শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া কি আশআরীরা দ্বীনের রক্ষক এমন কথা বলেছেন

প্রশ্ন: শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া কি আশ’আরীদেরকে ‘আনসারু উসূলিদ্দীন’ (أَنصَارُ أُصُولِ الدِّينِ) অর্থাৎ আশʿআরীরা দ্বীনের (মৌলিক বিষয়) এর রক্ষক।” এমন কথা বলেছেন?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। আমাদের নবী মুহাম্মদের প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের প্রতি আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর দুঃখজনক হলেও সত্যি, সঠিক তথ্য যাচাই-বাছাই ছাড়া বিভিন্ন ফোরাম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি কথা প্রচারিত হয় যে, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] আশʿআরীদের সম্পর্কে বলেছেন:وَأَمَّا لَعْنُ الْعُلَمَاءِ لِأَئِمَّةِ الْأَشْعَرِيَّةِ فَمَنْ لَعَنَهُمْ عُزِّرَ . وَعَادَتْ اللَّعْنَةُ عَلَيْهِ فَمَنْ لَعَنَ مَنْ لَيْسَ أَهْلًا لِلَّعْنَةِ وَقَعَتْ اللَّعْنَةُ عَلَيْهِ وَالْعُلَمَاءُ أَنْصَارُ فُرُوعِ الدِّينِ وَالْأَشْعَرِيَّةُ أَنْصَارُ أُصُولِ الدِّينِ“আর যারা আশʿআরী ইমামদের অভিশাপ দেয়, তাদের শাস্তি দেওয়া উচিত। অভিশাপ যার প্রাপ্য নয় তাকে অভিশাপ দিলে তা অভিশাপ দাতার উপরই ফিরে আসে। আলেমরা দ্বীনের فروع (শাখা-প্রশাখা) এর রক্ষক, আর আশʿআরীরা দ্বীনের اصول (মৌলিক বিষয়) এর রক্ষক।”(মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনু তাইমিয়্যাহ খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১৬) এটি ফাতওয়াটি প্রচার করে তারা দাবি করে যে শাইখ ইবনে তাইমিয়ার উক্তি!! কিন্তু এটি তাদের ভুল ধারণা কেননা এটি শাইখুল ইসলামের উক্তি নয় বরং এটি একজন আশআরী আলেমের উক্তি।

আমরা প্রতিটি পাঠককে অনুরোধ করছি, ইবনে তাইমিয়ার “মাজমু‘ আল-ফাতাওয়া” (৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৬)-এ উদ্ধৃত অংশটি নিজে পর্যালোচনা করার জন্য। ওই বক্তব্যের ঠিক আগে “قال” (তিনি বলেছেন) শব্দটি লক্ষ্য করুন, যা স্পষ্ট করে দেয় যে এটি ইবনে তাইমিয়ার নিজের কথা নয়, বরং তিনি অন্য একজন (আবু মুহাম্মাদ নামক এক ফকীহ) এর বক্তব্য শাইখুল ইসলাম উদ্ধৃত করছেন। ১৫ নং পৃষ্ঠার শেষ লাইনের শুরুতে ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলছেন: وكذلك رأيت في فتاوى الفقيه أبي محمد فتوى طويلة.. قال فيها:..” إلى أن يقول: [قال: وأما لعن العلماء الأئمة الأشعرية فمن لعنهم عزر وعادت اللعنة عليه… والعلماء أنصار فروع الدين والأشعرية أنصار أصول الدين.” قال: وأما دخولهم النار..]]الخ’“আমি ফকীহ আবু মুহাম্মাদের ফাতাওয়ায় একটি দীর্ঘ রায় দেখেছি… যেখানে তিনি বলেছেন: […] “আর যদি কোনো আলেম আশ‘আরী ইমামদের لعن (অভিশাপ) দেয়, তাকে শাস্তি দেওয়া উচিত। কারণ, যারা অভিশাপের অযোগ্য তাদের অভিশাপ করলে তা অভিশাপকারীর উপরই ফিরে আসে। আলেমরা দ্বীনের فروع (শাখা-প্রশাখা)-এর রক্ষক, আর আশ‘আরীরা দ্বীনের اصول (মৌলিক বিষয়)-এর রক্ষক।” তিনি আরও বলেন: ‘আশ‘আরীদের জাহান্নামে যাওয়া সম্পর্কে…’ ইত্যাদি।”
.
কিন্তু পরবর্তীতে (পৃষ্ঠা: ১৫৮–১৫৯) ইবনে তাইমিয়া সরাসরি “আবু মুহাম্মাদ ও তার অনুসারীদের সমালোচনা” করে লিখেন:وأيضاً فيقال لهؤلاء الجهمية الكلابية كصاحب هذا الكلام أبي محمد وأمثاله كيف تدعون طريقة السلف وغاية ما عند السلف أن يكونوا متابعين لرسول الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟” إلى أن يقول: ”وأبو محمد وأمثاله قد سلكوا مسلك الملاحدة الذين يقولون إن الرسول صلى الله عليه وسلم لم يبين الحق في باب التوحيد’“এই জাহমী-কুল্লাবীদের জিজ্ঞাসা করা উচিত: তোমরা কিভাবে সালাফদের পথ দাবি করো? সালাফদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল রাসূল (ﷺ)-এর অনুসরণ। আর আবু মুহাম্মাদ ও তার মতো লোকেরা সেই মুলহিদদের (নাস্তিকদের) পথে চলেছে, যারা বলে, রাসূল (ﷺ) তাওহীদের বিষয়ে সত্য স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেননি।”(মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনু তাইমিয়্যাহ খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১৫৮-১৫৯)
.
একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে—
(ক) আলোচিত উক্তিটি ইবনে তায়মিয়ার নয়, বরং একজন আশ’আরী তা বলেছেন, যিনি নিজের মতবাদকেই প্রশংসা করেছেন।

(খ) শাইখুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া এই ব্যক্তিকে এবং তার মতবাদকে জাহমি-কুল্লাবী মতাদর্শ ও নাস্তিকদের পথ অনুসরণকারী বলে আখ্যায়িত করেছেন, এবং তাদের ‘সালাফদের পথের অনুসারী’ হওয়ার দাবিকে স্পষ্টভাবে অস্বীকার করেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, যারা এই উক্তিকে ইবনে তায়মিয়ার প্রশংসা হিসেবে প্রচার করেছে, তারা প্রকৃতপক্ষে প্রতারণামূলক উপায়ে মিথ্যা প্রচার চালিয়েছে।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া রাহিমাহুল্লাহ) এর পক্ষ থেকে আশ’আরীদের ব্যাপারে কখনোই কোনো নিরঙ্কুশ প্রশংসা উচ্চারিত হয়নি। তার সবোর্চ্চ ইতিবাচক মন্তব্য পাওয়া যায় মাজমু‘উল ফাতাওয়ার ১২তম খণ্ডে, যেখানে তিনি বলেন, আশ’আরীরা অন্যদের তুলনায় কিছুটা নিকটবর্তী, এবং তাদের মতবাদ ওহি ও দর্শনের সংমিশ্রণ। তিনি যেসব আশ’আরীদের প্রশংসা করেছেন, তারা মূলত হাদীসচর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। আশ’আরী হওয়ার কারণে নয়, বরং সুন্নাহ্‌র অনুসরণে নিয়োজিত থাকার কারণে। তাও আবার, যেসব বিষয়ে তারা তাদের কালামি মতবাদের অনুসরণ করেছে, সেসব ক্ষেত্রে তিনি আল্লাহর কাছে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তবে এসব হালকা প্রশংসা তাদেরকে বিভ্রান্ত, পথভ্রষ্ট ও ভুলপথের অনুসারী বলার জায়গাগুলোর তুলনায় অনেক কম। কেননা, তিনি বহু স্থানে স্পষ্ট ভাষায় আশ’আরীদের বিদআতী, বিভ্রান্তিকর এবং বিপথগামী মতবাদের অনুসারী বলেছেন। এমনকি এত বেশি জায়গায় যে তা গণনা করাও কঠিন।
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি] পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন, একজন ব্যক্তি কখন আশআরীর অনুসারী হয়েও আহলুস সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত বিবেচিত হতে পারেন। তিনি বলেন:أما من قال منهم بكتاب الإبانة الذي صنفه الأشعري في آخر عمره ولم يظهر مقالة تناقض ذلك؛ فهذا يعَدُّ من أهل السنة، لكن مجرد الانتساب إلى الأشعري ؛ لا سيما وأنه بذلك يوهم حسناً لكل من انتسب هذه النسبة، وينفتح بذلك أبواب شر’“যারা আশআরীর জীবনের শেষ দিকে রচিত ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থের বক্তব্যকে গ্রহণ করে এবং এর পরিপন্থী কোনো মত প্রকাশ করেনি, তাদেরকে আহলুস সুন্নাহ ধরা যেতে পারে। তবে কেবলমাত্র আশআরীর প্রতি নিজেকে সম্পৃক্ত করা, বিশেষ করে যখন এতে মনে হয় যেন আশআরী নামে পরিচিত প্রত্যেকেই সঠিক পথের অনুসারী,এটি ভুল ধারণা তৈরি করে এবং এতে অনেক ফিতনার দরজা খুলে যায়।”(মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনু তাইমিয়্যাহ খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৩৬০)অর্থাৎ, যারা বাস্তবে সালাফদের আক্বীদার ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাদের জন্যও আশআরী নামে নিজেদের পরিচয় দেওয়া উচিত নয়, কারণ এটি একটি বিদআতি পরিচয় এবং নিন্দনীয় একটি বিষয়ে সম্পৃক্ততা।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
__________________________
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: শাইখ নাসরুল্লাহ আল মাদানী হাফি.।

Share: