প্রশ্ন: মহিমান্বিত মাস রমাদান তো শেষ হয়ে গেলো। রমাদান মাস থেকে আমরা কী শিক্ষা নিবো?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। আমাদের নবী মুহাম্মদের প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের প্রতি আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর আরবী ১২টি মাসের মধ্যে রমাদান মহান আল্লাহ তাআলার নিকট অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি মাস। রমাদান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এক মহান রহমত ও নেয়ামত। এ মাসে আমাদের আমল এবং ইবাদত বেশি হওয়ার কারণে আমরা অনেক সওয়াব লাভ করি। রমাদান চলে গেলেও আমাদের কর্তব্য শেষ হয়নি। মুমিনের জন্য প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তেই ইবাদত করার সুযোগ থাকে, কারণ আমাদের রব আল্লাহ তাআলা সব সময়ের প্রভু। রমাদান থেকে যে সকল ভালো আমল অভ্যাস করা হয়েছে, তা চালিয়ে যেতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِيْن “মৃত্যু আসা অবধি তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত করতে থাকো।” (সূরা হিজর: ১৫/৯৯)। হাদিসে এসেছে আয়িশাহ (রদিয়াল্লহু আনহা) বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করা হলো, আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় ‘আমল কী? তিনি বললেনঃ “যে ‘আমল সদাসর্বদা নিয়মিত করা হয়। যদিও বা তা পরিমাণে কম হয়।’’(সহীহ বুখারী হা/৬৪৬৫; সহীহ মুসলিম হা/৭৮৩)
.
রমাদানের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো তাক্বওয়া অর্জন করা, যা হলো আল্লাহভীতি। সুতরাং কতটুকু তাকওয়া অর্জন করতে পেরেছি আমরা? কেননা তাক্বওয়াই তো মুমিন নারী- পুরুষের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। তাক্বওয়ার স্থান হলো, ক্বলব বা অন্তর। যে ব্যক্তি তাক্বওয়া অর্জন করবে সে ব্যক্তি যেমন আল্লাহর ক্ষমা, রহমত ও জান্নাত পাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকে; এবং মুমিন ব্যক্তি সব ধরনের অসত্ কাজ, যেমন মিথ্যা, প্রতারণা, দুর্নীতি, চুরি, মদ, গান-বাজনা, বেহায়াপনা, এবং যেকোনো প্রকার জাহেলিয়াত থেকে বেঁচে থাকে। শাইখুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,”তাক্বওয়া’ হল, فِعْلُ مَا أَمَرَ اللهُ بِهِ وَتَرْكُ مَا نَهَى اللهُ عَنْهُ ‘আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা প্রতিপালন করা এবং যা নিষেধ করেছেন, তা পরিত্যাগ করা”(মাজমূউল ফাতাওয়া; খন্ড:২৭/৩৯)। আবু বকর আল-জাযায়েরী বলেন,”তাক্বওয়া’ হল,فِعْلُ مَا أَمَرَ اللهُ بِهِ وَرَسُوْلُهُ وَتَرْكُ مَا نَهَى اللهُ عَنْهُ وَرَسُوْلُهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ”আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) যা আদেশ করেছেন তা প্রতিপালন করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) যা নিষেধ করেছেন, তা পরিত্যাগ করা”।(আইসারুত তাফাসীর লি-কালামিল উ‘লা আল-কাবীর (মদীনা মুনাওয়ারা: মাকতাবাতুল ‘উলূম ওয়াল হিকাম, ৫ম সংস্করণ, ১৪২৪ হি./২০০৩ খ্রি.),পৃষ্ঠা: ৫৮৬) সুতরাং রমাদানে যেমন মুসলিমরা তাদের পাপ থেকে পরিত্রাণ পেতে চেষ্টা করে, বিড়ি-সিগারেট, তামাক ও জর্দা খাওয়া ব্যক্তিরাও তাতে বিরত থাকার চেষ্টা করেছে, এবং এ মাসে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ও শ্রম দিয়ে আমল ও ইবাদত করার চেষ্টাও করেছে, তেমনই পরবর্তী মাসগুলোতেও সেই প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম যেন অব্যাহত থাকে। তার সব আমল এমন হওয়া উচিত যেন সে মনে করে, সে সেগুলো রমাদানেই করছে এবং তার কর্মে রমাদানের পবিত্রতার ছাপ যেন সর্বদা প্রতিফলিত হয়।
.
হে আমাদের পাঠক! রমাদানের পরও নেক আমলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কবুলিয়তের অন্যতম লক্ষণ। যদি রমাদানের পর আপনি আল্লাহর ইবাদতে আগ্রহী থাকেন, তাহলে এটি ইঙ্গিত দেয় যে, আপনার রোযা ও তারাবীহ আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু যদি রমাদানের পর পুরোনো জীবনে ফিরে যান, তাহলে এটি ঠিক সেই নারীর মতো হয়ে যাবে, যাকে আল্লাহ কুরআনে উদাহরণ হিসেবে এনেছেন “তোমরা ওই নারীর মতো হয়ো না, যে সুতো পাকিয়ে শক্ত করার পর তা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে।” (সূরা আন-নাহল: ৯২) এই নারী কষ্ট করে সুতা পাকিয়ে টুপি, কাপড়, কম্বল ইত্যাদি বানাতো, কিন্তু পরে নিজেই সেটি ছিঁড়ে ফেলতো। তার এই কাজ দেখে লোকে তাকে পাগল ভাবতো।তেমনি রোযাদারদের অনেকের অবস্থাও এমনই এক মাস সিয়াম সাধনা করে, কুরআনের সাথে সম্পর্ক গড়ে, দোয়া-ইস্তিগফারে মশগুল থাকে; কিন্তু রমাযান শেষ হতেই পুরোনো গুনাহের জীবনে ফিরে যায়।এটি এমন, যেন কেউ পরীক্ষার হলে বসে তিন ঘণ্টা ধরে চমৎকার উত্তর লিখলো, কিন্তু খাতা জমা না দিয়ে নিজেই ছিঁড়ে ফেলে দিলো!
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] বলেছেন,”রামাদান হোক বা অন্য যে কোনো সময়, আল্লাহর কাছে কোনো আমল কবুল হওয়ার অন্যতম লক্ষণ হলো একটি সৎকর্মের পর আরেকটি সৎকর্ম করা। যদি কোনো মুসলিম রামাদানের পরও নিজেকে নেক আমলের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখে, সৎকর্মে অগ্রসর হয় এবং ইবাদত-বন্দেগিতে মনোযোগী থাকে, তবে এটি তার আমল কবুল হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ। অন্যদিকে যদি কেউ এর বিপরীত আচরণ করে নেক আমলের পর গুনাহের পথে ফিরে যায়, রামাদান শেষে গাফিলতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে এবং আল্লাহর আনুগত্য থেকে দূরে সরে যায়, তবে এটি তার আমল প্রত্যাখ্যাত হওয়ার লক্ষণ।”(মাজালিসু শাহরে রামাযান; পৃষ্ঠা: ১১৯)
.
রমদান পর মুসলিমের জন্য রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ করণীয় ও বর্জনীয় আমলসমূহ, নিম্নোক্ত তা আলোচনা করা হলো:
▪️ রমাদান পর মুসলিমের করনীয়:
____________________________________
(১).কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইবাদত চালিয়ে যাওয়া:
প্রিয় পাঠক! ইবাদতের পথ কখনো থামে না; এটি মৃত্যুর সীমানা পর্যন্ত চলমান। সুতরাং ইবাদত শুধু রমাদানের জন্য নয়, বরং মৃত্যু পর্যন্ত মুমিনের জীবনজুড়ে অব্যাহত থাকা উচিত। আল্লাহ বলেন,«وَ اعۡبُدۡ رَبَّكَ حَتّٰی یَاۡتِیَكَ الۡیَقِیۡنُ”তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত করো মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত।(সূরা হিজর, ১৫ আয়াত: ৯৯)
.
(২).রমাদানের শিক্ষা অব্যাহত রাখা: রমাদান আমাদের আত্মসংযম এবং ত্যাগের শিক্ষা দেয়। তাই রমাদানের পরও তার শিক্ষা অব্যাহত রাখা উচিত। যেমন নিয়মিত ফরজ নফল ইবাদত করা, অন্তরকে হিংসা বিদ্বেষ মুক্ত রাখা,সামর্থ্য অনুযায়ী দান সদকা করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করা হলো,আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় ‘আমল কী? তিনি বললেনঃ যে ‘আমল সদাসর্বদা নিয়মিত করা হয়।যদিও বা তা পরিমাণে কম হয়।’’(সহীহ বুখারী হা/৬৪৬৫; সহীহ মুসলিম হা/৭৮৩)
.
(৩). ফরজের পাশাপাশি তাহাজ্জুদ ও নফল নামাজের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া: রমাদান শেষে আমাদের তাহাজ্জুদ নামাজ ও অন্যান্য নফল ইবাদত চালিয়ে যাওয়া উচিত, যাতে আমরা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি। কেননা তাহাজ্জুদ নামাজ নফসের প্ররোচনায় গুনাহ সংঘটিত হতে বাধা দানকারী: আল্লাহ বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই রাত্রিজাগরণ প্রবৃত্তি দমনে অত্যন্ত কার্যকর।’’(সূরা মুযযাম্মিল, আয়াত: ৬) এমনকি এটি জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম উপায়”(তিরমিযি হা/২৪৮৫; ইবনু মাজাহ, হা/১৩৩৪)
.
(৬).নিয়মিত কুর’আন তেলাওয়াত করা: “কুরআন তেলাওয়াত কখনোই পরিত্যাগ করা উচিত নয়। যারা শুধুমাত্র রমজান মাসে কুরআন তেলাওয়াত করেন এবং বাকি সময় তা পরিত্যাগ করেন, তাদের প্রতি এমন আচরণ ঠিক নয়। নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ রাসূল ﷺ বলেছেন, «أهل الْقُرْآنَ هُمْ أَهْلُ اللهِ،وَخَاصَّته.»কুরআন তেলাওয়াতকারীরা আল্লাহর পরিজন এবং তাঁর বিশেষ বান্দা।'(মুসনাদ আহমদ হা/১২২৯২) আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন, «یٰیَحۡیٰی خُذِ الۡكِتٰبَ بِقُوَّةٍ”হে ইয়াহইয়া, তুমি কিতাবটি দৃঢ়তার সাথে ধারণ করো।”(সূরা মারিয়াম: ১২) আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন,إِنِّي لَأَسْتَحْيِي أَلَّا أَنْظُرَ كُلَّ يَوْمٍ فِي عَهْدِ رَبِّي مَرَّةً ‘প্রতিদিন একবার হ’লেও আমার রবের প্রতিশ্রুতি (কুরআনের) দিকে একবার নযর না বুলানোকে আমি খুই লজ্জাবোধ করি”।(তাফসীরে কুরতুবী; খণ্ড: ১;
পৃষ্ঠা: ২৮) ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:فَإِنَّ الَّذِي يُدَاوِمُ عَلَى ذَلِكَ (القُرْآنِ) يَذِلُّ لَهُ لِسَانُهُ وَيَسْهُلُ عَلَيْهِ قِرَاءَتُهُ، فَإِذَا هَجَرَهُ ثَقُلَتْ عَلَيْهِ القِرَاءَةُ وَشَقَّتْ عَلَيْهِ، ‘যে ব্যক্তি এই কুরআন নিয়মিত তেলাওয়াত করবে, এর জন্য তার জিব্বা নমনীয় হবে এবং তেলাওয়াত তার জন্য সহজ হয়ে যাবে। আর যখন সে কুরআন পরিত্যাগ করবে তখন এর তেলাওয়াত তার কাছে ভারী ও কঠিন হয়ে যাবে”।(ফাৎহুল বারী; খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ৭৯)
.
(৪).বেশি বেশি দু’আ করা: মুমিন রমজানের পরও আল্লাহর কাছে সুন্দর এবং কল্যানকর জীবনযাপনের জন্য দু’আ করে, কারণ একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহেই যাবতীয় বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। কুরআনে বলা হয়েছে:”হে আমাদের রব! হিদায়াত দেওয়ার পর আমাদের অন্তরকে বিভ্রান্ত করবেন না এবং আপনার পক্ষ থেকে করুণা দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি মহাদাতা।”(আল ইমরান ৩:৮) মুমিনের জীবনের যাবতীয় দুশ্চিন্তা দূর করার শ্রেষ্ঠ উপায় দু’আ। রাসূল (ﷺ) বলেন:”আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিষয় হলো দু’আ।” (ইবনে মাজাহ, হা/৩৮২৯; হাসান)
.
(৫).হালাল উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করা: হালাল উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাপূর্ণ। এটি শুধু ব্যক্তিগত শান্তি ও সন্তুষ্টির কারণ নয়, বরং এটি সমাজের কল্যাণেও অবদান রাখে। তাছাড়া হাদিসে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হারাম উপার্জন বা খাদ্য গ্রহণকারী ব্যক্তির দোয়া কবুল হয় না। রাসূল (ﷺ) বলেছেন:”এক ব্যক্তি দীর্ঘ ভ্রমণে ধুলিমলিন অবস্থায় হাত উঠিয়ে দোয়া করে বলে, ‘হে প্রভু, হে প্রভু,’ অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় হারাম এবং তার আহার্য হারাম, ফলে কেমন করে তার দোয়া কবুল হতে পারে?”(সহীহ মুসলিম: ১০১৫)
.
(৬).বেশি বেশি নফল সিয়াম পালন করা: নফল সিয়াম পালন করা একটি মহৎ ইবাদত, যা আত্মশুদ্ধি, তাক্বওয়া ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। এই আমল শুধু পাপ মোচনই করে না, বরং আখিরাতের জন্য অফুরন্ত সওয়াবের ভান্ডারও তৈরি করে। তাই নিয়মিত নফল রোজার অভ্যাস গড়ে তুলতে ছোট থেকে শুরু করুন, যেমন: প্রথমেই রমাদানের কাযা সিয়াম থাকলে আগে সেগুলো রাখুন, তারপর সপ্তাহে একদিন, তারপর ধীরে ধীরে বাড়ান। যেমন প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার, প্রতি আরবি মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তিনটি সিয়াম, আশুরার সিয়াম,শাওয়াল মাসের ৬ টি সিয়াম, আরাফার সিয়াম ইত্যাদি। রাসূল ﷺ বলেছেন: যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একদিন রোজা রাখে, আল্লাহ তা’আলা তাকে জাহান্নাম থেকে সত্তর বছরের দূরত্বে সরিয়ে দেন।”(সহীহ মুসলিম,হা/১১৫৩)
.
রমাদান শেষে মুসলিমদের জন্য কিছু কাজ বর্জনীয় যা তাদের ঈমান ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। রমাদান পর মুসলিমদের বর্জনীয় কিছু কাজ:
_______________________________________
(১).ফরজ আমল ত্যাগ করা এবং নিষিদ্ধ কাজে যুক্ত হওয়া:
কোনো অবস্থাতেই ফরজ আমল ত্যাগ করা এবং হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া যাবে না। কারণ,এ দুটোই মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতার মূল ভিত্তি।” সুতরাং শরীয়ত বিরোধী কোন কাজে যুক্ত হওয়ার পূর্বে মাথায় রাখতে হবে আল্লাহ সবকিছু দেখছেন এবং তার নিয়জিত ফেরেশতারা লিখছেন। একদিন সবকিছুর হিসাবে দিতে হবে।(দেখুন সূরা আহকাফ: ১৮; তিরমিজি হা/২৪১৯ সিলসিলা সহিহাহ হা/ ৯৪৬)
.
(২).নফসের আবেগের কাছে আত্মসমর্পণ করা:
.
রমাদান মাস আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি ও তাক্বওয়ার প্রশিক্ষণের এক মহান সুযোগ। এ মাসে মুসলিমরা নিজেদের নফসের খেয়াল-খুশি ও কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষা গ্রহণ করে। কিন্তু রমাদানের পর যদি কেউ আবার নফসের দাসত্বে ফিরে যায়, তবে সে রমযানের মূল শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। প্রকৃত বিজয় সেই ব্যক্তি অর্জন করে, যে রমাদানের পরও নফসের আবেগ ও কুপ্রবৃত্তির কাছে আত্মসমর্পণ না করে, বরং তাক্বওয়ার ওপর অটল থাকে। আল্লাহ বলেন:قَدۡ اَفۡلَحَ مَنۡ زَكّٰىهَا ۪ۙ”সফল সেই ব্যক্তি, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করলো।” (সূরা আশ-শামস: ৯) রমাদানের প্রকৃত সার্থকতা তখনই, যখন তা আমাদের জীবনে স্থায়ী পরিবর্তন আনে, আমাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে এবং নফসের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে।
.
(৩). গান বাজনা নাটক সিনেমা দেখা:
.
মিউজিক বাজানো ও শোনা, অশ্লীল নাটক সিনেমা দেখা হারাম হওয়ার ব্যাপারে ‘আলিমদের মধ্যে কোনো মতদ্বৈধতা নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ ‘আর মানুষের মধ্যে থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা ক্রয় করে। আর তারা এগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে। তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাজনক আযাব”(লুক্বমান, ৩১/৬)।উক্ত আয়াতে লাহওয়াল হাদীস বলতে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘ঐ সত্তার কসম, যিনি ছাড়া প্রকৃত কোনো মা‘বূদ নেই! নিশ্চয়ই এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো গান’। তিনি একথাটি তিনবার বলেন।(ইবনুল ক্বাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ, ইগাসাতুল লাহফান, ১/২৫৮-২৫৯) আবূ ‘আমির কিংবা আবূ মালিক আশ’আরী (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি নাবী ﷺ কে বলতে শুনেছেন, لَيَكُونَنَّ مِنْ أُمَّتِي أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّونَ الحِرَ، وَالحَرِيرَ، وَالخَمْرَ، وَالمَعَازِفَ “আমার উম্মাতের মধ্যে অবশ্যই এমন কতগুলো দলের সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশমী কাপড়, মদ ও মা‘আযিফকে (বাদ্যযন্ত্র) হালাল বলে বিশ্বাস করবে।” [সাহীহ বুখারী, হা/৫৫৯০] মা‘আযিফ হলো বাদ্যযন্ত্র, যা দিয়ে গান বাজানো হয়। যেমন: বীণা, বাঁশি, তবলা, তাম্বুরা, ক্লাইনেট, মন্দিরা প্রভৃতি।
.
(৪).অতি গর্ব ও অহংকার করা:
.
রমাদান ছিল আত্মশুদ্ধি ও সংযমের মাস, যেখানে বিনয় ও নম্রতা অর্জনের শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু রমাদানের পর যদি কেউ গর্ব ও অহংকারে মত্ত হয়, তবে তা রমাদানের মূল শিক্ষা ও ইসলামের আদর্শের বিপরীত। প্রকৃত মুত্তাকি সেই ব্যক্তি, যিনি রমাদানের পরও বিনয় ধরে রাখেন এবং নিজের অর্জনকে আল্লাহর দান হিসেবে দেখেন, অহংকারের উপলক্ষ হিসেবে নয়। কেননা অহংকার হলো পতনের মূল। রাসূল ﷺ বলেছেন,”ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে।(মুসলিম হা/৯১; মিশকাত হা/৫১০৮) শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,التَّكَبُّرُ شَرٌّ مِنَ الشِّرْكِ فَإِنَّ الْمُتَكَبِّرَ يَتَكَبَّرُ عَنْ عِبَادَةِ اللهِ تَعَالَى، وَالْمُشْرِكَ يَعْبُدُ اللهَ وَغَيْرَهُ.”অহংকার শিরকের চেয়েও নিকৃষ্ট। কেননা অহংকারী ব্যক্তি আল্লাহর দাসত্বের বিরুদ্ধে অহংকার করে। আর মুশরিক আল্লাহর ইবাদত করে এবং সাথে অন্যেরও করে”।(ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন; ২/৩১৬)
.
(৫).ধূমপান/মাদকে আসক্ত হওয়া:
রামাদান সংযম ও আত্মশুদ্ধির মাস। এটি শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার সময় নয়; বরং আত্মগঠনের এক সুবর্ণ সুযোগ। যারা ধূমপান বা মাদকাসক্তি ত্যাগ করতে চান, তাদের জন্য রামাদান হতে পারে এক নতুন সূচনা।এই মাসে সারাদিন ধূমপান থেকে বিরত থাকাই প্রমাণ করে যে, আপনি চাইলেই ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তাই রামাদানের সুযোগ নিয়ে ধাপে ধাপে ধূমপানের পরিমাণ কমিয়ে আনুন এবং ধৈর্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একসময় সম্পূর্ণরূপে তা পরিত্যাগ করুন। রমাদান শেষে যেন আবার পুরোনো অভ্যাসে ফিরে না যান, সেজন্য খাবারের পর সিগারেট বা মাদকের প্রলোভনকে প্রশ্রয় দেবেন না। মনে রাখবেন, আপনার শরীর ও মন উভয়ের সুস্থতার জন্য এটি এক অনন্য সিদ্ধান্ত। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন, এবং এই পবিত্র মাসকে নিজের জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যম বানান। মনে রাখবেন সাধারণ দলিলপ্রমাণের ভিত্তিতে ধূমপান হারাম। এটি শারিরীক ও মানসিক উভয় দিক থেকেই ক্ষতিকর। আল্লাহ বলেন,«وَ لَا تُلۡقُوۡا بِاَیۡدِیۡكُمۡ اِلَی التَّهۡلُكَةِ”স্বহস্তে নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না”।(সূরা বাকারা২ আয়াত:১৯৫)
.
(৬).গুনাতে লিপ্ত হওয়া আর বলা ঈমান হচ্ছে অন্তরে:
.
এই কথাটি কিছু অশিক্ষিত ও ভ্রান্ত যুক্তিদাতা লোকেরা বেশি বলে থাকে। এই সত্য কথাটি বলে বাতিলকে উদ্দেশ্য করা হয়। কেননা এই কথা উদ্ধৃতকারী ব্যক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজের পাপের পক্ষে সাফাই গাওয়া। কেননা সে দাবী করে যে, নেক আমল করা ও পাপ ত্যাগ করার পরিবর্তে অন্তরের ঈমানই যথেষ্ট। এটি সুস্পষ্ট ভ্রান্ত যুক্তি। কেননা ঈমান শুধু অন্তরে নয়। বরঞ্চ ঈমান যেমনটি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আলেমগণ সংজ্ঞা দেন: মুখের কথা, অন্তরের বিশ্বাস ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কর্ম। ইমাম হাসান আল-বসরী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: ঈমান বাহ্যিক বেশভুষা কিংবা অলীক চিন্তা নয়; বরং ঈমান হলো যা অন্তরে স্থির হয়েছে এবং কর্ম সেটাকে সত্যে পরিণত করেছে। পাপে লিপ্ত হওয়া ও নেক আমল বর্জন করা প্রমাণ করে যে, অন্তরে ঈমান নেই কিংবা রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ ঈমান। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা সুদ ভক্ষণ করো না।”[সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩০] এবং তিনি বলেন: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করো, তার নৈকট্যলাভের উপায় অন্বেষণ করো এবং তাঁর পথে জিহাদ করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।”[সূরা মায়িদা, আয়াত: ৩৫] এবং তিনি আরও বলেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহ্র প্রতি ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান এনেছে এবং সৎ কর্ম করেছে।”(সূরা মায়িদা,আয়াত: ৬৯)
.
(৭).গীবত, পরনিন্দা করা, দোষচর্চা করা:
গীবত করা শুধু একটি নৈতিক দোষ নয়,গীবত একটি ভয়াবহ পাপ। সমাজে যেসব পাপের প্রচলন সবচেয়ে বেশী তন্মধ্যে গীবত অন্যতম। এই পাপটি নীরব ঘাতকের মতো। বান্দার অজান্তেই এটা তার নেকীর ভান্ডার নিঃশেষ করে দেয় এবং তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করে ছাড়ে। এটি চুরি-ডাকাতি, সূদ-ঘুষ, যিনা-ব্যভিচার ও মরা মানুষের পঁচা গোশত খাওয়ার চেয়েও মারাত্মক ও নিকৃষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেন,”তোমাদের কেউ কি চাইবে যে, সে তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাবে? তোমরা তো এটাকে ঘৃণাই করো!” (সূরা আল-হুজুরাত: ১২) রাসূল ﷺ বলেন:বান্দা কখনো আল্লাহর অসন্তুষ্টিমূলক এমন কথা বলে ফেলে, যার গুরুত্ব সে নিজেও উপলব্ধি করতে পারে না। অথচ এ কারণে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে”।(সহীহ বুখারী হা/৬৪৭৮; মিশকাত হা/৪৮১৩)তাই আসুন, আমরা গীবত থেকে বিরত থাকি এবং আমাদের জিহ্বাকে কল্যাণমুখী করে তুলি।
.
পরিশেষে, হে আমার প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোনেরা! আপনার উদাসীনতা ঝেড়ে ফেলুন, গাফিলতির ঘুম থেকে জেগে উঠুন। দুনিয়ার মোহ আপনাকে ভুলিয়ে রাখার আগেই পথের পাথেয় সংগ্রহ করুন। অনন্ত জীবনের সে দীর্ঘ সফরের জন্য প্রস্তুত হোন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দিকে ফিরে আসুন, তাঁর করুণা ও ক্ষমার দ্বারস্থ হোন। হতে পারে, আপনি তাঁর ডাকে সাড়া পাবেন, তাঁর অশেষ রহমতের ছায়ায় আশ্রয় পাবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর রহমত লাভ করে, সেই-ই প্রকৃত সৌভাগ্যবান। ইমাম ইবনু রজব হাম্বলি (রাহিমাহুল্লাহ), বলেন, রামাদানের বিদায়ে মুমিনের চোখ কীভাবে অশ্রুসিক্ত হয় না অথচ সে জানে না যে, তার জীবনে রামাদান আবার ফিরে আসবে কি না!’ (ইমাম ইবনু রজব হাম্বলি (রাহিমাহুল্লাহ) লাতাইফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা: ২১৭)।
.
ইবনু রজব হাম্বলী (রাহিমাহুল্লাহ) আরো বলেন, ‘ঈদ ওই ব্যক্তির জন্য নয় যে নতুন পোশাক পরিধান করে; বরং ঈদ ওই ব্যক্তির জন্য যে তার আনুগত্য বৃদ্ধি করে। ঈদ ওই ব্যক্তির জন্য নয় যে নতুন পোশাকের সাজসজ্জা ও গাড়ি বহর প্রদর্শন করে; বরং ঈদ ওই ব্যক্তির জন্য যার পাপ মোচন করা হয়েছে।’ (ইবনে রজব হাম্বলী (রাহিমাহুল্লাহ) লাত্বায়েফুল মাআরেফ, পৃষ্ঠা: ২৭৭)। সুফিয়ান সাওরী (রাহিমাহুল্লাহ) -এর কতিপয় সাথী বলেন, আমি ঈদের দিন (ঈদের) সর্বপ্রথম শুরু করব চোখ নিম্নগামী করার মাধ্যমে। (ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ) আত্ব-তাবছিরা, পৃ. ১০৬) আল্লাহ আমাদের সকলকে তোওফিক দান করুন, আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
________________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।