আশ-শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, আল-মুহাদ্দিস, আল-মুফাসসির, আল-ফাক্বীহ, আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আবু বকর ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওজিয়্যা (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন,
إِذَا جَرَّى عَلَى الْعَبْد مَقْدُور يَكْرَههُ؛ فَلَهُ فِيهُ سِتَّة مَشَاهِد:
◇أَحُدّهَا: مَشْهَد التَّوْحِيد، وَأَنَّ الله هُوَ الَّذِي قَدَرهُ وَشَّاءهُ وَخَلْقهُ، وَمَا شَاء الله كَانَ، وَمَا لَمْ يَشَأ لَمْ يَكْن.
◇الثَّانِي: مَشْهَد الْعَدْل، وَأَنَّهُ مَاض فِيهُ حُكْمهُ، عَدْل فِيهُ قَضَاؤهُ.
◇الثَّالِث: مَشْهَد الرَّحْمَة، وَأَنَّ رَحْمَتهُ فِي هَذَا الْمَقْدُور غَالِبَة لِغَضَبه وَاِنْتِقَامه وَرَحْمَتهُ حَشُّوهُ.
◇الرَّابِع: مَشْهَد الْحِكْمَة، وَأَنَّ حِكْمَتهُ سُبْحَانَهُ اِقْتَضَت ذَلِكَ، لَمْ يُقَدِّرهُ سُدَى وَلَا قَضَّاهُ عَبَثا،
◇الْخَامِس: مَشْهَد الْحَمْد، وَأَنَّ لَهُ سُبْحَانَهُ الْحَمْد التَّامّ عَلَى ذَلِكَ مِنْ جَمِيع وُجُوهه.
◇السَّادِس: مَشْهَد الْعُبُودِيَّة، وَأَنَّهُ عَبْد مَحْض مِنْ كَلّ وَجَّه، تَجْرِي عَلَيْهُ أَحُكَّام سَيِّده وَأَقْضِيَتهُ بِحُكْم كَوْنه مُلْكهُ وَعَبْدهُ فَيُصَرِّفهُ تَحْتَ أَحْكَامه الْقُدْرِيَّة كَمَا يَصْرِفهُ تَحْتَ أَحْكَامه الدِّينِيَّة؛ فَهُوَ مَحَلّ لجَرَيانِ هَذِهِ الْأَحْكَام عَلَيْهُ.
“যদি কোনো বান্দার জীবনে এমন কিছু ঘটে, যা সে অপছন্দ করে, তবে তার উচিত এ বিষয়ে ছয়টি দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করা:
.
◇ প্রথম: তাওহিদের দৃষ্টিভঙ্গি এ কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা যে এটি আল্লাহ তাআলাই নির্ধারণ করেছেন, তাঁর ইচ্ছাতেই এটি সংঘটিত হয়েছে এবং তিনিই একে সৃষ্টি করেছেন। যা আল্লাহ চান, তাই ঘটে, আর যা তিনি না চান, তা কখনোই সংঘটিত হয় না।
.
◇ দ্বিতীয়: ন্যায়বিচারের দৃষ্টিভঙ্গি যে এতে আল্লাহর বিধান কার্যকর হয়েছে এবং তাঁর সিদ্ধান্ত ন্যায়সঙ্গত।
.
◇ তৃতীয়: রহমতের দৃষ্টিভঙ্গি যে এই ঘটনায় আল্লাহর দয়া ও করুণা নিহিত রয়েছে। কারণ, তাঁর রহমত তাঁর ক্রোধ ও শাস্তির ওপর প্রাধান্য পায়। ফলে, এতে অবশ্যই কোনো কল্যাণ ও মঙ্গল লুকিয়ে আছে।
.
◇ চতুর্থ: হিকমাহ (জ্ঞান ও প্রজ্ঞা)-এর দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করা যে আল্লাহ তাআলা অযথা কিছু নির্ধারণ করেন না। বরং তাঁর অপরিসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কারণেই এটি ঘটেছে। তিনি অনর্থক কোনো কিছু নির্ধারণ করেন না এবং উদ্দেশ্যহীনভাবে কোনো ফয়সালা দেন না।
.
◇ পঞ্চম: প্রশংসার দৃষ্টিভঙ্গি এই বিশ্বাস রাখা যে আল্লাহ তাআলা তাঁর নির্ধারিত সমস্ত বিষয়ে পরিপূর্ণ প্রশংসার যোগ্য। কারণ, তাঁর ফয়সালা সর্বদা হিকমাহ, রহমত ও ন্যায়বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
.
◇ ষষ্ঠ: দাসত্বের দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করা যে বান্দা পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর দাস। তার ওপর তাঁর মালিকের বিধান ও ফয়সালা কার্যকর হবে। আল্লাহ তাকে তাঁর কদরী (তাকদিরসংক্রান্ত) বিধানের মাধ্যমে পরিচালিত করেন, যেমন তিনি তাঁকে তাঁর শরয়ী (ধর্মীয়) বিধানের মাধ্যমেও পরিচালিত করেন। বান্দা হল সেই স্থান, যেখানে এই সমস্ত বিধান কার্যকর হয়। সুতরাং, বান্দার জন্য আবশ্যক হলো বিনীতভাবে আল্লাহর হুকুমের প্রতি আত্মসমর্পণ করা”।(ইবনু ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ, পৃষ্ঠা: ৩৬)
.
প্রিয় পাঠক! ইবনু কাইয়্যিম (রহিমাহুল্লাহ) এখানে মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া কষ্টকর বা অপছন্দনীয় ঘটনাগুলো সম্পর্কে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন, যা একজন মুমিনের হৃদয়ে থাকা উচিত। মূলত, তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, একজন মুমিন যখন কোনো বিপদ বা অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তখন সে যদি এই ছয়টি বিষয় উপলব্ধি করে, তবে তার হৃদয় প্রশান্ত থাকবে এবং সে সঠিকভাবে আল্লাহর বিধানের প্রতি আত্মসমর্পণ করতে পারবে।
৬ টি পয়েন্টের সংক্ষিপ্ত মর্ম বিশ্লেষণ:
(১). তাওহিদের দৃষ্টিভঙ্গি: সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছা ও পরিকল্পনার অংশ। কোনো কিছুই তাঁর জ্ঞানের বাইরে বা তাঁর অনুমতি ছাড়া ঘটে না। অতএব, বিপদ বা কষ্ট এলে মনে রাখা উচিত যে, এটি আল্লাহর নির্ধারিত এবং এর পেছনে অবশ্যই কোনো হেকমত (উদ্দেশ্য) আছে।
(২). ন্যায়বিচারের দৃষ্টিভঙ্গি: আল্লাহর প্রতিটি সিদ্ধান্ত ন্যায়সঙ্গত। যদিও আমাদের কাছে কোনো পরিস্থিতি অন্যায় বা কষ্টকর মনে হতে পারে, আল্লাহর বিধান কখনোই অন্যায় হতে পারে না। তিনি সবকিছু ন্যায়ের ওপর পরিচালনা করেন।
(৩). রহমতের দৃষ্টিভঙ্গি: বিপদের মধ্যেও আল্লাহর দয়া লুকিয়ে আছে। অনেক সময় আমরা তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারি না, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি কল্যাণকর হতে পারে। আল্লাহর দয়া তাঁর ক্রোধ ও শাস্তির ওপর প্রাধান্য পায়।
(৪). হিকমাহ (জ্ঞান ও প্রজ্ঞা)-এর দৃষ্টিভঙ্গি: আল্লাহর প্রতিটি কাজের পেছনে গভীর জ্ঞান ও উদ্দেশ্য থাকে। মানুষ সীমিত জ্ঞানের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে সেই হিকমাহ বুঝতে পারে না, কিন্তু পরবর্তীতে উপলব্ধি করে যে, এতে কল্যাণ ছিল।
(৫). প্রশংসার দৃষ্টিভঙ্গি: আল্লাহ যাই নির্ধারণ করেন, তা প্রশংসার যোগ্য। কারণ, তাঁর সব ফয়সালা হিকমাহ, রহমত ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে হয়। বান্দার উচিত বিপদের সময়ও আল্লাহর প্রশংসা করা এবং কৃতজ্ঞ থাকা।
(৬). দাসত্বের দৃষ্টিভঙ্গি: মানুষ আল্লাহর দাস। একজন দাসের কাজ হলো তার প্রভুর আদেশ মেনে চলা এবং তাঁর ফয়সালার প্রতি আত্মসমর্পণ করা। আল্লাহ তাঁর বান্দাকে কেবল শরয়ী বিধানের মাধ্যমেই পরিচালনা করেন না, বরং তাকদীরের বিধানের মাধ্যমেও পরিচালনা করেন। তাই বান্দার উচিত সব পরিস্থিতিতে বিনীতভাবে আল্লাহর সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া।
.
পরিশেষে সারকথা হচ্ছে, যখন কোনো বিপদ বা দুঃখজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হই, তখন এ ছয়টি বিষয় স্মরণ রাখলে মন শান্ত থাকবে, আল্লাহর ওপর ভরসা দৃঢ় হবে এবং দুঃখ-বেদনার পরিবর্তে ধৈর্য ও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টি তৈরি হবে। মূলত, এই দৃষ্টিভঙ্গিগুলো একজন মুমিনের তাকদীরের প্রতি ঈমান মজবুত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
________________________
✍️জুয়েল মাহমুদ সালাফি