প্রশ্ন: যদি আমি মসজিদে গিয়ে দেখি যে ইমাম ইতোমধ্যে রুকুতে চলে গেছেন, তাহলে আমি কীভাবে সালাতে অংশগ্রহণ করব? রুকুতে যাওয়ার সময় কি আমাকে তাকবিরে তাহরিমার পর আরও একটি তাকবির দিতে হবে?
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
প্রথমত: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। আমাদের নবী মুহাম্মদের প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের প্রতি আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর: প্রথমেই আমাদের জেনে রাখা আবশ্যক যে সালাতের ইক্বামত শুরু হয়ে গেলে তারাহুড়া করা যাবে না।বরং ধীরস্থির ও শান্তভাবে সালাতের দিকে গমন করতে হবে দৌঁড়ে সালাতে যাওয়া যাবে না।কেননা রাসূল (ﷺ) বলেছেন:إِذَا سَمِعْتُمُ الإِقَامَةَ فَامْشُوْا إِلَى الصَّلاَةِ، وَعَلَيْكُمْ بِالسَّكِينَةِ وَالْوَقَارِ وَلاَ تُسْرِعُوْا، فَمَا أَدْرَكْتُمْ فَصَلُّوْا وَمَا فَاتَكُمْ فَأَتِمُّوْا- “সালাতের ইক্বামত শুনলে তোমরা ধীর ও শান্তভাবে মসজিদে যাও এবং তাড়াহুড়া করো না। অতঃপর ইমামের সঙ্গে সালাতের যতটুকু অংশ পাও ততটুকু পড়ে নাও এবং যেটুকু অংশ ছুটে যায় তা (একাকী) পূর্ণ করে নাও।”।(সহীহ বুখারী হা/৬৩৬, ৯০৮; সহীহ মুসলিম হা/৬০৪)
.
দ্বিতীয়ত: যদি কোনো ব্যক্তি নারী-পুরুষ জামআতে (মসজিদে) প্রবেশ করে দেখেন যে, ইমাম রুকুতে চলে গেছেন, তাহলে তিনি তাড়াহুড়া না করে ধীরস্থিরভাবে যথানিয়মে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়াবেন, এরপর অন্তরে নিয়ত করে দুই হাত কাঁধ সমান তুলে তাকবীরে তাহরিমা (সালাত শুরু করার তাকবীর) বলে (বুকেহাত না বেঁধে) পূনরায় রুকুতে যাওয়ার নিয়তে রুকুর ‘তাকবীর দিয়ে রুকুতে যাবেন এবং রুকুর তাসবীহ (سُبْحَانَ رَبِّيَ الْعَظِيْمِ) পাঠ করবেন। তবে জামআতে দাড়িয়ে যদি আশঙ্কা হয় যে, রুকু পাওয়ার সুযোগ হারিয়ে যেতে পারে, তাহলে শুধু তাকবীরে তাহরিমা (সালাত শুরু করার তাকবীর) বললেই যথেষ্ট।(অর্থাৎ তাকবীরাতুল ইহরামের সাথে রুকুর তাকবীরও একসাথে আদায় হয়ে যাবে)। কেউ যদি ইমামকে রুকূর অবস্থায় পেয়ে তাঁর সাথে রুকূর (কমপক্ষে একবার) তাসবীহ পড়তে সক্ষম হয়, তাহলে তার সে রাকআত গণ্য হয়ে যাবে এক্ষেত্রে কিয়াম (দাড়ানো) ও সূরা ফাতিহা না পেলেও রাকআত হয়ে যাবে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে তিনি দাঁড়িয়ে তাকবীর বলার পর বুকে হাত রাখবেন না, ‘সানা’ বা ‘সূরা ফাতিহা’ও পড়বেন না। শুধুমাত্র তাকবীরাতুল ইহরাম বলে দ্রুত রুকু’তে চলে যাবেন। কারণ তখন তার জন্য রুকু’র তাকবীর বলা সুন্নাত। ওয়াজিব নয়। অপরদিকে ইমামের অনুসরণ করা মুকতাদীর জন্য ফরয। এটি যায়েদ ইবনে সাবিত, ইবনে উমর, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব, আতা,হাসান বাসরী এবং ইব্রাহীম আন-নাখাঈ (রহিমাহুমুল্লাহ) প্রমুখ থেকে বর্ণিত। চার ইমাম ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফি‘ঈ এবং ইমাম আহমাদ (রহিমাহুমুল্লাহ) এরাও এ মতের পক্ষপাতী ছিলেন। ইমাম আবু দাউদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: আমি ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্ভল (রাহিমাহুল্লাহ) কে জিজ্ঞেস করলাম:أُدرك الإمام راكعاً ؟ قال : يجزيك تكبيرة “আমি যদি ইমামকে রুকু অবস্থায় পাই, তাহলে কী করব?” তিনি বললেন: ‘তোমার জন্য একটি তাকবীরই যথেষ্ট হবে।”(মাসাইলুল ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বাল, পৃষ্ঠা: ৩৫)
.
এটি এ কারণে যে, রুকুর অবস্থায় একসাথে দুইটি তাকবির অর্থাৎ তাকবিরে ইহরাম ও রুকুর তাকবির বলার জন্য সাধারণত পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায় না। তাছাড়া একই অবস্থানে একই ধরণের দুটি ইবাদত একত্রে করা অনুচিত বলে বিবেচিত হয়। রুকুর নিয়ত শুরু করার নিয়তের সাথে বিরোধী নয়। সুতরাং সালাতের একটি মূল স্তম্ভ হিসেবে ইফতিতাহ তাকবির (তাকবিরে ইহরাম) রুকুর তাকবিরের প্রয়োজনীয়তাও পূরণ করে দেয়। এ বিষয়ে উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইফাদাহ তাওয়াফ যখন হজের শেষ সময়ে সম্পন্ন করা হয়, তখন তা বিদায়ী তাওয়াফের (তাওয়াফুল-ওয়াদা) বিকল্প হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।” (ইবনু কুদামাহ, আল মু্গনি; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১৮৩)
.
তবে হা! যদি দুটি তাকবির বলা সম্ভব হয় একটি ইফতিতাহর জন্য এবং অন্যটি রুকুর জন্য তাহলে এটি উত্তম। আবু দাউদ বলেছেন: আমি আহমদকে প্রশ্ন করলাম: ‘আপনি কি দুটি তাকবির বলার পক্ষে? তিনি উত্তর দিলেন : فإن كبر مرتين فليس فيه اختلاف “যদি সে দুটি তাকবির বলে, তাহলে এ ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই।”(মাসাইল ইমাম আহমদ ইবনু হাম্ভল; পৃষ্ঠা: ৩৫)।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: যদি মুক্তাদি ইমামের রুকু অবস্থানে উপস্থিত হয়, তবে সে কি ইস্তিফতাহর তাকবির এবং রুকুর তাকবির উভয়ই বলবে, নাকি শুধু ইস্তিফতাহর তাকবির বলবে তারপর রুকু করবে?
তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: الأولى والأحوط أن يكبر التكبيرتين : إحداهما : تكبيرة الإحرام وهي ركن ولا بد أن يأتي بها وهو قائم ، والثانية : تكبيرة الركوع يأتي بها حين هويه إلى الركوع ، فإن خاف فوت الركعة أجزأته تكبيرة الإحرام في أصح قولي العلماء ، لأنهما عبادتان اجتمعتا في وقت واحد فأجزأت الكبرى عن الصغرى ، وتجزئ هذه الركعة عند أكثر العلماء “সর্বোত্তম ও সর্বাধিক সতর্কতামূলক পদ্ধতি হলো দু’টি তাকবীর বলা:
(১).তাকবীরে তাহরীমা এটি রুকুন; দাঁড়ানো অবস্থায় এ তাকবীর বলা অবশ্যই জরুরি।(২).রুকুর তাকবীর রুকুতে যাওয়ার সময় এ তাকবীর বলা হয়। যদি কেউ রাক‘আত ছুটে যাওয়া আশঙ্কা করে (সময় কম থাকায়),তাহলে শুধু তাকবীরে তাহরীমাই যথেষ্ট হবে আলেমদের সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য মত অনুযায়ী। কারণ, এখানে দু’টি ইবাদত একই সময়ে একত্রিত হয়েছে, তাই বড় ইবাদত (তাকবীরে তাহরীমা) ছোট ইবাদতের (রুকুর তাকবীর) স্থলাভিষিক্ত হয়ে গেছে।এই রাক’আত অধিকাংশ উলামাদের মতে বৈধ।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা:২৪৪-২৪৫) অনুরূপ কথা ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারবে সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন।
.
এখানে একটি বিষয় জেনে রাখা আবশ্যক “যে ব্যক্তি জামাআতে সালাতে শরিক হচ্ছে, তার জন্য দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরিমা বলা আবশ্যক। যদি সে রুকু অবস্থায় কিংবা রুকুর জন্য ঝুঁকে পড়ার সময় তাকবীর বলে, তাহলে তা সহীহ হবে না।”
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,إذا أدرك الإمام راكعا كبر للإحرام قائما ثم يكبر للركوع ويهوي إليه , فإن وقع بعض تكبيرة الإحرام في غير القيام لم تنعقد صلاته فرضا بلا خلاف , ولا تنعقد نفلا أيضا على الصحيح “যদি কোনো ব্যক্তি ইমামের রুকুর সময় জামাআতে অংশগ্রহণ করে, তাহলে তার জন্য আবশ্যক হলো প্রথমে পূর্ণভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাকবিরে তাহরিমা (প্রারম্ভিক তাকবির) বলবে, এরপর রুকুতে যাওয়ার জন্য ঝুঁকবে। যদি সে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পূর্বেই তাকবিরের কিছু অংশ বলে ফেলে, তাহলে তার এই সালাত ফরজ হিসেবে গণ্য হবে না এ বিষয়ে আলিমদের মাঝে কোনো মতভেদ নেই। বরং সঠিক মত অনুযায়ী, তা নফল সালাত হিসেবেও গণ্য হবে না।”(ইমাম নববী আল-মাজমু ‘খণ্ড ৪; পৃষ্ঠা: ১১১)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:ولكن هنا أمْرٌ يجبُ أن يُتفَطَّنُ له ، وهو أنَّه لا بُدَّ أنْ يكبِّرَ للإحرامِ قائماً منتصباً قبل أنْ يهويَ ؛ لأنَّه لو هَوى في حالِ التكبيرِ لكان قد أتى بتكبيرةِ الإحرامِ غير قائمٍ ، وتكبيرةُ الإحرامِ لا بُدَّ أن يكونَ فيها قائماً “তবে এখানে একটি (গুরুত্বপূর্ণ) বিষয় রয়েছে, যা লক্ষ্য করা আবশ্যক তা হলো, ইহরামের তাকবীর অবশ্যই সম্পূর্ণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই দিতে হবে; সামনে ঝুঁকার আগেই। কেননা যদি কেউ তাকবীর বলতে বলতেই রুকুর উদ্দেশ্যে নীচের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে সে তাকবীর আদায় করেছে এমন অবস্থায়, যখন সে সম্পূর্ণ সোজাভাবে দাঁড়িয়ে ছিল না। অথচ ইহরামের তাকবীরের শর্তই হলো তা অবশ্যই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় হতে হবে।”(ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘, আলা জাদিল মুস্তাকনি খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১২৩) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: শাইখ নাসরুল্লাহ আল মাদানী (হাফি.)। অনার্স, মাদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব।