখ করেছেন। ফেরআউনের কবল থেকে বনি ইসরাইলের মুক্তি প্রসঙ্গে আল-কুরআনের ভাষ্য হলো:وَاَوْرَثْنَا الْقَوْمَ الَّذِيْنَ كَانُوْا يُسْتَضْعَفُوْنَ۠ مَشَارِقَ الْاَرْضِ وَمَغَارِبَهَا الَّتِيْ بٰرَكْنَا فِيْهَاؕ “পৃথিবীর প্রাচ্যে-প্রতীচ্যের একটি দুর্বল জাতিকে আমি বরকতময় ভূমির উত্তরাধিকার দান করেছি”।(সুরা আল-আ’রাফ, ৭: ১৩৭) নমরুদের অত্যাচার থেকে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর মুক্তি বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,وَنَجَّيْنٰهُ وَلُوْطًا اِلَى الْاَرْضِ الَّتِيْ بٰرَكْنَا فِيْهَا لِلْعٰلَمِيْنَ۰۰۷۱ “আমি ইবরাহীম (আ.) ও লুত (আ.)-কে মুক্তি দিয়েছি বরকতপূর্ণ ভূমিতে”।(সুরা আল-আম্বিয়া, ২১: ৭১) সাবা সম্প্রদায়ের বর্ণনায় আল্লাহ তাআলা বলেন,”সাবা সম্প্রদায়ের বর্ণনায় আল্লাহ তাআলা বলেন,وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ الْقُرَى الَّتِيْ بٰرَكْنَا فِيْهَا قُرًى ظَاهِرَةً ؕ ۰তাদের এবং বরকতময় ভূখণ্ডের মাঝে এমন কিছু জনপদ স্থাপন করেছি, যেগুলো পরস্পর সংযুক্ত ও পরিচিত”।(সুরা সাবা, ৩৪: ১৮)
.
(২). এই অঞ্চল থেকেই রাসূল (ﷺ)-এর ইসরা ও মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল: প্রিয় নবী (ﷺ)-এর ইশারা ও মি‘রাজ তথা নৈশ ভ্রমণ হয়েছে। তথা যমীনী সফর ও সাত আসমানের সফর শুরু হয়েছে মক্কাতুল মুকাররমা থেকে মুবারক ভূমি ফিলিস্তীনের মসজিদুল আক্বছা পর্যন্ত। এ সময় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কুদরতে মসজিদে আক্বছায় সকল নবী-রাসূলকে একত্রিত করেছেন। আর তাদের ইমামতি করেছেন মুহাম্মাদ (ﷺ)। এর মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, পৃথিবীর ইমামত বা নেতৃত্ব শেষ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে দেয়া হয়েছে এবং তাঁর উম্মতকে দেয়া হয়েছে। পূর্ববর্তীরা অযোগ্য হওয়ায় নেতৃত্ব তাদের নিকট থেকে নিয়ে উম্মতে মুহাম্মাদীকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ উম্মতে মুহাম্মাদী তাদের মূল চেতনা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে আজকে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের নিকট মার খাচ্ছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,سُبۡحٰنَ الَّذِیۡۤ اَسۡرٰی بِعَبۡدِہٖ لَیۡلًا مِّنَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ اِلَی الۡمَسۡجِدِ الۡاَقۡصَا الَّذِیۡ بٰرَکۡنَا حَوۡلَہٗ لِنُرِیَہٗ مِنۡ اٰیٰتِنَا ؕ اِنَّہٗ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ “তিনি পবিত্র যিনি তাঁর বান্দাকে (রাসূল (ﷺ)-কে) এক রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আক্বছায়, (বায়তুল মাক্বদিছ) যার চতুষ্পার্শ্বকে আমরা করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা’।(সূরা বানী ইসরাঈল: ১)। এই যে মি‘রাজের সফরটাও ছিল ফিলিস্তীন হয়ে।
.
(৩). এই অঞ্চল হচ্ছে সমস্ত আরযুল আম্বিয়া তথা আম্বিয়া-রাসূলের এলাকা: বিষেষ করে ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আলাইহিস সালাম)-এর পর থেকে শুরু করে যত নবী-রাসূল এসেছেন সবগুলো প্রায় ইবাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর বংশদ্ভুত। যাদেরকে বানু ইসরাঈলের বলা হয়। অর্থাৎ ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর ছেলে দু’জন। একজন ইসমাইল আরেকজন হচ্ছে ইসহাক। ইসহাকের ছেলের নাম ইয়াকূব। ইয়াকূবের অপর নাম হচ্ছে ইসরাঈল। সেখান থেকে বানী ইসরাঈল মানে ইসরাঈলের বংশধর। সুতরাং ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর ইসহাক্ব (আলাইহিস সালাম)-এর বংশ থেকে অধিকাংশই আম্বিয়া-রাসূল এসেছেন। যেমন ইসহাক (আলাইহিস সালাম)-এর ছেলে ইয়াকূব (আলাইহিস সালাম), আর তার ছেলে নবী ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)। অতঃপর যাকারিয়া, ইয়াইয়া, মূসা, ঈসা সহ সমস্ত আম্বিয়া ও রাসূল এই বংশ থেকেই এসেছেন।
.
(৪). এই অঞ্চলটি বহু মু‘জিযার স্থান: “এই শাম তথা ফিলিস্তীনের ভূমিতে অসংখ্য মু‘জিযা বা অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। এখানে ঈসা (আলাইহিস সালাম) ভূমিষ্ট হয়েছেন। ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর মা ছিল কিন্তু কোন বাবা ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, পৃথিবীতে প্রতিটি জিনিসের জন্য মাধ্যম করেছেন। কিন্তু মাধ্যম ছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা যেকোন কিছু করতে পারেন। ‘কুন ফাইয়াকুন’ তথা হয়ে যাও বললেই হয়ে যাবে। প্রজন্ম বৃদ্ধির জন্য একটা স্বাভাবিক নিয়ম হল নারী-পুরুষের সহবাস। অথচ নারী-পুরুষের মাধ্যমে ছাড়াও তিনি আদম (আলাইহিস সালাম)-কে সৃষ্টি করেছেন। আবার পুরুষ আছে কিন্তু নারী নেই। যেমন হাওয়া (আলাইহিস সালাম)-এর সৃষ্টি। অনুরূপভাবে নারী আছে কিন্তু নর নেই। যেমন ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর জন্ম। কেননা ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর মা মারিয়ামের স্বামী নেই। স্বামী ছাড়ায় তিনি গর্ভবতী হয়েছেন এবং সন্তান জন্ম দিয়েছেন। এই মু‘জিযার স্থান ছিল ফিলিস্তীন। এই ফিলিস্তীন থেকেই মূসা (আলাইহিস সালাম)-কে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইহুদীদের কবল থেকে মুক্তির জন্য ঈসা (আলাইহিস সালাম)-কে চতুর্থ আসমানে উঠিয়ে নিয়েছিলেন।
.
(৫). এই অঞ্চলে শেষ যমানায় মুসলমানদের হিজরত হবে: শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়া (মৃত: ৭২৮ হি.) বলেন, “ইসলামের প্রথমিক যুগে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের যে ফযীলত ছিল, শেষ যুগে শামে হিজরতের মাধ্যমেও অনুরূপ ফযীলত লাভ করবে”।(ইবনে তায়মিয়া,মানাকিবু আহলিশ শাম, পৃ. ৪০) আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন; আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ«سَتَكُوْنُ هِجْرَةٌ بَعْدَ هِجْرَةٍ، فَخِيَارُ أَهْلِ الْأَرْضِ أَلْزَمُهُمْ مُهَاجَرَ إِبْرَاهِيْمَ، وَيَبْقَىٰ فِي الْأَرْضِ شِرَارُ أَهْلِهَا تَلْفِظُهُمْ أَرْضُوْهُمْ، تَقْذَرُهُمْ نَفْسُ اللهِ، وَتَحْشُرُهُمُ النَّارُ مَعَ الْقِرَدَةِ وَالْـخَنَازِيْرِ».”(মদীনায়) হিজরত সম্পন্ন হওয়ার পর আর একটি হিজরত সংঘটিত হবে। তখন মুসলিম উম্মাহর মধ্যে শ্রেষ্ট মুসলমান হবে যারা হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর হিজরতের স্থান আঁকড়ে ধরবে। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে নিকৃষ্ট মুসলমানগণ অবস্থান করবে। পৃথিবী তাদেরকে নিজ ভূগর্ভ থেকে বের করে দিতে চাইবে, আল্লাহর নিকট তারা হবে ধিকৃত। একটি আগুন তাদেরকে বানর ও শুকরের সঙ্গে জমায়েত করে দেব”।(আবু দাউদ হা/২৪৮২)
.
(৬). ফিলিস্তীন তথা শাম দেশে মানুষের হাশর-নাশর হবে: তবে উক্ত হাশর পার্থিব জগতের হাশর, না-কি পরকালীন হাশর; এব্যাপারে আলেমগণের মাঝে ইখতিলাফ রয়েছে। গবেষকগণ বলেছেন, এটা পৃথিবীর হাশর। যা দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার আগে সংঘটিত হবে। যখন পৃথিবী ফিতনায় ভর্তি হয়ে যাবে। তখন শামদেশ ফিতনামুক্ত ভূমি হিসাবে অবশিষ্ট থাকবে। নবী (ﷺ) এ ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। এছাড়া ছাহাবায়ে কেরাম যখন রাসূল (ﷺ)-কে ফিতনার সময় কোথায় আশ্রয় নিব জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, ‘শাম দেশে তোমরা আশ্রয় নিবে’। আর শাম দেশ হলো ফিলিস্তীন।হাদীসে এসেছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,سَيَصِيرُ الْأَمْرُ إِلَى أَنْ تَكُونُوا جُنُودًا مُجَنَّدَةً جُنْدٌ بِالشَّامِ وَجُنْدٌ بِالْيَمَنِ وَجُنْدٌ بِالْعِرَاقِ قَالَ ابْنُ حَوَالَةَ خِرْ لِي يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنْ أَدْرَكْتُ ذَلِكَ فَقَالَ عَلَيْكَ بِالشَّامِ فَإِنَّهَا خِيرَةُ اللَّهِ مِنْ أَرْضِهِ يَجْتَبِي إِلَيْهَا خِيرَتَهُ مِنْ عِبَادِهِ فَأَمَّا إِنْ أَبَيْتُمْ فَعَلَيْكُمْ بِيَمَنِكُمْ وَاسْقُوا مِنْ غُدُرِكُمْ فَإِنَّ اللَّهَ تَوَكَّلَ لِي بِالشَّامِ وَأَهْلِهِ ‘পরিস্থিতি তার কাজের ধারা অনুযায়ী চলতে থাকবে, যতক্ষণ তোমরা তিনটি বাহিনীতে পরিণত না হও— একটি বাহিনী শামের, আরেকটি বাহিনী ইয়ামানের এবং অপরটি ইরাকের। ইবনে হাওয়ালাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! যদি আমি সেই দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকি তবে আমার জন্য একটি নির্ধারণ করে দিন। উত্তরে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমার শামে যাওয়া উচিত হবে। কারণ এটি আল্লাহর ভূমিসমূহের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম এবং তাঁর সবচেয়ে ভালো বান্দারাই সেখানে জড়ো হবে। আর যদি তুমি তা না চাও তবে তোমার ইয়ামান যাওয়া উচিত এবং সেখানকার কূপ থেকে পানি পান করা উচিত। কারণ আল্লাহ আমাকে নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি শাম এবং তার মানুষের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন’ (আবূ দাঊদ হা/২৪৮৩, মিশকাত হা/৬২৬৭)। তিনি আরও বলেন,إِنَّ فُسْطَاطَ الْمُسْلِمِينَ يَوْمَ الْمَلْحَمَةِ بِالْغُوطَةِ إِلَى جَانِبِ مَدِينَةٍ يُقَالُ لَهَا دِمَشْقُ مِنْ خَيْرِ مَدَائِنِ الشَّامِ ‘কুফফার-মুশরিকদের সাথে মহাযুদ্ধের দিন (ক্বিয়ামতের পূর্বের কোনো যুদ্ধ বা দাজ্জালের সাথে যে যুদ্ধ হবে) মুসলিমদের তাঁবু (ফিল্ড হেডকোয়ার্টার) ‘গুতা’ নামক স্থানে হবে, যা একটি শহরের পাশে অবস্থিত; যার নাম দিমাশক যা শাম বা সিরিয়ার শ্রেষ্ঠ নগরী”।(আবূ দাঊদ, হা/৪২৯৮; মিশকাত হা/৬২৭২)। উল্লেখ্য যে, ‘গুতা’ নামক জায়গাটা বর্তমানে সিরিয়ার রাজধানী দামেশক থেকে ৮ কি. মি. পূর্বে অবস্থিত। এখানকার মওসুম শুষ্ক ও গরম (মুহাম্মাদ আসেম উমার, তিসরী জঙ্গে আযীম আওর দাজ্জাল, (ফরিদ বুক ডিপো, দিল্লী), পৃ. ৬৯)। উল্লিখিত হাদীছগুলো প্রমাণ করে শাম বা সিরিয়া একটি বরকতময় জায়গা। ক্বিয়ামতের পূর্বমূহুর্তের সকল ঘটনা শাম-কেন্দ্রিক ঘটবে।
.
(৭). দামেশকের কোনো এক মসজিদে ঈসা (আলাইহিস সালাম) আসমান থেকে অবতরণ করবেন: ক্বিয়ামতের পূর্বমূহুর্তের সকল ঘটনা শাম-কেন্দ্রিক ঘটবে।আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিশ্বাস এই যে, ঈসা (আঃ)কে আল্লাহ তা’আলা জীবিত অবস্থায় আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন। ইহুদীরা তাকে হত্যা করতে পারেনি। কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে তিনি আমাদের জন্য শাসক হয়ে আবার দুনিয়াতে আগমণ করবেন। দাজ্জালকে হত্যা করবেন, খৃষ্টান ধর্মের পতন ঘটাবেন, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন, আমাদের নবীর শরীয়ত দ্বারা বিচার-ফয়সালা করবেন এবং ইসলামের বিলুপ্ত হওয়া আদর্শগুলো পুনর্জীবিত করবেন। পৃথিবীতে নির্দিষ্ট সময় অবস্থান করার পর তিনি মৃত্যু বরণ করবেন। মুসলমানগণ তার জানাযা নামায পড়ে তাকে দাফন করবেন। তাঁর আগমণের পক্ষে কুরআন ও সহীহ হাদীসে অনেক দলীল রয়েছে। রাসূল (ﷺ) বলেন,بَعَثَ اللهُ الْمَسِيحَ بْنَ مَرْيَمَ، فَيَنْزِلُ عِنْدَ الْمَنَارَةِ الْبَيْضَاءِ، شَرْقِيَّ دِمَشْقَ بَيْنَ مَهْرُودَتَيْنِ، وَاضِعًا كَفَّيْهِ عَلَى أَجْنِحَةِ مَلَكَيْنِ، إِذَا طَأْطَأَ رَأْسَهُ قَطَرَ، وَإِذَا رَفَعَهُ تَحَدَّرَ مِنْهُ مِثْلُ جُمَانٍ كَاللُّؤْلُؤِ ; فَلَا يَحِلُّ لِكَافِرٍ أَنْ يَجِدَ مِنْ رِيحِ نَفَسِهِ إِلَّا مَاتَ، وَنَفَسُهُ يَنْتَهِي حَيْثُ يَنْتَهِي طَرْفُهُ، فَيَطْلُبُهُ حَتَّى يُدْرِكَهُ بِبَابِ لُدٍّ فَيَقْتُلَهُ،”আল্লাহ তা‘আলা ঈসা ইবনু মারইয়াম (আঃ)-কে প্রেরণ করবেন এবং তিনি দামেশকের পূর্ব প্রান্তের শ্বেত মিনারা হ’তে হলুদ রঙের দু’টি কাপড় পরিহিত অবস্থায় দু’জন ফেরেশতার পাখায় হাত রেখে অবতরণ করবেন। তিনি যখন মাথা নিচু করবেন তখন ফোটা ফোটা ঘাম ঝরবে, আর যখন মাথা উঁচু করবেন তখন তা স্বচ্ছ মুক্তার মতো ঝরতে থাকবে। তিনি যে কোন কাফেরের কাছে যাবেন সে তার শ্বাসের বাতাসে ধ্বংস হয়ে যাবে। তার দৃষ্টি যতদূর পর্যন্ত যাবে তাঁর শ্বাসও ততদূর পর্যন্ত পৌছবে। এ অবস্থায় তিনি দাজ্জালকে অনুসন্ধান করতে থাকবেন। অবশেষে তিনি (বায়তুল মাক্বদিসের) ’লুদ্দ’ নামক দরজার কাছে পেয়ে তাকে হত্যা করবেন”।(সহীহ মুসলিম হা/২৯৩৭; তিরমিযী ২২৪০, আবূ দাউদ ৪৩২১; মিশকাত হা/৫৪৭৫)
.
পরিশেষে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদেরকে মসজিদে আক্বসাকে ফিরিয়ে দেন, মসজিদে আক্বসায় সালাত আদায় নসীব করেন। এছাড়া আল্লাহ রব্বুল আলামীন যেন কাফির-যালিমদের লাঞ্ছিত করেন, নির্মূল করেন ও ধ্বংস করেন। আল্লাহ যেন তাঁর খাছ মদদ আসমান থেকে নাযিল করেন। ওয়া সাল্লাল্লাহু সাল্লি আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ ওয়া আলা আলিহি ওয়া সহবিহি আজমাঈন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: