যার মাঝে পাঁচটি গুণ থাকবে সে জান্নাতে যাবে এই হাদীসটির ব্যাখ্যা

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর হাদীসে এসেছে,আবূ সাঈদ খুদরী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছেন, خَمْسٌ مَنْ عَمِلَهُنَّ فِيْ يَوْمٍ كَتَبَهُ اللهُ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ مَنْ عَادَ مَرِيْضًا وَشَهِدَ جَنَازَةً وَصَامَ يَوْمًا وَرَاحَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَأَعْتَقَ رَقَبَةً “যে ব্যক্তি এক দিনে পাঁচটি আমল করবে আল্লাহ তাকে জান্নাতের অধিবাসী করবেন। যে অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যায়, কোন জানাযায় উপস্থিত হয়, এক দিন সিয়াম পালন করে, জুমার দিন আগে আগে মসজিদে যায় এবং ক্রীতদাস স্বাধীন করে দেয়” (সহীহ ইবনে হিব্বান হা/২৭৭১; সহীহুল জামে হা/৩২৫২: হাদীসটি সহীহ)।
.
উল্লেখিত হাদীসটি আবূ সাঈদ খুদরী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, যেখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পাঁচটি বিশেষ আমলের কথা উল্লেখ করেছেন, যেগুলো একজন ব্যক্তিকে জান্নাতের অধিবাসী হওয়ার কারণ করে দিতে পারে। এগুলোর ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:

১. অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া:

অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া (যাকে আরবিতে ইয়াদাতুল মারীধ বলা হয়) ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া তার প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করা এবং তার জন্য দোয়া করা। এটি মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি করে এবং ইহা অসুস্থ ব্যক্তির মনে শান্তি ও স্বস্তি দেয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যায়, আল্লাহর রহমত তার উপর নেমে আসে। রাসূল (ﷺ) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি রোগীকে দেখার জন্য যায়, আসমান থেকে একজন ফেরেশতা তাকে লক্ষ্য করে বলে, ধন্য তুমি, ধন্য হোক তোমার এ পথ চলা। জান্নাতে তুমি একটি গৃহ তৈরী করে নিলে”।(তিরমিযী হা/২০০৮; মিশকাত হা/৫০১৫; সহীহুত তারগীব হা/২৫৭৮)। তিনি আরো বলেন, ‘যে মুসলিম সকাল বেলায় কোন অসুস্থ মুসলিমকে দেখতে যায়, তার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত সত্তুর হাযার ফেরেশতা দো‘আ করতে থাকে। যদি সে তাকে সন্ধ্যায় দেখতে যায়, তার জন্য সত্তর হাযার ফেরেশতা সকাল পর্যন্ত দু‘আ করতে থাকে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান তৈরী হয়’ (তিরমিযী হা/৯৬৯)। তিনি বলেন, ‘কোন মুসলিম যখন তার অন্য কোন মুসলিম ভাইয়ের রোগের খবর জানার জন্য যায়, সে না ফেরা পর্যন্ত জান্নাতের খুরফার মধ্যে অবস্থান করে। জিজ্ঞাসা করা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল! খুরফাহ কী? তিনি বললেন, জান্নাতের ফল-পাড়া”(সহীহ মুসলিম হা/২৫৬৮; মিশকাত হা/১৫২৭)।
.
২. জানাযায় উপস্থিত হওয়া:
.
মুসলিম ভাইয়ের জানাযায় অংশগ্রহণ করা ইসলামের একটি বড় সুপারিশকৃত কাজ। জানাযায় অংশগ্রহণ কেবল মৃত ব্যক্তির জন্য নয়, জীবিত ব্যক্তিদের জন্যও শিক্ষণীয়। এটি মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং পরকালীন জীবনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার তাগিদ দেয়।
রাসূল (ﷺ) এরশাদ করেন ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় কোন জানাযায় শরীক হ’ল এবং দাফন শেষে ফিরে এলো, সে ব্যক্তি দুই ‘ক্বীরাত’ সমপরিমাণ নেকী পেল। প্রতি ‘ক্বীরাত’ ওহোদ পাহাড়ের সমতুল্য। আর যে ব্যক্তি কেবলমাত্র জানাযা পড়ে ফিরে এলো, সে এক ‘ক্বীরাত’ পরিমাণ নেকী পেল”।(মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৬৫১)।
.
৩. এক দিন সিয়াম পালন করা:
.
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন সিয়াম পালন (রোজা রাখা) জান্নাতের পথে একটি শক্তিশালী মাধ্যম। সিয়াম আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখায়, পাপ থেকে বাঁচায় এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গভীর করে।এটি রমজানের বাইরে নফল সিয়াম বা বিশেষ দিনগুলোর সিয়াম হতে পারে। রাসূল ﷺ বলেন,مَنْ صَامَ يَوْمًا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ بَعَّدَ اللهُ وَجْهَهُ عَنِ النَّارِ سَبْعِيْنَ خَرِيْفًا ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি ছিয়াম পালন করবে, আল্লাহ তার চেহারাকে জাহান্নামের আগুন হ’তে ৭০ বছরের পথ দূরে রাখবেন’। অন্য বর্ণনায় ১০০ বছরের পথ দূরে রাখবেন বলা হয়েছে” (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৯৫৫, ৪/২৫৩: সিলসিলা সহীহাহ হা/২২৬৭, ২৫৬৫) জেনে রাখা ভাল যে, শুধুমাত্র জুমআর দিন রোযা না রাখা মুস্তাহাব।কারন জুমার দিন হল মুসলিমদের সাপ্তাহিক ঈদ। তা ছাড়া এ দিন হল যিকর ও ইবাদতের দিন। তবে যদি কেউ জুমআর আগে একদিন অথবা পরে একদিন রোযা রাখে তাহলে কোন সমস্যা নেই।আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: “তোমাদের কেউ যেন জুমার দিন রোযা না রাখে। কিন্তু যদি জুমার দিনের আগে বা পরে একদিন রোযা রাখে তাহলে জুমার দিন রোযা রাখতে পারে।”(বুখারী হা/১৯৮৫ ও মুসলিমে হস/১১৪৪)
.
৪. জুমার দিন আগে আগে মসজিদে যাওয়া:

জুমার দিনের ফজিলত অনেক বেশি এবং এদিন মসজিদে আগে যাওয়া বিশেষ নেক আমল। এর মাধ্যমে মানুষ জুমার খুতবা মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারে এবং এ আমলের জন্য আল্লাহর কাছ থেকে বিশেষ প্রতিদান পাওয়া যায়।এ ব্যাপারে রাসূল ﷺ বলেন,”যে ব্যক্তি জুম‘আর দিন গোসল করে সুগন্ধি মেখে মসজিদে এল ও সাধ্যমত নফল সালাত আদায় করল। অতঃপর চুপচাপ ইমামের খুৎবা শ্রবণ করল ও জামা‘আতে সালাত আদায় করল, তার পরবর্তী জুম‘আ পর্যন্ত এবং আরও তিনদিনের গোনাহ মাফ করা হয়”।(বুখারী হা/৮৮৩; মিশকাত হা/১৩৮১)। তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি জুম‘আর দিন ভালভাবে গোসল করে। অতঃপর সকাল সকাল পায়ে হেঁটে মসজিদে যায় এবং (আগে ভাগে নফল সালাত শেষে) ইমামের কাছাকাছি বসে ও মনোযোগ দিয়ে খুৎবার শুরু থেকে শুনে এবং অনর্থক কিছু করে না, তার প্রতি পদক্ষেপে এক বছরের সিয়াম ও ক্বিয়ামের অর্থাৎ দিনের ছিয়াম ও রাতের বেলায় নফল সালাতের সমান নেকী হয়’ (আহমাদ হা/১৬২১৭; তিরমিযী হা/৪৯৬; মিশকাত হা/১৩৮৮)। তিনি আরও বলেন, “জুম‘আর দিন ফেরেশতাগণ মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন ও মুছল্লীদের নেকী লিখতে থাকেন। এদিন সকাল সকাল যারা আসে, তারা উট কুরবানীর সমান নেকী পায়। তার পরবর্তীগণ গরু কুরবানীর, তার পরবর্তীগণ ছাগল কুরবানীর, তার পরবর্তীগণ মুরগী কুরবানীর ও তার পরবর্তীগণ ডিম ছাদাক্বার সমান নেকী পায়। অতঃপর খত্বীব দাঁড়িয়ে গেলে ফেরেশতাগণ দফতর গুটিয়ে ফেলেন ও খুৎবা শুনতে থাকেন’ (সহীহ বুখারী হা/৮৮১, ৯২৯; মুসলিম হা/৮৫০; মিশকাত হা/১৩৮৪)।
.
৫. ক্রীতদাস স্বাধীন করা:

প্রাক ইসলামী যুগে দাস প্রথার প্রচলন ছিল। ইসলাম আগমনের পরে রাসূল (ﷺ) দাস প্রথাকে বিলুপ্ত না করলেও, বিভিন্নভাবে এই প্রথাকে নিরুৎসাহিত করেছেন এবং দাস মুক্ত করার ফযীলত বর্ণনা করেছেন। গোলাম আযাদ বা দাস মুক্ত করা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভের অন্যতম একটি মাধ্যম। এবং এটি মানুষের স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি,مَنْ أَعْتَقَ رَقَبَةً مُؤْمِنَةً، أَعْتَقَ اللهُ بِكُلِّ عُضْوٍ مِنْهُ عُضْوًا مِّنَ النَّارِ، حَتَّى يُعْتِقَ فَرْجَهُ بِفَرْجِهِ، ‘যে ব্যক্তি কোন মুমিন দাসকে আযাদ করবে, আল্লাহ তা‘আলা এর প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে আযাদকারীর প্রতিটি অঙ্গকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দিবেন। এমনকি এর (দাসের) লজ্জাস্থানের বিনিময়ে তার (মুক্তকারীর) লজ্জাস্থানকে মুক্তি দিবেন’।(মুসলিম হা/১৫০৯; তিরমিযী হা/১৫৪১; ইরওয়াউল গালীল হা/১৭৪২) অপর বর্ণনায় তিনি বলেন, مَنْ أَعْتَقَ رَقَبَةً مُؤْمِنَةً كَانَتْ فِدَاءَهُ مِنَ النَّارِ، ‘যে ব্যক্তি একজন মুমিন দাসকে আযাদ করে দিবে, এর বিনিময়ে তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করে দেওয়া হবে’(আবূদাঊদ হা/৩৯৬৬, সনদ সহীহ) যদিও বর্তমানে দাসপ্রথা নেই, তবে এর সমতুল্য আমল হতে পারে কারো ঋণমুক্তি বা কাউকে সাহায্য করা ইত্যাদি।
.
পরিশেষে, উপরোক্ত এই পাঁচটি আমল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং জান্নাতের অধিকারী হওয়ার বড় মাধ্যম। এগুলো একদিকে আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা প্রকাশ করে, অপরদিকে সামাজিক দায়িত্ব ও কল্যাণের প্রতিফলন ঘটায়। এই হাদীসের মাধ্যমে ইসলামের একটি মৌলিক শিক্ষা প্রতিফলিত হয় যে আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালনও গুরুত্বপূর্ণ। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: