উত্তর: কুরবানী ইসলামের একটি অন্যতম নিদর্শন। কুরবানীর বিধান আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাহ ও মুসলমানদের ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে কুরবানী করেছেন, তাঁর সাহাবীবর্গ রা. কুরবানী করেছেন এবং তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে,কুরবানী করা মুসলমানদের আদর্শ এবং এটি একটি ইবাদত। কুরবানির ক্ষেত্রে সর্বোত্তম হচ্ছে একজন ব্যক্তি কিংবা একটি পরিবারের পক্ষ থেকে একটি পশু কুরবানি দেওয়া। তবে গরু কিংবা উটের মধ্যে অংশীদার হওয়া জায়েয। এমনকি কোন অংশীদারের উদ্দেশ্য যদি কুরবানী না হয় তবুও। যেমন; কারো উদ্দেশ্য হল বিয়ের ওয়ালিমার জন্য কিংবা খাওয়ার জন্য কিংবা বিক্রি করার জন্য গোশত পাওয়া ইত্যাদি। কারন প্রত্যেককে তার স্ব-স্ব নিয়তের ভিত্তিতে ফলাফল পাবেন যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী হচ্ছে: “আমলসমূহ নিয়ত দ্বারা হয়ে থাকে। আর প্রত্যেক ব্যক্তি যা নিয়ত করে সেটাই তার প্রাপ্য…”(সহিহ বুখারী হা/১; সহিহ মুসলিম হা/১৯০৭)
অংশীদারি কুরবানি দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি নিশ্চিত ভাবে একথা জানা যায় যে কোন অংশীদার তার উপার্জিত হারাম অর্থ দিয়েই কুরবানী দিচ্ছেন। কিংবা তার এই কুরবানী করার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য নয় বরং উদ্দেশ্য গোস্ত খাওয়া, কিংবা মানুষকে দেখানো উদ্দেশ্য হয় তাহলে নিয়ত খারাপ থাকার কারণে জেনে বুঝে তার সাথে কুরবানীতে অংশীদার হওয়া জায়েজ হবে না। কেননা এখানে হারামে সহযোগিতা করা রয়েছে। যা করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। মহান আল্লাহ্ তাআলা বলেন:وَ تَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡبِرِّ وَ التَّقۡوٰی ۪ وَ لَا تَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡاِثۡمِ وَ الۡعُدۡوَانِ ۪“তোমরা নেকী ও তাক্বওয়ার ক্ষেত্রে পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করা; পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কেউ কাউকে সহযোগিতা করবে না। আল্লাহ্কে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ্ কঠিন শাস্তিদাতা।”(সূরা মায়িদাহ: ৫/২) উপরিউক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এখানে আল্লাহ তা‘আলা মুমিন ব্যক্তিদেরকে ভালো কাজে সহযোগিতা করতে আদেশ করেছেন এবং অন্যায়, অসৎ ও হারাম কাজে সাহায্য, সহযোগিতা করতে নিষেধ করেছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, ২য় খণ্ড, পৃ. ১২;তাফসীরে কুরতুবী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৪৬-৪৭) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:“যে ব্যক্তি কোন হেদায়েতের দিকে আহ্বান করে সেই ব্যক্তি তাকে যারা অনুসরণ করবে তাদের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। তাদের সওয়াব থেকে সামান্যটুকুও কমানো হবে না। আর যে ব্যক্তি কোন পথভ্রষ্টতার দিকে ডাকে, তাকে যারা অনুসরণ করবে তার উপর তাদের সম পরিমাণ পাপ বর্তাবে। তাদের পাপ থেকে সামান্যটুকুও কমানো হবে না।”(সহিহ মুসলিম হা/৪৮৩১)
কিন্তু যদি অজানা বশত: শরিকানা কুরবানির ক্ষেত্রে অংশীদারদের কোন একজনের মধ্যে এমন কেউ থাকে যার সম্পন্ন অর্থ হারাম উপার্জন থেকে হয় অথবা বিশেষ পরিস্থিতিতে এমন ব্যক্তিকে ভাগে নেয়ার প্রয়োজন হয় যার অর্থ সম্পূর্ণ হালাল নয় (হালাল-হারামের সংমিশ্রণ আছে) তাহলে এটি অন্যান্য ভাগীদারদের উপরে প্রভাব ফেলবে না ইনশাআল্লাহ। কেননা একজনের দায়-দায়িত্ব অন্যজন বহন করবে না। ক্বিয়ামাতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ নিজ পাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। সেদিন আল্লাহ তা‘আলা কারোর উপর বিন্দুমাত্র যুলুম করবেন না এবং কেউ অন্য কারো পাপের বুঝাও বহন করবে না। মহান আল্লাহ বলেন,وَ لَا تَكۡسِبُ كُلُّ نَفۡسٍ اِلَّا عَلَیۡهَا ۚ وَ لَا تَزِرُ وَازِرَۃٌ وِّزۡرَ اُخۡرٰی ۚ”প্রত্যেকে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়ী এবং কেউ অন্য কারো ভার গ্রহণ করবে না”। (সূরা আল-আন‘আম: ১৬৪)। অন্যত্র তিনি বলেনكُلُّ امۡرِیًٴۢ بِمَا كَسَبَ رَهِیۡنٌ “প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের দায়ে আবদ্ধ।’ (সূরা আত-তূর: ২১; সূরা আল-মুদ্দাসসির: ৩৮; ইসলাম সাওয়াল জাওয়াব, ফাতাওয়া নং-৩১৮৬৯৮) এমন অসংখ্য দলিল রয়েছে যা প্রমান করে যে একজনের পাপের জন্য অন্য কারো কোন সমস্যা হবে না।
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.]‘আল-মাজমু’ গ্রন্থে বলেন:
يجوز أن يشترك سبعة في بدنة أو بقرة للتضحية ، سواء كانوا كلهم أهل بيت واحد أو متفرقين ، أو بعضهم يريد اللحم ، فيجزئ عن المتقرب ، وسواء أكان أضحية منذورة أم تطوعا ، هذا مذهبنا وبه قال أحمد وجماهير العلماء
কুরবানী দেওয়ার জন্য একটি উটে কিংবা একটি গরুতে সাতজন অংশীদার হওয়া জায়েয। হোক অংশীদারেরা সকলে একই বাড়ীর লোক কিংবা ভিন্ন ভিন্ন বাড়ীর লোক। কিংবা তাদের কারো কারো উদ্দেশ্য হয় শুধু গোশত সেক্ষেত্রেও কুরবানীকারীর পক্ষ থেকে কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। হোক না সে কুরবানীটা মানতের কুরবানী কিংবা নফল কুরবানী। এটাই আমাদের মাযহাব। এটা ইমাম আহমাদ ও জমহুর আলেমের অভিমত।(আল-মাজমু’ খন্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩৭২)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] তাঁর ‘আল-মুগনি’ গ্রন্থে বলেন:
وتجزئ البدنة عن سبعة ، وكذلك البقرة ، وهذا قول أكثر أهل العلم . . ثم ذكر بعض الأحاديث الدالة على هذا ، ثم قال :”إذا ثبت هذا ، فسواء كان المشتركون من أهل بيت ، أو لم يكونوا ، مفترضين أو متطوعين ، أو كان بعضهم يريد القربة ، وبعضهم يريد اللحم ; لأن كل إنسان منهم إنما يجزئ عنه نصيبه ، فلا تضره نية غيره ”
“একটি উট সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে। অনুরূপভাবে একটি গরুও। এটি অধিকাংশ আলেমের অভিমত। এরপর তিনি এ অভিমতের সপক্ষে কিছু হাদিস উল্লেখ করেন। অতঃপর বলেন: “এটা যখন সাব্যস্ত হল তখন এতে কোন সমস্যা নেই যে, অংশীদারগণ সবাই একই বাড়ীর হোক কিংবা না হোক। অংশীদারগণ সকলেই ফরয কোরবানী আদায়কারী হোক কিংবা নফল কোরবানী আদায়কারী হোক। অংশীদারদের কেউ কেউ আল্লাহ্র নৈকট্যের উদ্দেশ্য কোরবান করুন কিংবা কেউ কেউ শুধু গোশতের জন্য পশু জবাই করুক। কেননা প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার অংশই আদায় হবে। অন্যের নিয়ত তার কোন ক্ষতি করবে না।(আল-মুগনি’ খন্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ৩৬৩)।
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! কুরবানি করা এমন একটি ইবাদত যে ইবাদতের প্রতি শরিয়ত নর-নারী, বিবাহিত-অবিবাহিত নির্বিশেষে সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছে। সুতরাং প্রত্যেকের উচিত তার ইবাদত একনিষ্ঠভাবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যই হওয়া। শরিকানা কোরবানি দেয়ার ক্ষেত্রে দ্বীনদার- তাকওয়াশীল যাদের আয় উপার্জন হালাল তাদের সাথে ভাগে কুরবানি দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। জেনে বুঝে সালাত পরিত্যাগকারী, হারাম উপার্জন কারী, সুদখোর, ঘুষখোর এবং প্রকাশ্য পাপাচারে লিপ্ত এমন ব্যক্তিদের সাথে শরিকানা কুরবানীতে অংশগ্রহণ করা উচিৎ নয়। কারণ, এতে ঐ ব্যক্তির হারাম অর্থ খরচে সহযোগিতা করা হয়। যা মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য নয়।কিন্তু কোন অংশীদারের অর্থ হারাম হলে বাকিদের কুরবানী বাতিল হবেনা এটাই বিশুদ্ধ কথা। আল্লাহ তা‘আলা সকলকে লৌকিকতামুক্ত ইখলাসপূর্ণ কুরবানী করার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
___________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তাদ ইব্রাহিম বিন হাসান (হাফি.)