ভূমিকা: মহান আল্লাহ কিছু মাস, দিন ও রাত্রিকে অপরাপর থেকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন; যাতে তা মুসলিমের আমল বৃদ্ধিতে সহযোগী হয়। তাঁর আনুগত্যে ও ইবাদতে মনোযোগ বৃদ্ধি পায় এবং কর্মঠ মনে নতুন কর্মোদ্যম পুনঃ পুনঃ জাগরিত হয়। অধিক সওয়াবের আশায় সেই কাজে মনের লোভ জেগে ওঠে এবং তার বড় অংশ হাসিলও করে থাকে বান্দা। যাতে মৃত্যু আসার পূর্বে যথা সময়ে তার প্রস্তুতি এবং পুনরুত্থানের জন্য যথেষ্ট পাথেয় সংগ্রহ করে নিতে পারে।শরীয়তে নির্দিষ্ট ইবাদতের মৌসুম এই জন্যই করা হয়েছে যাতে ঐ সময়ে ইবাদতে অধিক মনোযোগ ও প্রয়াস লাভ হয় এবং অন্যান্য সময়ে অসম্পূর্ণ অথবা স্বল্প ইবাদতের পরিপূর্ণতা ও আধিক্য অর্জন এবং তাওবাহ করার সুযোগ লাভ হয়।অতএব সৌভাগ্যশালী সেই হবে, যে ঐ নির্দিষ্ট মাস বা কয়েক ঘণ্টার মৌসুমে নির্দিষ্ট ওযীফাহ ও ইবাদতের মাধ্যমে নিজ মওলার সামীপ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে। আমল ও ইবাদতের নির্দিষ্ট মৌসুমসমূহে আল্লাহর অনুগত ও দ্বীনদার বান্দা লাভবান হয় এবং অবাধ্য ও অলস বান্দা ক্ষতির শিকার হয়। তাই তো মুসলিমের উচিত, আয়ুর মর্যাদা ও জীবনের মূল্য সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত হওয়া এবং সেই সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত অধিকরূপে করা ও মরণাবধি সৎকার্যে অবিচল প্রতিষ্ঠিত থাকা। আল্লাহ তাআলা বলেন,(وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتّى يَأْتِيَكَ الْيَقِيْن)অর্থাৎ, ‘‘তোমার ইয়াকীন উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের উপাসনা কর।’’ (সূরা হিযর,১৫/৯৯) সালেম বিন আব্দুল্লাহ (রহ.) বলেন,‘ইয়াকীন’
(সুনিশ্চয়তা) অর্থাৎ মৃত্যু। অনুরূপ বলেছেন মুজাহিদ, হাসান, কাতাদাহ প্রভৃতি মুফাসসিরগণও।(তাফসিরে ইবনে কাসীর খন্ড:৪ পৃষ্ঠা:৩৭১)
.
বিভিন্ন হাদীস থেকে রমাদানের শেষ দশকে ইবাদতের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তৎপরতা আমরা জানতে। তিনি রমাদানের শেষ দশকে যে পরিমাণে ইবাদত করতেন, সেই পরিমাণ কখনই করতেন না।যেমন: আয়িশা (রা.) বলেন, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) রমাযানের শেষ দশকে ইবাদত করতে যে মেহনত ও চেষ্টা করতেন, মাসের অন্যান্য দিনগুলিতে তা করতেন না।(সহীহ মুসলিম ১১৭৫) অপর বর্ননায় আম্মাজান আয়েশা (রাঃ)আরো বলেন, রমাযানের শেষ দশক এসে উপস্থিত হলে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) (ইবাদতের জন্য) নিজের কোমর (লুঙ্গি) বেঁধে নিতেন, সারারাত্রি জাগরণ করতেন এবং আপন পরিজনকেও জাগাতেন।’’(সহীহ বুখারী ২০২৪নং, আহমাদ, মুসনাদ ৬/৪১, আবূ দাঊদ ১৩৭৬, নাসাঈ ১৬৩৯, ইবনে মাজাহ ১৭৬৮) অন্য এক বর্ণনায় আছে, তিনি নিজে সারারাত্রি জাগরণ করতেন এবং আপন পরিজনকেও জাগাতেন। ইবাদতে মেহনত করতেন এবং কোমর (বা লুঙ্গি) বেঁধে নিতেন।(সহীহ মুসলিম ১১৭৪)
.
উপরোক্ত হাদীসগুলোতে রমজানের শেষ দশকে প্রিয় নবী সর্বাধিক ইবাদত করলেও তিনি কোন হাদীসেই রমাদানের শেষ দশককে সর্বশ্রেষ্ঠ বলেননি। কিন্তু যিলহজ্বের প্রথম দশকের ব্যাপারে বলেছেন, এই দিনগুলো মর্যাদার দিক থেকে বছরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।যেমন,মহান আল্লাহ তাআলা যিলহজ্জের প্রথম দশ দিনকে অন্যান্য দিনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা দান করেছেন। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘দুনিয়ার দিনগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো দশ দিন। অর্থাৎ, জ্বিলহজ্জের (প্রথম) দশ দিন।’’ জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘আল্লাহর পথে জিহাদও কি এর সমতূল্য নয়?’ তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে, ওই ব্যক্তি (ব্যতিক্রম), যে (জিহাদে) তার চেহারাকে ধুলিযুক্ত করেছে (শহিদ হয়ে গেছে)।’’[বাযযার, আল-মুসনাদ: ১১২৮; আবু ইয়ালা, আল-মুসনাদ: ২০১০; হাদীসটি সহীহ]
.
রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, এমন কোন দিন নেই যে দিনসমূহের নেক আমল আল্লাহর নিকট যিলহজ্জ মাসের এই দশ দিনের নেক আমল অপেক্ষা বেশি প্রিয়। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আল্লাহর পথে জিহাদ করাও কি নয়? রাসূল (ﷺ) বললেন, জিহাদও নয়। তবে জান-মাল নিয়ে যদি কোন লোক জিহাদে বের হয় এবং এ দু’টির কোনটি নিয়েই আর ফিরে না আসে তার কথা ভিন্ন।(সহীহ বুখারী হা/৯৬৯; তিরমিযী হা/৭৫৭; মিশকাত হা/১৪৬০)
.
আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.) বলেন, একদা আমি রসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট ছিলাম। অতঃপর আমলসমূহের কথা উত্থাপন করলাম। তিনি বললেন, ‘‘এই দশ দিন ছাড়া কোন এমন দিন নেই যাতে আমল অধিক উত্তম হতে পারে।’’ তাঁরা বললেন, ‘হে রসূলুল্লাহ! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ?’ তিনি তার গুরুত্ব বর্ণনা করলেন, অতঃপর বললেন, ‘‘জিহাদও নয়। তবে এমন কোন ব্যক্তি যে নিজের জান-মাল সহ আল্লাহর রাস্তায় বের হয় এবং তাতেই তার জীবনাবসান ঘটে।’’(মুসনাদে আহমাদ, ইরওয়াউল গালীল ৩/৩৯৯) রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপর বর্ননায় বলেন, যেসব আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সর্বোত্তম মর্যাদা লাভ করা যায় যিলহজ্জ মাসের দশদিনের আমল তার অনুরূপ’।(সহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/১১৪৮; ইরওয়া ৩/৩৯৮।)
.
অতএব এই দলীলসমূহ হতে প্রমাণিত হয় যে, সারা বছরের সমস্ত দিনগুলি অপেক্ষা যিলহাজ্জের ঐ দশ দিনই বিনা বিয়োজনে উত্তম। এমন কি রমযানের শেষ দশ দিনও যিলহজ্জের দশ দিনের চেয়ে উত্তম নয়।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে,এই দিনগুলোতে তিনি রামাদানের শেষ দশকের চেয়েও বেশি ইবাদত করতেন, এমনটি দাবি করা কঠিন।
.
◾তাহলে দেখা যাচ্ছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)যিলহজ্জের প্রথম দশককে সর্বশ্রেষ্ঠ বলেছেন। কিন্তু নিজে বেশি আমল করতেন রামাদানের শেষ দশকে। তাহলে কোন দশকের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি?
____________________________________
এই মাসালায় আহালুল আলেমগণ তিন ভাগে বিভক্ত। আলিমগণের একটি অংশ বলেছেন রমাদানের শেষ দশকের শ্রেষ্ঠ কারণ,তাতে রয়েছে শবেকদর, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এবং আলমগনের আরেকটি অংশ বলেছেন জ্বিলহজ্জের প্রথম দশকের শ্রেষ্ঠ।কারন হাদীসে এই দশদিনকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। আবার এই দুয়ের মধ্যবর্তী কিছু উলামা বলেন, (যিলহজ্জের) দিনগুলো শ্রেষ্ঠ এবং রমযানের রাত্রিগুলি শ্রেষ্ঠ। অবশ্য এইভাবে সমস্ত দলীল সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আর আল্লাহই বেশী জানেন।(তাফসীর ইবনে কাসীর ৫/৪১২)
.
ইবনে কাসীর (রঃ) বলেন, ‘মোট কথা বলা হয়েছে যে, এই দশদিন সারা বছরের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম দিন; যেমনটি হাদীসের উক্তিতে প্রতীয়মান হয়। অনেকে রমযানের শেষ দশ দিনের উপরেও এই দিনগুলিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ, যে নামায, রোযা, সাদকাহ ইত্যাদি আমল এই দিনগুলিতে পালনীয় ঐ আমলসমূহই ঐ দিনগুলিতেও পালনীয়। কিন্তু (যিলহাজ্জের) ঐ দিনগুলিতে ফরজ হাজ্জ আদায় করার অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য রয়েছে।’
.
আবার, শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ ও ইমাম ইবনুল কায়্যিমসহ আরেকদল আলিম আরও গভীর বিশ্লেষণ করে মত দিয়েছেন যে, রামাদানের শেষ দশ ‘রাত’ যিলহজ্জের শেষ দশ ‘রাত’ থেকে উত্তম; কেননা রামাদানের শেষ দশ রাতের মধ্যেই আছে লাইলাতুল কদর। আর, যিলহজ্জের প্রথম দশ ‘দিন’ রামাদানের শেষ দশ ‘দিন’ থেকে উত্তম; কেননা এই দিনগুলোতেই আছে ইয়াওমুত তারবিয়াহ (৮ তারিখ), আরাফার দিবস (৯ তারিখ) এবং কুরবানির ঈদ (১০ তারিখ)। তাই, বলা যায়—যিলহজ্জের প্রথম দশ দিন ও রামাদানের শেষ দশ রাত মর্যাদায় সর্বশ্রেষ্ঠ। [ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমু‘উ ফাতাওয়া: ২৫/২৮৭; ইবনুল কাইয়িম, বাদায়িউল ফাওয়াইদ: ৩/১৬২; ইবনু কাসির, তাফসিরুল কুরআনিল আযিম: ৫/৪১৬]
.
এদিকে, সব মত বিশ্লেষণ করে বর্তমান সময়ের অন্যতম মুহাদ্দিস ও মুহাক্কিক আলিম শায়খ সুলাইমান ইবনু নাসির আল আলওয়ান (ফাক্কাল্লাহু আসরাহু) তাঁর সহিহ বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থে বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আর কোনো দিনই জ্বিলহজ্জের প্রথম দশ দিনের চেয়ে উত্তম নয়’’ (অন্য হাদিসে এসেছে, দুনিয়ার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো যিলহজ্জের প্রথম দশ দিন) এই হাদিসে সাধারণভাবে ‘আল-ইয়াওম’ সম্বোধন করা হয়েছে, যা মূলত রাত এবং দিন উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করে (অর্থাৎ ২৪ ঘন্টায় এক দিন হিসেবে)।তাই,এভাবে বলাটাই সঠিক হবে যে, যিলহজ্জের প্রথম দশক রামাদানের শেষ দশকের চেয়েও উত্তম। রাত-দিনের পার্থক্য (করে বলা প্রয়োজন) নেই। কিন্তু লাইলাতুল কদর ব্যতিক্রম। কদরের রাত জ্বিলহজ্জের দশ দিন, দশ রাত থেকেও উত্তম। (শায়খের আলোচনা সমাপ্ত)।
.
পরিশেষে আমার পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই রমজানের শেষ দশক শ্রেষ্ঠ নাকি যিলহজ্জের প্রথম দশক শ্রেষ্ঠ সেটা নিয়ে পড়ে না থেকে বরং আমাদের উচিত, রামাদানের শেষ দশক এবং যিলহজের প্রথম দশক দুটোরই উত্তম মূল্যায়ন করা সাথে বিভিন্ন ইবাদতের মাধ্যমে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা যেন কোনোভাবেই আমরা এই অফার গুলো থেকে বঞ্চিত না হই। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_____________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।