যে ব্যক্তি ষাট বছর বয়সে পৌঁছে গেল আল্লাহ্ তার বয়সের ওযর পেশ করার সুযোগ রাখেননি হাদীসটির ব্যাখ্যা

প্রশ্ন: রাসূল (ﷺ) বলেন: “যে ব্যক্তি ষাট বছর বয়সে পৌঁছে গেল, আল্লাহ্ তার বয়সের ওযর পেশ করার সুযোগ রাখেননি”।(সহীহ বুখারী) হাদীসটির ব্যাখ্যা কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর: আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,أَعْذَرَ اللهُ إِلَى امْرِئٍ أَخَّرَ أَجَلَهُ حَتَّى بَلَّغَهُ سِتِّينَ سَنَةً تَابَعَهُ أَبُو حَازِمٍ وَابْنُ عَجْلاَنَ عَنْ الْمَقْبُرِيِّ.”আল্লাহ্ যার আয়ু দীর্ঘ করেছেন, এমনকি তাকে ষাট বছরে পৌঁছে দিয়েছেন তার ওযর পেশ করার সুযোগ রাখেননি।(সহীহ বুখারী হা/৬৪১৯)
.
উক্ত হাদীস এনে ইমাম বুখারী (রহঃ) সহীহ বুখারী একটি অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন এভাবে:بَاب مَنْ بَلَغَ سِتِّينَ سَنَةً فَقَدْ أَعْذَرَ اللهُ إِلَيْهِ فِي الْعُمُرِ لِقَوْلِهِ “যে ব্যক্তি ষাট বছর বয়সে পৌঁছে গেল, আল্লাহ্ তার বয়সের ওযর পেশ করার সুযোগ রাখেননি”।(সহীহ বুখারী অধ্যায়:৮১/৫) অতঃপর কুরআনের আয়াত উল্লেখ করেছেন:(أَوَلَمْ نُعَمِّرْكُمْ مَا يَتَذَكَّرُ فِيهِ مَنْ تَذَكَّرَ وَجَاءَكُمُ النَّذِيرُ)আমি কি তোমাদেরকে এতটা বয়স দেইনি যে, তখন কেউ নাসীহাত গ্রহণ করতে চাইলে নাসীহাত গ্রহণ করতে পারতে? আর তোমাদের কাছে সতর্ককারীও এসেছিল…..। (সূরাহ ফাতির ৩৫/৩৭)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:

قال المؤلف – رحمه الله تعالى – فيما نقله عن أبي هريرة – رضي الله عنه – أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: « أعذر الله تعالى إلى امرئ أخَّرَ أجله حتى بلغ ستينَ سنةً». والمعنى أن الله – عزَّ وجلَّ – إذا عمر الإنسان حتى بلغ ستين سنة فقد أقام عليه الحجة، ونفى عنه العذر؛ لأنَّ ستين سنة يبقي الله الإنسان إليها؛ يعرف من آيات الله ما يعرف، ولاسيما إذا كان ناشئًا في بلد إسلامي، لا شك أن هذا يؤدي إلى قطع حجته إذا لاقى الله – عزَّ وجلَّ – لأنه لا عذر له، فلو أنه مثلًا قصر في عمره إلى خمس عشرة سنة، أو عشرين سنة، لكان قد يكون له عذر في أنه لم يتمهل ولم يتدبر الآيات، ولكنه إذا أبقاه إلى ستين سنة، فإنه لا عذر له، قد قامت عليه الحجة، مع أن الحجة تقوم على الإنسان من حين أن يبلغ، فإنه يدخل في التكليف ولا يعذر بالجهل، فإن الواجب على المرء أن يتعلم من شريعة الله ما يحتاج إليه، مثلًا: إذا أراد أن يتوضأ لابد أن يعرف كيف يتوضأ، إذا أراد أن يصلي لابد أن يعرف كيف يصلي، إذا صار عنده مال لابد أن يعرف ما مقدار النصاب، وما مقدار الواجب، وما أشبه ذلك، إذا أراد أن يصوم، لابد أن يعرف كيف يصوم، وما هي المفطرات، وإذا أراد أن يحج أو يعتمر يجب أن يعرف كيف يحج، وكيف يعتمر، وما هي محظورات الإحرام، إذا كان من الباعة الذين يبيعون ويشترون بالذهب مثلًا، لابد أن يعرف الربا، وأقسام الربا، وما الواجب في بيع الذهب بالذهب، أو بيع الذهب بالفضة، وهكذا إذا كان ممن يبيع الطعام، لابد أن يعرف كيف يبيع الطعام، ولابد أن يعرف ما هو الغش الذي يمكن أن يكون، وهكذا.

والمهم أن الإنسان إذا بلغ الستين سنة فقد قامت عليه الحجة التامة، وليس له عذر، وكل إنسان بحسبه، كل إنسان يجب عليه أن يتعلم من الشريعة ما يحتاج، إليه، في الصلاة والزكاة والصيام والحج والبيوع والأوقاف وغيرها، حسب ما يحتاج إليه.

وفي هذا الحديث دليل على أن الله – سبحانه وتعالى – له الحجة على عباده وذلك أن الله أعطاهم عقولًا، وأعطاهم أفهامًا، وأرسل إليهم رسلًا، وجعل من الرسالات ما هو خالد إلي يوم القيامة، وهي رسالة النبي صلى الله عليه وسلم فإن الرسالات السابقة محدودة، حيث إن نبي يبعث إلى قومه خاصة، ومحدودة في الزمن؛ حيث إن كل رسول يأتي بنسخ ما قبله، إذا كانت الأمة التي أرسل إليها الرسولان واحدة.

أما هذه الأمة فقد أرسل الله إليها محمدًا صلى الله عليه وسلم، وجعله خاتم الأنبياء، وجعل آيته العظيمة الباقية هذا القرآن العظيم، فإن آيات الأنبياء تموت بموتهم، ولا تبقى بعد موتهم إلا ذكرى، أما محمد صلى الله عليه وسلم فإن آيته هذا القرآن العظيم، باقية إلى يوم القيامة، كما قال تعالى: ﴿ وَقَالُوا لَوْلَا أُنْزِلَ عَلَيْهِ آيَاتٌ مِنْ رَبِّهِ قُلْ إِنَّمَا الْآيَاتُ عِنْدَ اللَّهِ وَإِنَّمَا أَنَا نَذِيرٌ مُبِينٌ * أَوَلَمْ يَكْفِهِمْ أَنَّا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ يُتْلَى عَلَيْهِمْ … ﴾ [العنكبوت: 50، 51]، فالكتاب كاف عن كل آية لمن تدبره، وتعقله، وعرف معانيه، وانتفع بأخباره، واتعظ بقصصه، فإنه يغني عن كل شيء من الآيات.

لكن الذي يجعلنا نحس بهذه الآيات العظيمة، أننا لا نقرأ القرآن على وجه نتدبره، ونتعظ بما فيه. كثير من المسلمين – إن لم يكن أكثر المسلمين – يَتْلونَ الكتابَ للتبرك والأجر فقط، ولكن الذي يجب أن يكون هو أن نقرأ القرآن لنتدبره ونتعظ بما فيه، ﴿ كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ ﴾، هذا الأجر ﴿ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ ﴾ هذه هي الثمرة، ﴿ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ ﴾

“লেখক (রহিমাহুল্লাহ) তার গ্রন্থে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিস উল্লেখ করেছেন, যেখানে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আল্লাহ্‌ তাআলা তার সেই বান্দার প্রতি সম্পূর্ণ অজুহাত তুলে দিয়েছেন, যার আয়ু ৬০ বছরে পৌঁছে গিয়েছে।” এখানে অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যদি একজন ব্যক্তিকে দীর্ঘ আয়ু দান করেন এবং তাকে ৬০ বছর পর্যন্ত জীবিত রাখেন, তবে তার জন্য আর কোনো অজুহাত অবশিষ্ট থাকে না। কারণ এত দীর্ঘ সময় আল্লাহর নিদর্শনগুলো দেখে বোঝার এবং তার বিধানসমূহ শেখার জন্য যথেষ্ট। বিশেষ করে যদি সেই ব্যক্তি ইসলামি পরিবেশে বেড়ে ওঠে, তবে অবশ্যই তার পক্ষে কোনো অজুহাত দেখানো সম্ভব নয় যখন সে আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে। যদি কোনো ব্যক্তির জীবন ১৫ বা ২০ বছরেই শেষ হয়ে যায়, তবে সে অজুহাত করতে পারে যে, তার কাছে পর্যাপ্ত সময় ছিল না আয়াতগুলো গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করার বা দিকনির্দেশনা শেখার। কিন্তু ৬০ বছর পর্যন্ত আয়ু লাভ করলে কোনো অজুহাত অবশিষ্ট থাকে না। তাছাড়া, মানুষের উপর দায়িত্ব (তাকলিফ) সেই মুহূর্তেই শুরু হয়ে যায়, যখন সে বালেগ হয়। তখন তার অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ প্রত্যেকের উপর দায়িত্ব বর্তায় শারিয়তের এমন জ্ঞান অর্জন করা, যা তার জন্য প্রয়োজনীয়। যেমন: ওজু করার প্রক্রিয়া জানা।নামাজের পদ্ধতি জানা।সম্পদের ক্ষেত্রে জাকাত, নিসাব ও দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত হওয়া।রোজার সঠিক নিয়ম ও কী কী রোজা ভঙ্গ করে, তা জানা।হজ বা উমরাহ করতে চাইলে এর পদ্ধতি ও ইহরামের নিষিদ্ধ কাজগুলো সম্পর্কে জানা।যদি কেউ স্বর্ণ বা রুপার ব্যবসা করে, তবে রিবা (সুদ)-এর প্রকারভেদ ও তা থেকে বাঁচার উপায় জানতে হবে। তেমনিভাবে যারা খাবার-দ্রব্য কেনাবেচা করে, তাদেরও জানতে হবে যে, কীভাবে সঠিকভাবে ব্যবসা করতে হয় এবং ধোঁকাবাজি এড়াতে হয়। এভাবে ইসলামি বিধান শেখা প্রত্যেকের জন্য তার প্রয়োজন অনুযায়ী অবশ্য কর্তব্য।
.
মানুষ যখন ষাট বছর বয়সে পৌঁছে যায়, তখন তার উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ণ দলিল প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এরপর তার আর কোনো অজুহাত থাকতে পারে না। প্রতিটি মানুষের জন্য তার সামর্থ্য, অবস্থান অনুসারে শরীয়তের প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করা বাধ্যতামূলক। যেমন: নামাজ, যাকাত, রোজা, হজ্ব, ক্রয়-বিক্রয়, ওয়াকফ ইত্যাদি এসব বিষয়ে তার যা জানা দরকার তা শেখা ফরজ। এই হাদিস থেকে প্রমাণ হয় যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর বান্দাদের উপর হক প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি তাদের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি দিয়েছেন, তাদের মধ্যে নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং এমন একটি দ্বীন দিয়েছেন যা কিয়ামত পর্যন্ত অটল থাকবে। এটা হল প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেরিত দ্বীন। পূর্ববর্তী বার্তাগুলো নির্দিষ্ট জাতি এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল। একজন নবী সাধারণত তার জাতির জন্য প্রেরিত হতেন এবং পরবর্তী নবী তার শরিয়ত রহিত করতেন। কিন্তু শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত হয়েছেন এবং তিনি শেষ নবী। তাঁর মহান নির্ধারণযোগ্য অলৌকিক নিদর্শন হল এই কুরআন, যা কিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। আগের নবীদের অলৌকিক নিদর্শনগুলো তাদের মৃত্যুর সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যেত। তবে প্রিয় নবীর অলৌকিক নিদর্শন এই কুরআন কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে। আল্লাহ তাআলা বলেন:আর তারা বলে, ‘তার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে নিদর্শনসমূহ নাযিল হয় না কেন’? বল, ‘নিদর্শনসমূহ তো আল্লাহর কাছে, আর আমি তো কেবল একজন প্রকাশ্য সতর্ককারী’।এটা কি তাদের জন্য যথেষ্ট (নিদর্শন) নয় যে, আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যা তাদের সম্মুখে পাঠ করা হয়?”(সূরা আনকাবূত: ৫০-৫১) এই কুরআন এমন নিদর্শন, যা যারা তা অনুধাবন করে, বোঝে, ও চিন্তা-ভাবনা করে, তাদের জন্য অন্যান্য সব নিদর্শনের চেয়ে যথেষ্ট। তবে, আমাদের জন্য সমস্যা হল, আমরা কুরআন পড়ি কিন্তু তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করি না এবং এর শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনে প্রয়োগ করি না। অধিকাংশ মুসলমান কুরআন তিলাওয়াত করেন কেবল বরকত ও সাওয়াব লাভের জন্য। অথচ মূল উদ্দেশ্য হল কুরআন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং তার আদেশ-নির্দেশগুলো বাস্তবায়ন করা। আল্লাহ তাআলা বলেন: “এটা এক কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যা বরকতময়, যাতে তারা তার আয়াতসমূহ নিয়ে চিন্তা করে এবং বুদ্ধিমান লোকেরা এতে উপদেশ গ্রহণ করে।” (সূরা সোয়াদ: ২৯) সুতরাং কুরআন পাঠের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো তার অর্থ ও নির্দেশগুলো গভীরভাবে বোঝা এবং সেগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে জীবনের প্রতিটি স্তরে তা কার্যকর করা। আল্লাহ আমাদের কুরআনের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করুন এবং তাতে আমল করার তাওফিক দিন”।(ইবনু উসাইমিন,শারহু রিয়াদিস সালিহিন (রিয়াদ: দারুল ওয়াতান, প্রকাশের ক্রমধারাবিহীন, ১৪২৬ হি.), খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ১৪০-১৪৩) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
____________________________
✍️জুয়েল মাহমুদ সালাফি

Share: