লেখকঃ ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ।
অনেক আবেগী ইসলাম-প্রিয় মুসলিম রাজনীতিকে শুধু ইবাদতই নয়, আরকানে ইসলাম ও অন্যান্য ইবাদতের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তারা মনে করেন রাজনীতির মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে তো ইসলাম ঠিকমতো পালন করা যাচ্ছে না। কাজেই, যে ব্যক্তি “দ্বীন প্রতিষ্ঠা”-র দায়িত্ব পালন করছেন না, অথবা “দ্বীন প্রতিষ্ঠা”-র জন্য অন্যান্য মাসনূন বা ‘গাতানুগতিক’ পদ্ধতিতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু রাজনীতি করছেন না তার শুধু এই একটি ইবাদত নষ্ট হচ্ছে না, বরং তার অন্যান্য ইবাদতও হচ্ছে না; বা হলেও কম সাওয়াব হচ্ছে। এজন্য তিনি “রাজনীতি” না করে শুধু ঈমান বিশুদ্ধ করা, নামায আদায় করা, যিকর করা, যাকাত প্রদান করা, হজ্ব করা, রোযা রাখা, ইলম শিক্ষা, দাওয়াত প্রদান ইত্যাদি সকল ইবাদত পালনকে অর্থহীন বা অপূর্ণ বলে দাবি বা প্রচার করেন। এভাবে মুসলিম সমাজে জঘন্য হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়ানো ছাড়াও তারা কয়েকভাবে অনেক ভুল করছেনঃ
প্রথমত, রাজনীতি কোনো ইবাদত নয়। ‘দ্বীন প্রতিষ্ঠা’ নামক ইবাদত পালনের অনেক উপকরণের মধ্যে একটি নতুন উপকরণ। কিন্তু আমরা উপকরণকেই ইবাদত ভাবছি।
দ্বিতীয়ত, কোনো একটি ইবাদত না করলে অন্য কোনো ইবাদত হবে না, – একথা বলতে হলে স্পষ্টভাবে কুরআন বা হাদীসের নির্দেশনা প্রয়োজন। শুধুমাত্র যুক্তিতর্ক দিয়ে একথা বললে আল্লাহর নামে বানোয়াট কথা বলা হবে। কেউ যদি সমাজের অন্যায় ও ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড দেখে অসন্তুষ্ট হলেও এর প্রতিবাদ ও প্রতিকারের জন্য একেবারেই চেষ্টা না করেন তাহলে তিনি গোনাহগার হবেন। কিন্তু তার অন্য কোনো ইবাদত কবুল হবে না বা সাওয়াব হবে না অথবা কম হবে – একথা স্পষ্টভাবে কোথাও বলা হয়নি। আর যদি তিনি নিজের সাধ্যমতো অন্যায়ের প্রতিবাদ ও পরিবর্তনের চেষ্টা করেন, তাহলে নির্দিষ্ট পদ্ধতি বা উপকরণ ব্যবহার না করার জন্য তার গোনাহ হবে মনে করা খেলাফে-সুন্নাত।
তৃতীয়ত, ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ব্যক্তি জীবনে ”দ্বীন প্রতিষ্ঠা” ফরয আইন। সমাজ ও রাষ্ট্রে তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা “ফরয কিফায়া”। প্রথম প্রকারের ইবাদতের জন্য মু’মিন ব্যক্তিগতভাবে দায়ী ও এর শাস্তি বা পুরস্কার পাবে। দ্বিতীয় প্রকারের ইবাদত সামাজিক দায়িত্ব। এক্ষেত্রে মু’মিনের দায়িত্ব হচ্ছে সমাজের অন্যান্য মানুষকে দাওয়াত দেওয়া, আহবান করা, নির্দেশ দেয়া ও নিষেধ করা। সাধ্য ও ক্ষমতা অনুসারে তা পালন করতে হবে। দাওয়াত ও আহবানের দায়িত্ব পালনের পরে যদি কেউ না শোনেন, তাহলে মু’মিনের কোনো গোনাহ হবে না। সমাজ পরিবর্তন, অন্যায় রোধ বা ইসলাম প্রতিষ্ঠা এই পর্যায়ের ইবাদত। এজন্য মু’মিনের সাধ্যমতো আহবান, নির্দেশ ও নিষেধের পরেও সমাজের মানুষ ইসলাম বিরোধী কর্মে লিপ্ত থাকলে সে জন্য তার কোনো অপরাধ হবে না। আর এই আহবান, নির্দেশ ও নিষেধের ইবাদত পালনে মু’মিন সুন্নাতের বাইরে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম পালন করতে বাধ্য নয়। আমরা বিষয়টি উল্টে দিয়েছি এবং মনে করছি- সমাজে অন্য মানুষে গোনাহ করছে আমার সাওয়াবের কাজ বোধহয় কবুল হচ্ছে না।
চতুর্থত, এই ধারণা ও কর্মের ফলে “দ্বীন প্রতিষ্ঠা”-র কাজ ব্যহত হচ্ছে। সমাজে অনেক ধার্মিক মানুষ রয়েছেন, যারা পশ্চাত্য গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে সরাসরি বা সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন-না বা স্বীকার করেন-না। তবে তারা ইসলামকে ভালবাসেন ও ধার্মিক মানুষদেরকে ভালবাসেন। সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত না থাকলেও ভোটাভোটির সময় তারা ইসলামপ্রিয় ধার্মিক মানুষকে ভোট দিতে আগ্রহী থাকেন। কিন্তু “ইসলাম প্রিয় ধার্মিক রাজনীতিবিদের” পক্ষ থেকে যখন এ সকল রাজনীতি বিমুখ ধার্মিক মানুষগুলিকে গালাগালি করা হয় এবং তাদের কোনো ইবাদতই হচ্ছে-না বলে বলা হয় তখন স্বভাবত মানবীয় দূর্বলতা ও জেদাজেদির ফলে তারা উক্ত ইসলামী রাজনীতিতে লিপ্ত ব্যক্তির বিরোধীতা ও গালাগালিতে লিপ্ত হন।
অথচ, ইসলামী রাজনীতিতে লিপ্ত ব্যক্তি যদি এদের ধর্মপালনের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা ও প্রকৃত ইসলামী ভাতৃত্ববোধসহ এদেরকে বুঝাতেন যে, আপনারা যে উদ্দেশ্যে নামায, যিকর, মাদ্রাসা, দাওয়াত ইত্যাদি ইবাদতে নিয়োজিত রয়েছেন সেই উদ্দেশ্যের পূর্ণতার জন্যই আমরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছি। আপনারা ও আমরা সকলেই দ্বীন প্রতিষ্ঠার কর্মে নিয়োজিত। আপনারা আপনাদের প্রক্রিয়ায় কাজ করুন, আমাদের জন্য দোয়া করুন এবং অন্য সময় সক্রিয় না- হলেও ভোটের সময় সেই ব্যক্তিকে ভোট দিন যিনি আপনাদের এই কর্মগুলি করবেন ও করাবেন। প্রচলিত “রাজনৈতিক মুনাফেকী” নয়, প্রকৃত ইসলামী ভাতৃত্ববোধ ও শ্রদ্ধাবোধসহ এভাবে কাজ করলে “দ্বীন প্রতিষ্ঠা”-র কর্ম উত্তমরুপে পালিত হতো।
উকরণকে ইবাদত মনে করার কারণেই আমরা চিন্তা করি যে, প্রত্যেক মুসলিমের জন্য দলে নাম লিখানো এবং দলের সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া ফরয আইন। কাজেই দলে নাম না লিখিয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার অন্যান্য কর্মে রত থেকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করলে এতে “দ্বীন প্রতিষ্ঠার”-র দায়িত্ব পালিত হবে-না বা পূর্ণ হবে না। এভাবে আমরা এমন একটি কর্মকে দ্বীনের অংশ মনে করছি যা কখনো রাসুলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবীগণ দ্বীন হিসাবে পালন করেননি।
সুত্রঃ
বইঃ এহইয়াউস সুনান, পৃঃ ৪৭২-৪৭৪।
লেখকঃ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহঃ