প্রশ্ন: যদি মু’মিন জানত যে, আল্লাহর নিকট কী শাস্তি রয়েছে, তাহলে কেউ তার জান্নাতের আশা করত না। আর যদি কাফের জানত যে, আল্লাহর নিকট কী করুণা রয়েছে, তাহলে কেউ তার জান্নাত থেকে নিরাশ হত না। হাদীসটির বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: প্রখ্যাত সাহাবী আবূ হুরায়রা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ৫৯ হি.] থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “ لَوْ يَعْلَمُ الْمُؤْمِنُ مَا عِنْدَ اللَّهِ مِنَ الْعُقُوبَةِ مَا طَمِعَ فِي الْجَنَّةِ أَحَدٌ وَلَوْ يَعْلَمُ الْكَافِرُ مَا عِنْدَ اللَّهِ مِنَ الرَّحْمَةِ مَا قَنَطَ مِنَ الْجَنَّةِ أَحَدٌ ”‘‘যদি মু’মিন জানত যে, আল্লাহর নিকট কী শাস্তি রয়েছে, তাহলে কেউ তার জান্নাতের আশা করত না। আর যদি কাফের জানত যে, আল্লাহর নিকট কী করুণা রয়েছে, তাহলে কেউ তার জান্নাত থেকে নিরাশ হত না।’’(সহীহ মুসলিম ২৭৫৫, তিরমিযী ৩৫৪২, আহমাদ ৮২১০, ২৭৫০৬, ৯৯১০; রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ৪৪৮; ইবনু হিববান ৬৫৬, সহীহ ৩৩৭৯, মিশকাত হা/২৩৬৭) অপর বর্ননায় আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি। إِنَّ اللَّهَ خَلَقَ الرَّحْمَةَ يَوْمَ خَلَقَهَا مِائَةَ رَحْمَةٍ، فَأَمْسَكَ عِنْدَهُ تِسْعًا وَتِسْعِينَ رَحْمَةً، وَأَرْسَلَ فِي خَلْقِهِ كُلِّهِمْ رَحْمَةً وَاحِدَةً، فَلَوْ يَعْلَمُ الكَافِرُ بِكُلِّ الَّذِي عِنْدَ اللَّهِ مِنَ الرَّحْمَةِ، لَمْ يَيْئَسْ مِنَ الجَنَّةِ، وَلَوْ يَعْلَمُ المُؤْمِنُ بِكُلِّ الَّذِي عِنْدَ اللَّهِ مِنَ العَذَابِ، لَمْ يَأْمَنْ مِنَ النَّارِ “আল্লাহ্ যেদিন রহমত সৃষ্টি করেন সেদিন একশটি রহমত সৃষ্টি করেছেন। নিরানব্বইটি তাঁর কাছে রেখে দিয়েছেন এবং একটি রহমত সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে পাঠিয়ে দিয়েছেন। যদি কাফির আল্লাহ্র কাছে সুরক্ষিত রহমত সম্পর্কে জানে তাহলে সে জান্নাত লাভে নিরাশ হবে না। আর মু’মিন যদি আল্লাহ্র কাছে যে শাস্তি আছে সে সম্পর্কে জানে তা হলে সে জাহান্নাম থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করবে না।(সহিহ বুখারী হা/ ৬৪৬৯; আ:প্র: ৬০১৯, ই:ফা: ৬০২৫)
.
হাদীসটির সরল অর্থ হচ্ছে; যে মুমিনের জন্য জান্নাত নির্ধারিত হয়েছে সে যদি সত্যিকারভাবে জানে যে, আল্লাহর নিকট কাফির ও পথভ্রষ্টদের জন্য জাহান্নামের কী কঠিন শাস্তি ও মহা আযাব রয়েছে, তাহলে কাফির তো দূরের কথা কোন মু’মিনই জান্নাতে প্রবেশের আশা করত না। বরং তার আশা হবে শুধুমাত্র জাহান্নাম থেকে দূরে থাকা বা মুক্ত থাকা। কারণ জাহান্নামের শাস্তি ও আযাব এতোটাই কঠিন যে কোনো শরীরই তা সহ্য করার সামর্থ রাখে না। হাদীসের এ অংশে আল্লাহর শাস্তির আধিক্যতার বর্ণনা রয়েছে যাতে মু’মিন ব্যক্তি তার রবের আনুগত্যের কারণে বা তাঁর রহমাতের উপর নির্ভর করে ধোঁকায় না পড়ে ফলে নিজেকে নিরাপদ ভাববে অথচ আল্লাহর কৌশল থেকে একমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় ছাড়া কেউ নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারে না। অপরদিকে তার বিপরীতে যদি কোন কাফের জানে যে পরম দয়ালু ও মহিমান্বিত আল্লাহর নিকট কী রহমত ও করুণা ও রয়েছে, তাহলে সেও তার রহমত থেকে নিরাশ হতো না বরং আল্লাহর রহমতের ব্যাপকতা এবং তিনি যে মহা ক্ষমাশীল তা জেনে জান্নাতে প্রবেশের আশা করতো। সুতরাং অত্র হাদীস দ্বারা বুঝা গেল যে আল্লাহর রহমত ও শাস্তির অবস্থা মানুষের পক্ষে আশা ও নিরাশার মধ্যাবস্থায় থাকাই উচিত। নবীগণ, আলেমসমাজ ও তাকওয়াবান লোকেরা ভয় ও আশা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করেছেন এবং তাদের ইবাদতের মধ্যে আল্লাহর ভালবাসাও থাকে। সুতরাং যে ব্যক্তি এ তিনটির কোন একটিকে ধারণ করে আল্লাহর ইবাদত করবে সে বিদআতী; এ অবস্থা তাকে কুফুরীর দিকেও নিয়ে যেতে পারে। ফেরেশতা, নবী ও নেককার লোকদের দোয়াকালীন অবস্থা উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন: “তারা যাদেরকে ডাকে তারাই তো তাদের রবের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে কত নিকটতর হতে পারে, আর তারা তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে।”[সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ৫৭] আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: “তারা সৎকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ত, আর তারা আগ্রহ ও ভীতির সাথে আমাকে ডাকত এবং তারা ছিল আমার কাছে ভীত-অবনত।”[সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৯০] আয়াতের তাফসিরে ইবনে জারীর তাবারী বলেন: ويعنى بقوله : ( رَغَباً ) : أنهم كانوا يعبدونه رغبة منهم فيما يرجون منه ، من رحمته ، وفضله .( وَرَهَباً ) : يعني : رهبة منهم ، من عذابه ، وعقابه ، بتركهم عبادته ، وركوبهم معصيته .وبنحو الذي قلنا في ذلك قال أهل التأويل .“আগ্রহ” এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- তারা তাঁর ইবাদত করত তাঁর রহমত ও অনুগ্রহ পাওয়ার আশা আগ্রহ নিয়ে। “ভীতির সাথে” অর্থাৎ তাঁর ইবাদত বর্জন ও নিষেধ লঙ্ঘন করত না তাঁর শাস্তির ভয়ে। আমরা যে তাফসির করেছি এ তাফসির অপরাপর তাফসিরকারকগণ উল্লেখ করেছেন।(তাফসিরে তাবারী; খন্ড: ১৮; পৃষ্ঠা: ৫২১) সুতরাং হাদীসটির সারাংশ হল, নিশ্চয়ই বান্দার উচিত হবে আল্লাহর সৌন্দর্যমণ্ডিত গুণাবলী গবেষণার মাধ্যমে এবং কঠোরতা গুণাবলী পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আশা এবং ভয়ের মাঝে অবস্থান করা। কেবল আশাহীন ভয়ের মধ্যে থাকাই নিরাশা ও হতাশা। আল্লাহ বলেন,إِنَّهُ لَا يَيْئَسُ مِنْ رَّوْحِ اللهِ إِلاَّ الْقَوْمُ الْكَافِرُوْنَ. ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত থেকে কেউ নিরাশ হয় না অবিশ্বাসী (কাফের) সম্প্রদায় ব্যতীত” (সূরা ইউসুফ ১২/৮৭)। আল্লাহ আরো বলেন, وَمَنْ يَّقْنَطُ مِنْ رَّحْمَةِ رَبِّهِ إِلَّا الضَّالُّوْنَ.”পথভ্রষ্টরা ব্যতীত তার প্রতিপালকের অনুগ্রহ হতে কে হতাশ হয়? (সূরা হিজর: ১৫/৫৬)।
.
যে ব্যক্তি ভয় ও আশা ব্যতীত শুধু ভালবাসা থেকে আল্লাহর ইবাদত করতে চায় তার দ্বীনদারি আশংকাজনক অবস্থায় আছে। সে ব্যক্তি চরম পর্যায়ের বিদআতী। এমনকি সে মুসলিম মিল্লাত থেকেও বেরিয়ে যেতে পারে। বড় বড় ইসলামবিদ্বেষীরা বলত: আমরা ভালবাসা থেকে আল্লাহর ইবাদত করি। যদি এটি আমাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে যায় তবুও!! তাদের কেউ কেউ বিশ্বাস করত নিছক ভালবাসার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। এদিক থেকে এটি ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বিশ্বাসের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন: “ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা বলে, আমরা আল্লাহর সন্তান ও তাঁর প্রিয়জন। আপনি বলুন, তবে তিনি তোমাদেরকে পাপের বিনিময়ে শাস্তি দিবেন কেন? বরং তোমার অন্যান্য সৃষ্ট মানবের অন্তর্ভুক্ত সাধারণ মানুষ। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি প্রদান করেন। নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে, তাতে আল্লাহরই আধিপত্য রয়েছে এবং তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে।”।[সূরা মায়িদা, আয়াত: ১৮] ইমাম তকি উদ্দিন সুবকি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:وأما هذا الشخص الذي جرد وصف المحبة ، وعبد الله بها وحدها : فقد ربا بجهله على هذا ، واعتقد أن له منزلة عند الله رفَعته عن حضيض العبودية ، وضآلتها ، وحقارة نفسه الخسيسة ، وذلتها ، إلى أوج المحبة ، كأنه آمِنٌ على نفسه ، وآخذٌ عهداً من ربِّه أنَّه من المقربين ، فضلاً عن أصحاب اليمين ، كلا بل هو في أسفل السافلين .فالواجب على العبد : سلوك الأدب مع الله ، وتضاؤله بين يديه ، واحتقاره نفسه ، واستصغاره إياها ، والخوف من عذاب الله ، وعدم الأمن من مكر الله ، ورجاء فضل الله ، واستعانته به ، واستعانته على نفسه ، ويقول بعد اجتهاده في العبادة : ” ما عبدناك حق عبادتك ” ، ويعترف بالتقصير ، ويستغفر عقيب الصلوات ، إشارة إلى ما حصل منه من التقصير في العبادة ، وفي الأسحار ، إشارة إلى ما حصل منه من التقصير ، وقد قام طول الليل ، فكيف من لم يقم؟! “পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি শুধু ভালবাসা থেকে আল্লাহর ইবাদত করে তার অজ্ঞতা এর চেয়ে বেশি। সে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর কাছে তার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। এর মাধ্যমে সে দাসত্বের দুর্বলতা, নিকৃষ্টতা ও জিল্লতি থেকে ভালবাসার শীর্ষে উন্নীত হয়েছে। যেন সে নিজের ব্যাপারে নিরাপদ। যেন সে তার রবের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়েছে যে, সে শুধু ডানপন্থী নয়; বরং মুকাররিবীন (নৈকট্যশীল) এর অন্তর্ভুক্ত। কক্ষনো নয়; বরং সে সর্বনিম্ন স্তরের একজন। বান্দার কর্তব্য হচ্ছে- আল্লাহর সাথে শিষ্টাচার রক্ষা করা, আল্লাহর সামনে নিজেকে তুচ্ছ, নগন্য ও ছোট মনে করা, আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করা। আল্লাহর প্রতিশোধ থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে না করা। আল্লাহর অনুগ্রহের আশা করা। তাঁর সাহায্য চাওয়া। নিজের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধেও আল্লাহর সাহায্য চাওয়া। অনেক চেষ্টা সাধনা করে ইবাদত করার পরেও এ কথা বলা যে, হে আল্লাহ! আপনার ইবাদত যথাযথভাবে আদায় করতে পারিনি। নিজের দুর্বলতার স্বীকারোক্তি দেয়া। নামাযে যেসব দুর্বলতা হয় সেগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে নামাযগুলোর শেষে ইস্তিগফার করা। শেষ রাতে দীর্ঘসময় ধরে কিয়ামুল লাইল আদায় করার পর এর মধ্যে যেসব ত্রুটি হয়েছে সেগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে ইস্তিগফার করা। আর যে ব্যক্তি আদৌ কিয়ামুল লাইল করেনি তার অবস্থা কেমন হওয়া চাই?!(ফাতাওয়াস সুবকি; খন্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৫৬০) ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:( وادعوه خوفاً وطمعاً ) أمر بأن يكون الإنسان في حالة ترقب ، وتخوف ، وتأميل لله عز وجل ، حتى يكون الرجاء والخوف للإنسان كالجناحين للطائر ، يحملانه في طريق استقامته ، وإن انفرد أحدهما : هلك الإنسان ، قال الله تعالى : ( نَبِّئْ عِبَادِي أَنِّي أَنَا الْغَفُورُ الرَّحِيمُ . وَأَنَّ عَذَابِي هُوَ الْعَذَابُ الْأَلِيمُ ) ) অর্থ- “ভয় ও আগ্রহ নিয়ে তাঁকে ডাক” (সূরা আরাফ: ৫৬) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন: আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন যেন মানুষ সতর্ক থাকে, ভীত থাকে এবং আল্লাহর প্রতি আশাবাদী থাকে। মানুষের মধ্যে ভয় ও আশা যেন একটি পাখির দুটো ডানার মতো। যে ডানাদ্বয় তাকে সরল পথে অবিচল রাখবে। যদি কেউ শুধু একটি ডানার উপর নির্ভর করে তাহলে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আপনি আমার বান্দাদেরকে জানিয়ে দিন যে, আমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু। এবং এটাও জানিয়ে দিন যে, আমার শাস্তি বড় যন্ত্রনাদায়ক। সূরা হিজর, আয়াত: ৪৯, ৫০; তাফসিরে কুরতুবী; খন্ড:৭; পৃষ্ঠা: ২২৭)
.
প্রশ্নে উল্লেখিত হাদীসটির ব্যাখ্যায় কারমানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
” والمقصود من الحديث: أن الشخص ينبغي أن يكون بين الخوف والرجاء؛ يعني لا يكون مفرطا في الرجاء بحيث يصير من الفرقة المرجئة – الذين يهونون من المعاصي ، ويجحدون بعض نصوص الوعيد بالعذاب -، ولا مفرطا في الخوف بحيث يصير من الوعيدية – الذين يقولون بتخليد المسلمين أصحاب المعاصي في النار -، بل يكون بينهما ، قال تعالى: ( وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ ). وكل من يتبع الملة الحنيفية السمحة السهلة: عرف أن قواعدها، أصولا وفروعا؛ كلها في الوسط ”
“হাদিস থেকে মূল উদ্দেশ্য হল: একজন ব্যক্তি ভয় এবং আশার মাঝে থাকা উচিত অর্থাৎ প্রত্যাশার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি না করা। এমনটি করলে মুর্জিয়ার অংশ তার মাঝে প্রবেশ করতে পারে। মুর্জিয়ারা পাপকে অবহেলা করে এবং আজাবের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে এমন কিছু নসকে অস্বীকার করে। আবার ভয়ের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করবে না কেননা আসে ওয়ায়ীদিয়াদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। তারা বলে মুসলমান ব্যক্তিরা যারা পাপ কাজ করে এরা জাহান্নামে চিরস্থায় থাকবে অথচ তাদের মাঝেই এই কাজগুলো রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর তারা তার দয়া প্রত্যাশা করে এবং তার শাস্তিকে ভয় করে”।(সূরা ইসরাইল: ৫৭) যারা হানাফী মাজহাবকে অনুসরণ করে তারা এর নিয়ম নীতি শাখা-প্রশাখা সবকিছু জানে যে এগুলো হল শৈথিল্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত”।(কাওয়াকিবুদ দারারি: ২২/২২৭)
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:
” ولهذا قال بعض السلف : من عبد الله بالحب وحده فهو زنديق ، ومن عبده بالخوف وحده فهو حروري [ الحرورية : هم الخوارج ] ، ومن عبده بالرجاء وحده فهو مرجىء ، ومن عبده بالحب والخوف والرجاء فهو مؤمن .
والمقصود : أن تجريد الحب والذكر عن الخوف يوقع في هذه المعاطب ؛ فإذا اقترن الخوف جمعه على الطريق ورده إليها ، كلما كَلَّها شيء [أي : أتعبها] ، كالخائف الذى معه سوط يضرب به مطيته لئلا تخرج عن الطريق ، والرجاء حاد يحدوها ، يطلب لها السير ، والحب قائدها وزمامها الذى يشوقها ؛ فإذا لم يكن للمطية سوط ولا عصا يردها إذا حادت عن الطريق : خرجت عن الطريق ، وضلت عنها .فما حفظت حدود الله ومحارمه ، ووصل الواصلون إليه بمثل خوفه ورجائه ومحبته ؛ فمتى خلا القلب من هذه الثلاث : فسد فسادا لا يرجى صلاحه أبدا . ومتى ضعف فيه شيء من هذه: ضعف إيمانه بحسبه ”
“কোন কোন সালাফ বলেছেন: যে ব্যক্তি শুধু ভালবাসার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করে সে নাস্তিক, আর যে ব্যক্তি শুধু ভয়ের মাধ্যমে ইবাদত করে, সে হল হারুরী [হারুরিয়্যাহ: তারা খারিজী], এবং যে শুধুমাত্র আশা নিয়ে তাঁর ইবাদত করে সে হল মুরজিয়া’। যে ব্যক্তি ভালবাসা, ভয় এবং আশা নিয়ে তাঁর ইবাদত করে সে মুমিন।
মূল উদ্দেশ্য হল: ভালবাসা এবং ভয়ের স্মরণ থেকে মুক্ত থাকা বিষয়টি মন্দ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যায়। যদি ভয় থাকে তাহলে রাস্তায় চলন্ত অবস্থায় কোন জিনিস দেখলে সেটাকে সে প্রতিহত করতে পারবে না। আর আশা এটি একটি ধারালো জিনিস যেটা তার গন্তব্য খোঁজে এবং ভালোবাসা সেটাকে পরিচালনা করে যা কোন তরবারি বা ধনুক সেটাকে তার রাস্তা থেকে সরাতে পারেনা ফলে সে বিপথগামী হয়ে যায় এবং হারাম কাজে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু যখন ভয় আশা ভালবাসা এই তিনটি বিষয়ে একসাথে জড়িত হবে তখন অন্তরটিতে খারাপ কাজের কোন আশ্রয় পাবে না। আর যখন এই তিনটি থেকে একটি মুক্ত হয়ে যাবে তখন তার অন্তরটা যেমন দুর্বল হবে খারাপ কাজ থেকে তেমনভাবে তার অন্তরকে সরাতে পারবে না। (ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ১৫ পৃষ্ঠা: ২১)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,
الواجب على المكلف ذكرا كان أو أنثى ألا ييأس، ولا يقنط ويدع العمل ، بل يكون بين الرجاء والخوف يخاف الله ، ويحذر المعاصي ، ويسارع في التوبة ، ويسأل الله العفو، ولا يأمن من مكر الله ويقيم على المعاصي ويتساهل ؛ ولكن يحذر معاصي الله ، ويخافه ولا يأمن ، بل يكون بين الخوف والرجاء ”
“মুকাল্লাফ ব্যক্তির উপর আবশ্যক হলো নিরাশ , হতাশা না হওয়া, আমল ছেড়ে না দেওয়া বরং সে আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভয়ের মাঝে আমল করবে, আল্লাহকে ভয় করবে, পাপ থেকে সাবধান থাকবে, তওবার ক্ষেত্রে দেরি করবে না, আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করবে। যারা আল্লাহর সাথে প্রতারণা করে তাদের থেকে বিরত থাকবে খারাপ কাজের উপর থাকবে না। আল্লাহর নাফরমানি মূলক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকবে তাকে ভয় করবে। (বিন বায; ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব: ৪/৩৮)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন;” إن غلب عليه الرجاء ؛ وقع في الأمن من مكر الله ، وإن غلب عليه الخوف ؛ وقع القنوط من رحمة الله ، وكلاهما من كبائر الذنوب ” .
“যদি তার উপর আশা প্রবল হয়, তাহলে সে আল্লাহর প্রতারণার নিরাপদের মাঝে পতিত হবে, অথবা তার কাছে ভয়টা যদি প্রবল হয়ে যায়, তাহলে সে আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে হতাশা হয়ে যাবে ।এই দুটোই হলো বড় পাপের অন্তর্ভুক্ত”। (লিকাউল বাবিল মাফতুহ: ৭/১১)
.
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) কে আরো জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন: আশা এবং ভয়ের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মতামত কী?
.
উত্তরে শাইখ বলেন: “মানুষ আশাকে ভয়ের উপর প্রাধান্য দিবে? না ভয়কে আশার ওপর? এ ব্যাপারে আলিমদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। ইমাম আহমাদ ইবন হান্বল রহ. বলেছেন, মানুষের নিকট আশা এবং ভয় সমান সমান হওয়া উচিৎ। একটিকে অন্যটির ওপর প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ নয়। তিনি আরো বলেন, একটি অন্যটির ওপর প্রাধান্য দিলে বিপথগামী হবে। কেননা আশাকে প্রাধান্য দিলে মানুষ আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করবে। আর ভয়কে প্রাধান্য দিলে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে পড়বে। কোনো কোন আলিম বলেন, সৎ আমলের ক্ষেত্রে আল্লাহর রহমত পাওয়ার আশাকে প্রাধান্য দিবে এবং পাপ কাজের প্রতি ধাবিত হওয়ার সময় আল্লাহর ভয়কে সামনে রাখবে। কেননা বান্দা আনুগত্যের কাজের দ্বারা আল্লাহর প্রতি ভালো ধারণা আবশ্যক হওয়ার কাজ করে থাকে। তাই আশার দিককে অর্থাৎ আমলটি প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ। আর মনের ভিতরে যদি পাপ কাজের ইচ্ছা জাগ্রত হয়, তখন আল্লাহর ভয়কে প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ। যাতে পাপ কাজে লিপ্ত না হয়। কিছু কিছু আলিম বলেছেন, সুস্থ ব্যক্তির ভয়কে প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ। আর অসুস্থ ব্যক্তির জন্য আশার আলো থাকা দরকার। কেননা সুস্থ ব্যক্তির নিকটে ভয় বেশি থাকলে পাপের কাজে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত থাকবে। আর রোগী ব্যক্তি আশাকে প্রাধান্য দিবে। কারণ, সে যদি আশাকে প্রাধান্য দেয়, তা হলে আল্লাহর সাথে ভালো ধারণা রাখা অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে। এ মাসআলাতে আমার কাছে গ্রহণ যোগ্য কথা হলো মানুষের অবস্থাভেদে হুকুম বিভিন্ন হবে। ভয়ের দিককে প্রাধান্য দিতে গেলে যদি আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হওয়ার আশঙ্ককা থাকে, তা হলে মন থেকে এ ধরণের ভয় দূর করে দিয়ে আশার দিককে স্থান দিবে। আর যদি আশঙ্ককা থাকে যে, আশার দিককে প্রাধান্য দিতে গেলে আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেকে মুক্ত ভাবার ভয় রয়েছে, তা হলে ভয়কেই প্রাধান্য দিবে। মানুষ তার অন্তরের ডাক্তার। যদি তার অন্তর জীবিত থাকে। আর যদি অন্তর মৃত হয়ে থাকে, তা হলে তার কোনো চিকিৎসা নেই”।(ইবনু উসাইমীন; ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম প্রশ্ন নং-২২)
.
মহান আল্লাহ আমাদেরকে আকীদা, আমল, কথা, দাওয়াত, চরিত্র ইত্যাদিসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রকৃত সালাফী ও আহলে হাদীস হওয়ার তৌফিক দান করুন এবং এই বিজয় কাফেলাকে সার্বিকভাবে সর্বত্র নিরাপত্তা দান করুন। আমীন!(আল্লাহই ভাল জানেন)। _______________________________
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তাদ ইব্রাহিম বিন হাসান (হাফি:) শিক্ষক, চর বাগডাঙ্গা সেরাজুল হুদা লতিফিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া ও হাফিজিয়া মাদরাসা চাঁপাইনবাবগঞ্জ।