যখন দুজন মুসলিম তরবারি নিয়ে পরস্পর মুখোমুখি হয় তখন হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়ই জাহান্নামে যাবে

প্রশ্ন: “যখন দু’জন মুসলিম তরবারি নিয়ে পরস্পর মুখোমুখি হয় তখন হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়ই জাহান্নামে যাবে” হাদিসটির বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর: আবূ বকরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ إِذَا الْتَقَى الْمُسْلِمَانِ حَمَلَ أَحَدُهُمَا عَلَى أَخِيهِ السِّلَاحَ فَهُمَا فِي جُرُفِ جَهَنَّمَ فَإِذَا قَتَلَ أَحَدُهُمَا صَاحِبَهُ دَخَلَاهَا جَمِيعًا “দু’জন মুসলিম যখন পরস্পরে বিবাদে লিপ্ত হয়ে একজন অপরজনের ওপর অস্ত্র ধারণ করে তাহলে তারা উভয়ে জাহান্নামের দাঁরপ্রান্তে উপনীত হবে। অতঃপর যদি একজন অপরজনকে হত্যা করে বসে, তাহলে তারা উভয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে”। অপর বর্ণনাতে রয়েছে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃإِذَا الْتَقَى الْمُسْلِمَانِ بسيفهما فَالْقَاتِلُ وَالْمَقْتُولُ فِي النَّارِ» قُلْتُ: هَذَا الْقَاتِلُ فَمَا بَالُ الْمَقْتُولِ؟ قَالَ: «إِنَّهُ كَانَ حَرِيصًا عَلَى قَتْلِ صَاحِبِهِ “যখন দু’জন মুসলিম তরবারি নিয়ে পরস্পর মুখোমুখি হয় তখন হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়ই জাহান্নামী হয়। আমি বললাম, হত্যাকারীর বিষয়টিতো পরিষ্কার; কিন্তু নিহত ব্যক্তি এমন (জাহান্নামী) হলো কেন? অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, কেননা সেও তার সঙ্গীকে হত্যা করার আকাঙ্ক্ষায় ছিল”।(সহীহ বুখারী ৬৮৭৫, মুসলিম ২৮৮৮, আবূ দাঊদ ৪২৬৮, নাসায়ী ৪১২২, আহমাদ ২০৪৩৯, সহীহ আত তারগীব ২৮১১)
.
হাদীসটির অর্থ হচ্ছে: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন,“যখন দু’জন মুসলিম তলোয়ার নিয়ে উভয় উভয়কে হত্যার উদ্দেশ্যে পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন হত্যাকারী তার সঙ্গীকে হত্যায় জড়িত হওয়ার অপরাধে জাহান্নামী। সাহাবীদের কাছে নিহত ব্যক্তির জাহান্নামী হওয়ার ব্যাপারটি দূর্বোধ্য মনে হলে তারা প্রশ্ন করলেন নিহত ব্যক্তি কিভাবে জাহান্নামী হবে? তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে অবহিত করলেন যে নিহত ব্যক্তিও তার সঙ্গীকে হত্যা করতে আগ্রহী ছিল আর হত্যাকারী তাকে হত্যা করে অগ্রগামী হওয়ার কারণই তাকে হত্যাকারীকে হত্যা করতে বাঁধাগ্রস্ত করেছে। হাদিসটির ব্যাখায় ইমাম খাত্তাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:”এই শাস্তির বিধান প্রযোজ্য এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে যে দুনিয়াবী শত্রুতার নিমিত্তে যুদ্ধ করে অথবা রাজত্ব কামনা করে। সুতরাং যে অত্যাচারী অথবা আক্রমণকারীর সাথে যুদ্ধ করে তার ওপর শাস্তি প্রযোজ্য নয়। কেননা এক্ষেত্রে শারী‘আতের নির্দেশ রয়েছে”।(বিস্তারিত জানতে দেখুন ফাতহুল বারী ১২ তম খন্ড, হাঃ ৬৮৭৫)
.
ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন: ” بيَّنَ هذا الحديث أن القتال إذا كان على جهل من طلب دنيا ، أو اتباع هوى ، فهو الذي أريد بقوله : ( القاتل والمقتول في النار “এই হাদিসটি স্পষ্ট করে দেয় যে লড়াই যদি জাহেলিয়াতের উপর ভিত্তি করে পার্থিব জীবন কামনা করা বা নিজের কামনা-বাসনার অনুসরণ করে তাহলে এই কথাটিই হাদিসের অর্থ বোঝায়(হত্যাকারী এবং নিহত ব্যক্তি জাহান্নামী)।(ফাতহুল বারী ১৩ তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩২)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] (উক্ত) হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন:

وأما كون القاتل والمقتول في النار فمحمول على من لا تأويل له، ويكون قتالهما عصبية ونحوها، ثم كونه في النار معناه مستحق لها، وقد يجازى بذلك، وقد يعفو الله تعالى عنه، هذا مذهب أهل الحق.
وقال أيضا قوله: صلى الله عليه وسلم: إن المقتول في النار لأنه أراد قتل صاحبه، فيه دلالة للمذهب الصحيح الذي عليه الجمهور أن من نوى المعصية، وأصر على النية يكون آثما؛ وإن لم يفعلها ولا تكلم.

“হত্যাকারী ও নিহত উভয়েরই জাহান্নামে থাকার প্রসঙ্গটি কেবল সেইসব লোকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যাদের কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই এবং যাদের যুদ্ধবিগ্রহ শুধুমাত্র গোষ্ঠীগত সংঘাত বা অথবা অনুরূপ ছিলো। অতঃপর সে জাহান্নামে থাকার অর্থ হল সে এটির যোগ্য, সে এর জন্য শাস্তি পেতে পারে অথবা আল্লাহ তাআলা চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। এটাই আহলুল হক্বদের অভিমত।

তিনি আরও বলেন: নিহত ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে কারণ সেও হত্যাকারীকে হত্যা করার জন্য উদ্বুদ্ধ ছিল। জমহুরদের নিকটে এটা দ্বারা দলিল হলো যে ব্যক্তি পাপ করার ইচ্ছা করে এবং তার নিয়তে অটল থাকে সে গুনাহগার। যদিও সে এটা না করে (নিয়ত করেছে কিন্তু কাজ করেনি) বা কথা না বলে (মুখে উচ্চারণ করেনি কিন্তু নিয়ত করেছে)।(ইমাম নববী, শারহু সহীহ মুসলিম, ১১তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৮)
.
জেনে রাখা ভাল যে, রাসূল (ﷺ)-এর সাহাবীগণের মাঝে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তা এই শাস্তির অন্তর্ভুক্ত নয়। কেননা আহলুস সুন্নাহ্ ও আহলুল হকদের বিশুদ্ধ ‘আকীদা হলো তাদের প্রতি সুধারণা রাখা। আর তাদের মাঝে ঘটে যাওয়া বিষয়াবলীকে এবং তাদের পরস্পর যুদ্ধের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ থেকে বিরত থাকা। তারা ইজতিহাদ করেছেন এবং ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু এগুলো তারা পাপের উদ্দেশে বা দুনিয়া লাভের উদ্দেশে করেননি। বরং তাদের প্রত্যেকেই মনে করতো যে, তারা ন্যায়পন্থী সত্যবাদী এবং তাদের প্রতিপক্ষের লোকেরা অন্যায়কারী ও বাড়াবাড়িকারী। এভাবেই তাদের মাঝে আল্লাহর বিধানের প্রতি প্রত্যাবর্তন করতে গিয়ে যুদ্ধ অবধারিত হয়ে যায়। তাদের কেউ ছিলেন সঠিক আবার কেউ ভুল-ত্রুটির ক্ষেত্রে অপারগ হওয়াই বেঠিক। কেননা এটা হয়েছে ইজতিহাদের কারণে। আর মুজতাহিদ যখন ভুল করে তখন তার গুনাহ হয় না। এর একটি জলন্ত উদাহরণ হচ্ছে,সিফফিন যুদ্ধ। আহলুস্ সুন্নাহ্-এর মত হলো ‘আলী ঐ যুদ্ধে সঠিক ও ন্যায়পন্থী ছিলেন। যদিও এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী উভয় দল ইসলামের উপরেই কায়েম ছিল। তবে প্রতিপক্ষের মধ্যেও ইজতিহাদের ক্ষেত্রে তাদের ভুল থাকলেও, সেটি গুনাহ হিসাবে বিবেচিত হয়নি।আর সমস্যাটা ছিল সংশয়পূর্ণ। এমনকি সাহাবীদের একটি দল এই বিষয়ে দিশেহারা এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। ফলে তারা উভয় দল থেকে বিরত ছিলেন এবং যুদ্ধে জড়াননি। আর নিশ্চিতভাবে সঠিকতা বুঝতে পারেননি। অবশেষে তারা তাদেরকে সহযোগিতা থেকে পিছু হটেছিলেন। এটি তাদের সতর্কতা এবং ফিতনা থেকে বাঁচার অভিপ্রায় নির্দেশ করে। সুতরাং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে,বর্তমানেও মুসলিম উম্মাহর ঐক্য রক্ষায় সর্বদা সতর্ক থাকা প্রয়োজন। মহান আল্লাহ আমাদেরকে আকীদা, আমল, কথা, দাওয়াত, চরিত্র ইত্যাদিসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রকৃত সালাফী ও আহলে হাদীস হওয়ার তৌফিক দান করুন এবং এই কাফেলাকে সার্বিকভাবে সর্বত্র নিরাপত্তা দান করুন। আমীন!!(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
____________________
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তাদ ইব্রাহিম বিন হাসান (হাফি:)
শিক্ষক, চর বাগডাঙ্গা সেরাজুল হুদা লতিফিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া ও হাফিজিয়া মাদরাসা‌ চাঁপাইনবাবগঞ্জ।

Share: