যেসব বিদআতি দলের সঙ্গে সালাফি আক্বীদায় মৌলিক মতভেদ রয়েছে তাদের সঙ্গে কি কুফর ও শিরকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া বৈধ

প্রশ্ন: যেসব বিদআতি দলের সঙ্গে সালাফি আক্বীদায় মৌলিক মতভেদ রয়েছে, তাদের সঙ্গে কি কুফর ও শিরকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
প্রথমত: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর সালাফি আকীদার বিরোধী বিদআতি দলগুলোর সঙ্গে কুফর ও শিরকের বিরুদ্ধে যৌথভাবে লড়াই করা কি শরীয়ত সম্মত কিনা এই প্রশ্নটি ফিকহ ও আক্বীদা দুটির সমন্বয়ে গঠিত একটি স্পর্শকাতর ইস্যু। এর উত্তর নির্ভর করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার ওপর। সালাফদের মানহাজের আলোকে প্রকৃত ঐক্যের ভিত্তি একমাত্র কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ। বিশুদ্ধ আকীদা ও খাঁটি তাওহীদের ভিত্তি ছাড়া মুসলিমদের মাঝে স্থায়ী ও কল্যাণকর ঐক্য কখনোই গড়ে উঠতে পারে না। কেননা তাওহিদ ও সুন্নাহ-ই হল সেই মূল উৎস যা মানুষের হৃদয়গুলোকে একত্রিত করে এবং আল্লাহর রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে। পক্ষান্তরে শির্ক ও বিদআত মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর গজব ও শাস্তির দরজা খুলে দেয়। অতএব তাওহিদ ও সুন্নাহ ছাড়া যে কোনো ধরনের ঐক্য ক্ষণস্থায়ী, ভঙ্গুর ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির দিকে ধাবিত হতে বাধ্য। কিছু আলিম বলেন: দ্বীনের ক্ষেত্রে একতা (ঐক্য) বলতে বোঝায়, ‘দ্বীনের ওপর মানুষের একতাবদ্ধ হওয়া, যে ঐক্য কোন নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে না।’ এর মানদণ্ড হচ্ছে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবিবর্গের আদর্শের ওপর ঐক্যবদ্ধ হওয়া। যে ব্যক্তি সেই আদর্শের ওপর বহাল থাকবে, সে ব্যক্তি যে জায়গা কিংবা যে ভূখণ্ডেই থাকুক না কেন, সে ঐক্যবদ্ধ মুসলিম দলের সাথে রয়েছে বলেই বিবেচিত হবে। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন, وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا “তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিভক্ত হয়ো না।” [সুরা আলে ইমরান: ১০৩] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي ‘‘আমার উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। শুধু একটি দল ছাড়া সবগুলো জাহান্নামে যাবে। সাহাবিগণ বললেন,”হে আল্লাহর রসুল, সে দল কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘আমি ও আমার সাহাবিরা যে আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত (তার ওপর যারা প্রতিষ্ঠিত থাকবে)”। [সুনানে তিরমিজি হা/২৬৪১; সনদ: হাসান] আবু দাউদের বর্ণনায় রয়েছে, هِيَ الْجَمَاعَةُ “ঐক্যবদ্ধ জামাতটিই সেই দল।”(আবু দাউদ হা: ৪৫৯৭; সনদ: হাসান] ইবনু মাজাহর বর্ণনায় এসেছে, قِيلَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ مَنْ هُمْ؟ قَالَ : الْجَمَاعَةُ “বলা হলো, হে আল্লাহর রসুল, কোন দলটি মুক্তিপ্রাপ্ত? তিনি বললেন, ঐক্যবদ্ধ দলটি।” [ইবনু মাজাহ, হা: ৩৯৯২; সনদ: সহিহ] দ্বীনের ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ দলের মানদণ্ড এটাই। আমাদের দ্বীনের ক্ষেত্রে আমাদেরকে জামাতবদ্ধভাবে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই ঐক্যবদ্ধ দলের মানদণ্ড ও স্বরূপ হচ্ছে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবিবর্গের আদর্শকে ধারণ করা। যে ব্যক্তি সেই আদর্শের ওপর বহাল থাকবে, সে এই ঐক্যবদ্ধ দলের একজন হিসেবে পরিগণিত হবে। আর যে ব্যক্তি সেই আদর্শের বিরোধিতা করবে, সে ঐক্যবদ্ধ দল থেকে বের হয়ে যাবে। যদিও ফের্কাবাজ লোকেরা নিজেদেরকে ‘জামাত (ঐক্যবদ্ধ দল)’ বলে অভিহিত করে, তবুও তাদের দলটি সঠিক শরয়ি দ্বীনী দল হিসেবে বিবেচ্য নয়।
.

দ্বিতীয়ত: আমরা যদিও বিদ‘আতী ও ভ্রান্ত মতাবলম্বীদের পরিহার করা এবং তাদের বাতিল আক্বীদা প্রত্যাখ্যান করা অপরিহার্য বলে বিশ্বাস করি, তবুও নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত আলিমদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে আমরা দেখতে পাই যে, এই বিষয়টি যেমন জিহাদ ও ইসলামী রাজনীতির অন্যান্য বহু বিষয় মাসলাহাত নিশ্চিত করণ ও মাফসাদাতের মূল উৎপাটনের উপর নির্ভরশীল। যদি জিহাদের কোনো ক্ষেত্রে বিদ‘আতীদের সাথে সহযোগিতা করার প্রয়োজন দেখা দেয় এবং তা আমাদের আক্বীদার মৌলিক নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, তাহলে তাদের সহায়তা নেওয়াতে কোনো আপত্তি নেই। কারণ আমাদের মহান শরী‘আতের লক্ষ্য হলো মাসলাহাত অর্জন ও পূর্ণতা দেওয়া এবং মাফসাদাত দূর করা বা কমিয়ে আনা। তাই যখন উচ্চতর মাসলাহাত অর্জন নিম্নতর মাফসাদাত সহ্য ছাড়া সম্ভব না হয়, তখন সেই মাফসাদাত গ্রহণ করা জায়েয।এই বিষয় আমাদের ইমাম হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] গুরুত্বপূর্ণ কিছু মূলনীতি উল্লেখ করেছেন তিনি বলেন: “যখন দুটি ওয়াজিব (আবশ্যক) কাজ একত্রিত হয়, যা একসাথে পালন করা সম্ভব নয়, তখন অধিক গুরুত্বপূর্ণটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এ অবস্থায় অন্যটি (দ্বিতীয় কাজটি) প্রকৃতপক্ষে ওয়াজিব থাকে না এবং অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজটি পালনের জন্য যারা অন্যটি ছেড়ে দেয়, তারা প্রকৃতপক্ষে কোনো ওয়াজিব ত্যাগকারী গণ্য হয় না। একইভাবে, যদি দুটি হারাম নিষিদ্ধ) কাজ একত্রিত হয়, যেখানে বড় হারামটি ত্যাগ করার জন্য ছোট হারামটি করতে হয়, তখন সেই অবস্থায় ছোট হারামটি করা প্রকৃতঅর্থে হারাম গণ্য হয় না। যদিও সাধারণভাবে একে ‘ওয়াজিব ত্যাগ করা’ বা ‘হারাম কাজ করা’ বলা হয়, তবুও এতে সমস্যা নেই। এ ধরনের ক্ষেত্রে বলা হয়:ওয়াজিব কাজ ত্যাগ করা হয়েছে কোনো ওজরের কারণে’ এবং ‘হারাম কাজ করা হয়েছে প্রাধিক্যপূর্ণ (مصلحة) মাসলাহাতের বা (ضرورة) প্রয়োজনীয়তার কারণে, অথবা অপেক্ষাকৃত বড় হারাম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য’ কম হারাম কাজ করা। এটি সেই ব্যক্তির মতো, যে নামাজের সময় ঘুমিয়ে থাকার কারণে বা ভুলে যাওয়ার কারণে পরে তা আদায় করে। নবী (ﷺ) বলেছেন:”যে ব্যক্তি সালাতের সময় ঘুমিয়ে থাকে বা ভুলে যায়, সে যেন স্মরণ হওয়ার পরই তা আদায় করে। কারণ, সেই সময়টিই তার জন্য নির্ধারিত। এ ছাড়া এর কোন কাফফারা নেই। এই পরস্পরবিরোধী অবস্থার নিয়ম একটি অত্যন্ত বিস্তৃত বিষয়, বিশেষ করে এমন সময় ও স্থানে যেখানে নবুয়তের প্রভাব কমে গেছে এবং খিলাফতের যুগের নীতিমালা অনুপস্থিত। সেখানে এ ধরনের সমস্যা বেশি দেখা দেয়। যত নেতিবাচক পরিবেশ বৃদ্ধি পাবে, ততই এ ধরনের জটিল প্রশ্নের সংখ্যা বাড়বে।এসব অবস্থা উম্মতের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যখন ভালো ও মন্দ কাজ একসাথে মিশে যায় তখন বিভ্রান্তি ও জটিলতা তৈরি হয়। কেউ কেউ শুধু ভাল দিক দেখে একপক্ষকে সমর্থন করে এমনকি যদি তা বড় ধরনের মন্দও বয়ে আনে। আবার কেউ কেউ শুধু খারাপ দিক দেখে অন্যপক্ষকে সমর্থন করে এমনকি যদি তা অনেক বড় ভাল কাজ ত্যাগ করতে হয়। মধ্যপন্থীরা যারা উভয় দিক বিবেচনা করে, তাদের অনেকের কাছেই মন্দ-কল্যাণকর সঠিক পরিমাণ স্পষ্ট হয় না। অথবা স্পষ্ট হলেও তারা এমন কাউকে পায় না যারা ভাল কাজ করতে ও মন্দ কাজ ত্যাগ করতে সাহায্য করতে পারে। কারণ, এখানে ব্যক্তিগত রুচি ও মতামত জড়িয়ে যায়। এজন্য আলেমদের উচিত এ ধরনের পরিস্থিতি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা। কোন কোন ক্ষেত্রে করণীয় হল যেমন আগে ব্যাখ্যা করেছি কোন কিছু আদেশ বা নিষেধ করার সময় ক্ষমা প্রদর্শন করা, এর অর্থ এ নয় যে তা সম্পূর্ণ হালাল বা বাতিল করে দেওয়া। যেমন যদি কোন নির্দেশ দেওয়ার মাধ্যমে বড় গুনাহ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে সেই নির্দেশ না দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ কোন অপরাধীকে এমন শাসকের কাছে সোপর্দ করা, যে তাকে তার অপরাধের চেয়েও বেশি কঠোর শাস্তি দেবে। অথবা কোন মন্দ কাজ নিষেধ করতে গিয়ে যদি বড় ধরনের ভাল কাজ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সেই নিষেধ থেকে বিরত থাকা। যাতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাদ না পড়ে।

সুতরাং আলেম কখনো আদেশ দেবেন, কখনো নিষেধ করবেন, কখনো অনুমতি দেবেন, আবার কখনো আদেশ-নিষেধ বা অনুমতি দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। যেমন খাঁটি বা প্রাধিক্যপূর্ণ কল্যাণের জন্য আদেশ দেওয়া। খাঁটি বা প্রাধিক্যপূর্ণ অকল্যাণের জন্য নিষেধ করা। আর পরস্পরবিরোধী অবস্থায়, সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে প্রাধিক্যপূর্ণ দিককে অগ্রাধিকার দেওয়া যেমন আগে বলা হয়েছে।কিন্তু যদি আদেশপ্রাপ্ত বা নিষেধপ্রাপ্ত ব্যক্তি সম্ভাব্যতার সীমা মানতে না চায় হয় অজ্ঞতার কারণে, নয়তো জুলুমের কারণে এবং তার অজ্ঞতা বা জুলুম দূর করা সম্ভব না হয় তখন উত্তম পন্থা হলো তাকে আদেশ বা নিষেধ না করে চুপ থাকা। যেমন বলা হয় কিছু প্রশ্নের উত্তর হল নীরবতা। রাসূল (ﷺ) ও প্রথম দিকে কিছু বিষয়ে আদেশ-নিষেধ থেকে নীরব থাকতেন, যতক্ষণ না ইসলাম শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত হয়। একইভাবে আলেমও বক্তব্য ও প্রচারের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা বা ঘোষণা পরবর্তী সময়ের জন্য স্থগিত রাখতে পারেন, যখন তা বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি হবে। যেমন আল্লাহ তাআলা কিছু আয়াত ও বিধান রাসূল (ﷺ)-এর সামর্থ্য অনুযায়ী ধাপে ধাপে নাযিল করেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রকৃত অবস্থা হলো, আল্লাহ বলেন:”আমি কখনো শাস্তি দেই না, যতক্ষণ না রাসূল প্রেরণ করি।”(সূরা ইসরা: ১৫) বান্দার উপর দলিল প্রতিষ্ঠিত হয় দুটি বিষয়ের মাধ্যমে: (১).আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তা বুঝা বা জানার সামর্থ্য থাকা। (২).তা পালন করার শক্তি থাকা। যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনে অক্ষম (যেমন পাগল), অথবা আমল করতে অক্ষম, তার উপর কোনো আদেশ বা নিষেধ প্রযোজ্য নয়।যখন দ্বীনের কোনো অংশ জানার সুযোগ থাকে না, অথবা তা পালনে অক্ষমতা দেখা দেয়, তখন সেই ব্যক্তির জন্য যে জ্ঞান বা আমল টিতে অক্ষম তা ঐ ব্যক্তির মতোই, যে পুরো দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ বা পুরো দ্বীন পালনে অক্ষম (যেমন পাগল)। এগুলো হল সেই সময়, যখন দ্বীনের প্রচার দুর্বল হয়ে পড়ে। যখন আলেম, শাসক বা উভয়ের সমন্বয়ে কেউ দ্বীন প্রতিষ্ঠা করে, তখন রাসূল (সা.)-এর বানী ধাপে ধাপে প্রকাশ করা হয়।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ২০; পৃষ্ঠা: ৫৭-৫৯)
.

তৃতীয়ত: আমাদের অনেক ইমাম মুশরিকদের সহায়তা নেওয়াকে জায়েয বলেছেন, যদি জিহাদের প্রয়োজনে তা প্রয়োজন হয় এবং তারা মুসলিমদের প্রতি বিশ্বস্ত ও সুধারণা পোষণ করে। যেমন ইমাম শাফি‘ঈ (রহ.)-এর মত এবং ইমাম আহমাদ (রহ.) থেকে একটি বর্ণনা।(আল-মুগনী: খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ৪৪৭, কাশশাফ আল-কিনা‘: খণ্ড: ৪; পৃষ্টা: ১২৮৭, তাকমিলাত আল-মাজমূ‘ শরহ আল-মুহাযযাব: খণ্ড: ১৯; পৃষ্ঠা: ২৮০) তাদের দলীলসমূহের মধ্যে রয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুনাইনের যুদ্ধে সাফওয়ান ইবনু উমাইয়্যাহ (তখনো তিনি মুশরিক ছিলেন) এর থেকে বর্ম ধার নিয়েছিলেন।(আবু দাউদ: হা/৩৫৬২, ইমাম আলবানী হাদীসটি সহীহ বলেছে) তারা অপর বর্ননা: “ফিরে যাও, আমি কোনো মুশরিকের সাহায্য নেব না”(সহিহ মুসলিম:হা/ ১৮১৭) এই হাদীসটিকে এমন অবস্থার সাথে খাপ খাইয়েছেন যখন তাদের সাহায্যের প্রয়োজন নেই অথবা তারা বিশ্বস্ত নয়। এখন যদি মুশরিকদের সাথে সহযোগিতার ব্যাপারটি এমন হয়, তাহলে যারা বিদ‘আতী কিন্তু সামগ্রিকভাবে মুশরিকদের চেয়ে আমাদের নিকটতর তাদের ব্যাপারে কী বলা যাবে?
.

বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়েই সংক্ষিপ্তভাবে বললে: আমাদের পূর্বসূরি ন্যায়পরায়ণ ইমামগণ যাঁদের পথই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের পথ একটি সর্বজনস্বীকৃত নীতির উপর সুদৃঢ় ছিলেন: বিদ‘আতিদের সঙ্গে উঠাবসা, মেলামেশা বা চলাফেরা করা যাবে না। এটি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মৌলিক আক্বীদাহর অন্যতম ভিত্তি। এই বিষয়ে আহলুস সুন্নাহর এক মহান ইমাম, শাইখুল ইসলাম, হাফিয আবূ ‘আব্দুল্লাহ আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃত্যু: ২৪১ হি.) স্পষ্ট ভাষায় বলেন:أصول السنة عندنا: ترك الخصومات والجلوس مع أصحاب الأهواء.“আমাদের নিকট সুন্নাহর মূলনীতি হচ্ছে তর্ক-বিতর্ক পরিহার করা এবং বিদ‘আতপন্থীদের সঙ্গে বসা-বসতি এড়িয়ে চলা।”(উসূলুস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা: ৩; শারহু উসূলি ই‘তিক্বাদ আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, হাদীস নং ৩১৭, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ১৪৮) এই নীতিমালা কেবল ইমাম আহমাদের ব্যক্তিগত মত নয়, বরং এটি রাসূলুল্লাহ ﷺ, সাহাবায়ে কেরাম এবং তাঁদের অনুগামী সালাফে সালেহীনগণের সুস্পষ্ট মানহাজেরই অংশ। তবুও মুসলিম বিদআতি দলগুলোকে কাফেরের সঙ্গে তুলনা করার কোনো সুযোগ নেই। বরং একজন মুসলিম এমনকি খ্রিস্টান (আহলে কিতাব) বিজয়ী হলেও আনন্দিত হয়, যদি তার প্রতিপক্ষ হয়ে থাকে একজন অগ্নিপূজক (মাজুসী)। এই ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন: “রোমানরা পরাজিত হয়েছে (২), পৃথিবীর নিকটবর্তী স্থানে; কিন্তু তারা তাদের এই পরাজয়ের পর কয়েক বছরের মধ্যে আবার বিজয়ী হবে (৩)। সমস্ত ক্ষমতা আল্লাহর পরেও এবং আগেও। আর সেই দিন মুমিনরা আনন্দিত হবে”।[সূরা রূম: ২-৪]
.

হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন:لو كان المتنازعان مبطلين كأهل الكتاب والمشركين إذا تجادلوا أو تقاتلوا كان المشروع ‌نصر ‌أهل ‌الكتاب ‌على ‌المشركين بالقدر الذي يوافقهم عليه المؤمنون إذا لم يكن في ذلك مفسدة تقاوم هذه المصلحة فإن ذلك من الحق الذي يفرح به المؤمنون».”যদি পরস্পর বিরোধী দু’পক্ষই পথভ্রষ্ট হয়- যেমন আহলে কিতাব ও মুশরিকরা, তবে যখন তারা বিতর্কে বা যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন শরীয়তসম্মত বিধান হলো, মুমিনদের স্বার্থ অনুযায়ী আহলে কিতাবদের সমর্থন দেওয়া, যদি না এতে বড় কোন ক্ষতি হয়। কেননা এটা এমন এক সত্য, যা দেখে মুমিনেরা আনন্দিত হয়।[বায়ান তালবিস আল-জাহমিয়্যা ফি তা’সিসে বিদায়িহিম আল কালামিয়্যাহ; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১৯৫) তাই বিবেকবান ব্যক্তি কখনোই একজন মুসলিম বিদআতিকে ছেড়ে কাফেরকে সমর্থন দেয় না। এই বিষয়টিতেই এতটাই সুস্পষ্ট উপকারিতা ও ক্ষতির প্রতিরোধ রয়েছে, যা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ইবনু তাইমিয়া বলেন:ألا ترى أن أهل السنة وإن كانوا ‌يقولون ‌في ‌الخوارج والروافض وغيرهما من أهل البدع ما يقولون، لكن لا يعاونون الكفار على دينهم، ولا يختارون ظهور الكفر وأهله على ظهور بدعة دون ذلك».”তুমি কি দেখো না? আহলে সুন্নাহর লোকেরা, যদিও তারা খারিজি, রাফেজি ইত্যাদি বিদআতিদের সম্পর্কে কঠিন কথা বলেন, তবুও তারা কখনো কাফেরদেরকে দ্বীনের বিষয়ে সহযোগিতা করে না, বরং তারা চাই না যে কুফরের বিজয় হোক এমন বিদআতির ওপর, যাদের বিদআত কুফরের চেয়ে কম ক্ষতিকর।”(ইবনু তাইমিয়া মিনহাজুস সুন্নাহ: খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৩৭৫) বরং এমন বিদআতিদের সাহায্য করাই অধিক প্রাধান্য পায়, কারণ এতে অনেক কল্যাণ রয়েছে এবং অনেক ভুলে যাওয়া ফরজ বিষয় পুনরুজ্জীবিত হয়। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রহ.) বলেন:فإذا تعذر إقامة الواجبات من العلم والجهاد وغير ذلك إلا بمن فيه بدعة ‌مضرتها ‌دون ‌مضرة ترك ذلك الواجب: كان تحصيل مصلحة الواجب مع مفسدة مرجوحة معه خيرا من العكس».”যদি কোন ফরজ কাজ যেমন জ্ঞান অর্জন, জিহাদ ইত্যাদি কেবল এমন কারও মাধ্যমে সম্ভব হয়, যার মধ্যে বিদআত রয়েছে, তবে সেই ফরজ কাজ সম্পাদন করাই শ্রেয়, যদিও তার সাথে কিছু ক্ষুদ্র ক্ষতি জড়িত থাকে। কারণ, ফরজ আদায়ের মাধ্যমে অর্জিত উপকারিতা ক্ষুদ্র ক্ষতির তুলনায় অনেক বড়।”(মাজমূ’ আল-ফাতাওয়া; খণ্ড: ২৮; পৃষ্ঠা: ২১২)
.

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ)-কে এক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, ইহুদী ও নাসারাদের উপর রাফিযীদের (শিয়া) প্রাধান্য দেয়। তিনি উত্তরে বলেন: (كل من كان مؤمنا بما جاء به محمد صلى الله عليه وسلم فهو خير من كل من كفر به؛ وإن كان في المؤمن بذلك نوع من البدعة سواء كانت بدعة الخوارج والشيعة والمرجئة والقدرية أو غيرهم؛ فإن اليهود والنصارى كفار كفراً معلوماً بالاضطرار من دين الإسلام. والمبتدع إذا كان يحسب أنه موافق للرسول صلى الله عليه وسلم لا مخالف له لم يكن كافرا به؛ ولو قدر أنه يكفر فليس كفره مثل كفر من كذَّب الرسول صلى الله عليه وسلم).“যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তা বিশ্বাস করে, সে ঐ সমস্ত লোকের চেয়ে উত্তম যারা তা মানে না যদিও ঐ মুমিনের মধ্যে কোনো বিদ‘আত থাকে; তা খাওয়ারিজ, শিয়া, মুরজি‘আ, ক্বাদারিয়্যাহ অথবা অন্যান্যদের বিদ‘আতই হোক না কেন। কারণ ইহুদী ও নাসারারা এমন কাফির যাদের কুফরী ইসলামী শরী‘আতের দৃষ্টিতে সুবিদিত। পক্ষান্তরে একজন বিদআতি যদি মনে করে যে, সে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসারী, বিরোধী নয়, তাহলে সে কাফির নয়। এমনকি যদি ধরে নেওয়া হয় যে, সে কাফির, তবুও তার কুফরী ঐ ব্যক্তির কুফরীর মতো নয় যে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মিথ্যা সাব্যস্ত করে।(মাজমূ‘ আল-ফাতাওয়া: খণ্ড: ৩৫; পৃষ্ঠা: ২০১) বরং আল্লাহ সর্বজ্ঞ আমরা এমনকি কাফিরদের কোনো গোষ্ঠীর সাথে ঐসব কাফিরদের বিরুদ্ধে সহযোগিতা করতে পারি যারা ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য অধিকতর ক্ষতিকর, শর্ত থাকে যে, মুসলিমরা তাদের দ্বীনের মধ্যে কোন রকম ছাড় দেবে না বা কুফরীর প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করবে না। যেমন হাদীসে এসেছে: “তোমরা রোমানদের সাথে নিরাপদ শান্তিচুক্তি করবে, অতঃপর তোমরা ও তারা পেছন থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে; ফলে তোমরা বিজয়ী হবে, গনীমত লাভ করবে এবং নিরাপদে ফিরে আসবে। এরপর তোমরা একটি টিলাবহুল মাঠে অবতরণ করবে। তখন একজন খ্রিস্টান ক্রুশ উত্তোলন করে বলবে: ‘ক্রুশ বিজয়ী হয়েছে!’ তখন এক মুসলিম ব্যক্তি ক্রুদ্ধ হয়ে তা ভেঙে ফেলবে। এরপর রোমানরা বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং মহাযুদ্ধের জন্য সমবেত হবে।”(আবু দাউদ: ৪২৯২, ইবন মাজাহ: ৪০৮৯, ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) সহীহ বলেছেন)।
.

এ কারণেই আমরা দেখি, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) এবং অন্যান্য আলিমগণ সুলতান মাহমুদ বিন সুবুক্তিকিন গজনভীর জিহাদের প্রশংসা করেছেন, যিনি ভারতের মূর্তিগুলো ধ্বংস করেছিলেন। যদিও অনেকের মতে তিনি কারামিয়া মতাদর্শের অনুসারী ছিলেন- যেমন ইমাম যাহাবী (রহ.) তার সিয়ার; খণ্ড: ১৭; পৃষ্ঠা: ৪৮৬) এবং ইবনে কাসীর [আল-বিদায়া-ওয়ান-নিহায়া; খণ্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ৩২) এ উল্লেখ করেছেন। কারামিয়ারা ছিল আব্দুল্লাহ বিন কারামের অনুসারী, একটি কালামী গোষ্ঠী যারা কিছু আকিদার ক্ষেত্রে সালাফদের মাযহাবের বিরোধী ছিল, বিশেষত ইমান সংক্রান্ত বিষয়ে তারা মুরজিয়া মত পোষণ করত। তবুও সুলতান মাহমুদ গজনভী তার কারামী বিশ্বাস সত্ত্বেও ছিলেন আল্লাহর পথে একজন মুজাহিদ, ধার্মিক ও সৎ ব্যক্তি। তিনি রাফেযী ও জাহমিয়াদের বিদ‘আতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। এজন্যই শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) তার বিভিন্ন গ্রন্থে তার প্রশংসা করেছেন। যেমন তিনি তার মাজমুউ ফাতাওয়া-তে বলেন:ولما كانت مملكة محمود بن سُبُكتكين من أحسن ممالك بني جنسه كان الإسلام والسنة في مملكته أعز، فإنه غزا المشركين من أهل الهند، ونشر من العدل ما لم ينشره مثله، فكانت السنة في أيامه ظاهرة والبدع في أيامه مقموعة”যেহেতু মাহমুদ বিন সুবুক্তিকিনের রাজ্য তার সমকালীন অন্যান্য রাজ্যগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম ছিল, তাই তার রাজ্যে ইসলাম ও সুন্নাহ অধিক মর্যাদাপ্রাপ্ত ছিল। তিনি হিন্দুস্তানের মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন এবং এমন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা তার মতো অন্য কেউ করতে পারেনি। ফলে তার শাসনামলে সুন্নাহ ছিল প্রসারিত ও প্রকাশ্য, আর বিদআত ছিল দমনকৃত ও কোণঠাসা।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২২) এমনকি শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) নিজেও মামলুকদের পতাকাতলে তাতারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, যদিও মামলুকদের মধ্যে জুলুম ও সীমালঙ্ঘন ছিল, এমনকি কিছু আকিদাগত বিষয়ে তাদের সাথে তার মতবিরোধও ছিল। বস্তুত, তারা তাকে তার সালাফি আকিদার কারণে বহুবার কারাগারে বন্দী করেছিল। আধুনিক যুগেও আমরা দেখেছি, উম্মাহর বড় বড় আলিমগণ রা-শি-য়ার বিরুদ্ধে আ-ফ-গান জি-হা-দকে সমর্থন করেছিলেন, যদিও কিছু আ-ফ-গান মুজাহিদের মধ্যে বিদ‘আত ও শিরকী বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। শাইখ আব্দুল আযিয ইবনে বায (রাহিমাহুল্লাহ) যুবকদের আ-ফ-গানিস্তানে গিয়ে আ-ফ-গানদের জি-হা-দে অংশগ্রহণের পরামর্শ দিতেন, পাশাপাশি তাদেরকে সুন্নাহ শেখাতে এবং বিদ‘আত থেকে সতর্ক করতেন। সর্বোপরি শরীয়তের মূলনীতি হল যখন বৃহত্তর কল্যাণ অর্জনের জন্য ছোটখাটো অসুবিধা সহ্য করা প্রয়োজন হয়, তখন তা জায়েয। তবে এ ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যেন দ্বীনের মৌলিক নীতির সাথে আপোস না হয়। আল্লাহ আমাদের সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে অটল থাকার তৌফিক দান করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: শাইখ নাসরুল্লাহ আল মাদানী (হাফি.) অনার্স, মাদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব।

Share: